আইনস্টাইন, মহাকর্ষ তরঙ্গ এবং লাইগো - ১

পৃথিবীতে তখন কোনো মানুষের চিহ্ন নেই। আদিম একটি গ্রহ। সেখানে নেই কোনো গাছপালা, কিংবা অন্য কোনো জীবজন্তুও। একেবারে বিরান বলা চলে। তবে সে যুগে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখা সম্ভব হলে কিছুটা প্রাণের স্পন্দন ধরা পড়ত। কারণ, গোটা গ্রহটি এককোষী একটি জীবের দখলে। তারাই তখন গ্রহটির সবচেয়ে জটিল জীব। তাদের নাম ব্যাকটেরিয়া। অতিক্ষুদ্র এক জীবাণু।

ঠিক সেই সময় পৃথিবী থেকে বহু বহু দূরে দানবীয় ভরের দুটি কৃষ্ণগহ্বর আটকে গেছে পরস্পরের মৃত্যুপাকে। নাছোড়বান্দার মতো নিজেদের দিকে ঘুরতে শুরু করেছে তারা। পাকে পাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে একটি আরেকটিকে। একসময় শেষ হলো তাদের পাক খাওয়া। পরস্পরকে টেনে নিল প্রগাঢ় মৃত্যুচুম্বনে। কৃষ্ণগহ্বর দুটি একীভূত হয়ে গেল চিরকালের জন্য। দুইয়ে দুইয়ে এক, একে একে একাকার।

ঠিক সেই মুহূর্তে কৃষ্ণগহ্বর দুটি থেকে আমাদের সূর্যের ভরের তিন গুণ ভর আক্ষরিক অর্থে বিলীন হয়ে গেল। ক্ষণিকের মধ্যে সেই ভর সুনামির মতো স্থান-কালে আবির্ভূত হলো প্রচণ্ড এক শক্তিরূপে। তীব্র এক যন্ত্রণার মতো স্থান-কালের পথ ধরে চারদিকে ঢেউ হয়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। আলোর বেগে। এটাই স্থান-কালের ঢেউ, যার গালভরা নাম গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ। বাংলায় মহাকর্ষ তরঙ্গ।

অতি অল্প সময়ের জন্য মহাকর্ষ তরঙ্গটির শক্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল, মহাবিশ্বের সব নক্ষত্র সম্মিলিতভাবে যে পরিমাণ শক্তি বিকিরণ করে, তার চেয়ে ৫০ গুণ বেশি। বিষয়টিকে এভাবেও বলা চলে, কৃষ্ণগহ্বর দুটির এভাবে এক হয়ে যাওয়ার কারণে স্থান-কালে প্রচণ্ড ঢেউ তৈরি না করে যদি দৃশ্যমান আলো তৈরি হতো, তাহলে গোটা মহাবিশ্ব ৫০ গুণ বেশি উজ্জ্বল দেখা যেত।

পুকুরের মাঝখানে ঢিল ছুড়লে তার চারপাশে বৃত্তাকারে যেভাবে ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে, মহাকর্ষ তরঙ্গও ছড়িয়ে পড়ল তেমনিভাবে। যাত্রাপথে কোটি কোটি ছায়াপথ আর তারও চেয়ে বেশি নক্ষত্রে আলোড়ন তুলল এই তরঙ্গ। এদিক-ওদিক বাঁকিয়ে-চুড়িয়ে দিল, যেন ছায়াপথ আর নক্ষত্রগুলোকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। একইভাবে মহাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অগণিত গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু আর ধূমকেতুকে কাতুকুতু দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল আরও সামনে।

একদিন আকাশ থেকে আচমকা নেমে এল বিশাল এক গ্রহাণু। মহাকাশের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুকের আঘাতে ডাইনোসরও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। গ্রহাণুর বিপুল ধ্বংসস্তূপে ভারী হয়ে উঠল পৃথিবীর বাতাস, দীর্ঘকাল ঢাকা পড়ে রইল আকাশ

তখন টেকটোনিক প্লেটগুলোর নড়াচড়া চলছে আমাদের প্রিয় পৃথিবীতে। প্লেটগুলো পরস্পরের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে নিজেদের সঙ্গে সংঘর্ষও হলো তাদের। সাগর, মহাসাগরের বুক থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে লাগল সুউচ্চ পাহাড়-পর্বত, কোথাও-বা দেখা দিল গভীর খাদ, উপত্যকা। তিন বিলিয়ন বছর ধরে গ্রহটির প্রাণ বলতে ওই এককোষী জীব। একসময় বহুকোষী জীবের আবির্ভাব হলো। ধীরে ধীরে পৃথিবীর বুকে দেখা মিলল উদ্ভিদ আর প্রাণীদের। আন্তগ্রহীয় ধ্বংসস্তূপে তারাও একবার ধ্বংস হলো, তারপর আবার মাথা তুলে দাঁড়াল নতুন করে। একসময় ডাইনোসর নামের এক দানবীয় জীব দাপিয়ে বেড়াতে লাগল পৃথিবীর আনাচে-কানাচে।

একদিন আকাশ থেকে আচমকা নেমে এল বিশাল এক গ্রহাণু। মহাকাশের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুকের আঘাতে ডাইনোসরও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। গ্রহাণুর বিপুল ধ্বংসস্তূপে ভারী হয়ে উঠল পৃথিবীর বাতাস, দীর্ঘকাল ঢাকা পড়ে রইল আকাশ। ক্রমাগত সূর্যের আলোর অভাবে শুরু হলো বরফযুগ। অবশেষে তারও অবসান হলো। দীর্ঘদিন পর পৃথিবীর বুকে দেখা দিল অদ্ভুত দুই পেয়ে এক জন্তু। মানুষ তার নাম। তাদের বংশধর একসময় দখল নিল গোটা পৃথিবী। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিতে কালে কালে হিমালয়ের সুউচ্চ মাউন্ট এভারেস্ট থেকে শুরু করে সাত মহাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল তারা। একসময় চাঁদের নরম ধুলাতেও ছাপ পড়ল তাদের পায়ের চিহ্নের।

ওদিকে স্থান-কালের সেই ঢেউ বহু ছায়াপথ আর নক্ষত্রকে মাড়িয়ে তখনো আগের মতোই ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। একসময় আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ের শেষ সীমা অতিক্রম করে ঢুকে পড়ল তার সর্পিল বাহুর ভেতরে। ক্রমেই মিল্কিওয়ের অরিয়ন নামের সর্পিল বাহুর দিকে এগিয়ে এল। আমাদের সৌরজগতের শেষ প্রান্তের বরফাচ্ছন্ন ধূমকেতুর মেঘকে ধাক্কা মেরে এগিয়ে আসতে লাগল আরও কেন্দ্রের দিকে। বামন গ্রহ প্লুটোকে ছুঁয়ে একে একে আলোড়ন তুলল গ্যাস জায়ান্ট গ্রহ শনি ও বৃহস্পতি এবং তাদের চাঁদে। তাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে এল আরও সামনে, আমাদের মাতৃনক্ষত্র সূর্যের দিকে। যাত্রাপথে এরপর মাড়িয়ে যেতে লাগল পাথুরে গ্রহগুলোকে। মঙ্গলের বুক চিরে, আমাদের চাঁদে সুড়সুড়ি দিয়ে অকস্মাৎ ঢুকে পড়ল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে।

মহাবিশ্বে সুদীর্ঘ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বছর যাত্রার পর অবশেষে তারা ছুটে গেল মনুষ্যনির্মিত বিশাল এক যন্ত্রের দিকে। সেই যন্ত্র অনেক কাল ধরে একনিষ্ঠ প্রেমিকের মতো ধৈর্য ধরে শুধু তাদের জন্যই তীব্র প্রতীক্ষায় বসেছিল। শেষ পর্যন্ত সে প্রতীক্ষার অবসান হলো।

২.

হ্যানোভার, জার্মানি। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল। ঠিক দুপুরবেলা। কম্পিউটারে ই-মেইল আসার একটা পিং শব্দ শোনা গেল। নিজের কম্পিউটারের সামনে বসেছিলেন মার্কো ড্রাগো। তবে ই–মেইলটিকে খুব একটা পাত্তা দিলেন না। তখন একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লেখায় ভীষণ ব্যস্ত তিনি। প্রতিদিন ঠিক এ সময় এ রকম ই–মেইল আসে তাঁর কাছে। ছকে বাঁধা রুটিনের মতো। মাঝেমধ্যে সেগুলোর বিশেষ কোনো তাৎপর্যও থাকে না। তাই শুরুতে তেমন গা করলেন না ড্রাগো। ভাবলেন, হাতের কাজ শেষ করে ই–মেইলটা চেক করবেন।

সেদিন ছিল সোমবার। ড্রাগোর জন্য দিনটি শুরু হয়েছিল একেবারে সাদামাটাভাবে। প্রতিদিনের মতো সেই বাঁধাধরা রুটিন। হ্যানোভারের কেন্দ্রস্থলে শান্তশিষ্ট শহর নর্ডস্ট্যাডে থাকেন তিনি। শরতের রোদেলা সকালে নিজের ফ্ল্যাট ছেড়েছেন। এরপর ১০ মিনিট হেঁটে পৌঁছেছেন নিজের কর্মস্থল ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাভিটেশনাল ফিজিকসে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের নামে তৈরি করা এই ইনস্টিটিউটের কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২০০। আধুনিক ধাঁচের এক জোড়া আয়তকার ভবনের মাঝখানে একটি রোডওয়ের মাধ্যমে দুই ভাগে বিভক্ত। তবে কাচনির্মিত একটা করিডর দিয়ে সেটি পরস্পর সংযুক্ত।

কাঁটায় কাঁটায় সকাল নয়টায় একতলায় নিজের অফিসে পৌঁছালেন ড্রাগো। গা থেকে কোট খুলে জায়গামতো রেখে নিজের ডেস্কে বসলেন। রাতভর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে একগাদা ই–মেইল আসে তাঁর কাছে। লাইগো-ভার্গো কোলাবরেশনে প্রায় এক হাজার মানুষ যুক্ত। তাঁরাও ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছেন বিভিন্ন দেশে। দেশে দেশে রাত–দিনের পার্থক্যের কারণে প্রায় সারা রাত ধরেই ননস্টপ ই–মেইল আসতে থাকে তাঁর কাছে। সেগুলো চেক করেই তাঁর অফিসের কাজ শুরু হয়।

প্রায় এক বছর আগে ইতালির ভেরোনা শহরের কাছে ট্রেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্মানিতে এসেছেন তিনি। তাঁর পোস্ট ডক্টরাল চাকরি শুরু হয়েছিল অনেকের কাছে আলবার্ট আইনস্টাইন ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত এক প্রতিষ্ঠানে। সেখানে তাঁর কাজ ছিল নির্দিষ্ট কিছু অ্যালগরিদম মনিটর করা। যুক্তরাষ্ট্রের লাইগো গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ ডিটেক্টর এবং ইউরোপের ভারগো ডিটেক্টরের আউটপুট বিশ্লেষণের জন্য এসব অ্যালগরিদম মনিটর করা হতো। সেখান থেকে খুঁজে দেখা হতো মহাকর্ষ তরঙ্গ হওয়ার মতো বিশ্বাসযোগ্য কোনো সংকেত মহাকাশ থেকে আদৌ পাওয়া গেল কি না।

সায়েন্টিফিক পেপারটি যতটুকু লিখেছেন, সেটুকু সেভ করে মেইল চেক করতে ইনবক্সে ঢুকলেন ড্রাগো। সেখানে ‘অ্যালার্ট’ লেখা একটি মেইল দেখতে পেলেন। সেটাতেই ক্লিক করলেন তিনি। ইতালির পিসায় অবস্থিত ভার্গো ডিটেক্টরের কাজ তখনো শুরু হয়নি (এই ইন্টারফেরোমিটারের নামকরণ করা হয়েছে মহাকাশের ৫০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের ভার্গো ক্লাস্টারের নামে)। তাই মেইলে মাত্র দুটি অ্যাটাচমেন্ট দেখতে পেলেন ড্রাগো। এর মধ্যে একটি এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানার লিভিংস্টোন থেকে, আরেকটি ওয়াশিংটন রাজ্যের হ্যানফোর্ড থেকে।

