বুধগ্রহে কি নামা যায়

ছোটদের জন্য সহজ ভাষায় লেখা কঠিন। সহজ কথা যে যায় না বলা সহজে! অথচ একদম সহজ-সাবলীল ভাষায় লেখা এ বই। টেলিস্কোপ কী বলে নামের বইটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাদুগা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। পাভেল ক্লুশান্‌ৎসেভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন অরুণ সোম। এ বইয়ে প্রচুর ছবি আছে। সেগুলো এঁকেছেন ইয়ে. ভোইশ্‌ভিল্লো, ব. কালাউশিন, ব.স্তারোদুব্‌ৎসেভ এবং ইউ. কিসিলিওভ। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে বইটি প্রকাশিত হচ্ছে…

এখান থেকে সূর্য খুব কাছে। সূর্যকে দেখায় বিরাট। পৃথিবী থেকে যেমন দেখায়, তার প্রায় তিন গুণ বড়

এবারে আমাদের মহাকাশযান যাত্রা করল বুধের দিকে। অমনিতে মনে হয় বুধ বুঝি ঘুরপাক খায় না। যেন সব সময় ‘এক পাশ হয়ে’ সূর্যের দিকে উড়ে চলেছে। কিন্তু এটা চোখের ভ্রম মাত্র। গ্রহটার কলঙ্কগুলো নিরীক্ষণ করে দেখ। সেগুলো আলোর দিক থেকে ছায়ার দিকে অল্প অল্প করে ‘সটকে যাচ্ছে’। তার মানে খয়েরি রঙের এই গোলকটি, ধীরে ধীরে হলেও, ঘোরে ঠিকই।

বুধ চলে তাড়াতাড়ি। তিন মাসে সে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু নিজের অক্ষদণ্ডের চারদিকে ঘুরে ঘুরে সূর্যের কিরণে দেহের সব ‘পাশ’গুলো গরম করতে সে সময় নেয় পুরো ছয়টি মাস।

বুধে বহুকাল আগে সব জল ফুটে ভাপ হয়ে উবে গেছে, প্রায় সব বায়ু মিলিয়ে গেছে মহাকাশে

বোঝ কাণ্ড! বুধের দিন-রাত তার বছরের দ্বিগুণ! অর্থাৎ বুধে ‘নববর্ষ’ দিনে দুবার উদ্‌যাপন করা যায়! এই ধরো, সকালে আর সন্ধ্যায়। তবে হ্যাঁ, একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না: সকাল যদি ওখানে হয়, ধরো, আমাদের এখানকার জানুয়ারিতে, তাহলে ‘সন্ধ্যা’ কিন্তু এপ্রিলের আগে হচ্ছে না। আজব গ্রহ বটে!

এই গ্রহের কোন জায়গায় তাহলে আমরা নামব? এখান থেকে সূর্য খুব কাছে। সূর্যকে দেখায় বিরাট। পৃথিবী থেকে যেমন দেখায়, তার প্রায় তিন গুণ বড়। অসহ্য গরম। একেবারে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। বুধের আলোকিত দিকটা একটা অগ্নিকুণ্ডবিশেষ—৪০০ ডিগ্রি! এরকম ‘গরম দিন’ স্থায়ী হয় তিন মাস। এখানে আমাদের মহাকাশযান নামানোর কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। জ্বলে-পুড়ে যাব! এমন তাপমাত্রায় কাচ নরম হয়ে যায়, সীসে যায় গলে!

বুধের সঙ্গে চাঁদের অনেক মিল আছে। চাঁদের মতোই বুধেও ম্যাড়মেড়ে একঘেয়ে প্রান্তর, সেই সঙ্গে এখানে ওখানে গর্ত আর পাথর। সর্বত্র সেই এক রকম গোল গোল গহ্বর, চারধার টিলায় ঘেরা। কেবল আকাশ এখানে চাঁদের আকাশের মতো পুরোপুরি কালো নয়। এখানকার আকাশ কালচে বেগুনি।
‘বিদঘুটে’ কক্ষপথের জন্যই বুধের আকাশে সূর্য সমতালে চলতে পারে না

বুধে বহুকাল আগে সব জল ফুটে ভাপ হয়ে উবে গেছে, প্রায় সব বায়ু মিলিয়ে গেছে মহাকাশে। সেখানে কেবল শুকনো, নগ্ন পাথর। দিনের বেলায় এমন গনগনে যে পা ফেলামাত্র তোমার বুটজুতোয় আগুন ধরে যাবে।

