সৌরজগতের সবচেয়ে উষ্ণ গ্রহ শুক্র

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর নানা রহস্যের সমাধান। পৃথিবী ও আকাশ নামে এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…

শুক্র গ্রহফাইল ছবি: রয়টার্স

সূর্যাস্তের পর মাঝেমধ্যে আকাশের পশ্চিম ভাগে দেখা দেয় একটি অতি উজ্জ্বল তারা। এটি সন্ধ্যাতারা, অন্ধকার ঘনিয়ে আসার অনেক আগেই এর আবির্ভাব। তারপর নিচের দিকে নামতে নামতে একসময় দিগন্তে অদৃশ্য হয়ে যায়।

আকাশের পূর্ব ভাগে সূর্যোদয়ের আগে মাঝেমধ্যে একটি অতি উজ্জ্বল তারার সাক্ষাৎ ঘটে। অন্য যেকোনো তারার চেয়ে বেশিক্ষণ থাকে এটি। আর সব তারা অদৃশ্য হয়ে গেল, কিন্তু শুকতারা তখনও বর্তমান। দিগন্তে সূর্য দেখার পর এটি ঝাপসা হয়ে যায়। 

সূর্যাস্তের আধ ঘণ্টাখানেক পরে বাইরে গিয়ে পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যাতারার খোঁজ করো। খোঁজ পেলে পশ্চিম দিগন্তে এর মন্থর অধোগতি দেখো ভালো করে। পশ্চিমে সন্ধ্যাতারার পাত্তা না মিললেও কাউকে বলে রেখো, যেন সূর্যোদয়ের আধ ঘণ্টা আগে তোমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেয়। বাইরে গিয়ে পূর্ব দিকে তাকিও—হয়তো একটি উজ্জ্বল তারা চোখে পড়বে। 

রহস্যটার অর্থ কী? আসলে রহস্য কিছু নেই: শুকতারা ও সন্ধ্যাতারা দুটি ভিন্ন তারা নয়, একটিই নক্ষত্র, কখনো সকালে, কখনও সন্ধ্যেবেলায় চোখে পড়ে। মাঝেমধ্যে তো একেবারে দেখাই যায় না ওটাকে। আর এই জ্যোতিষ্ককে তারা বলা ভুল—এটি নক্ষত্র নয়, শুক্র গ্রহ। সৌন্দর্যদেবীর খাতিরে রোমানরা এর নাম দেয় ভেনাস। 

ভেনাস সত্যিই অত্যন্ত সুন্দর গ্রহ। মৃদুশ্বেত দীপ্তি এর, উজ্জ্বলতার দিকে কোনো গ্রহ-নক্ষত্র এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না।

পৃথিবী সম্পর্কে শুক্রের বিভিন্ন মূর্তি

হয়তো তোমরা ভাববে, ‘এত উজ্জ্বল যখন, নিশ্চয়ই খুব বড় একটা গ্রহ।’

তা নয় কিন্তু। আমাদের গ্রহের চেয়ে শুক্র বড় নয়। শুক্র আর পৃথিবীকে মাঝে মাঝে বলা হয় যমজ। শুত্রুকে এত উজ্জ্বল মনে হয় কারণ চাঁদের পর এটিই আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। শুক্র পৃথিবীর ৪ কোটি ২০ লাখ কিলোমিটার কাছে আসতে পারে। পৃথিবী ও প্লুটোর মধ্যে যে ব্যবধান, তার তুলনায় এ দূরত্ব অত্যন্ত কম। 

পৃথিবীর বছরের চেয়ে শুক্রের বছর অনেক ছোট, ২২৫ দিন, অর্থাৎ সাড়ে সাত পার্থিব মাস। শুক্রেরও কলা আছে, চাঁদ এবং বুধের মতো। 

ভালো দূরবীক্ষণ যন্ত্রে শুক্রের দিকে তাকালে চোখে পড়বে কয়েকটি নিরাকার ছোপ—তার কয়েকটা উজ্জ্বল, কয়েকটা অন্ধকার। দেখতে অনেকটা মেঘের মতো। আর বায়ুমণ্ডল থাকলে তবে তো মেঘ ভাসতে পারে। তাই শুক্র গ্রহে বায়ুমণ্ডল আছে নিশ্চয়ই। সে বায়ুমণ্ডল খুব উঁচু আর ঘন। 

শুক্র গ্রহে বায়ুমণ্ডল আছে—এটা প্রথম ধরা পড়ে রাশিয়ার মিখাইল লমোনোসভের কাছে। এটি তিনি আবিষ্কার করেন ১৭৬১ সালে, প্রায় ২৫০ বছর আগে। তখন বিরল ঘটনা দেখেন তিনি—সূর্যের চক্রফলক হয়ে শুক্র গ্রহের যাত্রা। পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে সরাসরি লাইনে শুক্র গ্রহ থাকলেই এটা ঘটে। তখন গ্রহের আলোকিত দিকটা থাকে সূর্যের পানে, আর অন্ধকার দিকটা আমাদের দিকে। তাই সূর্যের উজ্জ্বল মুখ হয়ে যাওয়ার সময় এটিকে দেখায় অতি ক্ষুদ্র কালো একটি বৃত্তের মতো।

সূর্যের কাছে শুক্রের আগমন মুহূর্তটিতে লমোনোসভের চারপাশে একটা ক্ষীণ আলোকবেষ্টনী দেখেন তিনি। ঠিকই ধরেন যে এটি শুক্রের সূর্যালোকিত বায়ুমণ্ডল। 