অ্যাটাচমেন্ট খুলে কম্পিউটার মনিটরে স্পিল্ট স্ক্রিনে দুটিই পাশাপাশি দেখতে লাগলেন ড্রাগো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। কারণ, মেইলের ভাষ্য, ইস্টার্ন স্ট্যান্ডার্ড টাইম অনুযায়ী ভোর ৫টা ৫১ মিনিটে লিভিংস্টোনের ডিটেক্টরে একটি অদ্ভুত কম্পন ধরা পড়েছে। এর ঠিক ৭ মিলিসেকেন্ড পর, অর্থাৎ ১ সেকেন্ডের ১০০ ভাগের অনেক কম সময় পর প্রায় একই ধরনের একটি কাঁপুনি ধরা পড়ে হ্যানফোর্ডের ডিটেক্টরেও। বেশ মিল আছে কম্পন দুটির মধ্যে। কারণ, গ্রাফ পেপারে বাঁ থেকে ডান দিকে যাওয়া কম্পন দুটির রেখার ওঠানামার মধ্যে বেশ মিল দেখা যাচ্ছে; অর্থাৎ কম্পনটি যাত্রাপথে বিশাল রুলারটাকে প্রায় হুবহু একই রকম সংকুচিত ও প্রসারিত করেছে। ১ সেকেন্ডের ১০ ভাগের প্রায় ১ ভাগ সময়ে গ্রাফে কম্পনরেখার ওঠানামা ক্রমেই দ্রুততর আর উগ্র হয়ে উঠেছে। এভাবে সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছে হঠাৎ করে থেমে গেছে রেখাটি।

পৃথিবী অতিক্রম করে যাওয়া কোনো মহাকর্ষ তরঙ্গের নির্ভুল স্বাক্ষর এটি। নিঃসন্দেহে একত্র হয়ে যাওয়া একজোড়া কৃষ্ণগহ্বর থেকে উৎপন্ন মহাকর্ষ তরঙ্গ এখানে তার স্বাক্ষর রেখে গেছে। কিন্তু ড্রাগো যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। পুরো ফলাফলটি তাঁর কাছে চরম অবিশ্বাস্য বলে মনে হলো। কয়েক মুহূর্ত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে ডুবে রইলেন তিনি।

পৃথিবীতে যদি কোনো মহাকর্ষ তরঙ্গ আসে, তার উৎপত্তি হবে অবশ্যই আমাদের কাছ থেকে অতি দূরের কোনো জায়গায়। অবিশ্বাস্য বিপুল আয়তনের স্থান পেরিয়ে আসতে গিয়ে সেই তরঙ্গ একসময় অতিক্ষুদ্র আর দুর্বল ঢেউয়ে পরিণত হবে

লাইগো প্রজেক্টের সূচনা হয়েছিল ১৯৮০-এর দশকের শুরুর দিকে। ১৯৯০-এর দশকে এটি স্থাপনের কাজ শুরু হয়। তবে লাইগো মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তকরণ কার্যক্রম শুরু হয় ২০০২ সালের দিকে। ২০১০ সাল পর্যন্ত কোনো সফলতা ছাড়াই চলতে থাকে। এরপর বড় ধরনের আপগ্রেডের জন্য কিছুদিন তা বন্ধ রাখা হয়েছিল। উন্নত মানের ডিটেক্টর স্থাপনের পর এটি পরিচিতি পায় অ্যাডভান্সড লাইগো নামে। মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তের জন্য লাইগো এখন যথেষ্ট সংবেদনশীল বলা যায়। এরপরও ডিটেক্টরগুলোর সংবেদনশীলতা বাড়াতে মাঝেমধ্যেই এটি আপগ্রেড করা হয়। সে সময় এ–সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড বলতে গেলে প্রায় বন্ধই থাকে। মাসখানেক আগেও এ রকম একটি আপগ্রেড কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর আবার চালু হয়েছে অ্যাডভান্সড লাইগো। ড্রাগো ভাবলেন, এটা দৈবঘটনা নাকি যে ডিটেক্টরটা নতুন করে চালু করতে না করতেই মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরা পড়ল? তেমনটি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখতে পেলেন না তিনি।

