পৃথিবী ও আকাশ
জিওর্দানো ব্রুনো
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর সম্পর্ক। পৃথিবী ও আকাশ নামের এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…
সেকালে ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ড যাওয়াটা ছিল দুঃসাধ্য। প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে উত্তুঙ্গ পাহাড়ের প্রাচীর—আল্পস পর্বতমালা। উচু গিরিসঙ্কটে শুধু বিপজ্জনক সঙ্কীর্ণ পথের ফালি।
ধনীরা খচ্চরের পিঠে চেপে পাহাড় অতিক্রম করত, স্থানীয় লোকেরা দেখাত পথ। যারা গরিব তারা যেত পদব্রজে, মাঝে মাঝে পথ হারিয়ে বরফে জমে বা খাদে পড়ে মৃত্যু। শীতের দুর্ধর্ষ তুষারঝড়ের সময় প্রায়ই মানুষ মারা যেত।
তখনকার দিনে পথে চোর ডাকাতের সংখ্যা বেশ ছিল, তাদের হাত এবং প্রাকৃতিক নানা অসুবিধা এড়াবার জন্য যাত্রীরা ঘোড়সওয়ার ও পদচারী—দুইই যেত বড় দল বেঁধে।
১৫৭৬ সালের শীতকালে সুইজারল্যান্ডযাত্রী এমন একটি ক্যারাভানে যোগ দিলেন মঠবাসীর বেশধারী এক নবীন ইতালীয়।
সরাইখানায় যখন দলের লোক বিশ্রাম করে তখন যুবকটি সহযাত্রীদের থেকে আলাদা বসে থাকেন কোণে ঘুপসিতে। তাদের কথাবার্তায় যোগ দেন না: কেন তিনি চলেছেন এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেন সংক্ষেপে। আর কথা বলার সময়ে পোষাকের হুড দিয়ে মুখ আবৃত করেন। পথ চলেন একা একা, পুলিশ বা অন্য মঠবাসীদের এড়িয়ে চলেন।
কৌতূহলীরা পর্যন্ত যাত্রাশেষে নবীন ইতালীয়টির গোপন কথা ধরতে পারেনি। কিন্তু তাঁর গল্পটা এবার তোমাদের বলি।
তাঁর নাম জিওর্দানো ব্রুনো। 'স্বাধীন চিন্তার' জন্য দুস্তর সাজার কথা ওঠাতে মাতৃভূমি ইতালি ছেড়ে তিনি পলাতক। স্বাধীন চিন্তার মানে, চার্চের নির্দেশমাফিক না চলে অনেক বিষয়ে অন্যভাবে ভাবার দুঃসাহস তিনি ধরতেন।
ইতালির ছোট একটি শহর নোলায় তাঁর জন্ম ১৫৪৮ সালে। অল্প বয়সে অনাথ হয়ে মানুষ হন মঠে। এ কথা তোমরা তো আগেই শুনেছ যে তখন শিক্ষালিপ্সুদের যাজক আর মঠবাসীদের কাছে আবেদন করতে হত। সব শিক্ষার রূপ ছিল ধর্মতত্ত্বগত; ছেলেরা পড়তে শিখত ধর্মগ্রন্থ থেকে, আমাদের মতো প্রথম ভাগ থেকে নয়।
লাইব্রেরিতে কদাচিত লোক আসত। সেখানে নিরিবিলিতে বা নিজের বদ্ধদ্বার কুঠরিতে গোপনে বইটি মন দিয়ে পড়লেন ব্রুনো। নতুন দর্শনের সহজ স্বচ্ছতা তাঁকে অবাক করে দিল। নিজেকে সামলাতে না পেরে একজন মঠবাসীর কাছে বললেন কোপের্নিকাসের রচনার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার কথা।
ক্যাথলিক মঠবাসীদের মধ্যে অনেক বিভাগ ছিল, তাদের নাম সম্প্রদায় বা বর্গ। সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল ডমিনিকান বর্গ। ব্রুনো শিক্ষা পান ডমিনিকানদের কাছে। খুব চালাক চতুর ছিলেন বলে তিনি অনেক জ্ঞান আহরণ করেন। বর্গে তাঁকে গ্রহণ করা হয়। পরে তিনি যাজক হন।
বয়স যখন নিতান্ত কাঁচা তখনই চার্চের অনেক শিক্ষাবলী নিয়ে তিনি চিন্তা করতেন। অনেক কিছু তাঁর কাছে ভ্রান্ত ঠেকত। মনে দেখা দিল প্রথম নানা ভীরু সংশয়।