একই সময়ে শুত্রুকে পর্যবেক্ষণকারী অন্যান্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা লমোনোসভের মতো অবহিত ছিলেন না। আলোর মালা তাঁদেরও চোখে পড়ে, কিন্তু জিনিসটা কী, তাঁরা বোঝেননি। তাঁরা শুধু এই বলে আপত্তি করেন যে আলোকবেষ্টনীর জন্য সূর্যের চক্রফলকের প্রান্তে ঠিক কোন সময়ে শুক্র গ্রহের প্রান্ত পৌঁছায়, সেটা তাঁরা ধরতে পারেননি। কিন্তু লমোনোসভ লেখেন: ‘শুক্র গ্রহ নিশ্চয়ই বায়ুমণ্ডল দ্বারা পরিবৃত...আমাদের পৃথিবীর চারদিকে যেমন, ঠিক তেমন (তার চেয়ে বড় হয়তো)।’ 

মিখাইল ভাসিলিয়েভিচ লমোনোসভ

লমোনোসভ যে এত স্পষ্টভাবে বুঝেছিলেন, সেটা আশ্চর্য। কেননা তিনি মানমন্দির থেকে গ্রহটির গতি দেখেননি, হাতে-গড়া একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র বাড়ির জানালা দিয়ে বাগিয়ে দেখেন। 

সূর্যের চক্রফলক হয়ে শুক্রের গতি ঘটে কদাচিৎ। এরকম শেষবার ঘটে ১৮৮২ সালে, পরেরটা ২০০৪ সালে। 

লমোনোসভের সময় থেকে বিজ্ঞান এগিয়েছে অনেক দূর। কোন কোন গ্রহে বায়ুমণ্ডল আছে, বিজ্ঞানীরা শুধু যে সেটা জানেন, তা নয়; তাঁরা বলতে পারেন, সে বায়ুমণ্ডলে কোন কোন গ্যাস আছে। 

তাঁরা জানেন, শুক্রের বায়ুমণ্ডলে নাইট্রজেন আছে, কিন্তু অক্সিজেন আছে কি না, তা নিশ্চিত নন। এর অর্থ কী, নিশ্চয়ই জানো। মানে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন পাঠাবার মতো কোনো উদ্ভিদ নেই শুক্রে, অথবা যা আছে, তারা সংখ্যায় একদম অল্প। 

চন্দ্রলোকে আমাদের যাত্রার একটা কথা তোমাদের মনে আছে নিশ্চয়। সেখানকার দিন আর রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য অনেক বেশি, কেননা রাত আর দিন—দুটোই ৩৫৪ ঘণ্টা দীর্ঘ। চাঁদের চেয়ে শুক্র সূর্যের অনেক কাছে। তাই বায়ুমণ্ডল না থাকলে দিনরাতের তাপমাত্রার পার্থক্য আরও বেশি হবে সেখানে। দিনের বেলায় বায়ুমণ্ডলে ভাসমান ঘন মেঘ সূর্যের জ্বলন্ত রশ্মি থেকে গ্রহপৃষ্ঠকে বাঁচায়। আর রাতে বায়ুমণ্ডলের দরুন উত্তাপ অতি তাড়াতাড়ি মহাশূন্যে বিলীন হয় না। 

তবু শুক্রে দিবাভাগের তাপমাত্রা আমাদের পক্ষে অতিশয় বেশি—১০০ ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠে। তার মানে, শুক্রের মহাসাগরগুলো—আর বিজ্ঞানীদের ধারণা, শুক্রে মহাসাগর রয়েছে—পৃথিবীতে ফুটন্ত পানির মতো গরম হবে।*

সূর্যের চক্রফলকে শুক্রের অতিক্রমণ

শুক্রের রাত্রিভাগে মেঘস্তরের উত্তাপ মেপেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা—হিমাঙ্কের নিচে ২৩ ডিগ্রি। এটা সহনীয়। রাশিয়ার মস্কোয় এ তাপমাত্রাকে খুব কঠোর মনে করা হয় না। 

যাহোক, উদ্ভিদজীবন যে নেই, তা বলা যায় না সুনিশ্চিতভাবে।** পৃথিবীতে তো এমন জলজ উদ্ভিদ আছে, যেগুলো উষ্ণ প্রস্রবণে বেঁচে থাকে। আর পৃথিবীর উদ্ভিদ আরও অনেক কঠোর শৈত্য সইতে শিখেছে। তাই খুব সম্ভব শুক্রে উদ্ভিদ আছে, খুব বেশি নয় কিন্তু, আর খুব বেশি দিন থেকে নয়, তাই এমন পরিমাণ অক্সিজেন তারা নিঃসৃত করতে পারেনি, যাতে বিজ্ঞানীদের যন্ত্রপাতিতে ধরা পড়ে।

(চলবে…)

মূল: আলেকজান্ডার ভলকভ

অনুবাদ: সমর সেন

* শুক্রে কোনো সাগর বা মহাসাগর নেই। নাসার তথ্য অনুযায়ী, আজ থেকে ২০০ কোটি বছর আগে শুক্রে ছোট্ট কোনো সাগর থাকতে পারে। সেটা যদি সত্যি হয়েও থাকে, বর্তমানে এতে কোনো সাগর বা মহাসাগর নেই।

** এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণায় উদ্ভিদ বা প্রাণী—কোনো ধরনের জীবন পাওয়া যায়নি শুক্র গ্রহে।

*** পাঠকের সুবিধার্থে বইয়ের মূলভাব ঠিক রেখে বানানরীতির কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে