বৃহস্পতি আর শনি কেমন

ছোটদের জন্য সহজ ভাষায় লেখা কঠিন। সহজ কথা যে যায় না বলা সহজে! অথচ একদম সহজ-সাবলীল ভাষায় লেখা এ বই। ‘টেলিস্কোপ কী বলে’ নামের বইটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাদুগা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। পাভেল ক্লুশান্‌ৎসেভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন অরুণ সোম। এ বইয়ে প্রচুর ছবি আছে। সেগুলো এঁকেছেন ইয়ে. ভোইশ্‌ভিল্লো, ব. কালাউশিন, ব.স্তারোদুব্‌ৎসেভ এবং ইউ. কিসিলিওভ। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে বইটি প্রকাশিত হচ্ছে…

বুধ, শুক্র ও মঙ্গলে আমরা নামতে পেরেছিলাম। তেমন একটা স্বাচ্ছন্দ্যকর না হলেও অন্ততপক্ষে কোনো কিছুর ওপর পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশটা নিরীক্ষণ করা যায়।

কিন্তু বৃহস্পতি ও শনির কথা যদি বলো, সেখানে নামা একেবারে অসম্ভব। এই দুই গ্রহ বস্তুতপক্ষে স্রেফ মেঘ দিয়ে তৈরি বললেও আপত্তি করার কিছু নেই।

বৃহস্পতিকে রসিয়ে রসিয়ে দেখতে গেলে নামতে হয় আইওতে। আর সব উপগ্রহের চেয়ে এটাই বৃহস্পতির সবচেয়ে কাছে

যেমন ধরো, বৃহস্পতি গ্রহটি—যত বড় দেখায় আসলে তত বড় নয়। কিন্তু এটা আছে কুলের ভেতরকার বীচির মতো—বিশাল মেঘের গোলার ভেতর। আমরা বলি ‘বৃহস্পতি কী বিরাট!’ কিন্তু বিরাট বলতে তো কেবল তার পোশাকটা।

কিন্তু বৃহস্পতির আছে দস্তুরমতো ৯৫টি উপগ্রহ। তাদের মধ্যে কতগুলো খুব বড়। দুটো আমাদের চাঁদের সমান, দুটো তো আবার আয়তনে বুধের চেয়ে কম না।

পৃথিবী থেকে বৃহস্পতির উপগ্রহগুলোর কোনো রকম খুঁটিনাটি আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। অনেক দূরে। কিন্তু হালে মার্কিন স্বয়ংক্রিয় স্টেশন ‘পাইওনিয়ার’ ও ‘ভয়েজার’ বৃহস্পতি ও শনির পাশ দিয়ে উড়ে গেছে। তারা খুব কাছ থেকে ওই দুই গ্রহ এবং তাদের উপগ্রহদের ছবি তুলেছে। দেখা গেছে, বৃহস্পতির সবচেয়ে বড় বড় উপগ্রহগুলো খুব কৌতূহলোদ্দীপক।

বৃহস্পতি খুব দ্রুত ঘুরছে বলে তার বিষুবরেখা বরাবর এলাকায় মেঘের প্রলেপ পড়েছে—খরস্রোতা নদীর বুকে জলের ধারার মতো। মেঘের এই ধারাগুলো অনবরত একটা আরেকটাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে, আকার বদল করছে।
সৌরপরিবারে শনিই সম্ভবত সবচেয়ে সুন্দর গ্রহ

‘আইও’ হলো একটা ‘মরচে’ রঙের গোলা। ভেতরটা সম্ভবত বেজায় গরম। সেখানে সবসময় আগ্নেয়গিরির প্রচন্ড অগ্ন্যুদ্গীরণ চলছে।

‘ইউরোপা’—উজ্জ্বল, সাদা-সোনালি রঙের, সমান, যেন পালিশ করা। কিন্তু আগাগোড়া চিড়-খাওয়া।

‘গ্যানিমিড’—সবচেয়ে বড়, কালো, তার গায়ে আগাগোড়া সাদা সাদা আঁচড়। দেখে মনে হয় যেন কঠিন বরফে তৈরি, কালো খোসায় ঢাকা, তার ওপরে যেন ধারালো কোনো কিছু দিয়ে সপাং সপাং করে মারা হয়েছে।

‘ক্যালিস্টো’—বিশাল, খয়েরি রঙের, একেবারে ভাঙাচোরা। আগাগোড়া গর্তে আর গর্তে ক্ষতবিক্ষত।

বৃহস্পতিকে রসিয়ে রসিয়ে দেখতে গেলে নামতে হয় আইওতে। আর সব উপগ্রহের চেয়ে এটাই বৃহস্পতির সবচেয়ে কাছে।

বৃহস্পতি খুব দ্রুত ঘুরছে বলে তার বিষুবরেখা বরাবর এলাকায় মেঘের প্রলেপ পড়েছে—খরস্রোতা নদীর বুকে জলের ধারার মতো।

মেঘের এই ধারাগুলো অনবরত একটা আরেকটাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে, আকার বদল করছে।

কিন্তু প্রত্যেকটি তারাই একটা সূর্য। আর দূরের এই সূর্যদের অনেকেরই নিজস্ব গ্রহ থাকতে পারে। সেই সব গ্রহের কোনটি হয়তো আমাদের পৃথিবীর মতো। সেখানে হয়তো লোকজন বাস করে।
সৌরপরিবারে শনিই সম্ভবত সবচেয়ে সুন্দর গ্রহ। শনিরও উপগ্রহ আছে। শনির উপগ্রহগুলোর মধ্যে একটা হলো ‘টাইটান’

