১৮ নভেম্বর, ১৯১৫ সাল। ইউরোপে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল।
জার্মানির রাজধানী বার্লিনের পশ্চিমের শহরতলি থেকে এক লোক চলেছেন শহরের কেন্দ্রের দিকে। পোশাক-আশাকে লোকটা এমনিতে একটু আলুথালু গোছের। মাথার চুল উষ্কখুষ্ক থাকে প্রায়ই। কিন্তু কে জানে কেন, সেই বৃহস্পতিবারে একটু পরিপাটি দেখা যাচ্ছিল লোকটাকে।
বার্লিনের স্প্রি নদীর পাড়ঘেঁষা নামকরা ব্র্যানডেনবার্গ গেট। সেই গেট তিরের মতো ভেদ করে সোজা চলে গেছে সুপ্রশস্ত উনটার ডেন লিনডেন অ্যাভিনিউ। এই পথে ধরে হেঁটে চলেছেন লোকটা। এই রাস্তার একটু দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রুশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেসের ভবন। জার্মানির সম্মানজনক একটি প্রতিষ্ঠান। দেশটির জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতীক। কিছুক্ষণ পরে সেই প্রুশিয়ান একাডেমিতে পৌঁছালেন তিনি। অতঃপর দৃপ্ত পায়ে ঢুকলেন ভবনের ভেতরে।
ওদিকে যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেও থেমে নেই প্রুশিয়ান একাডেমির কাজ। একাডেমির সদস্যরা এক লেকচার শোনার জন্য সেদিনও উপস্থিত হয়েছেন। বক্তা তাঁদেরই নতুন এক সহকর্মী। কিছুক্ষণ পর এক লোককে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে দেখা গেল সভাকক্ষে। লিনডেন অ্যাভিনিউ ধরে হেঁটে আসা সেই লোক কিছু কাগজ হাতে নিয়ে বক্তব্য দিতে মঞ্চে উঠলেন। লোকটির নাম আলবার্ট আইনস্টাইন। জার্মানির আলোচিত বিজ্ঞানী। সেই ১৯০৫ সালে যুগান্তকারী পাঁচটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে বিজ্ঞানের রাজ্যে বেশ একটা হইচই বাধিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে পদার্থবিজ্ঞানে আলোচিত এক নাম আইনস্টাইন। ওই পাঁচ পেপারের মধ্যে ছিল একটা বৈপ্লবিক তত্ত্ব, যার পোশাকি নাম বিশেষ আপেক্ষিকতা।
এরপর বার্লিনের স্প্রি নদীর অনেক পানি গড়িয়েছে। ওদিকে টানা ১০ বছর চেষ্টা করে বিশেষ আপেক্ষিকতার সঙ্গে মহাকর্ষ বলের সম্পর্ক খুঁজেছেন আইনস্টাইন। এত দিনের পরিশ্রম তাঁর বৃথা যায়নি। অবশেষে সফল হয়েছেন তিনি। খুঁজে পেয়েছেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত সেই তত্ত্ব। তার নাম দিয়েছেন জেনারেল রিলেটিভিটি বা সাধারণ আপেক্ষিকতা।
১৮ নভেম্বরের ওই সভাতে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব উপস্থাপন করেন আইনস্টাইন। সেই সঙ্গে দিলেন আনকোরা একটা সমীকরণও। তত্ত্বটি মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণার খোলনলচে পাল্টে দিল। এই তত্ত্বমতে, মহাকর্ষ আসলে স্থান-কালের চাদরে বক্রতার প্রভাব। সেই প্রভাবে পৃথিবী গড়িয়ে গড়িয়ে ঘুরতে বাধ্য হচ্ছে সূর্যের চারপাশের বক্রতার চাদরে।
তবে স্বাভাবিকভাবে যেকোনো নতুন তত্ত্ব যত সুন্দরই হোক না কেন, তা প্রস্তাব করার সঙ্গে সঙ্গেই বিজ্ঞানীরা সাদরে বরণ করে নেন না। বরং নতুন তত্ত্বকে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ওই তত্ত্ব থেকে আগাম কোনো ভবিষ্যদ্বাণীও করতে হয়। এসব পরীক্ষা আর ভবিষ্যদ্বাণীতে তাকে পাস করতে হয়। টেনেটুনে পাস নয়, রীতিমতো গোল্ডেন এ প্লাস পেতে হয়।
সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রস্তাবের পরপর তাই আইনস্টাইন রাতারাতি বিখ্যাত বনে গেছেন কিংবা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা তাঁর পিঠ চাপড়ে বাহবা দিতে শুরু করেছেন—এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। আসলে তাঁকে এ তত্ত্ব নিয়ে অনেক বিরোধিতা আর সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। একসময় তো তাঁকে আর তাঁর তত্ত্ব নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল—আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে ১০০ বিজ্ঞানী। এ বই সম্পর্কে তিনি যে মন্তব্য করেছিলেন, সেটাও এখন ইতিহাস। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি ভুল হই, তাহলে একজনই যথেষ্ট। ১০০ জনের দরকার কী!’
আমি যদি ভুল হই, তাহলে একজনই যথেষ্ট। ১০০ জনের দরকার কী!
যা–ই হোক, সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রস্তাবের পর সেটি আদৌ সঠিক কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা জরুরি হয়ে দেখা দিল। এর মধ্যে দুটি পরীক্ষার মুখোমুখি হলো তত্ত্বটি। একটি হলো বুধের গতিপথের বিচ্যুতির সঠিক ব্যাখ্যা এবং আরেকটি আলোর বক্রতাবিষয়ক পরীক্ষা।
বুধের গতিপথের সঠিক ব্যাখ্যাটা কী? সে কথা বলতে গেলে একটু পেছনের কথা জানা দরকার।
২
১৬৬৬ সাল। ভারতবর্ষে দিল্লির মসনদে তখন ক্ষমতাসীন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব। তাঁর সেনাপতি সুবাদার শায়েস্তা খান তখন বাংলায় বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন। বছরের শুরুতে তিনি পর্তুগিজদের সহায়তায় আরাকানদের চট্টগ্রাম থেকে হটিয়ে তার নাম দিয়েছেন ইসলামাবাদ। বাংলার রাজধানী ঢাকাতেও তখন ব্যাপক উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। মাত্র এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়ার প্রবাদপ্রতিম কাল অতিক্রম করছে ঢাকা। এই সমৃদ্ধিতে ভাগ বসাতে পর্তুগিজদের মতো ইউরোপ থেকে একে একে বণিকেরা ভিড় জমাতে শুরু করেছেন এই বাংলায় তথা গোটা ভারতবর্ষে। তাঁদেরই একটা দল ছিল ইংরেজ। ইংল্যান্ডের বাসিন্দা তাঁরা।
ঠিক সেই সময় ভয়াবহ প্লেগে আক্রান্ত লন্ডনসহ ইংল্যান্ডের কিছু শহর। সংক্রমণ ঠেকাতে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দলে দলে মানুষ শহর-বন্দর ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছে। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ। এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়ি উলথ্রপে চলে গেলেন তরুণ আইজ্যাক নিউটন। সেখানে মহামারিতে অলস সময় না কাটিয়ে লেগে গেলেন বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। কথিত আছে, সেই গ্রীষ্মে বাগানে বসে গাছ থেকে আপেল পড়া দেখতে পান তিনি। তারপর আবিষ্কার করেন মহাকর্ষ তত্ত্ব। এই মহাকর্ষ সূত্র মহাকাশের গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্রের গতি থেকে শুরু করে পৃথিবীর যেকোনো বস্তুর পতন বা গতির ব্যাখ্যা দিতে পারত। তাই নিউটন হয়ে উঠলেন সেকালের বিজ্ঞানের জগতে মুকুটহীন সম্রাট। তাঁর সেই রাজত্ব টিকে রইল আরও দুই শতাব্দীজুড়ে।
মহাকাশের যেকোনো ঘটনা ব্যাখ্যায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র। যেমন আঠারো শতকে শনি গ্রহের গতিপথের একটি বিচ্যুতি দেখা গেল। নিউটনের সূত্র দিয়েও সেটা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। কারও কারও মনে হলো, তবে কি নিউটনের সূত্র ভুল? কিন্তু নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র এতই বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে যে তা ভুল ভাবার উপায় নেই। তাহলে? অন্য কিছু দায়ী বলে ভাবলেন জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেল। নিউটনের সূত্র ব্যবহার করে হার্শেল হিসাব করে দেখলেন, সৌরজগতের একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে আরেকটি গ্রহ থাকলেই কেবল শনির এ গতিপথের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তার খোঁজে রাতের আকাশে দুরবিন তাক করে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন হার্শেল। বেশ কিছুদিনের চেষ্টায় অবশেষে ১৭৮১ সালের ১৩ মার্চ মিলল সেই কাঙ্ক্ষিত বস্তু। নতুন গ্রহটির নাম দেওয়া হলো ইউরেনাস।
এর প্রায় ৬৪ বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। আরেকবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র। এবার গোলমাল ধরা পড়ল ইউরেনাসের কক্ষপথে। তাতে জ্যোতির্বিদেরা সিদ্ধান্তে এলেন, হয় নিউটনের সূত্র ভুল, নয়তো আকাশে আরেকটা অজানা গ্রহ আছে। সেই গ্রহ হয়তো ইউরেনাসের কক্ষপথে এই ঝামেলা বাধাচ্ছে। নিউটনকে ভুল ভাবতে চাইলেন না বেশির ভাগ জ্যোতির্বিদ। তাহলে? নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র কাজে লাগিয়ে মহাকাশে আরেকটি অজানা গ্রহ থাকার সম্ভাবনার কথা বললেন ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দুজন বিজ্ঞানী। তাঁরা হলেন জন কাউচ অ্যাডামস ও আরবেইন ল্য ভ্যারিয়ে। তাঁরা হিসাব করে বললেন, আকাশের ঠিক কোন জায়গাটায় গ্রহটা দেখা যাবে। ১৯৪৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দুরবিনে আকাশের নির্ধারিত জায়গায় প্রথমবার ধরা পড়ে নতুন গ্রহ। নাম দেওয়া হয় নেপচুন। এই সাফল্যে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী জ্যোতির্বিদ হিসেবে পরিচিতি পান ল্য ভ্যারিয়ে। অচিরেই রাজার আদেশে প্যারিস মানমন্দিরের পরিচালক পদে আসীন হন তিনি। যখন-তখন ডাক পড়ে রাজদরবারে।
ধারাবাহিক এসব সাফল্যে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র নিয়ে আর কারও কোনো সন্দেহ থাকল না। আস্থা বাড়ল আগের চেয়ে শতগুণ। তবে কয়েক বছর কাটতে না কাটতেই সৌরজগতের গ্রহগুলোর গতিপথ নিয়ে আরেকবার ঝামেলায় পড়লেন বিজ্ঞানীরা। এবার বুধ গ্রহ নিয়ে। অনেক দিন ধরে বুধ গ্রহের কক্ষপথে একটি অসংগতি ধরা পড়ছিল। সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধের কক্ষপথ ঠিক উপবৃত্তাকার নয়। ফরাসি বিজ্ঞানী ল্য ভ্যারিয়ে বুধের গতিপথ হিসাব–নিকাশ করতে গিয়ে দেখেন, নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র