আমাদের ছায়াপথের নাম আকাশগঙ্গা। ইংরেজি নাম মিল্কিওয়ে। বিশেষত গ্রীষ্মের আকাশে ছায়াপথটির দেখা মেলে। দেখতে আসলেই নদীর মতো। কিন্তু ছায়াপথ আবার নদীর মতো কী করে হয়? আসলে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ অনেকগুলো সর্পিল বাহু নিয়ে গঠিত। তেমনি একটি বাহুর নাম ওয়ারনবাহু। আমরা খালি চোখে এই বাহুর ভেতরের দিকের তারকাগুলোকেই দেখতে পাই। অন্য দিকের তুলনায় বেশি নক্ষত্র থাকায় বাহুটি খুব সহজে চোখে পড়ে। তাকালে মনে হয় উত্তর থেকে দক্ষিণে একটি নদী যেন বয়ে যাচ্ছে। শুধু নেই কুলু কুলু ধ্বনিটি। কিন্তু গ্রিকরা আবার ভাবল, আকাশে একটি পথের মতো দেখা যাচ্ছে। আর পথের ওপর যেন দুধ বিছিয়ে রাখা হয়েছে। তাই তারা এর নাম দিল গ্যালাক্সিয়াস কিক্লোস বা মিল্কিওয়ে। বাংলায় যেটা হয় দুধেল পথ।
এত দিন আমরা জানতাম, আকাশগঙ্গা দেখতে প্রায় সমতল ডিস্ক বা চাকতির মতো। যাকে অন্য অর্থে বলা চলে দ্বিমাত্রিক। অনেক সময় তুলনা করার জন্যে আমরা বলিও ছায়াপথ আসলে প্যানকেকের মতো। মানে নক্ষত্রগুলো কেন্দ্রের চারপাশে চাকতির মতো আকৃতি তৈরি করে অবস্থান করছে। গোলক বা সিলিন্ডারের মতো ত্রিমাত্রিকভাবে নয়। আমাদের অন্যতম প্রতিবেশী গ্যালাক্সি আন্ড্রোমিডাকেও টেলিস্কোপের চোখে প্যানকেকের মতোই দেখা যায়।
কিন্তু মহাবিশ্ব আসলে এত সরল বস্তু নয়। প্রতিনিয়তই আমরা মহাবিশ্বের নতুন রহস্য, নতুন নতুন তথ্য দ্বারা শিহরিত হই। এই যেমন২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জানা গেল আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য। চীনের বিজ্ঞানীরা জানালেন, আমাদের ছায়াপথ সমতল নয়। এর আকৃতি বক্র। আবার একই সঙ্গে পাক খাওয়া।
বিষয়টি জানালেন চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্স ও ম্যাকোয়ার ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিদেরা। এ বিষয়ক গবেষণার জন্য তাঁরা ১৩৩৯টি সেফেইড বিষম তারা নিয়ে কাজ করেছেন। এ ধরনের তারার একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আছে। অন্য তারাদের মতো এরা সব সময় সমান উজ্জ্বল থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বলতা কমে-বাড়ে। কতটুকু কমবে-বাড়বে তা নির্ভর করে এদের প্রকৃত উজ্জ্বলতা বা দীপ্তির ওপর। নক্ষত্রগুলো সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে ওয়াইজ (WISE) নামের মহাকাশ টেলিস্কোপ থেকে। পূর্ণনাম ওয়াইড-ফিল্ড ইনফ্রারেড সার্ভে এক্সপ্লোরার। তাঁরা বলছেন, প্রাপ্ত তথ্যের সাহায্যে আকাশগঙ্গার একটি ত্রিমাত্রিক বা থ্রিডি ম্যাপ তৈরি করেছেন। এ–বিষয়ক কাজ ৪ ফেব্রুয়ারি বিখ্যাত নেচার অ্যাস্ট্রোনমি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ছায়াপথের বাইরের দিকের নক্ষত্রগুলো ক্রমাগত বেশি বক্রভাবে অবস্থান করছে। বিষয়টি একটু চমকপ্রদ হলেও নতুন কিছু নয়। এর আগেও প্রায় ডজনখানেক ছায়াপথের বক্র ও পাকানো আকৃতির কথা জানা গেছে। তবু এমন আকৃতি কিন্তু দুর্লভ ঘটনা।
কিন্তু আকাশগঙ্গার আকৃতি জেনে ফেলা সহজ কোনো কাজ নয়। এটা অনেকটা একটি ঘরের মধ্যে বসে পুরো গ্রামের আকৃতি বোঝার চেষ্টা করার মতো। আসলে তার চেয়েও অনেক কঠিন। সাধারণত একই রকম অন্য ছায়াপথের আকৃতি দেখে মিল্কিওয়ের আকৃতি অনুমান করা সম্ভব হয়েছে। কারণ, নিজের ছায়াপথ পুরোটা দেখা না গেলেও টেলিস্কোপের চোখে অন্য ছায়াপথরা প্রায় পুরোটা তো ধরা দেয়। তবে মিল্কিওয়ে যে পাকানো হতে পারে তার ইঙ্গিত ৫০ বছর ধরেই পাওয়া যাচ্ছিল। নতুন ম্যাপে আরও জানা গেল, মিল্কিওয়ের পাকানো চাকতির মধ্যে নতুন নক্ষত্রও রয়েছে। ফলে কিছুটা বোঝা গেল, বাইরের দিকের এই বাঁক ও পাকের কারণ আসলে চাকতির ভেতরের দিকের পুরোনো ও ভারী নক্ষত্রের কারসাজি।
অনেক দূর থেকে তো দেখলে মনে হয় আমাদের মিল্কিওয়ের কেন্দ্র কয়েক শ কোটি নক্ষত্রের সমন্বয়ে গড়া। যাদের মিলিত ভরের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে বাইরের দিকের তারকারা। কয়েক শ মিলিয়ন বছর লাগে এক একটি পূর্ণ ঘূর্ণন সম্পন্ন হতে। কিন্তু কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে নক্ষত্রগুলোর মিলিত মহাকর্ষের প্রভাব কমে আসে। মিল্কিওয়ের চাকতির বেশির ভাগজুড়েই রয়েছে হাইড্রোজেন গ্যাস। বাইরের দিকের নক্ষত্রের ক্ষেত্রে কম মহাকর্ষের সুযোগে এই গ্যাস আর একটি সমতলে সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং আকৃতি হয়ে যায় বক্র ও পাকানো। অনেকটা ইংরেজি এস (S) অক্ষরের মতো।