প্রাচীনকালের মানুষ মনে করত, উল্কাপাত হলো মহাকাশ থেকে তারা খসে পড়া। তাই একে তারাখসা বা শুটিং স্টারও বলা হয়। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা জেনেছি, মহাকাশ থেকে নক্ষত্র খসে পড়ে উল্কার সৃষ্টি হয় না।
উল্কা শব্দটা এসেছে মিটিওরয়েড থেকে। এর অর্থ গ্রহাণুর চেয়ে ছোট কোনো কঠিন বস্তু। উল্কার আকার সাধারণত ৩০ মাইক্রোমিটার থেকে ১ মিটার ব্যাসের হয়। মিটিওরয়েড উৎপন্ন হয় কোনো গ্রহাণু থেকে অথবা ধূমকেতুর কোনো অংশ কক্ষপথ বিচ্যুত হয়ে।
আকাশে যে রঙের উল্কা দেখা যায়, এর কারণ, বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পর বাতাসের চাপ ও তার ফলে উৎপন্ন তাপ। বাতাসের মধ্য দিয়ে কোনো বস্তু চলার সময় এর পৃষ্ঠের সঙ্গে লেগে থাকা বাতাসও একই সঙ্গে চলতে চায়। ফলে সেখানে বাধাদানকারী বল তৈরি হয়। এ বলের কারণে সৃষ্ট চাপই বায়ুচাপ। ঘর্ষণের কারণে তাপও উৎপন্ন হয়। উল্কার বেগ বাতাসে শব্দের বেগের তুলনায় অনেক বেশি। তাই উল্কার গতিপথ থেকে বাতাস সরে যেতে পারে না। ফলে বাতাস ভেদ করে উল্কা চলে যায়। এ সময় সেখানে কয়েক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সৃষ্টি হয়। ফলে আয়নিত হয়ে ওঠে উল্কার গতিপথের বাতাস। তাই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সেই গতিপথ। বায়ুচাপের কারণে তৈরি হওয়া এই আয়নগুলো ৪৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রতি মিনিটে লাখ লাখ উল্কা প্রবেশ করে। তবে এদের বেশির ভাগই ধূলিকণার সমান। এগুলো বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরগুলোতেই পুড়ে শেষ হয়ে যায়। তাই বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরে সব সময়ই এ রকম আয়নিত উল্কাপথ তৈরি হয়।
আয়নিত বায়ুস্তরে রেডিও সিগন্যাল প্রতিফলিত করে তথ্য আদান–প্রদান করা যায়। আবার এসব আয়নিত পথ বাতাসের সঙ্গে প্রবাহিত হয়। ফলে এসব আয়ন থেকে আসা বিকিরণের ডপলার শিফট মেপে বাতাসের গতিবেগ বের করা যায়। আয়নগুলোর ক্ষয়ের হার বের করে সেই বায়ুস্তরে বাতাসের ঘনত্বও জানা যায়।
পৃথিবীর সাপেক্ষে উল্কার বেগ কত হবে, তা তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ধারিত হয়—সৌরজগতে পৃথিবীর কক্ষপথের গতি, উল্কাপিণ্ডের উৎসের গতি ও পৃথিবীর অভিকর্ষ বল। উল্কা সাধারণত সোজাসুজি মাটিতে পড়ে না। কারণ, পৃথিবীর সাপেক্ষে উল্কাপিণ্ডের উৎসের সাধারণত স্পর্শ বরাবর আপেক্ষিক গতির উপাংশ বেশি থাকে। অভিকর্ষের কারণে এই গতিপথ বেঁকে গিয়ে উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবীপৃষ্ঠে পতিত হয়।
গ্রহাণু থেকে উৎপন্ন উল্কার বেগ অভিকর্ষের কারণে পৃথিবীর মুক্তিবেগের (১১ কিমি/সেকেন্ড) কাছাকাছি হয়। মুক্তিবেগ হলো কোনো রকেটকে সর্বনিম্ন যে বেগে পাঠালে এটি পৃথিবীর মহাকর্ষ অতিক্রম করতে পারে, সেই বেগ। শক্তির সংরক্ষণশীলতার নীতি থেকে জানা যায়, মহাকাশে থাকা কোনো স্থির (বা অনেক কম গতিসম্পন্ন বস্তু, যেমন গ্রহাণু) বস্তুও পৃথিবীর অভিকর্ষের কারণে পৃষ্ঠে স্পর্শ করার সময় এর বেগ মুক্তিবেগের সমান হবে। তবে ধূমকেতু থেকে উৎপন্ন উল্কার বেগ আরও বেশি হয়, সেকেন্ডে ৫০-৭০ পর্যন্ত হয়।
হালকা ওজনের উল্কার ওপর বাতাসের বাধা বেশি প্রভাব ফেলে। এতে এদের ত্বরণ কমতে থাকে। বাতাসের বাধা আবার বস্তুর বেগের সঙ্গে বাড়ে। ফলে একসময় বাতাসের বাধা অভিকর্ষের সমান হয়ে যায়। তাই উল্কার নিট ত্বরণ তখন শূন্যে নামে। তখন বস্তু সমবেগে, তথা ‘ক্রান্তিবেগে’ পড়তে থাকে। হালকা ভরের ওজনের উল্কার ক্রান্তিবেগ অনেক কম হয়। ঘণ্টায় ১৮০-৩৬০ কিলোমিটার। বেগ কমে যাওয়ার পর বাতাসে উল্কার উজ্জ্বল গতিপথ আর দেখা যায় না। কারণ, কম গতিশক্তির কারণে উৎপন্ন তাপমাত্রাও কমে যায়। ফলে উজ্জ্বল ঝলক আর তৈরি হতে পারে না। এ দশাকে ডার্ক ফ্লাইট বলে।