এই একই সময় গ্রহের অন্য অংশে, তার ছায়াচ্ছন্ন দিকে সূচীভেদ্য কালো রাত। ভয়ঙ্কর ঠান্ডা। তাপমাত্রা সেখানে মাইনাস ১৫০ ডিগ্রি হিমাঙ্ক, এমনকি তার চেয়েও বেশি। সূর্য দিগন্তে অস্ত গেল, তারপর তিন মাস তার আর দেখা নেই। বুধের নিজস্ব চাঁদ পর্যন্ত নেই। তবে শুক্র গ্রহটি আমাদের আকাশে যেমন দেখায়, বুধের আকাশে তার চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল। কেবল এই শুক্রই থেকে থেকে বুধের হিমজমাট শিলাগুলোকে রাতের বেলায় অল্প-স্বল্প আলোকিত করে। আর যখন এই শুক্রও অস্ত যায়, তখন বুধের বুকে নেমে আসে নিশ্ছিদ্র আঁধার।

কিন্তু তা সত্ত্বেও এই গ্রহে নিরাপদে অবতরণ করা সম্ভব। এমনকি মহাকাশযান থেকে বেরিয়ে হাঁটাচলাও করা যায়। বলা বাহুল্য, স্পেসস্যুটে।

সূর্য অস্ত গেলে দিনের আলো রাতারাতি সন্ধ্যার মধ্যে নৈশ হিমে পরিণত হতে পারে না। সম্ভবত ঠান্ডা হয় অল্প অল্প করে। এই বদল যখন ঘটতে থাকে, তখন একটা সময় তাপমাত্রা নিশ্চয়ই এমন পর্যায়ে আসে যেটা আমাদের অভ্যস্ত, আমাদের কাছে প্রীতিকর—এই ধরো, ১৫-২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।

তাই আমরা আমাদের মহাকাশযান নামাব আলো ও ছায়ার মাঝখানের সীমানায়, ‘অগ্নিকুণ্ড’ ও ‘হিমঘর’-এর মাঝামাঝি ফালি জায়গায়, যেখানে এখন সন্ধ্যা। যেখানে এখন আর গরম নেই, তবে ঠান্ডাও এখনও পড়েনি।

নেমে আমরা চারদিকে তাকিয়ে দেখি।

বুধের সঙ্গে চাঁদের অনেক মিল আছে। চাঁদের মতোই বুধেও ম্যাড়মেড়ে একঘেয়ে প্রান্তর, সেই সঙ্গে এখানে ওখানে গর্ত আর পাথর। সর্বত্র সেই এক রকম গোল গোল গহ্বর, চারধার টিলায় ঘেরা। কেবল আকাশ এখানে চাঁদের আকাশের মতো পুরোপুরি কালো নয়। এখানকার আকাশ কালচে বেগুনি। হাজার হোক, বুধে এখনও একটু-আধটু বাতাস রয়ে গেছে। সূর্য এখন একেবারে দিগন্তে। টিলা আর শৈলচূড়াগুলো থেকে লম্বা লম্বা ছায়া পড়েছে। ছায়ায় পাথর জুড়িয়ে আসছে। ছোঁয়া যায়। শিলাগুলো থেকে গরম উনুনের মতো আরামদায়ক তাপ পাওয়া যাচ্ছে।

বুধ ঘোরে ধীরে ধীরে। তাই প্রতিদিন আমাদের তেমন একটা বেশি পথ পাড়ি দিতে হবে না। ছয় মাসে আমাদের ‘ভূপ্রদক্ষিণ’ শেষ হবে। এই পর্যটন করার সময় আমরা গরমে বা ঠান্ডায়—কোনোটাতেই মরব না।
বুধে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই। শুধু পাথর

ঘণ্টা বিশেক কেটে যায়। আমাদের পৃথিবীর সময়ের মাপে প্রায় এক দিন। অথচ এখানে সূর্য সবে দিগন্তরেখার ওপারে নামল। তাও আবার পুরোপুরি নয়, তার কিনারাটা এখনও পাহাড়-পর্বতের মধ্যিখানে একটা চোখ ধাঁধানো ‘আলোকস্তম্ভ’-এর মতো জ্বলজ্বল করছে।

কয়েক ঘণ্টা বাদে এই ‘আলোকস্তম্ভ’টাও নিভে যায়। আমাদের চারদিকের পাহাড়-পর্বতের চূড়াগুলো তখনও আলো দিচ্ছে। পরে ধীরে ধীরে সে আলোও নিভে যায়। নেমে আসে নিশ্ছিদ্র আঁধার। সেই সঙ্গে দ্রুত ঠান্ডা নামতে থাকে।