ড্রাগোর মনের ভেতর পাগলাঘণ্টার মতো অ্যালার্ম বেজে যেতে লাগল। তার পেছনে আরও কিছু কারণও আছে। মহাকর্ষ তরঙ্গ খুবই দুর্বল। তার কারণও খুব সরল। আসলে খোদ মহাকর্ষও খুব দুর্বল। মানবদেহে পরমাণুগুলোকে পরস্পরকে বেঁধে রাখে বৈদ্যুতিক বল। সেই বলের তুলনায় মহাকর্ষ বল ১০ হাজার বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন ভাগ দুর্বল (বা ১০৩৬ ভাগ দুর্বল)। সিঁড়ি বা পাহাড়ে ওঠার সময় মহাকর্ষের শক্তিটা বোঝা যায়। কিন্তু তবু অন্য বলগুলোর তুলনায় এটি খুবই দুর্বল।

স্থান-কাল অবিশ্বাস্য রকম দৃঢ়। ইস্পাতের চেয়েও তা এক বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন গুণ বেশি দৃঢ়। একটি ড্রামের পৃষ্ঠে কম্পন তোলা সহজ, কিন্তু স্থান-কালে কম্পন তোলা খুব কঠিন। অবশ্য বাতাসে হাত নাড়িয়েও স্থান-কালের বুননে ঢেউ তোলা যায়। কিন্তু তা এতই দুর্বল যে যন্ত্রে শনাক্ত করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। কেবল অতিদানবীয় ভরের তীব্র নড়াচড়া—যেমন দুটি কৃষ্ণগহ্বর একীভূত হয়ে যাওয়ার কারণে স্থান-কালে যে মহাকর্ষ তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, তাকেই একুশ শতকের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দিয়ে শনাক্ত করার সামর্থ্য রাখি আমরা।

মহাবিশ্বে কৃষ্ণগহ্বর একীভূত হওয়ার ঘটনাও বেশ বিরল বলে একসময় ধারণা করতেন বিজ্ঞানীরা। এর মানে হলো, পৃথিবীতে যদি কোনো মহাকর্ষ তরঙ্গ আসে, তার উৎপত্তি হবে অবশ্যই আমাদের কাছ থেকে অতি দূরের কোনো জায়গায়। অবিশ্বাস্য বিপুল আয়তনের স্থান পেরিয়ে আসতে গিয়ে সেই তরঙ্গ একসময় অতিক্ষুদ্র আর দুর্বল ঢেউয়ে পরিণত হবে। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করা হয়েছিল, লাইগো-ভার্গো ডিটেক্টরে যে প্রথম মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরা পড়বে, তা এতই দুর্বল হবে যে ব্যাকগ্রাউন্ড গোলমালের ভিড়ে তাকে কোনোমতে বোঝা সম্ভব হবে। কিন্তু ড্রাগোর কম্পিউটার স্ক্রিনে যে সংকেত দেখা যাচ্ছে, তাকে সেভাবে দুর্বল বা অস্পষ্ট বলা চলে না। সেটা যে বেশ শক্তিশালী, তাতে কোনো ভুল নেই। তরঙ্গটি যেন এখন কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে ড্রাগোর ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কাজেই হঠাৎ সন্দেহ হলো ড্রাগোর। এটা কী তবে কোনো ফলস অ্যালার্ম? একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এমনটিই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন মার্কো ড্রাগো।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় আরেকটি সম্ভাবনার কথাও তাঁর মাথায় এল। সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে দ্রুত পায়ে নিজের অফিসঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। লম্বা করিডর ধরে হন্তদন্ত হয়ে হাঁটতে দেখা গেল তাঁকে।

করিডরের অন্য প্রান্তে থাকেন তাঁর সুইডিশ পোস্ট ডক্টরাল কলিগ অ্যান্ড্রু লান্ডগ্রেন। উত্তেজিত ড্রাগোর মুখে সব শুনলেন তিনি। তড়িঘড়ি করে নিজের কম্পিউটারের দিকে ছুটে গেলেন অ্যান্ড্রু। ই–মেইল খুলে নির্ধারিত লিংকে ক্লিক করলেন। হ্যানফোর্ড আর লিভিংস্টোন থেকে আসা হুবহু তরঙ্গের রেখাচিত্র তার মনিটরেও ভেসে উঠল। দুজনেই সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে তখন একই কথা ভাবছেন: ওটা কিছুতেই সত্য হতে পারে না।

তাঁদের এ রকম ভাবনার পেছনে আসলে দুটি যৌক্তিক কারণ ছিল। ডিটেক্টরের সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করে দেখার জন্য লাইগো-ভার্গোর ইঞ্জিনিয়াররা মাঝেমধ্যে সিস্টেমে ফেক সিগন্যাল ঢুকিয়ে দেন। যাকে বলে ফেক ইনজেকশন বা ব্লাইন্ড ইনজেকশন। কিন্তু সে রকম কিছু করা হলে ই–মেইলে তার উল্লেখ থাকার কথা। ড্রাগো এবং অ্যান্ড্রু তেমন কোনো ভুয়া সংকেতের কথা খুঁজে পেলেন না।

দ্বিতীয় আরেক ধরনের ফেক সিগন্যালের ডিজাইন করেন ইঞ্জিনিয়াররা। পদার্থবিদেরা সন্দেহজনক সংকেত থেকে খাঁটি মহাকর্ষ তরঙ্গকে যাতে আলাদা করতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করতে এই ফেক সিগন্যাল দেওয়া হয়। পদার্থবিদদের ছোট্ট একটি দল এ ধরনের ভুয়া সংকেত নিয়ে কাজ করে। বিষয়টি গোপন রাখার জন্য তাঁদের রীতিমতো শপথ করানো হয়। সে ধরনের কোনো সংকেত ধরা পড়লে কিংবা কোনো জার্নালে সায়েন্টিফিক পেপারে এ রকম কোনো শনাক্তের দাবি করে প্রকাশের একেবারে শেষ মুহূর্তেই কেবল তাঁরা সেই ভুয়া সংকেতের কথা স্বীকার করেন। ২০১০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এ রকম একটি ভুয়া সংকেতের কথা দাবি করা হয়েছিল একটি পেপারে। মজার ব্যাপার হলো, সেটা ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার জার্নালে জমাও দেওয়া হয়েছিল। লেখাটি প্রকাশিত হব হব করছে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে জানা গেল সংকেতটি ছিল ভুয়া।

তাই আগের অভিজ্ঞতার কারণে মন থেকে সন্দেহ যাচ্ছিল না তাঁদের। বেশ কিছুক্ষণ বিষয়টি নিয়ে সলাপরামর্শ করলেন ড্রাগো আর অ্যান্ড্রু। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে এলেন, কম্পিউটারে তাঁরা যে সংকেত দেখতে পাচ্ছেন, সেটা খুব সম্ভবত ভুয়া। তবে আগে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। সেটা করতে তাঁদের কাছে তখন কেবল একটি কাজই বাকি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের হ্যানফোর্ড আর লিভিংস্টোনের সব কার্যক্রম ঠিকঠাক চলছে কি না, ফোন দিয়ে তার খোঁজখবর নেওয়া।

কিন্তু হ্যানফোর্ডে তখন গভীর রাত। রাত সাড়ে তিনটা। অন্যদিকে লিভিংস্টোনে বাজে সাড়ে পাঁচটা। তাই লিভিংস্টোনের কন্ট্রোল রুমে ফোন দিলেন ড্রাগো।

সে সময় কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে ছিলেন উইলিয়াম পার্কার। লাইগোর লিভিংস্টোনে টেকনিশিয়ানের দায়িত্ব তাঁর। অনেক কসরত করে ফোনে তাঁকে ধরতে পারলেন ড্রাগো। পার্কার নিশ্চিত করলেন, সব ঠিকমতোই চলছে। যন্ত্রপাতিতে কোনো ঝামেলা নেই। আবার ফেক ইনজেকশনের কোনো শিডিউল নেই বলেও নিশ্চিত করলেন তিনি।