ভারী উল্কার বেগের ওপর বাতাসের বাধা বেশি প্রভাব ফেলতে পারে না। ফলে এগুলো অতি উচ্চ বেগে ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ে। সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো এগুলোর সংখ্যা খুব কম। কিছু কিছু উল্কার আকার খুব বড়। সেগুলোকে বলে ফায়ারবল। এ পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে ভারী উল্কার ভর ৬০ টন (নামিবিয়ার হোবা উল্কাপাত)।
ভূপৃষ্ঠে উল্কাপিণ্ড আঘাত হানলেই যে সেখানে ভয়ংকর কোনো চিহ্ন রেখে যাবে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তেমনটা ঘটে না। চিহ্ন তৈরি হলেও বড়সড় খুব কমই দেখা যায়। বেশির ভাগই খুব দ্রুত আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। তবে মাঝেমধ্যে খুব ভারী উল্কা পৃথিবীতে আঘাত করে। তখন সেখানে গভীর খাদ তৈরি হয়। আঘাতের সময়ে সৃষ্টি হয় অনেক উচ্চ তাপমাত্রা। ফলে উল্কাটি পুরোপুরি বাষ্পীভূত হয়ে চারদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় আশপাশের অনেক অঞ্চলজুড়ে শকওয়েভ তৈরি হয়। ক্ষয়ক্ষতিও হতে পারে বেশি মাত্রায়।
উল্কার কারণে তৈরি হওয়া গর্ত বা খাদ কত বড় হতে পারে? প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার উইন্সলোতে একটি উল্কাপিণ্ড আঘাত করে। এর ফলে সৃষ্টি হয় ব্যারিঞ্জার ক্রেটার। মূলত লোহা দিয়ে গঠিত সেই উল্কার ব্যাস ছিল ৩০-৫০ মিটার। কিন্তু ক্রেটারের ব্যাস ১ হাজার ২০০ মিটার এবং ২০০ মিটার গভীর। তবে এ রকম বড় খাদের সংখ্যা পৃথিবীতে খুব বেশি নয়। ছোট–বড় ১২০টির মতো উল্কাচিহ্ন পাওয়া গেছে সারা পৃথিবীতে। জলস্রোত, টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়া, ঝড়-বন্যা–জলবায়ু ইত্যাদির কারণে উল্কার আঘাতের চিহ্ন বিলীন হয়ে যায়।
তবে পৃথিবী ছাড়া অন্যান্য গ্রহেও উল্কাপাত হয়। বেশির ভাগ গ্রহেই বায়ুমণ্ডল নেই কিংবা থাকলেও তা খুব পাতলা। সেসব গ্রহে ক্রেটার বা গর্তের সংখ্যা অনেক। এসব গ্রহের পৃষ্ঠের আকৃতি গঠনে এসব গর্ত বিশেষ ভূমিকা রাখে। যেমন চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই বলে অসংখ্য ক্রেটার দেখা যায়। তা ছাড়া চাঁদে জলাশয় এবং টেকটনিক নড়াচড়া না থাকায় ক্রেটার অনেক দীর্ঘস্থায়ী হয়।
আবার গ্যাসীয় গ্রহে উল্কাপাত ঘটলে সেখানে কোনো ক্রেটার তৈরি হয় না। এ ক্ষেত্রে গ্রহের শরীরে রিং আকৃতির দাগ তৈরি হয়, যা খুব দ্রুতই গ্রহের বায়ুপ্রবাহে বিলীন হয়ে যায়। শুমেকার-লেভি–৯ নামের ধূমকেতুটি ১৯৯২ সালে বৃহস্পতি গ্রহের খুব কাছাকাছি চলে আসে। বৃহস্পতির আকর্ষণে ভেঙে ২১ খণ্ড হয়ে যায় ধূমকেতুটি। এই টুকরাগুলো প্রায় দুই বছর গ্রহটিকে প্রদক্ষিণ করে। ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে বৃহস্পতির গায়ে আঘাত হানে। সৌভাগ্যক্রমে তখন নাসার গ্যালিলিও অরবিটার বৃহস্পতির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। তাই এই পুরো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়।
ছোটখাটো উল্কার ফলে পৃথিবীর তেমন ক্ষতি হয় না। তবে কয়েক শ মিটার ব্যাসের গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত করলে নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণের চেয়েও বড় ক্ষতি করতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব আঘাতের পূর্বাভাস আগেভাগে জানা যায় না। তাই পৃথিবীতে আঘাতের আশঙ্কাময় উল্কা ও গ্রহাণু শনাক্ত করা এবং এগুলো থেকে বাঁচার উপায় বের করা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: নাসা ও ব্রিটানিকা ডটকম