কিন্তু ঘাবড়িও না। বুধ ঘুরে গিয়ে যদি আমাদের ছায়ায় নিয়ে যেতে পারে, তাহলে আমরাও ‘উল্টো দিকে ফিরে গিয়ে’ ফের আলোয় চলে আসতে পারি। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, চলে আসতে পারি আলো ও ছায়ার সীমানায়। আর আমরা যদি চলতেই থাকি, তাহলে সারা সময় এই সীমানায় থেকে যাওয়া যায়।

আমরা তা-ই করব। আমাদের এমন যান আছে, যা যেকোনো জায়গার ওপর দিয়ে যেতে পারে। তাতে চেপে আমরা ‘সূর্যের নাগাল ধরতে’ যাব।

বুধ ঘোরে ধীরে ধীরে। তাই প্রতিদিন আমাদের তেমন একটা বেশি পথ পাড়ি দিতে হবে না। ছয় মাসে আমাদের ‘ভূপ্রদক্ষিণ’ শেষ হবে। এই পর্যটন করার সময় আমরা গরমে বা ঠান্ডায়—কোনোটাতেই মরব না। সব সময় থেকে যাব ‘লাগসই জায়গা’টায়। আমরা খুব চালাক, তাই না?

ছয় মাস ভ্রমণকালে আমরা দুবার বিশ্রাম করতে পারলাম, একই জায়গায় দুসপ্তাহ করে বাস করতে পারলাম। অবশ্য এটা ঠিক যে পরে সূর্য যখন ফের আকাশে নিজের পথে যাত্রা শুরু করল, তখন তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনে ১৫০-২০০ কিলোমিটার আমাদের চলতে হয়েছিল।
চাঁদের মতোই বুধেও ম্যাড়মেড়ে একঘেয়ে প্রান্তর, সেই সঙ্গে এখানে ওখানে গর্ত আর পাথর

এই গ্রহের অদ্ভুত প্রকৃতি দেখে অবাক হয়ে যেয়ো না। এর কক্ষপথ একপাশে সামান্য হেলে গেছে। সূর্য তার ঠিক মাঝখানে নয়, একটা প্রান্তের খানিকটা কাছাকাছি। বুধ এই কক্ষপথে চলতে চলতে কখনো সূর্যের কাছাকাছি চলে আসে, কখনো-বা তার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। বুধ থেকে সূর্যের দিকে তাকালে দেখতে পাবে সূর্য কখনো ‘স্ফীত’ হয়ে উঠছে, প্রচণ্ড তাপ দিচ্ছে; কখনো-বা ‘সঙ্কুচিত’ হয়ে গিয়ে তাপ কমিয়ে দিচ্ছে। এই ‘ঠান্ডা ঋতু’তে বুধে শূন্যাঙ্কের ওপরে ২৫০-৩০০ ডিগ্রি তো তুচ্ছ! এই ‘বিদঘুটে’ কক্ষপথের জন্যই বুধের আকাশে সূর্য সমতালে চলতে পারে না। তিন মাসে একবার তাকে গতিবেগ মন্থর করতে হয়, সে থেমে গিয়ে খানিকটা পেছনে হটে যায়। কেবল আরও একবার যেন ‘শক্তি সঞ্চয়ের জন্য’ স্থির হয়ে একটু দাঁড়িয়ে থেকে ফের সামনের দিকে ছুট মারে।

পরমাশ্চর্য! পৃথিবীতে এমন ঘটে না। কিন্তু এই ‘পরমাশ্চর্যের’ জন্য আমাদের বেশ সুবিধাও হলো। ছয় মাস ভ্রমণকালে আমরা দুবার বিশ্রাম করতে পারলাম, একই জায়গায় দুসপ্তাহ করে বাস করতে পারলাম। অবশ্য এটা ঠিক যে পরে সূর্য যখন ফের আকাশে নিজের পথে যাত্রা শুরু করল, তখন তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিনে ১৫০-২০০ কিলোমিটার আমাদের চলতে হয়েছিল। কিন্তু আমাদের এই যানটি সর্বত্র অবাধ গতিতে চলতে পারে বলে কোনো অসুবিধাই আমাদের হয়নি।

এভাবে আমরা সম্পূর্ণ গ্রহটা ঘুরে এলাম। সব দেখলাম। তবে হ্যাঁ, দুঃখের কথা এই যে বুধে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই। শুধু পাথর। সর্বত্র একই রকম পাথর—মৌন, স্থির। মৃত জগৎ। চাঁদেরই মতন।

(চলবে...)

মূল: পাভেল ক্লুশান্‌ৎসেভ

অনুবাদ: অরুণ সোম

'টেলিস্কোপ ও আকাশ' বই থেকে আরও পড়ুন