পার্কারের শেষ কথাটি শুনে চমকে উঠলেন ফোনের এ প্রান্তের ড্রাগো। তাহলে কি সংকেতটা সত্যি নাকি? এবার আর চোখ নয়, নিজের কানকেও আর বিশ্বাস করতে পারলেন না। মন থেকে সন্দেহ পুরোপুরি না গেলেও উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠল তাঁর হৃৎপিণ্ড। মুহূর্তেই তা সংক্রমিত হলো অ্যান্ড্রুর মধ্যেও। তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নিলেন ড্রাগো আর অ্যান্ড্রু। গোটা লাইগো-ভার্গো কোলাবরেশনের সবাইকে এ সম্পর্কে ই–মেইল পাঠাতে হবে।

নিজের কম্পিউটারে ফিরে এসে কি–বোর্ড চেপে লিখতে লাগলেন ড্রাগো, ‘হাই অল, এক ঘণ্টা আগে খুবই চমৎকার একটি ঘটনা ঘটেছে। এটি যে কোনো হার্ডওয়্যার ইনজেকশন ছিল না, তা কি কেউ নিশ্চিত করতে পারো?’

এরপর দিনটার বাকি সময়টুকু ব্যস্তভাবে কেটে গেল ড্রাগোর। যুক্তরাষ্ট্রে ততক্ষণে লাইগোর কর্মীদের ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে। চোখ রগড়ে ড্রাগোর পাঠানো মেইলটা নজরে পড়তে লাগল একে একে সবার। রহস্যময়, সন্দেহজনক সংকেতটি নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হলো তাঁদের মধ্যে। শিগগিরই মেইলের উত্তর পাঠাতে লাগলেন কর্মীরা।

মেশিনগানের বুলেটের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ই–মেইল ছুটে আসতে লাগল ড্রাগোর কাছে। সেগুলো সামলানোও ড্রাগোর পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব হয়ে উঠল। দিনটা এতই ব্যস্তভাবে কেটে গেল যে নিজের ভেতরের টগবগে উত্তেজনাও ঠিকমতো ঠাহর করে উঠতে পারলেন না। কিন্তু তখনো পর্যন্ত তিনি মনে মনে সন্দেহ করে বসে আছেন যে সংকেত ভুয়াই ছিল।

দুদিন পর সবকিছু পাল্টে গেল। সেদিন একদল পদার্থবিদের কাছ থেকে হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দেওয়ার মতো একটি খবর শোনা গেল। তাঁরা জানান, কোনো ফেক বা ব্লাইন্ড ইনজেকশনের ঘটনা ঘটেনি। এবার আর কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। সত্যি সত্যিই ধরা পড়েছে গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ। বহু প্রতীক্ষিত মহাকর্ষ তরঙ্গ।

ব্যস্ততম একটি দিন শেষ করে সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় যাওয়ার জন্য নিজের অফিসঘর ছেড়ে বেরোলেন ড্রাগো। লম্বা করিডরের এক জায়গায় এক মিটার উঁচু বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের প্রতিকৃতি বসানো। এর পাশ দিয়েই এক্সিটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ড্রাগো। প্রায় ১০০ বছর আগে এই মানুষটাই মহাকর্ষ তরঙ্গের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে ড্রাগোর মনে হলো, আইনস্টাইন যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলছেন, ‘কী, বলেছিলাম না, আছে।’

চলবে...

সূত্র:

১. ব্রায়ান ক্লেগ, গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ: হাউ আইনস্টাইন’স স্পেসটাইম রিপলস রিভিল দ্য সিক্রেট অব দ্য ইউনিভার্স, আইকন বুকস, লন্ডন, যুক্তরাজ্য, ২০১৮

২. ক্লিফোর্ড এম. উইল এবং নিকোলাস ইউনেস, ইজ আইনস্টাইন স্টিল রাইট, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, যুক্তরাজ্য, ২০২০

৩. জেড জেড. বাকওয়াল্ড (সম্পাদনা), আইনস্টাইন ওয়াজ রাইট: দ্য সায়েন্স অ্যান্ড হিস্ট্রি অব গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভস, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, যুক্তরাষ্ট্র, ২০২০

৪. হ্যারি কলিন্স, গ্র্যাভিটি’স কিস: দ্য ডিটেকশন অব গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভস, এমআইটি প্রেস, যুক্তরাষ্ট্র, ২০১৭

৫. মিচিও কাকু, প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস, পেঙ্গুইন, যুক্তরাজ্য, ২০০৬

৬. উইকিপিডিয়া

*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত