শুক্র গ্রহে আমরা কী দেখতে পাব

ছোটদের জন্য সহজ ভাষায় লেখা কঠিন। সহজ কথা যে যায় না বলা সহজে! অথচ একদম সহজ-সাবলীল ভাষায় লেখা এ বই। ‘টেলিস্কোপ কী বলে’ নামের বইটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাদুগা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। পাভেল ক্লুশান্‌ৎসেভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন অরুণ সোম। এ বইয়ে প্রচুর ছবি আছে। সেগুলো এঁকেছেন ইয়ে. ভোইশ্‌ভিল্লো, ব. কালাউশিন, ব.স্তারোদুব্‌ৎসেভ এবং ইউ. কিসিলিওভ। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে বইটি প্রকাশিত হচ্ছে…

এবার শুক্রগ্রহ পরিদর্শন করা যাক। শুক্র সূর্যের দ্বিতীয় নিকটতম গ্রহ। শুক্র বুধের মতো একেবারেই নয়। বুধ ছিল মেঘহীন, প্রায় অস্পষ্ট, হালকা বায়ুমণ্ডলে ঘেরা। নগ্ন পাথর সেখানে পালাক্রমে কখনো জলন্ত সূর্যকিরণে কখনো বা ভয়ঙ্কর হিমে পীড়িত। কিছুই নড়ে না। পরিপূর্ণ নৈঃশব্দ।

এখানে সবই তার উলটো। শুক্র গ্রহের ওপরে আছে খুব ঘন, গাঢ় বায়ুমণ্ডলের প্রলেপ। সেই বায়ুমণ্ডলে এত বেশি মেঘ যে গ্রহটা যেন সাদা তুলোয় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো, বিন্দুমাত্র আলোর ঝলক তার ভেতর দিয়ে যায় না।

এই সাদা লেপের আড়ালে কী আছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা শত শত বছর ধরে এই নিয়ে মাথা ঘামান।

সবাই একটা বিষয়ে একমত হন যে শুক্র গ্রহ নিশ্চয়ই বেশ উষ্ণ হবে। কেননা তা আমাদের তুলনায় সূর্যের কাছাকাছি।

সবাই এটা বুঝতে পারতেন যে শুক্রে চির গোধূলির রাজত্ব। শুক্রে যদি কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব থাকেও তাহলে তাদের মাথার ওপরে সব সময় ঘুরে বেড়ায় ঝড়ের মেঘ। তারা ধারণাই করতে পারে না যে নীল আকাশ, সূর্য আর তারা বলে কিছু থাকতে পারে।

বাকি সব ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত। নানা রকম জল্পনা-কল্পনা করতে থাকেন বিজ্ঞানীরা।

শুক্র গ্রহের ওপরে আছে খুব ঘন, গাঢ় বায়ুমণ্ডলের প্রলেপ

একদল বেশ জোর দিয়ে বলতেন যে শুক্র হলো কূলকিনারাহীন এক মহাসাগর। সেখানে আকাশ থেকে অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে। এক কথায়, সর্বত্র পানি আর পানি।

অন্যেরা আপত্তি তুলে বলেন, ওখানকার পানি অনেক আগে শুকিয়ে গেছে। শুরু হলো পুরোপুরি একটা খটখটে মরুভূমি।

কেউ কেউ আবার দুই দলের মতের মধ্যে একটা রফায় আসার চেষ্টা করলেন। তাঁরা বললেন, পৃথিবীতে যা যা আছে ওখানেও সম্ভবত সে সবই আছে। সমুদ্র আছে, আবার মরুভূমিও আছে। পাহাড়-পর্বত আছে, বনজঙ্গল আছে। গরমের দরুন গাছগাছড়া সেখানে প্রচুর ঘন। নিবিড় অরণ্যে ঘুরে বেড়ায় আশ্চর্য জন্তুজানোয়ার। কালো মেঘের নীচে পাখাওয়ালা অদ্ভুত সব প্রাণী।

কার কথা যে সত্যি তা বোঝার কোন উপায় ছিল না। টেলিস্কোপে কেবল দেখা যেত সাদা তুলোর গোলা—এর চেয়ে বেশি আর কিছুই নয়। তখন কাজে যোগ দিলেন বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাঁদের টেলিস্কোপ বিশেষ ধরনের। যে চোঙ্গা দিয়ে দেখতে হয় তাঁদের ওই টেলিস্কোপে তা নেই। তাঁরা অতি সংবেদনশীল বেতারযন্ত্র ও বিশাল থালার আকারের বিশেষ এক ধরনের অ্যারিয়ালের সাহায্য নিলেন। এই অ্যারিয়াল যে দিকে তাক করা থাকে কেবল সেই দিক থেকে বেতার তরঙ্গ ধরে।

বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাঁদের অ্যারিয়ালগুলো বিভিন্ন দিকে মুখ করে রাখলেন। দেখা গেছে সব তেতে ওঠা জিনিস থেকে বেতার তরঙ্গ বিচ্ছুরিত হয়। অবশ্য তাই বলে কোনো রকম শব্দ বা সঙ্গীত বহনের ক্ষমতা এই সব তরঙ্গের নেই। এদের যদি ধরে কোন লাউডস্পিকারে চালান করা যায় তাহলে স্রেফ খসখস আওয়াজ শোনা যাবে। কিন্তু এই খসখস নানা রকমের হয়ে থাকে। ঈষদুষ্ণ জিনিস থেকে এক রকম আর উত্তপ্ত জিনিস থেকে আরেক রকম। বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই আওয়াজগুলো আলাদা আলাদা করে চিনতে শিখেছেন, ফলে তাঁরা দূর থেকে কোন জিনিসের তাপমাত্রা মাপতে পারেন।

বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাই এবার তাঁদের যন্ত্রের অ্যারিয়াল শুক্র গ্রহের দিকে মুখ করে রাখলেন। শুক্র গ্রহ থেকে বিচ্ছুরিত বেতার-তরঙ্গ ধরার পর তাঁরা জানালেন শুক্র গ্রহের মেঘ ঠান্ডা, কিন্তু সেই মেঘের নীচেই আছে একটা প্রায় গনগনে লাল শক্ত পিঠ!

বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কথা লোকে বিশ্বাস করল না। শুক্র একে বুধের তুলনায় সূর্য থেকে দূরে, আবার মেঘে ঢাকা। সুতরাং বুধের চেয়ে গরম সে হবে কী করে?

ওখানে আসলে কী আছে পুরোপুরি জানার জন্য সোভিয়েত বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনীয়ররা শক্তিশালী রকেটের সাহায্যে শুক্রে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। সেগুলোর নাম ‘আন্তঃগ্রহ স্বয়ংক্রিয় স্টেশন’।

এই স্টেশনগুলোর একেকটি শুক্রে পৌঁছাতে তিন মাস সময় লাগে! প্রথম দুটি স্টেশন পাশ দিয়ে উড়ে চলে যায়। তৃতীয়টি শুক্রে পৌঁছায় বটে, কিন্তু কোনো সংবাদই পাঠাতে পারেনি। তবে এর পরেরগুলো চমৎকার ভাবে নিজেদের কর্তব্য সম্পাদন করে। সেগুলো শুক্র গ্রহে গিয়ে সেখানকার বায়ুমণ্ডল ভেদ করে, ব্রেক কষে প্যারাসুট খুলে ধীরে ধীরে রহস্যময় মেঘের মধ্যে ডুবে যেতে থাকে। নামার সময় তারা তাদের যন্ত্রপাতির সাহায্যে যা যা উপলব্ধি করে সে সবই অবিরাম বেতারে প্রেরণ করতে থাকে।

বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আনন্দ আর ধরে না। তাঁদের অনুমানই সত্য প্রমাণিত হলো। স্টেশনের যন্ত্রপাতির সাহায্যে ধরা পড়ল যে শুক্রের বায়ুসমুদ্রের তলদেশে গরম ৪৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সত্যিকারের একটা জলন্ত চুল্লি যাকে বলে।

যন্ত্রপাতি আরও বহু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য পাঠাল। যেমন, আমরা জানতে পারলাম যে শুক্রে দিন-রাত, শীত-গ্রীষ্মে সর্বদা এই গরম থাকে; সেখানকার বায়ু, আমাদের এখানকার বায়ুর চেয়ে কয়েক ডজন গুণ ঘন এবং তার উপাদানও সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষের পক্ষে বিষাক্ত।

টাটানো মাটিতে নামার পর দুটো স্টেশন চারপাশের এলাকার ছবি পর্যন্ত তোলে। টেলিভিশনের সাহায্যে শুক্র গ্রহের পাথরের ক্লোজ আপও দেখায়।

এবার এসো জীবনযাপনের সম্পূর্ণ অনুপযোগী এই গ্রহটাতে নামার চেষ্টা করে দেখা যাক। আমাদের মহাকাশযানটি অবশ্য অগ্নিরোধক আর বেশ মজবুতও। অতএব ঝুঁকি নেওয়া যেতে পারে।

বিশাল তুলোর গোলাটার দিকে উড়ে আসতে আসতে গায়ে যেন কেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে। নামব কোথায়? কিছুই যে দেখা যায় না! আমাদের পায়ের নিচে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে মেঘের রাশি। আমাদের নিচে যদি সমভূমি থাকে তাহলে ভালো বলতে হবে, কিন্তু যদি থাকে পাহাড়ের ধারালো খোঁচা খোঁচা চুড়ো কিংবা অতল খাদ?

আমাদের মহাকাশযান মেঘের ভেতরে নামতে থাকে। সাদা কুণ্ডলী যেন ফুঁসতে ফুঁসতে চারদিক থেকে আমাদের জড়িয়ে ধরছে, পোর্টহোলের বাইরে ছুটে চলেছে, আমাদের মাথার ঠিক ওপরে এসে মিশেছে। অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল।

শিল্পীর কল্পনায় শুক্র গ্রহ

দেখতে দেখতে মেঘের রাশি শেষ হয়ে গেল। এখন সেগুলো মাথার ওপর হলদেটে ছাদ হয়ে আছে। আমাদের পায়ের নীচে দেখা যাচ্ছে বহু কিলোমিটারব্যাপী অতলস্পর্শ গহ্বর, তার তলায় ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে অস্পষ্ট চোখে পড়ে অন্ধকার আর আলোর কিছু কিছু ছোপ। এই হলো আমাদের শুরু, তার কঠিন পিঠ!

একটা ধাক্কা। মহাকাশযানটা একদিকে কাত হয়ে পড়ে কোথায় যেন পিছলে সরে গেল। পাথরের সঙ্গে তার গায়ের ঘষা লাগায় ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ তুলে আরও একবার ধাক্কা খেয়ে স্থির হয়ে গেল।

মনে হলো সব ঠিক আছে। অগ্নিনিরোধক স্পেসস্যুট পরে আমরা বেরিয়ে এলাম।

স্বীকার করতে বাধা নেই প্রথম প্রথম একটু ভয়-ভয়ই করতে থাকে। প্রাকৃতিক দৃশ্যটা বড়ই হতাশাব্যঞ্জক। সর্বত্র চলেছে সেই একই রকম একঘেয়ে বিবর্ণ পাথুরে মরুভূমি। কোথাও কোনো ডোবা নেই, কোনো ঝোপঝাড়ের চিহ্ন নেই, মোটের ওপর প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই। কেবল স্থির নগ্ন পাথর আর পাথর। মাথার ওপর ধূসর-কালো রঙের মসৃণ মেঘের আচ্ছাদন। যেটুকু আলো এসে পড়েছে তা ম্যাটমেটে, ছায়াহীন। শরৎকালে মেঘলা দিনে আমাদের এখানে যেমন হয়। বাতাস ঘোলাটে, যেন সামান্য ধোঁয়া-ধোঁয়া। এই ধূসর আঁধারের মধ্যে দূরের পাথরগুলো মিলিয়ে যায়, দিগন্ত চোখে পড়ে না।

কিন্তু তা হলেও চাঁদ বা বুধের মতো শুক্র পুরোপুরি মৃত জগৎ নয়। নজর করে দেখলে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে এমন কিছু জিনিস এখানে চোখে পড়বে। বায়ু ধীরে ধীরে বইছে। এটাকে বাতাস অবশ্য ঠিক বলা যায় না। পৃথিবীর বাতাস ক্ষিপ্র, দমকা, অস্থির প্রকৃতির। কিন্তু এখানে অনুভূতিটা এমন হয় যেন একটা বিশাল নদীর মধ্যে ডুবে আছে। আর সে নদীর পানি শান্ত গম্ভীর ভাবে, ধীরেসুস্থে একই দিকে বয়ে চলেছে। এই শান্ত স্রোতের তাড়নায় ছোট ছোট নুড়ি পাথর জমির ওপর দিয়ে অলস গতিতে গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে। ধোঁয়ার মধ্যে কোথাও কোথাও চোখে পড়ে মন্থরগতিতে ভাসমান ঘোলাটে ধারা—সম্ভবত ধুলো। দূরের দিকে তাকালে দেখতে পাবে পাথরগুলো সামান্য নড়াচড়া করছে, যেমন আমাদের এই পৃথিবীতে খুনির ওপরকার গরম হাওয়ার ভেতর দিয়ে তাকালে দেখতে পাও। মোটের ওপর বায়ুর অস্বাভাবিক ঘনত্ব পরিষ্কার উপলব্ধি করা যায়। যখন জমির ওপর পা ফেল তখন পায়ের তলা থেকে কুয়াশা ওপরে ভেসে ওঠে আর স্রোতে ধীরে ধীরে তা একপাশে সরে যেতে থাকে। পৃথিবীর নদীর তলার পলিমাটির মতো। দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন। স্রোত চাপ দেয়। মনে হয় যেন কেউ হাতের তালু তোমার গায়ে ঠেকিয়ে আলতো করে, অথচ জেদ ধরে তোমাকে ধাক্কা মারতে মারতে এগিয়ে যেতে বলছে। স্রোতের মুখে চলা সহজ! কিন্তু স্রোতের বিপরীতে চলা বড় কঠিন। তোমাকে নীচু হয়ে খুঁজতে হবে কোথায় পায়ের ভর দেওয়া যায়। পা তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। স্পেসস্যুটের ভেতরে গরম এখনও টের পাওয়া যাচ্ছে না। কেবল পায়ের তলায়, বুটের পুরু সোল্ থাকা সত্ত্বেও ইতিমধ্যেই গরম লাগছে।

আমরা আমাদের প্রথম পরীক্ষা চালাই। সঙ্গে করে যে ফ্লাস্ক নিয়ে এসেছিলাম সেখান থেকে আধ গেলাস পানি চেটাল পাথরের ওপর ঢালি। গনগনে স্টোভের ওপর পড়লে যেমন হয় মুহূর্তের মধ্যে জল ইতস্তত বিন্দু বিন্দু হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল, পাথরের ওপর চড়বড় আওয়াজ তুলে ছটফট করতে করতে দেখতে দেখতে খানিকটা বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত বাদেই পাথর খটখটে শুকনো।

শুক্র গ্রহের বায়ুসমুদ্র অনেকটা পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরেরই মতো

আমাদের কাছে এক টুকরো সীসা আছে। সেটাকে পাথরের ওপর রাখলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছাইরঙা ধাতুর টুকরোটা গলে টলটলে রূপোলি পানি হয়ে গেল।

গর্ত খোঁড়ার চেষ্টা করে দেখা যাক। শাবল দিয়ে আমরা বড় বড় পাথর উলটে ফেলি, পাথরের তলাকার মাটি ভেঙে কোদাল দিয়ে সরাই। অনেক কষ্টে পাথুরে জমির আধ মিটার খানেক গভীর পর্যন্ত খড়ি। গর্তটার তলায় এক টুকরো সীসে ফেললে তা কিন্তু যেমনকার তেমন পড়ে থাকে, গলে না। তার মানে, অগ্নি-তপ্ত জগৎ বলতে আমরা যাকে জানি সেটা এই গ্রহের ওপরকার একটা পাতলা স্তর মাত্র। গভীরে অনেকটা ঠান্ডা। সেখানে তাপমাত্রা মোটে ৩০০ ডিগ্রি।

মহাকাশযান থেকে আমরা সেই যে বেরিয়েছি তারপর কয়েক মিনিট কেটে গেছে। এখন কিন্তু আমাদের এই তাপনিরোধক স্পেসস্যুটের ভেতরেও বেশ গরম লাগতে শুরু করেছে। আমরা আমাদের মহাকাশযানে ফিরে চলি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হয়।

বোতাম টিপি। মহাকাশযানের মাথার ওপর বেলুন ফুলে ওঠে। আমাদের যান মাটি ছেড়ে ওপরে উঠে ভাসতে শুরু করে।

পোর্টহোলের ভেতর দিয়ে দেখতে পাবে বাইরে ধীরে ধীরে আলো ফুটে উঠছে। তারপর হঠাৎ প্রবল ধারায় কেবিনের ভেতরে এসে ঢোকে চোখ ধাঁধানো সূর্যের আলো। আমাদের যানটা জলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ছিপির মতো। মেঘের ভেতর থেকে ভুস করে ছিটকে বেরিয়ে আসে! চারধারে ফের আমাদের অভ্যস্ত, স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ, আলোয় প্লাবিত মহাকাশ। এখানে কী চমৎকার!

এই হল শুক্র গ্রহ। কিন্তু আমরা তাই বলে হাল ছেড়ে দিচ্ছি না। পৃথিবীতে জলময় মহাসাগরের তলায়ও আরামের কিছু নেই। সেখানে ঠান্ডা, চির আঁধার। কিন্তু মহাসাগরের অধিবাসীদের তাই বলে তো আর কেউ মহাসাগরের তলায় ঘুরে বেড়াতে বাধ্য করছে না। সেখানে কুকুর বাস করে না, বেড়ালও বাস করে না। এমন কোনো জীব বাস করে না যাদের পায়ের তলায় শক্ত মাটির দরকার। বাস করে মাছেরা। তাদের অনেকে তলা কাকে বলে জানেই না। ওখানে তারা কখনো যায়নি। সারা জীবনই তারা সাঁতার কাটে, পানির ওপরিভাগের কাছাকাছি দিয়ে চলে।

শুক্র গ্রহের বায়ুসমুদ্র অনেকটা পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরেরই মতো। ওই বায়ুসমুদ্রের ওপরিভাগের কাছাকাছি সাঁতরে সাঁতরে সেখানে জীবন যাপন করা সম্ভব, এমনও তো হতে পারে?

শুক্র গ্রহের মেঘরাশির ওপরের দিকে গরম নেই। সেখানকার বায়ু, প্রায় পৃথিবীর উপরিভাগের বায়ুর মতো ঘন। তোমার আমার মতো মানুষ ওরকম বায়ুসমুদ্রে সাঁতার অবশ্যই কাটতে পারবে না। আমরা পড়েই যাব। পাখি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে নিজেকে সামলাতে পারে, কিন্তু মাঝে মাঝে তাকেও তো বিশ্রাম নিতে হয়। কোথায় সে বসবে? ফেঁসোর মতো ছোট ছোট কীটপতঙ্গের ব্যাপার অবশ্য সম্পূর্ণ আলাদা। এরকম বায়ুসমুদ্রে তারা ধূলিকণার মতো ভেসে থাকতে পারে, এর জন্য ডানা ঝাপটানোর পর্যন্ত দরকার হয় না।

