কার্দাশভ স্কেলে একটি সভ্যতা কত উন্নত, তা নির্ধারণ করা হয় সেই সভ্যতা কতটা শক্তি সংগ্রহ করছে, তার ওপর। এই স্কেলে আমাদের বর্তমান সভ্যতা আছে টাইপ জিরোতে।
কল্পনা করুন, অমরত্ব আপনার হাতের মুঠোয়। চাইলে মহাবিশ্বের যেকোনো জায়গায় ভ্রমণ করতে পারেন। ওয়ার্মহোল তৈরির মতো শক্তি সংগ্রহ করা বিমান চালানোর মতো সহজ। কী দারুণ হতো তাহলে, তাই না? এসবই সম্ভব কার্দাশভ স্কেলের টাইপ থ্রি সিভিলাইজেশনে। এগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সম্ভব অতি উন্নত সেই সভ্যতায়। প্রশ্ন হলো, এরকম সভ্যতার কি অস্তিত্ব আছে? মানুষের পক্ষে কি পৃথিবীতে টাইপ থ্রি সিভিলাইজেশন গড়ে তোলা সম্ভব? হলে কীভাবে? আমাদের কি সেই চেষ্টা করা উচিত? অতি উন্নত এ সভ্যতায় প্রযুক্তি কি আমাদের পক্ষে কাজ করবে, না বিপক্ষে?
কার্দাশভ স্কেলে একটি সভ্যতা কত উন্নত, তা নির্ধারণ করা হয় সেই সভ্যতা কতটা শক্তি সংগ্রহ করছে, তার ওপর। এই স্কেলে আমাদের বর্তমান সভ্যতা আছে টাইপ জিরোতে। আমরা এখনও জীবাশ্ম জ্বালানি বা পারমাণবিক শক্তির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক শক্তির বেশির ভাগই আমরা ব্যবহার করতে পারি না। পৃথিবীর মধ্যকার ও বাইরে থেকে আসা সব ধরনের মহাজাগতিক শক্তি সংগ্রহ করে ব্যবহার করা গেলে মানব সভ্যতাকে টাইপ ওয়ান সিভিলাইজেশন বলা যাবে। পদার্থবিদ মিচিও কাকুর মতে, সব ঠিক থাকলে আগামী এক থেকে দুই শতাব্দীর মধ্যে হয়তো টাইপ ওয়ান সিভিলাইজেশনে পৌঁছে যাবে মানব সভ্যতা।
টাইপ থ্রি সিভিলাইজেশন গ্যালাক্সির ভেতরে থাকা প্রায় সব গ্রহ-নক্ষত্র থেকে যেহেতু শক্তি সংগ্রহ করতে পারবে, তাই শক্তির পরিমাণ হবে প্রায় অসীম। গ্রহান্তরে পাড়ি জমানোর বিষয়টা হবে এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়ার মতো সহজ।
টাইপ টু সিভিলাইজেশন হতে হলে শুধু পৃথিবী নয়, সূর্য থেকেও পুরোদমে শক্তি সংগ্রহ করতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির ধারা বজায় থাকলে আগামী কয়েক হাজার বছরের মধ্যে মানুষ সে পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে বলে মনে করেন জাপানি বংশোদ্ভুত মার্কিন এ পদার্থবিদ। বিষয়টি বেশ আশাব্যঞ্জক। এর পরের ধাপ, অর্থাৎ টাইপ থ্রি সিভিলাইজেশনে পৌঁছাতে মানুষের ১ থেকে ১০ লাখ বছরের মতো সময় প্রয়োজন। মিচিও কাকু এমনটাই মনে করেন। টাইপ থ্রি সিভিলাইজেশনে মানুষ সংগ্রহ করবে পুরো গ্যালাক্সির শক্তি। প্রয়োজনমতো ব্যবহার করবে সেটা। এ কথার অর্থ আসলে কী? এত শক্তি ব্যবহার করা একটা সভ্যতা দেখতে আসলে কেমন হবে? নিজ চোখে টাইপ থ্রি সিভিলাইজেশন দেখার সুযোগ আমাদের নেই। ১০ লাখ বছর তো সহজ কথা নয়। তবে চাইলেই আমরা বিষয়টা কল্পনার চোখে দেখে নিতে পারি। বিজ্ঞানের যুক্তিতে দেখতে পারি, কেমন হতে পারে অতি উন্নত সে সভ্যতার অবস্থা।
টাইপ থ্রি সিভিলাইজেশন গ্যালাক্সির ভেতরে থাকা প্রায় সব গ্রহ-নক্ষত্র থেকে যেহেতু শক্তি সংগ্রহ করতে পারবে, তাই শক্তির পরিমাণ হবে প্রায় অসীম। গ্রহান্তরে পাড়ি জমানোর বিষয়টা হবে এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়ার মতো সহজ। শুধু তাই নয়, নতুন করে গ্রহ, নক্ষত্র বা নক্ষত্রব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রযুক্তি ও শক্তি—দুটোই থাকবে মানুষের হাতে।
এ সময় পৃথিবী বা মঙ্গলের মতো গ্রহগুলো হবে শুধু খনিজ সম্পদ সংগ্রহের ঠিকানা। গ্রহগুলো থেকে খনিজ সম্পদ নিয়ে গড়ে তোলা হতে পারে ডাইসন ঝাঁঝরি (SWARMS)। এর কাজ অনেকটা ডাইসন গোলকের মতোই। পার্থক্য হলো, ডাইসন ঝাঁঝরি শুধু নক্ষত্রের শক্তি সংগ্রহ করবে না, বরং এখানে থাকবে বসবাসের জায়গা, কৃত্রিম উপগ্রহসহ নানা সুবিধা।
বায়োটেকনোলজি বা জীবপ্রযুক্তিতে দক্ষতা মানুষকে প্রচণ্ড ক্ষমতাধর করে তুলতে পারে। চিকিৎসার উন্নয়নের ফলে রোগের হাত থেকে মিলতে পারে চিরমুক্তি। অমরত্বও সম্ভব বলে মনে করেন অনেকে। তবে প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়তো মানুষের অস্তিত্বকে কিছুটা বিপন্ন তুলতে পারে। যন্ত্র ও জৈবিক প্রাণের সমন্বয়ে মানুষ স্বেচ্ছায় হয়ে উঠতে পারে সাইবর্গ—আধা যন্ত্রমানব। আধাযান্ত্রিক এই মানুষ একেবারে নিছক কল্পনা নয়। গত দশকে সেই যাত্রা শুরু হয়েছে। মস্তিষ্কে চিপ বসানোর জন্য চলছে হিউম্যান ট্রায়াল। সূদূর ভবিষ্যতের এ দিকটা তাই পরিষ্কার নয়। তবে এমন আশংকার কথা বলছেন অনেক বিজ্ঞানী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিকসের উন্নতি মানুষকেও ছাড়িয়ে যাবে কি না, তা বলা কঠিন। এ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা যেমন আছে, তেমনি অনেকে বলেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু আসলে নেই। তবু শংকা তো থাকেই।
ধরা যাক, কোনোভাবে মানুষ নিজের অস্তিত্ব স্বাভাবিকভাবে টিকিয়ে রাখল। ভৌতবিজ্ঞানের অবস্থা কেমন হবে তখন? অতি উন্নত সে সভ্যতায় পদার্থবিজ্ঞান হবে এখনকার চেয়ে অনেক ভিন্ন। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানুষের পক্ষে প্ল্যাংক শক্তি, অর্থাৎ মহাকর্ষ ও কোয়ান্টাম জগতের শক্তি—আরও সরল করে বললে, গোটা স্থান-কালের শক্তি সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা অনুসারে, ভর আছে, এমন কোনো বস্তুর পক্ষে আলোর চেয়ে বেশি বেগে ছোটা সম্ভব নয়। প্ল্যাঙ্ক স্কেলে ওয়ার্মহোল তৈরি করা তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব। টাইপ থ্রি সিভিলাইজেশনে মানুষের হাতে থাকবে অকল্পনীয় শক্তি। এই শক্তি আর বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নয়নের কারণে হয়তো বড় পরিসরেও ওয়ার্মহোল তৈরি করা সম্ভব হবে। আর তা হলে গতির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ভ্রমণ করা যাবে মহাবিশ্বের যেকোনো স্থানে।
বিপুল এ শক্তি প্রায় অসীম হলেও আসলে সীমাবদ্ধ। একসময় গ্যালাক্সির শক্তিও ফুরিয়ে আসবে। তখন আরও শক্তির জন্য ছুটতে হবে টাইপ ফোর সিভিলাইজেশনে।
ভাবছেন, টাইপ ফোর সিভিলাইজেশন আবার কী? সে নাহয় আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।
সূত্র: হোয়াটইফশো, উইকিপিডিয়া, পপুলার মেকানিকস
এই সিরিজের আরও লেখা পড়ুন
১. ব্ল্যাকহোলে পড়ে গেলে কী হবে?
৩. পৃথিবীর ব্যাসার্ধ দ্বিগুণ হলে কী হতো?
৪. পৃথিবীর সব মানুষ একসঙ্গে লাফ দিলে কী হবে?
৫. সূর্যের ভর অর্ধেক হলে কি হত?
৬. পৃথিবীর দুটি চাঁদ থাকলে কী হতো?
৮. জীবাশ্ম জ্বালানী না থাকলে কী হতো?
৯. পৃথিবী সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ হলে কী হতো?
১০. পৃথিবীর আহ্নিক গতি না থাকলে কী হতো?
১১. সপ্তাহ ধরে চোখের পলক না ফেললে কী হবে?
১২. মানব সভ্যতা টাইপ ওয়ান সিভিলাইজেশন হলে কী হতো?
১৩. পৃথিবী আলোর গতিতে ঘুরলে কী হতো?
১৪. সূর্যে নিউক্লিয়ার বোমা ফেললে কী হবে?
১৫. পৃথিবীর সমস্ত সাপ মারা গেলে কী হতো
১৬. মানুষের ঘাম না হলে কী হতো?
১৭. সৌরজগতে আরেকটা নক্ষত্র ঢুকে পড়লে কী হতো?
১৮. পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র না থাকলে কী হতো?
১৯. মানুষ পরমাণুর মতো ছোট হতে পারলে কী হতো?
২০. সূর্য পালসারে পরিণত হলে পৃথিবীর কী হতো?
২১. মানব সভ্যতা টাইপ টু সিভিলাইজেশন হলে কী হতো?
২২. উড়োজাহাজের ভেতর সব যাত্রী একসঙ্গে লাফ দিলে কী হবে?
২৩. সমস্ত রাস্তা সোলার প্যানেলে ঢাকলে কেমন হতো?
২৪. তেলাপোকা কি পারমাণবিক বিস্ফোরণে বাঁচতে পারে?
২৫. সৌরজগতের গ্রহগুলোর আকার দ্বিগুণ হলে কী হতো?
২৬. মারিয়ানা ট্রেঞ্চে পৃথিবীর সব ময়লা ফেললে কী হতো?
২৮. পৃথিবী আলোর বেগে ঘুরলে কী হতো?
২৯. মহাবিশ্বের সমস্ত হিলিয়াম হারিয়ে গেলে কী হতো?
৩০. সৌরজগতে বায়ুমণ্ডল থাকলে কী হতো?
৩১. কেপলার টুটুবি সৌরজগতের গ্রহ হলে কী হতো?
৩২. এক মিনিটের জন্য ঘর্ষণ বল না থাকলে কী হতো
৩৩. বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে কী হতো
৩৪. চাঁদে হ্যালির ধূমকেতু আছড়ে পড়লে কী হতো
৩৫. পৃথিবীর দুটি সূর্য থাকলে কী হতো