মহাকাশ
চাঁদ গ্রহ না উপগ্রহ, কে ঠিক করবে
চাঁদকে আমরা পৃথিবীর উপগ্রহ বলেই জানি। কিন্তু এটা যে উপগ্রহ, তা কে ঠিক করল? কেউ যদি চাঁদকে গ্রহ বলতে চান, তাহলে কি ভুল হবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল। কিন্তু কেন?
ভাবতে পারেন, চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ—এটা তো ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। চাঁদ আবার গ্রহ হতে যাবে কেন? এটা কোনো প্রশ্ন হলো? বুদ্ধিমান পাঠক এমনটা ভেবে চড়াও হলে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু ওই যে আইনস্টাইন বলেছেন, ‘কল্পনা জ্ঞানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ এ প্রশ্নটাও সেরকম কল্পনার আশ্রয় নিয়ে মাথায় এসেছে। আর বিজ্ঞানে এ ধরনের কাল্পনিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই, উত্তর তো দিতে হবে। কিন্তু এককথায় এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। না না, রেগে যাবেন না। কথাটা আমার নয়। স্বয়ং বিজ্ঞানীরাই বলছেন, চাঁদকে গ্রহ বলা যাবে কি না, তা এককথায় প্রকাশ অসম্ভব। এবার নিশ্চয়ই কৌতূহল হচ্ছে। মাথায় প্রশ্ন আসছে, কেন এককথায় উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়? চলুন, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।
প্রথমত, পৃথিবীর সঙ্গে চাঁদের একটু মিল খুঁজে দেখি। পৃথিবী একটা পাথুরে গ্রহ, গোলাকার, নিয়মিত সূর্য ও নিজের চারপাশে ঘুরছে। চাঁদেরও এই বৈশিষ্ট্য আছে। ওটাও গোলাকার, পাথুরে এবং নিজের ও সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। অবশ্য সঙ্গে পৃথিবীর চারপাশেও ঘুরছে। আবার চাঁদ ও পৃথিবীর অনেক গঠনগত উপাদানেরও মিল রয়েছে। ধারণা করা হয়, পৃথিবী সৃষ্টির সময় ‘থিয়া’ নামে একটি গ্রহের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। ফলে পৃথিবীর কিছু অংশ ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। থিয়াও ভেঙেচুরে যায়, এর কিছু অংশ গলে মিশে যায় পৃথিবীর সঙ্গে। আরেকটি বড় অংশ ভেঙে ছিটকে যায় বাইরের দিকে। এসব ভাঙ্গা অংশ মহাকর্ষ বলের টানে আবার একত্র হয়ে পরে গঠিত হয়েছে চাঁদ। এ জন্যই চাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর অনেক মিল। যদিও আকারে পৃথিবীর প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। তাহলে, এত মিল থাকা সত্ত্বেও আমরা চাঁদকে কেন গ্রহ না বলে উপগ্রহ বলছি?
আসলে চাঁদ যে একটা উপগ্রহ, এটা কিন্তু আমরা পৃথিবীর মানুষই ঠিক করেছি। জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা বা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন মূলত এসব বিষয় ঠিক করে। তাদের নিয়মানুযায়ী, কোনো বস্তুর গ্রহ হওয়ার জন্য অন্তত চারটি মানদন্ড পূরণ করতে হয়। ২০০৬ সালে এই মানদন্ডগুলো ঠিক করে দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন। প্রথমত, বস্তুটিকে অবশ্যই যথেস্ট বড় হতে হবে। এত বড় যেন নিজের মহাকর্ষ শক্তির কারণে বস্তুটি প্রায় গোলাকার হয়। দ্বিতীয়ত, বস্তুটিকে অবশ্যই সূর্যের চারপাশে ঘুরতে হবে। সূর্য ছাড়া (সৌরজগতের) অন্য কোনো বস্তুকে কেন্দ্র করে তা একই সময় ঘুরতে পারবে না। (আসলে বিষয়টি হলো, নিজ নক্ষত্র ছাড়া সেই নক্ষত্রব্যবস্থার আর কিছুকে ঘিরে সেটি ঘুরতে পারবে না।) তৃতীয়ত, বস্তুটির নিজস্ব কক্ষপথে কোনো ছোট বস্তু থাকতে পারবে না। ওই বস্তুর মহাকর্ষ শক্তির সাহায্যে নিজ কক্ষপথ পরিষ্কার রাখতে হবে। চতুর্থত, বস্তুটি এত বড় হতে পারবে না যে ভবিষ্যতে কখনো নক্ষত্রে পরিণত হয়।
আমাদের চাঁদ এই শর্তগুলোর মধ্যে দুটি মানে না। প্রথমত, চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে। দ্বিতীয়ত, চাঁদ নিজের কক্ষপথ পরিষ্কার রাখার মতো যথেষ্ট বড় নয়। কারণ, চাঁদ নিজেই পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। সে হিসেবে চাঁদকে গ্রহ বলা যায় না। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ২০০৬ সালে। তা ছাড়া প্রাচীনকালে রোমানরা চাঁদকে গ্রহ বলেই মানত। তারা বিশ্বাস করত, পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছে। তাদের এ বিশ্বাস যে ভুল ছিল, তা হয়তো এখন আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্কাইলার গ্রেসন বলেছেন, ‘চাঁদ গ্রহ কি না, তা নির্ভর করছে আপনি প্রশ্নটি কাকে করছেন, তার ওপর। বেশির ভাগ বিজ্ঞানী ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের সংজ্ঞা মেনে নিয়েছেন। তবে সবাই কিন্তু একমত হয়নি।’
তবে গ্রহের বিকল্প সংজ্ঞাও কিন্তু আছে। জিওফিজিক্সের সংজ্ঞা অনুসারে, কোনো বস্তুকে গ্রহ হতে হলে অবশ্যই বৃত্তাকার হওয়ার মতো যথেষ্ট বড় হতে হবে। তবে এত বড়ও নয় যে ভবিষ্যতে কোনো দিন বস্তটি পারমাণবিক ফিউশনের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন করতে পারবে। এই সংজ্ঞা অনুসারে চাঁদকে গ্রহ বলা যায়। একইভাবে গ্রহ বলা যায় বামন গ্রহ প্লুটোকেও।
অনেকে চাঁদকে উপগ্রহ ভাবে, কারণ এটা অনেক ছোট। কিন্তু আসলেই কি চাঁদ অনেক ছোট? পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করা যায়। পৃথিবীর চার ভাগের এক ভাগ হলো চাঁদ। এটা যে আসলেই অনেক ছোট নয়, তা অন্যান্য বড় গ্রহগুলোর সঙ্গে তাদের চাঁদগুলোর তুলনা করলে বুঝবেন। বৃহস্পতির সবচেয়ে বড় চাঁদ গ্যানিমিড গ্রহটির ২৭ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। আবার শনির সবচেয়ে বড় চাঁদ টাইটান কিন্তু শনি গ্রহের তুলনায় ২৫ ভাগের ১ ভাগ। সেখানে আমাদের চাঁদ পৃথিবীর ৪ ভাগের ১ ভাগ। প্লুটোর বড় চাঁদ শ্যারন বামন গ্রহটির তুলনায় অর্ধেক। এমনকি সৌরজগতের বাইরে প্রায় ৮ হাজার আলোকবর্ষ দূরে বৃহস্পতির আকারের একটি গ্রহকে প্রদক্ষিণ করছে নেপচুনের মতো বিশালাকার একটা উপগ্রহ। ফলে এসব চাঁদকে কি আসলেই ছোট বলা যায়? এসব বিষয় বিবেচনা করলে বিষয়টা একটু জটিল হয়ে ওঠে।
তবে আপনি যদি জটিলতার মধ্যে না যেতে চান, তাহলে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের সংজ্ঞাটি মেনে নিতে পারেন। এটাই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। আর এই সংজ্ঞা অনুসারে চাঁদ কোনো গ্রহ নয়, উপগ্রহ। এ নিয়ে তবু কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন। গ্রেসনের মতে, ‘মহাবিশ্বের বেশির ভাগ জিনিস আপনি একটি সংজ্ঞা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। ফলে কোন সংজ্ঞা আপনি মানবেন আর কোনটা মানবেন না, তা ঠিক করতে হবে আপনাকেই।’