তাই শুক্রে মেঘরাশির ওপরে ধূলিকণার মতো এই রকম খুদে খুদে জীব থাকা খুবই সম্ভব। নীচে, বায়ুর নীচের স্তরে অগ্নিকুণ্ড থাকলেও তাদের কিছুই আসে যায় না। ওখানে যাবার আদৌ কোন বাসনা তাদের নেই।

মোটের ওপর শুক্র গবেষণার বিষয়। লোকে এখানে আসবে, কিন্তু বায়ুসমূদ্রের তলদেশে নামতে যাবে না। কোন্ দরকার? তারা বেলুনে বা বায়ুযানে চেপে মেঘের ওপরে ভেসে ভেসে যাবে। নানা রকম অগ্নিরোধক যন্ত্রপাতি নীচে নামিয়ে দিয়ে, রাডারের সাহায্যে গ্রহের ওপরিভাগ হাতড়ে হাতড়ে তারা শুক্রের মানচিত্র তৈরি করে ফেলবে। হয়তো সেখানে পাওয়া যাবে উঁচু উঁচু পাহাড়-পর্বত, যার চূড়ায় গরম তেমন বেশি নেই। আবার সেখানকার মেরুপ্রদেশ স্নিগ্ধও হতে পারে।

কোনো কোনো বিজ্ঞানী এমন অভিমতও প্রকাশ করেছেন যে, শুক্রকে গোছগাছ করে বসবাসের উপযোগী করে তোলা যায়। তারা বলেন, এর জন্য দরকার শুক্রের আবহমণ্ডলে এক বিশেষ ধরনের কীট ছেড়ে দেওয়া। বায়ুমণ্ডলে ভাসতে ভাসতে তারা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করবে, সমস্ত গ্রহে ছড়িয়ে পড়বে এবং কয়েক বছরের মধ্যে শুক্রের বায়ুর উপাদান পালটে ফেলবে। বায়ুমণ্ডলে স্বচ্ছতা আনবে।

তখন গ্রহের পিঠ ধীরে ধীরে জুড়িয়ে আসবে। মেঘ থেকে তার ওপর অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরবে। তার বুকে দেখা দেবে নদী, সরোবর, সমুদ্র। আর্দ্র জমিতে লোকে বীজ বুনবে। বনজঙ্গল গজাবে। বনজঙ্গল বায়ুকে অক্সিজেন যোগাবে, ফলে বায়ু, জীবজন্তু ও মানুষের নিঃশ্বাস গ্রহণের উপযোগী হয়ে উঠবে।

প্রলোভন জাগায়, তাই না? দ্বিতীয় পৃথিবী গড়ে তোলা—একবার ভেবে দেখ দেখি!

আপাতত এটাকে আমরা কল্পনাবিলাসই বলব। আপাতত বলছি। পরে কী হবে সে দেখা যাবে। শুক্রকে ঢেলে সাজানোর আগে তাকে নিয়ে ভালোমতো গবেষণা করতে হবে।

মার্কিন স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র শুক্রের চারদিকে ঘুরে র‍্যাডারের সাহায্যে মেঘের ভেতর দিয়ে তার পিঠ হাতড়ে দেখেছে। তা থেকে ওখানে কোথায় পাহাড়-পর্বত আছে, কোথায় সমভূমি আছে জানা সম্ভব হয়েছে, গ্রহটির মানচিত্রও তৈরি করা গেছে। শুক্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্টেশনগুলোও অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। এরকম প্রতিটি স্টেশন এই আশ্চর্য গ্রহটির প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন নতুন নানা তথ্য পাঠায়।

আচ্ছা, আপাতত আরও দূরে যাত্রা করা যাক। আমরা তৃতীয় গ্রহটিতে না থেমে তার পাশ কাটিয়ে চলে যাব এবারে। ওটা তো আমাদেরই গ্রহ—পৃথিবী। আমাদের বন্ধুবান্ধবের উদ্দেশে হাত নেড়ে যাত্রা করি সোজা চতুর্থ গ্রহে—মঙ্গলে!

(চলবে...)

মূল: পাভেল ক্লুশান্‌ৎসেভ

অনুবাদ: অরুণ সোম