মঠের লাইব্রেরির একটা অজ্ঞাত তাকে একদিন একটা ধুলোভরা, চামড়ায় বাঁধানো, ইঁদুরে-কাটা বই তাঁর হাতে এল। নবীন যাজক বইটি খুলে ল্যাটিন ভাষায় লেখা নাম থেকে জানলেন, সেটা টরুনের নিকোলাস কোপের্নিকাসের রচনা। বিষয়বস্তু হলো গ্রহ-নক্ষত্রের কথা।
প্রসিদ্ধ এই বইটির বিষয়ে কানাঘুষো ইতিমধ্যেই জিওর্দানো শুনেছিলেন। আর এখন একেবারে হাতের মুঠোয় এসে পড়েছে মহারত্নটি! এবার মঠবাসীদের মুখ থেকে নয়, স্বয়ং লেখকের কাছ থেকে তিনি জানবেন কোপার্নিকাসের তত্ত্ব।
লাইব্রেরিতে কদাচিত লোক আসত। সেখানে নিরিবিলিতে বা নিজের বদ্ধদ্বার কুঠরিতে গোপনে বইটি মন দিয়ে পড়লেন ব্রুনো। নতুন দর্শনের সহজ স্বচ্ছতা তাঁকে অবাক করে দিল। নিজেকে সামলাতে না পেরে একজন মঠবাসীর কাছে বললেন কোপের্নিকাসের রচনার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার কথা। ব্রুনোর দুঃসাহসী বচনের কথা মঠবাসীটি বলে দিল ডমিনিকান বর্গের শীর্ষস্থানীয়দের কাছে।
ভয়ঙ্কর শাস্তির হুমকি দেওয়া হল নবীন মঠবাসীকে। তখন তিনি স্বদেশ ছেড়ে পালালেন, যাজকপদ পরিত্যাগ করলেন। মঠবাসীর বেশ তিনি ছাড়লেন না। কেননা যে দেশে হাজার হাজার মঠবাসী এবং যেখানে যাজকবৃন্দের লোকে ভয়সম্ভ্রম করে, সেখানে এ বেশ রক্ষাকবচের সামিল।
আমাদের সৌরজগতের মতো প্রত্যেকটি নক্ষত্র এক একটি বিশ্বজগতের কেন্দ্র, এমন বিশ্বজগতের সংখ্যা অসীম। ব্রুনো আরও বলেন, মহাশূন্যে সব বিশ্বজগতের শুরু ও শেষ আছে, তারা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল।
পালিয়ে তিনি বাঁচলেন বটে, কিন্তু বহু বছর স্বদেশের মুখ আর দেখতে পেলেন না। সারা জীবন কোপার্নিকাসের ধ্যানধারণা বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন জিওর্দানো ব্রুনো। অবশ্য বাধ্য চেলার মতো শুধু পুরনো বুলি কপচাননি তিনি। কোপার্নিকাসের মতামত তিনি বিকশিত করেন। বিশ্বজগৎ বিষয়ে তাঁর ধারণা এমন কি গুরুর ধারণার চেয়েও সঠিক।
ব্রুনো বললেন, শুধু পৃথিবী কেন, সূর্যও নিজের অক্ষে ঘোরে। ব্রুনোর মৃত্যুর অনেক দশক পরে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।
ব্রুনো বেশ জোর দিয়ে বলেন যে, আমাদের সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে অনেক গ্রহ। আর নতুন অনেক গ্রহ আবিষ্কৃত হবে যাদের কথা পৃথিবীতে অজানা। ব্রুনোর মৃত্যুর ২০০ বছর পর প্রথম নতুন গ্রহ ইউরেনাস আবিষ্কৃত হলো। আরও পরে আবিষ্কৃত হলো নেপচুন, প্লুটো এবং শত শত গ্রহাণুপুঞ্জ। প্রতিভাবান মানুষটির ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হলো এভাবে।
সুদূর নক্ষত্রগুলোতে বিশেষ নজর দেননি কোপার্নিকাস। ব্রুনো বললেন যে, প্রত্যেকটি নক্ষত্র এক একটি সূর্য, আমাদের সূর্যের মতোই প্রকাণ্ড, আর তাদের প্রদক্ষিণ করে নানা গ্রহ। অনেক দূরে বলে সেগুলো আমাদের চোখে পড়ে না। আমাদের সৌরজগতের মতো প্রত্যেকটি নক্ষত্র এক একটি বিশ্বজগতের কেন্দ্র, এমন বিশ্বজগতের সংখ্যা অসীম। ব্রুনো আরও বলেন, মহাশূন্যে সব বিশ্বজগতের শুরু ও শেষ আছে, তারা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। অসাধারণ দুঃসাহসী ধারণাটি হলো, খৃষ্টধর্ম মতে, বিশ্বজগত অবিনশ্বর, ঈশ্বর যেভাবে সৃষ্টি করেছেন অনাদিকাল ঠিক সেভাবে আছে।
ক্ষুরধার মনশক্তি ছিল ব্রুনোর। শুধু বুদ্ধির সাহায্যে যে সব জিনিস তিনি বুঝতে পারেন সেগুলো পরে দূরবীক্ষণের সাহায্যে আবিষ্কার করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। জ্যোতির্বিজ্ঞানে কী দারুণ পরিবর্তন ব্রুনো আনেন সেটা আমাদের পক্ষে এমন কি কল্পনা করা কঠিন। যেন কারাগার থেকে একটি বন্দীকে তিনি মুক্ত করলেন। আর সেই মানুষটির চোখের সামনে অন্ধকার ঘুপসি জেলকুঠরির দেয়ালের জায়গায় অবারিত হল অপরূপ ও অসীম একটি বিশ্বজগত।
মহান বিজ্ঞানী জানতেন না যে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাঁকে ইতালিতে ফিরিয়ে আনার বেইমানি পরিকল্পনাটা করেছিল ইনকুইজিশন। ধর্মের বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্তদের নির্যাতনের জন্য ইতালি ও স্পেনে যে নিষ্ঠুর বিচারসভা বসত তার নাম ইনকুইজিশন।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী কেপলার কিছুকাল পরের লোক। তিনি স্বীকার করেন যে, ‘সুবিখ্যাত ইতালীয়টির রচনাবলী পড়ার সময় মাথা ঘোরে, হয়তো তিনি মহাশূন্যে চলেছেন, যে মহাশূন্যের কেন্দ্র নেই, আদি নেই, শেষ নেই। এ কথাটা ভাবলে গোপন একটা বিভীষিকা আচ্ছন্ন করে দেয়।’
জিওর্দানো ব্রুনোকে চরম শত্রু বলে চিনল চার্চ। অগণিত অধ্যুষিত জগৎ বর্তমান, বিশ্বজগৎ শেষহীন—ব্রুনোর এ তত্ত্ব বিশ্ব সৃষ্টি ও পৃথিবীতে খ্রিষ্টের আবির্ভাব বিষয়ে বাইবেলের সমস্ত কাহিনীকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করল আর এদের ওপরে তো খৃষ্টধর্মের পত্তন। ব্রুনোর বিরুদ্ধে চার্চ কর্তৃক আনা অভিযোগে ১৩০টি পয়েন্ট ছিল।
ব্রুনোকে কালাপাহাড়ী লোক বলে ঘোষণা করল চার্চের পান্ডারা। এ-দেশ ও-দেশে তাঁর বাস নিষিদ্ধ করে দিল কর্তৃপক্ষদের অনুরোধ করে। আর ব্রুনো যত ঘোরেন তত বেশি করে ছড়াতে লাগলেন নিজের মতাবলী সারা পৃথিবীতে।
বহু দিন নির্বাসনে কাটল। রৌদ্রোজ্জল ইতালিতে ফিরে যাওয়ার বাসনা প্রখর হলো ব্রুনোর। এর সুযোগ নিয়ে তাঁর সর্বনাশ ঘটাল শত্রুরা।
একজন নবীন ইতালীয় অভিজাত, জিওভানি মচেনিগো, এমন ভাব দেখালেন যে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে মুদ্রিত ব্রুনোর অগুনতি লেখায় তাঁর সাতিশয় আগ্রহ*। ব্রুনোকে তিনি লিখলেন যে তাঁর শিষ্য হতে চান, পরিশ্রমের মূল্য দেবেন অনেক।
স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ব্যাপারটা নির্বাসিত ব্রুনোর পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক, কিন্তু বেইমানি করে মচেনিগো আশ্বাস দিলেন যে, সব শত্রুর হাত থেকে তাঁকে তিনি রক্ষা করতে পারবেন। ব্রুনোর আস্থা হলো, বিদেশে ঘুরে ঘুরে তাঁর ক্লান্তি এসে গিয়েছিল।