কাজে লাগিয়ে তাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। হিসাব বলছে, বুধ গ্রহের অনুসুর (কক্ষপথে সূর্যের সবচেয়ে কাছের বিন্দু) বিন্দুর প্রতি ১০০ বছরে ১ ডিগ্রির ৬ ভাগ বিচ্যুতি হয়। বুধের কক্ষপথের যেকোনো বিন্দু থেকে শুরু করে সূর্যের চারপাশে ঘুরে আবারও সেই বিন্দুতে ফিরে আসতে তার ৮৮ দিন লাগে। কিন্তু পর্যবেক্ষণে দেখা গেল, বুধের অনুসুর থেকে শুরু করে পুরো পথপরিক্রমা শেষে আগের বিন্দুতে ফিরছে না। বরং ফিরছে আগের বিন্দু থেকে একটু দূরে। বুধের অনুসুরের সরে যাওয়ার পরিমাণ খুবই সামান্য।
ল্য ভ্যারিয়ে কাগজে-কলমে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হিসাব করে দেখতে লাগলেন। তাঁর হিসাবে বুধের নিকটতম প্রতিবেশী শুক্রের আকর্ষণ বুধের অনুসুর বিন্দুকে প্রতি শতাব্দীতে পাঁচ হাজার ভাগের এক ভাগ এগিয়ে যেতে বাধ্য করে। অর্থাৎ বুধের কারণে প্রতি শতকে প্রায় ২৮০ দশমিক ৬ আর্ক সেকেন্ড এগিয়ে যায় ওই অনুসুর বিন্দু। দানবীয় গ্রহ বৃহস্পতির টানে প্রতি শতকে অনুসুর বিন্দু সরে যায় ১৫২ দশমিক ৬ আর্ক সেকেন্ড। একইভাবে পৃথিবীর কারণে সরে যায় ৮৩ দশমিক ৬ আর্ক সেকেন্ড। আর সৌরজগতের বাকি গ্রহগুলোর কারণে অনুসুর বিন্দু সরে যাওয়ার পরিমাণ ৯ দশমিক ৯ আর্ক সেকেন্ড। সব কটি যোগ করে প্রতি ১০০ বছরে বুধের অনুসুর বিন্দুর বিচ্যুতি পাওয়া গেল ৫২৬ দশমিক ৭ আর্ক সেকেন্ড।
কিন্তু সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণে দেখা গেল, এই অনুসুরের সরে যাওয়ার পরিমাণ প্রতি শতকে হয় ৫৬৫ আর্ক সেকেন্ডে (আধুনিক হিসেবে ৫৭৪ আর্ক সেকেন্ড)। কাগজে-কলমে আর বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য মাত্র ৩৮ আর্ক সেকেন্ড (অবশ্য আধুনিক মান ৪৩ আর্ক সেকেন্ড)। ১ আর্ক সেকেন্ড হলো ১ ডিগ্রির ৩ হাজার ৬০০ ভাগের ১ ভাগ। অর্থাৎ ১০০ বছরে বুধের অনুসুর সরে যায় ১ ডিগ্রির ৬ ভাগের ১ ভাগ মাত্র। কিন্তু এই সামান্য ভুলও হওয়ার কথা নয়। জ্যোতির্বিদেরা চান একেবারে নিখুঁতভাবে মিলে যাবে সবকিছু, কোনো বিচ্যুতি থাকবে না। তাই বিষয়টা তাঁদের ভাবিয়ে তুলল। বিশেষ করে মাথা তেতে উঠল ল্য ভ্যারিয়ের।
নিউটনীয় বলবিজ্ঞানে এর ব্যাখ্যা নেই। তাহলে? নিউটনের সূত্রে কি কোনো ত্রুটি আছে? না, এবারও ল্য ভ্যারিয়ের কাছে পাস করে গেলেন নিউটন। নেপচুন গ্রহ আবিষ্কারের সাফল্যের রেশ তখনো কাটেনি। সেই খ্যাতি তখনো তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন তিনি। তারই রেশ ধরে তিনি ধারণা করলেন, সূর্য আর বুধের মাঝখানে আরেকটি ছোট আকৃতির কোনো গ্রহ আছে নিশ্চয়ই। মনে মনে ভাবলেন, আরেকটি নতুন গ্রহ আবিষ্কার করতে পারলেই কেল্লা ফতে। তখন তাঁকে আর পায় কে!
