গ্রহটা দেখতে পৃথিবীর মতো। যেন একটা নীল মার্বেল। প্রথম দেখায় অনেকে পৃথিবী বলে ভুল করতে পারেন। কিন্তু ভালোভাবে খেয়াল করলে বুঝবেন, ওটা আসলে পৃথিবী নয়। তখন ভাবতে পারেন, গ্রহটা থেকে একটু ঘুরে এলে কেমন হয়? গুগল করলেই জানবেন, ওটা পৃথিবী থেকে প্রায় ৬৩ আলোকবর্ষ দূরে। এই দূরত্ব দেখে ভিনগ্রহে যাওয়ার ইচ্ছাটা হয়তো মরে যাবে। কারণ, দূরত্ব তো আর কম নয়! আলো এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে, তাকে বলে এক আলোকবর্ষ। জানেন নিশ্চয়ই, আলো সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। ফলে এক বছরে যে কত পথ পাড়ি দেবে, তা হিসাব করাও কঠিন কাজ। আর ৬৩ আলোকবর্ষ কত দূরে, তা বের করা তো আরও কঠিন। আলো ৬৩ বছর ধরে চললে যতটা পথ যাবে, এই গ্রহটা ঠিক ততদূরে।
কিন্তু আমরা একটু কল্পনার আশ্রয় নিই। আমাদের বর্তমান প্রযুক্তির সাহায্যে এত দূরের গ্রহে যাওয়া সম্ভব নয়, এ আমরা সবাই জানি। তাই বলে কি কল্পনাও করব না? চলুন, কল্পনার ডানা মেলে পৃথিবীর মতো দেখতে ওই গ্রহটা ঘুরে আসি। ধরে নিই, আমরা এমন প্রযুক্তির নভোযান আবিষ্কার করলাম, যা আলোর চেয়ে অনেক বেশি গতিতে চলে (যদিও বাস্তবে সম্ভব নয়, শুধু কল্পনা)। ধরি, মাত্র ৭ দিনে আমরা ৬৩ আলোকবর্ষ দূরের গ্রহে পাড়ি দিতে পারব।
আমাদের যাত্রা শুরু হলো। ৭ দিনের যাত্রার শেষে গ্রহের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। মহাকাশযানে বসে দেখতে পাবেন, গ্রহটি পৃথিবী থেকে অনেক বড়। অনেকটা আমাদের গ্রহদানব বৃহস্পতির মতো। আর গ্রহটি তার নক্ষত্রের খুব কাছাকাছি থেকে ঘুরছে। অনেকটা বুধ গ্রহের মতো। বিজ্ঞানীরা এমন গ্রহকে বলেন হট জুপিটার। মূলত যেসব এক্সোপ্ল্যানেট বা সৌরজগতের বাইরের গ্রহের আকার বৃহস্পতি আকৃতির, গঠন গ্যাসীয় এবং নিজস্ব নক্ষত্রকে খুব অল্প দিনে প্রদক্ষিণ করতে পারে (পৃথিবীর হিসেবে ১০ দিনের কম), সেগুলো হট জুপিটার।
গ্রহের পৃষ্ঠে এত বাতাস যে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল। ঘণ্টায় প্রায় ৮ হাজার ৭০০ কিলোমিটার বেগে সেখানে বাতাস বয়।
এদিক থেকে আমাদের সৌরজগতের জুপিটার বা বৃহস্পতি গ্রহ কিন্তু আলাদা। এটি গ্যাসদানব হলেও সূর্যের কাছে নেই। বরং সূর্য থেকে অনেক দূরে এর অবস্থান। শনি গ্রহও গ্যাসীয়, কিন্তু সেটা সূর্য থেকে আরও দূরে।
যা-ই হোক, আমাদের গন্তব্যের গ্রহটি এমন হট জুপিটার। আর নিজ নক্ষত্রের খুব কাছ থেকে ঘোরে বলে এর তাপমাত্রাও অস্বাভাবিক বেশি। প্রায় ১ হাজার ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা মাত্র ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সৌরজগতের সবচেয়ে উষ্ণ গ্রহ শুক্র। এর গড় তাপমাত্রা ৪৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এসবের তুলনায় আমাদের গন্তব্য-গ্রহটির তাপমাত্রা অনেক অনেক বেশি। কিন্তু আমরা এখানেই থেমে যেতে চাই না। ধরে নিই, ওই গ্রহে নামার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী স্পেসস্যুট আমাদের কাছে আছে। ফলে গ্রহে অবরতণ করতে আর কোনো বাধা রইল না।
সব প্রতিকূলতা দূর করে আমরা পৃথিবীর মতো সুন্দর গ্রহটিতে অবতরণ করলাম। তাপমাত্রার ছিঁটেফোঁটাও টের পাচ্ছি না। কিন্তু আরেক নতুন বিপদের আমদানি হয়েছে। গ্রহের পৃষ্ঠে এত বাতাস যে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল। ঘণ্টায় প্রায় ৮ হাজার ৭০০ কিলোমিটার বেগে সেখানে বাতাস বয়। এমন বাতাসে নভোযান থেকে নামবেন কি না, তা নিয়ে ভাবছেন। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নভোযান হওয়ায় ওটার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। নভোযান থেকে বের হবেন নাকি হবেন না, এটা যখন ভাবছেন, তখন শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। কিন্তু একি? বৃষ্টির ফোঁটা কোথায়? এ যে গুড়ি গুড়ি কাচ বৃষ্টি হয়ে ঝরছে! বসে বসে কিছুক্ষণ সেই সৌন্দর্য দেখলেন। কিন্তু অমন সৌন্দর্য শুধু নভোযান থেকে দেখতে পারবেন। বাইরে বের হলে কাচের বৃষ্টির খোঁচায় স্পেসস্যুট ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তার ওপরে ওই প্রচণ্ড বাতাস! আর কি সুন্দর গ্রহটির পৃষ্ঠে পা রাখার সাহস দেখাবেন?
এই যে সুন্দর কিন্তু ভয়ংকর গ্রহটিতে এতক্ষণ কল্পভ্রমণ করলাম, তার নাম এইচডি ১৮৯৭ ৩৩বি। দেখতে সুন্দর হলেও অত্যন্ত বিপজ্জনক গ্রহ। একে চাইলে ভয়ংকর সুন্দর গ্রহ বলা যায়!
এই এক্সোপ্ল্যানেট বা বহিঃসৌরজাগতিক গ্রহটি ২০০৫ সালের ৫ অক্টোবর আবিষ্কার করেছেন ফ্রান্সের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। বৃহস্পতি থেকে ১১.২ গুণ ভারি এই গ্রহের ব্যাসার্ধও ১১.৪ গুণ বেশি। গ্রহটি তার নিজ নক্ষত্রের চারপাশে ঘণ্টায় ১৫২ কিলোমিটার বেগে ঘুরছে। ফলে নক্ষত্রকে একবার প্রদক্ষিণ করতে গ্রহটির সময় লাগছে ২.২ দিন। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের হট জুপিটার গ্রহ।