এক জায়গায়, বৃহস্পতির সাদা সাদা ফালির মধ্যে কোনো কোনো সময় চোখে পড়ে একটা অদ্ভুত লাল দাগ। নদীর তলা থেকে জল ঘুলিয়ে উঠলে যেমন হয়, এই জায়গাটায়ও যেন ঠিক তেমন। কোনো গভীর তলদেশ থেকে উঠছে লাল ধোঁয়া। রক্তিম মেঘ সাদা মেঘের ধারা কেটে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে, কখনো উজ্জ্বল হয়ে আসছে, কখনো-বা ফ্যাকাসে।

বলা যায় না, হয়তো এই মেঘের সমুদ্রের তলায় কোনো এক আগ্নেয়গিরি ফুঁসে উঠে অগ্ন্যুদ্গীরণ করছে, কখনো নিভে যাচ্ছে, কখনো নবোদ্যমে জ্বলে উঠছে? কোনো একদিন বৃহস্পতির এই রহস্যের সমাধান তোমরা করবে।

আপাতত আরও দূরে যাওয়া যাক।

এর পরের গ্রহ—শনি। বৃহস্পতির সঙ্গে তার খুব মিল। বৃহস্পতির মতো এটাও এক বিরাট মেঘের গোলা—এই মেঘের গোলার গভীরে আছে শক্ত শাঁস। শনিকে ঘিরে আছে একটা বেড় (রিং বা বলয় নামে পরিচিত)। এই জন্যে তাকে দেখতে বেশ জমকালো। তাই বলে কিন্তু ভেবে বসো না যে শনির বেড়টা টুপির মতো শক্ত। মোটেই তা নয়। এই গ্রহের চারপাশে খুদে যেসব টুকরো-টাকরা (পাথর ও গ্রহাণু) ছুটে চলেছে এটা তা দিয়ে তৈরি।

আমরা আমাদের মহাকাশযানে চেপে এই বেড় ভেদ করে উড়ে যেতে পারি—আকাশ থেকে যখন শিলাবৃষ্টি পড়ে, তখন তা ভেদ করে যাওয়া যায়। কেবল ছোট ছোট দানাগুলো (পাথর) মহাকাশযানের গায়ে ঝমঝম আওয়াজ করে—এই যা।

সৌরপরিবারে শনিই সম্ভবত সবচেয়ে সুন্দর গ্রহ। শনিরও উপগ্রহ আছে। শনির উপগ্রহগুলোর মধ্যে একটা হলো ‘টাইটান’। তার আয়তন বুধের সমান। তাকে জড়িয়ে আছে যে বায়ুমণ্ডল, তার গঠনপ্রকৃতি পার্থিব বায়ুমণ্ডলের গঠনপ্রকৃতির কাছাকাছি। কে বলতে পারে, হয়তো সেখানে জীবন আছে?

সূর্য থেকে ভীষণ দূরে। এত দূরে যে সুর্যের চারধারে একপাক ঘুরতে লেগে যায় ২৫০ বছর। সূর্যকে ওখান থেকে দেখায় শুধু একটা ছোট্ট জ্বলজ্বলে তারার মতন—বলাই বাহুল্য, এক ফোঁটাও তাপ দেয় না।
বৃহস্পতির সঙ্গে তার খুব মিল। বৃহস্পতির মতো এটাও এক বিরাট মেঘের গোলা—এই মেঘের গোলার গভীরে আছে শক্ত শাঁস

বাকি গ্রহগুলো তেমন আকর্ষণীয় নয়। ইউরেনাস ও নেপচুন বৃহস্পতির মতো। আর প্লুটো ঠান্ডায় জমাট বাধা গ্রহ, ধু-ধু করছে। সূর্য থেকে ভীষণ দূরে। এত দূরে যে সুর্যের চারধারে একপাক ঘুরতে লেগে যায় ২৫০ বছর। সূর্যকে ওখান থেকে দেখায় শুধু একটা ছোট্ট জ্বলজ্বলে তারার মতন—বলাই বাহুল্য, এক ফোঁটাও তাপ দেয় না।

আমাদের সৌরজগতে প্লুটো হলো শেষ গ্রহ* (২০০৬ সালের পর থেকে প্লুটো বামন গ্রহ)। প্লুটোর পরে শুরু হয়েছে ফাঁকা জায়গা, চলে গেছে সেই তারারা যেখানে আছে সেখান পর্যন্ত।

কিন্তু প্রত্যেকটি তারাই একটা সূর্য। আর দূরের এই সূর্যদের অনেকেরই নিজস্ব গ্রহ থাকতে পারে। সেই সব গ্রহের কোনটি হয়তো আমাদের পৃথিবীর মতো। সেখানে হয়তো লোকজন বাস করে। তারাও হয়তো আমাদেরই মতো।

কিন্তু সে তো অনেক দূরে! আমরা আমাদের প্রতিবেশী গ্রহদের সম্পর্কেই বা এখন পর্যন্ত কতটুকু জানি?

(চলবে...)

মূল: পাভেল ক্লুশান্‌ৎসেভ

অনুবাদ: অরুণ সোম

'টেলিস্কোপ ও আকাশ' বই থেকে আরও পড়ুন