সেই সুখভাবনায়, ১৮৫৯ সালের সেপ্টেম্বরে ফরাসি একাডেমিতে একটা গবেষণাপত্র জমা দেন ল্য ভ্যারিয়ে। এতে বলা হয়, বুধ ও সূর্যের মাঝখানে আরেকটি গ্রহ থাকতে পারে, যার কারণে বুধ গ্রহের এই অনুসুর ঘটে। এই গ্রহের সম্ভাব্য আকার ও ভর কেমন হবে, তা–ও হিসাব করে বের করেন ল্য ভ্যারিয়ে। কিন্তু তা–ই যদি হবে, তাহলে গ্রহটা এতকাল কেউ দেখেনি কেন? ল্য ভ্যারিয়ে নিজেই উত্তর দিলেন, আকারে ছোট আর সূর্যের অনেক কাছে বলেই সূর্যের উজ্জ্বলতায় সবার চোখ এড়িয়ে গেছে। একমাত্র উপায় সূর্যগ্রহণের সময় সেটাকে খুঁজে বের করা। সে চেষ্টাও করে দেখা হলো বেশ কয়েকবার, কিন্তু সেই গ্রহের টিকিটিরও কোনো হদিস মিলল না।
ল্য ভ্যারিয়ে হতাশ। কিন্তু চাঙা হতেও সময় লাগল না। কারণ, বছরের শেষে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত এক চিঠি পেলেন। প্রেরক অজপাড়াগাঁয়ের এক চিকিৎসক, নাম লেসকারবোল্ট।
৩
রাজধানী প্যারিস থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরের একটা গ্রাম। সেই গ্রামের বাসিন্দা লেসকারবোল্ট। পুরো নাম এডমন্ড মোডেস্টে লেসকারবোল্ট। গ্রাম্য চিকিৎসক। সঙ্গে শখের জ্যোতির্বিদ। রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে চলে জ্যোতির্বিদ্যাচর্চা।
১৮৫৯ সালের ২৬ মার্চ ছিল সূর্যগ্রহণ। সকাল থেকেই রোগী দেখায় ব্যস্ত ছিলেন। একটা জরুরি সার্জারিও করতে হয়েছে সেদিন। রোগীকে বিদায় দিয়ে মাঝখানে একটু ফুরসত পান তিনি। সে সময় নিজের সাড়ে তিন ইঞ্চির প্রতিফলক দুরবিন দিয়ে সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করেন। হঠাৎ সূর্যের সামনে একটা ছোট্ট কালো বিন্দু দেখতে পান তিনি। শুরুতে সেটাকে পাত্তা দেননি লেসকারবোল্ট। কিন্তু সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দেখতে পেলেন, ওটা নড়ছে।
এর মধ্যে আরেক রোগীর ডাকে চেম্বারে গিয়ে বসতে বাধ্য হন। সেই রোগীকে বিদায় করে দ্রুত ফিরে আসেন বাগানে। আবারও চোখ রাখেন দুরবিনে। তখনো খুদে বস্তুটিকে দেখতে পেলেন তিনি। ওই বস্তু যে বুধ গ্রহ নয়, নতুন কোনো অজানা বস্তু, তা নিশ্চিত। নিজের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বস্তুটার অবস্থান ও গতিপথ নির্ণয় করেন শৌখিন ওই জ্যোতির্বিদ।
এরপর প্রায় ৯ মাস কাউকে কিছু না বলে স্রেফ চুপচাপ বসে থাকেন লেসকারবোল্ট। এমন সময় পত্রিকায় ল্য ভ্যারিয়ের কথা আর বুধ ও সূর্যের মাঝখানে সম্ভাব্য একটা গ্রহের কথা জানতে পারেন তিনি। এরপর কাগজ–কলম টেনে নিয়ে প্যারিস মানমন্দির বরাবর চিঠি লেখেন। সেই চিঠি পেয়ে হাতে যেন চাঁদ পেলেন ল্য ভ্যারিয়ে। এতকাল পিছু ছুটেও যার নাগাল পাননি, সেটা একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে ধরা দিয়েছে দেখে আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন। তড়িঘড়ি করে চেপে বসেন ট্রেনে। প্রত্যন্ত গ্রামের ওই চিকিৎসকের বাড়ির পথে ছুটলেন ভ্যারিয়ে আর তাঁর সহযোগীরা।
১৮৬০ সালে প্যারিস বিজ্ঞান একাডেমিতে নতুন গ্রহ আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। এর নাম দেওয়া হলো ভালকান। গ্রিক পুরাণের অগ্নিদেবতা। সূর্যের একেবারে কাছাকাছি থাকায় যথারীতি গ্রহটি অগ্নিগর্ভই হওয়ার কথা। সেটি মাথায় রেখে এই নাম
লেসকারবোল্টকে কিছু না জানিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে পৌঁছেই আগে লেসকারবোল্টের পরীক্ষা নিলেন ভ্যারিয়ে। আসলে লেসকারবোল্ট সত্যি বলেছেন, নাকি মিথ্যা বলছেন, তা যাচাই করে দেখতে চান তিনি। নেপচুন আবিষ্কার করার কারণে তিনি তখন ফ্রান্সের নামকরা জ্যোতির্বিদ। শুধু ফ্রান্স কেন, গোটা ইউরোপেই তিনি সুপরিচিত। তাই কাঁচুমাচু হয়ে ভ্যারিয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকেন লেসকারবোল্ট। অবশ্য সে পরীক্ষায় উতরে গেলেন তিনি। চিকিৎসক লেসকারবোল্টের যন্ত্রপাতি ও জ্যোতির্বিদ্যাসংক্রান্ত জ্ঞান বাজিয়ে দেখে ভ্যারিয়ে নিশ্চিত হন, চিকিৎসক সত্যি কথাই বলছেন।
তাই অজানা বস্তুটি নিজের চোখে না দেখলেও তাকে গ্রহের মর্যাদা দিতে উঠেপড়ে লাগেন তিনি। ১৮৬০ সালে প্যারিস বিজ্ঞান একাডেমিতে নতুন গ্রহ আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। এর নাম দেওয়া হলো ভালকান। গ্রিক পুরাণের অগ্নিদেবতা। সূর্যের একেবারে কাছাকাছি থাকায় যথারীতি গ্রহটি অগ্নিগর্ভই হওয়ার কথা। সেটি মাথায় রেখে এই নাম। লেসকারবোল্টের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ভালকান সূর্য থেকে ২১ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আর সূর্যের চারপাশের কক্ষপথে প্রায় ১৯ দিনে এক পাক ঘোরে বলে হিসাব করে বের করলেন তিনি। লেসকারবোল্টকে প্যারিসে ডেকে এনে পুরস্কৃতও করা হলো। ল্য ভ্যারিয়ে আরেক দফা সম্মানের বন্যায় ভেসে যাওয়ার অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগলেন।
কিন্তু সমস্যা হলো, গ্রহটি কেউ কেউ দেখার দাবি করেছে বটে, কিন্তু অধিকাংশ প্রভাবশালী জ্যোতির্বিদের চোখে সেটি কখনোই ধরা পড়ল না। ভালকানবিরোধী প্রথম বোমাটি ফাটালেন ফরাসি জ্যোতির্বিদ ইমানুয়েল লিয়াস। তিনি লেসকারবোল্টের ভালকান দেখার দাবি এককথায় নাকচ করে দিলেন। তিনি দাবি করলেন, লেসকারবোল্ট যে সময় অজানা বস্তুটি দেখেছেন, ঠিক একই সময়ে আরও শক্তিশালী দুরবিন দিয়ে আকাশের একই জায়গায় পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। কিন্তু এমন কোনো বস্তু দেখতে পাওয়া যায়নি বলে জানান ইমানুয়েল। সেই নিয়ে কিছুদিন দুই পক্ষের বাদানুবাদ চলল।
১৮৬০ সালে আরেকটা সুযোগ পাওয়া গেল। সে বছর ভারতের মাদ্রাজ এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ও মেলবোর্ন থেকে ভালকান খুঁজে দেখা হলো। কিন্তু কেউই কিছুই পেলেন না। ১৮৬৯ সালের ৭ আগস্ট আরেকটা পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা দিল আমেরিকায়। এবারও কেউ কেউ ভালকান দেখার দাবি করলেন, কেউ কেউ জানালেন অমন কিছু দেখেননি। ভালকান দেখার দাবিটা তাই নিরপেক্ষভাবে যাচাই করে দেখা গেল না। দাবিগুলোও নির্ভরযোগ্য মনে হলো না জ্যোতির্বিদদের কাছে।
এদিকে সাধের গ্রহটাকে নিজ চোখে না দেখেই ১৮৭৭ সালে মারা গেলেন ল্য ভ্যারিয়ে। বলাই বাহুল্য, মনে ভীষণ একটা আক্ষেপ নিয়ে চিরবিদায় নেন তিনি। তবে ভ্যারিয়ের মৃত্যুতেও থামল না ভালকান অনুসন্ধানের কাজ। জ্যোতির্বিদেরা আকাশ হাতড়ে চললেন গ্রহটার খোঁজে। ১৮৮৩, ১৮৮৭, ১৮৮৯, ১৯০০, ১৯০১, ১৯০৫ ও ১৯০৮ সালেও গ্রহটা দেখার আশায় আকাশ চষে দেখেছেন তাঁরা। কিন্তু মাথার ঘাম পায়ে ফেলাটাই সার হয়েছে। পাওয়া যায়নি ভালকান। ফরাসি চিকিৎসক লেসকারবোল্টের ভালকান দেখার দাবি কি তাহলে ভুল? তিনি কি আকাশে সেদিন অন্য কিছু দেখেছিলেন? উত্তর মিলল না। ভালকান নিয়ে দীর্ঘদিন একটি ধোঁয়াশা রয়ে গেল। তবে এ ধোঁয়াশা অবশেষে কেটে গেল আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের কল্যাণে।
৪
১৯১৫ সালে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের চূড়ান্ত সমীকরণ প্রকাশের কয়েক বছর আগেই এই সমস্যার সমাধান দিলেন আইনস্টাইন। আইনস্টাইন তাঁর সমীকরণ ব্যবহার করে বুধের কক্ষপথ গণনা করলেন। সূর্যের মতো ভারী বস্তুর কাছে স্থান-কালের চাদরে যে বিপুল বক্রতা তৈরি হবে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বুধের কক্ষপথ হিসাব করেন তিনি। আইনস্টাইন হিসাব করে দেখালেন, তাঁর তত্ত্ব ব্যবহার করে বুধ গ্রহের কক্ষপথসংক্রান্ত সমস্যার নিখুঁত সমাধান করা যায়। বাকি থাকা সেই ৪৩ আর্ক সেকেন্ডের হিসাবও খাপে খাপে মিলে গেল। প্রুশিয়ান একাডেমিতে সে ফল উপস্থাপন করেন আইনস্টাইন। তাতে অর্ধশতক দাপিয়ে বেড়ানোর পর অপমৃত্যু হলো ল্য ভ্যারিয়ের সাধের গ্রহ ভালকানের।
তবে ভালকান নামের গ্রহটি জ্যোতির্বিদ্যা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হলেও সাধারণ মানুষের মনে অনেক দিন জেঁকে বসেছিল। তাই তো জনপ্রিয় স্টার ট্রেক সিরিজেও ভালকান নামের গ্রহ ও সেখানকার বাসিন্দাদের (যেমন স্কোপ ভালকানের বাসিন্দা) সদর্পে মহাকাশ দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যায়। আবার বাংলাদেশের স্কুলের পাঠ্যবইয়েও সত্তরের দশকে ভালকান নামের গ্রহের কথা বলা হতো। স্কুলের গাইড বইয়ে আশির দশকের শেষ দিকেও লেখা থাকত, ‘গ্রহের সংখ্যা ৯টি। তবে সম্প্রতি ভালকান নামের নতুন আরেকটি গ্রহ আবিষ্কারের কথা শোনা যাচ্ছে।’
বিজ্ঞানীরা এখন একমত যে ভালকানের অস্তিত্ব আসলে কখনোই ছিল না। ওটা ছিল আসলে একদল মানুষের মিথ্যা আকাশকুসুম কল্পনা। সেই জ্বরে কাবু হয়েছিলেন অনেকে। আর তাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা রেখেছিলেন ল্য ভ্যারিয়ে। মানুষের বিভ্রম আর বৈজ্ঞানিকভাবে উচ্চাভিলাষী ভাবনা যে কত বড় তাসের ঘর নির্মাণ করতে পারে, এটা তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: দ্য ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল, স্টিফেন হকিং; ইন পারসুট অব দ্য আননোন, ইয়ান স্টুয়ার্ট; অ্যাসেন্ট অব গ্র্যাভিটি, মারকোস চোন; রিয়েলিটি ইজ নট হোয়াট ইট সিমস, কার্লো রোভেলি; ঈশ্বরকণা, মানুষ ইত্যাদি, পথিক গুহ; মহাকর্ষের কথা, সুকন্যা সিংহ, উইকিপিডিয়া।