মহান বিজ্ঞানী জানতেন না যে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাঁকে ইতালিতে ফিরিয়ে আনার বেইমানি পরিকল্পনাটা করেছিল ইনকুইজিশন। ধর্মের বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্তদের নির্যাতনের জন্য ইতালি ও স্পেনে যে নিষ্ঠুর বিচারসভা বসত তার নাম ইনকুইজিশন। ইনকুইজিশনের কালে বিচারকেরা হাজার হাজার লোকের প্রাণদণ্ড দেয়। এবার তাদের বলি হবে ব্রুনো।
ভেনিসে গিয়ে ব্রুনো মচেনিগোকে পড়াতে শুরু করলেন। শিষ্য তাঁকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল যে চলে যাওয়ার সঙ্কল্প করলে প্রথমে তার কাছে বিদায় নিতে আসবেন। মচেনিগোর ভয়, পাছে ইনকুইজিশনের মতলব টের পেয়ে ব্রুনো পালিয়ে যান, যৌবনে যেমন পালিয়েছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিদায় নিতে এলে তাঁকে আটকে রাখতে পারবে সে। কয়েক মাস পড়ার পর মচেনিগো বলল ব্রুনো তাকে ভালো করে শিক্ষা দিচ্ছেন না, তাঁর গুপ্ত বিদ্যার সমস্ত কিছুর ভাগ দিতে তিনি নারাজ।
এর উত্তরে ভেনিস ছাড়ার প্রস্তুতি নিলেন ব্রুনো। মচেনিগো খবর দিল ইনকুইজিশনে। ১৫৯২ সালের ২৩শে মে প্রসিদ্ধ পণ্ডিত গ্রেপ্তার হলেন, আটটি ভয়ঙ্কর বছর কাটল কারাগারে।
যে কুঠরিতে তিনি বন্দী তার ঠিক ওপরে সাঁসের ছাদ। গ্রীষ্মকালে অসহ্য গরম, শীতকালে স্যাঁতস্যাঁত আর ঠান্ডা। এ কারাগারে বন্দীর জীবন সুদীর্ঘ একটি যন্ত্রণা—তিলে তিলে মৃত্যুর সামিল।
১৬০০ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি জিওর্দানো ব্রুনোকে রোমে পুড়িয়ে মারা হয়। অত্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে দণ্ডিত মানুষটিকে নিয়ে যাওয়া হলো দণ্ডস্থানে। সামনে রক্তলাল একটি পতাকা। সব গির্জায় ঘণ্টা বেজে উঠল। পুরো পোষাকে শত শত যাজক মৃত্যুকালীন স্তব গাইতে লাগল।
হত্যাকারীরা ব্রুনোকে আট বছর কারাগারে বন্ধ রাখে কেন? তাদের আশা, ব্রুনো নিজের মতামত প্রত্যাহার করবেন। প্রত্যাহার করলে তাদের বিরাট জয়। সারা ইউরোপে পরিচিত ও সম্মানিত ব্রুনো যদি ঘোষণা করেন যে তিনি ভ্রান্ত, চার্চই অভ্রান্ত, তাহলে বিশ্বজগতের গঠন সম্বন্ধে চার্চের উপকথায় আবার বিশ্বাস ফিরে আসত অনেক লোকের।
ব্রুনোর কিন্তু অদম্য মনোবল। চার্চের বিচারকদের হুমকি ও অত্যাচারে তিনি মাথা নোয়ালেন না। নিজের মতামতের সত্যতা বিষয়ে নানা প্রমাণ তিনি দিলেন নাছোড় বান্দাভাবে।
তাঁর প্রাণদণ্ড দিল ইনকুইজিশন। বিচারসভার রায় শুনে বিচারকদের শান্ত কণ্ঠে বললেন ব্রুনো: ‘দণ্ডাজ্ঞা শুনে আমার যা ভয়, দয়াময় ঈশ্বরের নামে এ দণ্ডাজ্ঞা উচ্চারণে তার চেয়ে বেশি ভয় আপনাদের।’
বকধার্মিকের মতো বিচারকরা রায় দিতেন এভাবে: ‘বিনা রক্তপাতে অপরাধীর দণ্ড হউক এ অনুরোধ জানাইতেছে পুণ্য চার্চ।’ এ দণ্ডাজ্ঞা আসলে ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর—এর অর্থ যে অভিযুক্তকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হবে!
১৬০০ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি জিওর্দানো ব্রুনোকে রোমে পুড়িয়ে মারা হয়। অত্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে দণ্ডিত মানুষটিকে নিয়ে যাওয়া হলো দণ্ডস্থানে। সামনে রক্তলাল একটি পতাকা। সব গির্জায় ঘণ্টা বেজে উঠল। পুরো পোষাকে শত শত যাজক মৃত্যুকালীন স্তব গাইতে লাগল। দণ্ডিতের গায়ে একটি হলুদ পোষাক, তার ওপরে শয়তানের কুৎসিৎ ছবি কালো রঙে আঁকা। মাথায় উঁচু একটা মোচার মতো টুপি, টুপিতে অগ্নিশিখার মধ্যে শিঁটিয়ে থাকা একটি মানুষের ছবি। হাঁটার সময় ব্রুনোর হাত-পায়ের ভারি শেকলের ঝনঝনানি। হত্যাকারীদের ভয় ছিল, পাছে জনগণকে সত্য জানাবার শেষ একটা চেষ্টা করেন ব্রুনো, তাই তাঁর জিভ ফেড়ে দেয় তারা।
ব্রুনোর পিছনে বিশপ ও যাজক, রাষ্ট্রীয় কর্মচারী এবং অভিজাতদের একটা মিছিল, প্রত্যেকে সুসজ্জিত।
যে চত্বরে দণ্ডস্থান সেখানে হাজার হাজার রোমান নাগরিক জমায়েত হয়েছে। মিছিলের পথে লোকে লোকারণ্য। তামাসার জন্য ব্যাকুল সবাই, সমস্ত ব্যাপারটা তাদের কাছে উৎসবের দিনের একটা অঙ্গ; সাহসী বিজ্ঞানীর প্রতি অসম্ভব পাশবিক ব্যবহারে বিচলিত, এমন লোক মুষ্টিমেয় মাত্র।
খুঁটিতে বাঁধার আগে ক্ষমালাভের বিনিময়ে নিজের মতামত প্রত্যাহারের আর একটি সুযোগ দেওয়া হল ব্রুনোকে। ঘৃণার সঙ্গে সে ডাক অগ্রাহ্য করে দৃঢ় পদে এগিয়ে গেলেন মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানী। আগুনে দগ্ধে মরার সময়ে একবারও কাতরোক্তি করেননি তিনি।
ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হলো বটে কিন্তু বিজ্ঞানের বিকাশ রুধতে পারল না চার্চের কর্তৃপক্ষরা।
সংগ্রামে নিহত এক একটি বিজ্ঞানী-সৈন্যের জায়গা নিল আরও দশটি বিজ্ঞানী। রোমে যে চত্বরে ব্রুনো মৃত্যুবরণ করেন সেখানে ১৮৮৯ সালে তাঁর একটি স্মৃতিস্তম্ভ বসানো হয়।
*ব্রুনোর রচনাবলীর প্রথম সংস্করণের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ আছে মস্কোয়, লেনিন লাইব্রেরিতে।
(চলবে…)