চাঁদে হ্যালির ধূমকেতু আছড়ে পড়লে কী হতো

দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৬ কিলোমিটার ও প্রস্থে ৮ কিলোমিটারের মতো এই মহাজাগতিক বস্তুটি প্রতি প্রায় ৭৪-৭৯ বছর পরপর পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসে। শেষবার এসেছে ১৯৮৬ সালে।

বাদাম আকৃতির বিশাল এক বস্তু ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে। নাম তার হ্যালির ধূমকেতু। অন্য সব ধূমকেতুর মতো এটাও জমাট বাঁধা বরফ, গ্যাস ও ধূলিকণার এক মহাজাগতিক স্তুপ।

দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৬ কিলোমিটার ও প্রস্থে ৮ কিলোমিটারের মতো এই মহাজাগতিক বস্তুটি প্রতি প্রায় ৭৪-৭৯ বছর পরপর পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসে। শেষবার এসেছে ১৯৮৬ সালে। আবারও ফিরে আসবে ২০৬১ সালে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিপদ তৈরি করেনি ধূমকেতুটি। তবে এর কক্ষপথ যদি খানিকটা সরে গিয়ে চাঁদের কক্ষপথকে ছেদ করত, তাহলে হয়তো প্রলয়ংকারী এক সংঘর্ষ দেখার দুর্ভাগ্য হতো পৃথিবীবাসীর। ভয়াবহ সেই সংঘর্ষ পৃথিবী থেকে দিনের বেলাতেই খালি চোখে দেখা যেত। আসলেই এমন কিছু হলে মানুষের মহাকাশ অভিযানের ওপর কেমন প্রভাব পড়ত এর? চাঁদেরই-বা কতটা ক্ষতি হতো? কিংবা পৃথিবীর?

২০৬১ সাল। আকাশে প্রলয়ংকারী ধ্বংসলীলা দেখার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছে লাখো মানুষ। ধূমকেতুটির কক্ষপথ খানিকটা বিচ্যুত হয়ে গেছে। আছড়ে পড়তে যাচ্ছে চাঁদের বুকে। বিজ্ঞানীরা আগেই হিসাব-নিকাশ করে সব কিছু বের করে ফেলেছেন। কখন আকাশের কোনদিকে সংঘর্ষ ঘটবে, তাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আগেই। বিপদজনক ঘটনা, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তীব্র কৌতুহলের কাছে বিপদ পাত্তা পায়নি। সবাই বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

তাই সংঘর্ষের কারণে শুধু চন্দ্রপৃষ্ঠেই খাদ তৈরি হবে না। বরং হ্যালির ধূমকেতুর ধাক্কায় চাঁদের পৃষ্ঠ আক্ষরিক অর্থেই ভেঙে যাবে। পৃথিবী থেকে দৃশ্যটিকে দেখাবে ভয়ংকর-সুন্দর!

২০১৩ সালে একটি গ্রহাণু আছড়ে পড়ে চাঁদে। যার ফলে প্রায় আট সেকেন্ডের একটি আলোক প্রদর্শনী তৈরি হয়। চাঁদের বুকে তৈরি হয় ৪০ মিটার প্রশস্ত এক খাদ। এখনও তেমনই একটা কিছু হতে যাচ্ছে। পার্থক্য হলো, হ্যালির ধূমকেতু ২০১৩ সালে আছড়ে পড়া সেই গ্রহাণুর চেয়ে ৫৫০ বিলিয়ন গুণ ভারী।

তাই সংঘর্ষের কারণে শুধু চন্দ্রপৃষ্ঠেই খাদ তৈরি হবে না। বরং হ্যালির ধূমকেতুর ধাক্কায় চাঁদের পৃষ্ঠ আক্ষরিক অর্থেই ভেঙে যাবে। পৃথিবী থেকে দৃশ্যটিকে দেখাবে ভয়ংকর-সুন্দর!

কিন্তু চাঁদের বেলায় তা হবে না। এই উপগ্রহটির জন্য সংঘর্ষটি সাক্ষাৎ দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। চাঁদের কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসবে ম্যাগমার স্রোত। চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রচুর পরিমাণে ধূলিকণা ও পাথরের টুকরো ছড়িয়ে পড়বে মহাশূন্যে। ধূলিকণা বা ছোট্ট পাথরের টুকরো চাঁদের আশপাশেই ঘুরবে। কিন্তু বড় আকারের টুকরোগুলো চাঁদ থেকে সরে যাবে প্রবল গতিতে। গন্তব্য—পৃথিবী। পৃথিবীর মহাকর্ষ বল এসব ছিটকে পড়া বড় টুকরোকে টানবে নিজের দিকে।

এ অবস্থায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগে কিছুটা সময় পাওয়া যাবে। অগ্নিবৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাটির নিচের বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে হতে পারে মানুষকে। এখন পর্যন্ত সর্বশেষ বায়ুমণ্ডলে মহাজাগতিক পাথর বিস্ফোরিত হয়েছিল ২০১৩ সালে।

মহাকাশ থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কোনো কিছু ঢুকে পড়লে বাতাসের কণাগুলোর সঙ্গে তার প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। বস্তুর গতি যত বেশি হয়, সংঘর্ষের পরিমাণ তত বাড়ে। আবার অভিকর্ষজ ত্বরণের কারণে প্রতি মুহূর্তে পড়ন্ত বস্তুর গতি বাড়তে থাকে।

চেলিয়াবিনস্ক নামের উল্কাটির আকার ছিল প্রায় সাড়ে ৬২ ফুট। ভূপৃষ্ট থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার ওপরে এটি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের সময় উল্কাটি প্রায় ৫ লাখ টন টিএনটি বিস্ফোরকের সমান শক্তি নিঃসরণ করে। রাশিয়ায় তখন ১ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হন। হ্যাঁ, রাশিয়ার চেলিয়াবিনস্ক অঞ্চলে দুর্ঘটনা ঘটার কারণেই অমন নামকরণ।

মহাকাশ থেকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কোনো কিছু ঢুকে পড়লে বাতাসের কণাগুলোর সঙ্গে তার প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। বস্তুর গতি যত বেশি হয়, সংঘর্ষের পরিমাণ তত বাড়ে। আবার অভিকর্ষজ ত্বরণের কারণে প্রতি মুহূর্তে পড়ন্ত বস্তুর গতি বাড়তে থাকে। ফলে সংঘর্ষও আরও বেশি হয়। আর সংঘর্ষ মানেই তাপ। এই তাপ থেকে তৈরি হয় আগুন ও বিস্ফোরণ।

চাঁদের কোনো টুকরো যদি চেলিয়াবিনস্ক উল্কার সমান আকারের হয়, তবে তা পৃথিবীর ছোটখাটো যেকোনো শহর ধ্বংস করার মতো মারাত্মক হতে পারে। এমনকি যেকোনো শহর পুরোপুরি ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে। চাঁদ কিন্তু হ্যালির ধূমকেতুর প্রভাবে নিজে পুরোপুরি ধ্বংস হবে না। ভাঙাচোরা চাঁদটি আগের মতোই ঝুলে থাকবে আকাশের কোণে। কক্ষপথ বদলে যাবে অনেকটাই। ধাক্কা কোন দিক থেকে এসেছে, তার ওপর নির্ভর করবে চাঁদ পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাবে নাকি ধীরে ধীরে কাছে আসবে।

হ্যালির ধূমকেতুর সত্যি সত্যি চাঁদে আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। আমরা শুধু এ লেখায় সম্ভাবনাটুকু ভাবতে চেয়েছি।

যাই হোক না কেন, আমাদের চন্দ্রজয়ের স্বপ্নটা তখন হয়ে উঠবে আরও কঠিন। চাঁদের বুকে হয়তো মহাকাশযান নামানো যেত। কিন্তু সেটা এখনকার চেয়ে অনেক বেশি বিপদজনক হয়ে উঠত। চাঁদকে ঠিকঠাক রাখার জন্য মহাকাশ সংস্থাগুলোকে এখনকার চেয়ে ঘাম ঝরাতে হতো অনেক। কারণ, ক্ষত-বিক্ষত চাঁদ থেকে যেকোনো সময় ঝরে পড়তে পারে নতুন কোনো পাথরের টুকরো। তা ছাড়া কক্ষপথচ্যুত হয়ে কাছে এলে বিপদ। পৃথিবীর মহাকর্ষের টানে ভেঙে অসংখ্য টুকরো চন্দ্রখণ্ড তৈরি করতে পারে বলয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে চাঁদের আর অস্তিত্ব থাকত না। আবার কক্ষপথচ্যুত হয়ে দূরে গেলেও হারিয়ে যেত চাঁদ এক সময়। যেভাবেই হোক, চাঁদ হারানোর একটা ঝুঁকি থাকত। এই ঝুঁকি নেওয়ার শক্তি কি পৃথিবীর আছে? কিই-বা হতো চাঁদ না থাকলে? সেটা জানতে চাইলে পড়তে পারেন ‘চাঁদ না থাকলে কী হতো’।

শেষ করার আগে বলে রাখি, হ্যালির ধূমকেতুর সত্যি সত্যি চাঁদে আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। আমরা শুধু এ লেখায় সম্ভাবনাটুকু ভাবতে চেয়েছি। কাজেই এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে রাতের ঘুম হারাম করার প্রয়োজনও নেই!

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াটইফশো, দ্য প্লানেটারি সোসাইটি, উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন