সূর্যে নিউক্লিয়ার বোমা ফেললে কী হবে?

মানুষের তৈরি পারমাণবিক বোমা কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে সক্ষম, তার প্রমাণ পৌনে এক শতাব্দী বা প্রায় ৭৫ বছর আগেই পৃথিবী দেখেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই ভয়ংকর তাণ্ডবলীলার পরও চলেছে পারমাণবিক বোমা নিয়ে নানান গবেষণা। বর্তমানে পৃথিবীতে পারমাণবিক বোমার সংখ্যার অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বিধ্বংসী এই মারণাস্ত্র শুধু যে বিস্ফোরণ ঘটিয়েই ক্ষান্ত হয় তা কিন্তু নয়। বিস্ফোরণের পর বোমা নির্গত তেজস্ক্রিয় রশ্মিও প্রাণ ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে।

শান্তিপ্রিয় মানুষেরা প্রায়ই এমন একটা পৃথিবী কল্পনা করেন, যেখানে কোনো পারমাণবিক বোমা থাকবে না। তবে, পৃথিবীকে পারমাণবিক বোমা শূন্য করাও সহজ নয়। আগে থেকে যেসব পারমাণবিক বোমা তৈরি করা আছে পৃথিবীতে, সেগুলোকে আগে ধ্বংস করতে হবে। কিন্তু কীভাবে ধ্বংস করবেন? পৃথিবীতে এসব বোমা বিস্ফোরণ করা মৃত্যু ডেকে আনার নামান্তর। তবে হ্যাঁ, নিরাপদে এসব বোমা ধ্বংসের জন্য উপযুক্ত স্থান হতে পারে মহাশূন্য। কল্পনার পঙ্খীরাজের রাশটা আরও একটু ঢিলে করে দিই। কেমন হতো যদি এই বোমাগুলো সূর্যে ফেলা হতো? ঠিক কী পরিমাণ নিউক্লিয়ার বোমা সূর্যের মাঝে ফেলা যাবে? এসব বোমার বিস্ফোরণের কারণে কি ধ্বংস হতে পারে সূর্য?

সূর্যের প্রধান জ্বালানী হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা ও চাপ দুটোই প্রচণ্ড বেশি। এতই বেশি যে, এখানে দুটো হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস মিলে তৈরি হয় হিলিয়াম পরমাণু। এ সময় দুটো হাইড্রোজেন পরমাণুর মোট ভরের চেয়ে হিলিয়াম পরমাণুর ভর কিছুটা কম হয়। অর্থাৎ, কিছুটা ভর শক্তিতে পরিণত হয়। E=mc2 সূত্রে এ কথাটাই বলেছেন আলবার্ট আইনস্টাইন। এসব শক্তিই বিদ্যুৎচুম্বকীয় বিকিরণ ও তাপ হয়ে সূর্য থেকে ছড়িয়ে পরে সৌরজগতে। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া।

সূর্যে হাইড্রোজেন বোমা ফেলার আগে পৃথিবী নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাইড্রোজেন বোমাগুলো শুরুতে জমা করতে হবে।

পৃথিবীতে যে ধরনের পারমাণবিক বোমা ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে ব্যবহৃত হয়েছিলো সেগুলো কাজ করে নিউক্লিয়ার ফিশন পদ্ধতিতে। এখানে দুটি পরমাণু জোড়া লাগার বদলে একটি পরামাণু ভেঙে যায় এবং কিছুটা ভর হারায়। হারানো ভরটুকুই পরিণত হয় শক্তিতে। এক কথায়, সূর্যের শক্তি উৎপাদন পক্রিয়া আর নিউক্লিয়ার ফিশন বোমার শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বিপরীত।

তবে, আধুনিক পারমাণবিক অস্ত্রে নিউক্লিয়ার ফিউশন, অর্থাৎ সূর্যের শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়াই কাজে লাগানো হয়। হাইড্রোজেন আইসোটোপ ব্যবহার করে এসব মরণাস্ত্র তৈরি করা হয় বলে এদের আরেক নাম হাইড্রোজেন বোমা। এটি নিউক্লিয়ার ফিশন বোমা চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী।

মোটামুটি প্রায় ৫০০ কোটি বছর পর সূর্যের জ্বালানী ফুরিয়ে আসবে। শেষ হয়ে যাবে সূর্যের আয়ু। শুধু সূর্য একাই নিঃশেষ হবে না। তার আগে লোহিত দানব নক্ষত্র হয়ে ধ্বংস করবে পৃথিবী সহ সৌরজগতের বেশকিছু গ্রহকে। সে পর্যন্ত মানবসভ্যতা টিকে থাকলে খাদ্য, বস্ত্র বা চিকিৎসার মতো প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে সূর্যকে বাঁচানো। এ ক্ষেত্রে কি হাইড্রোজেন বোমা কাজে আসবে?

সূর্যে হাইড্রোজেন বোমা ফেলার আগে পৃথিবী নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাইড্রোজেন বোমাগুলো শুরুতে জমা করতে হবে। এখানে রাজনৈতিক মতৈক্য এবং কারিগরি দক্ষতা জরুরী। ধরা যাক, সেটা সম্ভব হলো। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে বর্তমানে অন্তত ১৩ হাজার পারমাণবিক বোমা আছে।

নাগাশাকিতে যে বোমাটি ফেলা হয়েছিলো সে পরিমাণ ভরের একটি বোমা মহাকাশে পাঠাতে বর্তমানে খরচ হবে প্রায় ১৭০ বিলিয়ন ডলার।

এদের প্রত্যেকটি আবার কমপক্ষে ১০০ কিলোটন ডিনামাইটের সমান শক্তি ধারন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাশাকিতে যে বোমা ফেলা হয়, তার চেয়ে প্রায় ৬০ গুণ বেশি শক্তিশালী ৬৫০টি বোমা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই আছে। এসব বোমা স্থানান্তর বা রক্ষণাবেক্ষণ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। উনিশ থেকে বিশ হলেই ঘটতে পারে মারাত্মক বিস্ফোরণ। সবগুলো বোমা যদি কোনোভাবে আমাদের বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরিত হয়, তাহলে পৃথিবী জুড়ে নেমে আসবে পারমাণবিক শীতকাল। কারণ বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট ধুলো, গ্যাস বা ধোঁয়া বায়ুমণ্ডলে আস্তরণ তৈরি করবে। সূর্যের আলো যাবে ঢেকে। তাপ ছাড়া পুরো পৃথিবী পরিণত হবে শীতল গ্রহে। সূর্যকে বাঁচানোর জন্য আমরা যেখানে সূর্যে পারমাণবিক বোমা ফেলতে চাইছি, সেখানে যদি বোমার কারণে নিজেদের সূর্য থেকে আলাদা করে ফেলি, তাহলে সেটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। হেঁয়ালির মতো শোনালেও এ আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই পারমাণবিক বোমা নাড়াচাড়া করতে হলে প্রথমেই কারিগরি সক্ষমতা অনন্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া জরুরী।

নাগাশাকিতে যে বোমাটি ফেলা হয়েছিলো সে পরিমাণ ভরের একটি বোমা মহাকাশে পাঠাতে বর্তমানে খরচ হবে প্রায় ১৭০ বিলিয়ন ডলার। এ থেকে ১৩ হাজার বোমা পাঠাতে কেমন খরচ হতে পারে তা খুব সহজেই বের করা যায়। মনে রাখতে হবে, এই পরিমাণ অর্থ খরচ হবে শুধু বোমাগুলো মহাকাশে পাঠাতে। মহাকাশযানগুলো সূর্যের কাছাকাছি নিতে হলে খরচ আরও বাড়বে।

আছে সূর্যের তাপে টিকে থাকার মতো পদার্থ তৈরির জটিলতাও। সূর্যে পারমাণবিক বোমা ফেলতে হলে সূর্যের কাছাকাছি যাবার মতো মহাকাশযান আগে তৈরি করতে হবে। ধরা যাক, সেটাও হলো কোনোভাবে। তারপরও কথা থেকেই যাচ্ছে।

১৩ হাজার পারমাণবিক বোমা পৃথিবী জন্য মারাত্মক শক্তির উৎস হতে পারে। কিন্তু সূর্যের শক্তির কাছে এটা কিছুই নয়। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, সূর্য থেকে প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, তা এই সবগুলো বোমার সম্মিলিত শক্তির প্রায় ৭ কোটি গুণ বেশি। অর্থাৎ, সূর্যে ১৩ হাজার পারমাণবিক বোমা ফেলার অর্থ দাবানলের মাঝে একটা দিয়াশলাই ছুড়ে ফেলার মতো।

মানে, এই বোমার কারণে সূর্যের তেমন কোনো ক্ষতিই  হবে না। একই কথা নিউক্লিয়ার ফিশন বোমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই, সূর্যের জ্বালানী জোগানোর সামর্থ্য পৃথিবীবাসীর নেই।

সূর্যকে বাঁচানো না গেলেও সূর্যে পারমাণবিক বোমাগুলো ফেলতে পারলে পৃথিবী মুক্তি পেত এক ভয়ানক অভিশাপ থেকে। সেটাও কম কিছু না। কিন্তু পারমাণবিক বোমা মুক্ত পৃথিবী গড়তে কি মানুষ এতো খরচ আর পরিশ্রম করতে রাজি হবে? তার চেয়ে বড় কথা, এটাই কি উপযুক্ত সমাধান? মোটেই না। বরং পৃথিবীকে পারমাণবিক বোমার আতঙ্ক থেকে মুক্ত করতে প্রয়োজন শুধু মানুষের একটুখানি সদিচ্ছা। জাতিগত বৈষম্য ভুলে সব মানুষ যদি একে অন্যের সঙ্গে একাত্ম হয়, তাহলে পারমাণবিক বোমাগুলো আর সূর্যে পাঠানোর প্রয়োজন নেই। এসব বোমা ভালো কাজে লাগানোর অনেক উপায় তখন বেরিয়ে আসবে। শান্তিময় পৃথিবীর জন্য এটুকু স্বপ্ন দেখা সম্ভবত দোষের কিছু নয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াট ইফ শো ডট কম, উইকিপিডিয়া, হাউ ইট ওয়ার্কস ম্যাগাজিন