সম্প্রতি জেমস ওয়েবের প্রথম ডিপফিল্ড ছবিটি বিশ্লেষণ করে কানাডিয়ান এনআইআরআইএসএস আনবায়াসড ক্লাস্টার সার্ভে দল মহাবিশ্বের প্রাচীনতম নক্ষত্রপুঞ্জ শনাক্ত করেছে। তাঁদের এই গবেষণাপত্রটি আজ বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটারস-এ।
গবেষণাপত্রটির সহ-প্রধান লেখক বাংলাদেশী জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী লামীয়া আশরাফ মওলা। বর্তমানে তিনি কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডানল্যাপ ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকসে ডানল্যাপ ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন।
জেমস ওয়েব নভোদুরবিন নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সিগুলোর সন্ধান করা। ওয়েবের প্রথম ডিপ ফিল্ড ছবি বিশ্লেষণ করে সেটাই করেছেন এই গবেষক দল। নয় বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের ‘দ্য স্পার্কলার গ্যালাক্সি’তে তাঁরা শনাক্ত করেছেন মহাবিশ্বের দূরতম নক্ষত্রপুঞ্জ। গ্যালাক্সিটির এমন নামকরণের কারণ এটিকে ঘিরে থাকা গুটি গুটি কিছু লালচে-হলুদ বিন্দু। গবেষকরা এদেরকে বলেন ‘স্পার্কলস’, বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ঝলমলে স্ফুলিঙ্গের মতো’।
কানাডিয়ান গবেষকদল বলছেন, এই স্পার্কলসগুলো হয় তরুণ নক্ষত্রপুঞ্জ—এতে নিয়মিত হারে সে সময় জন্ম নিচ্ছিল একের পর এক শিশু নক্ষত্র। বিগ ব্যাংয়ের তিন বিলিয়ন বছর পরে, নক্ষত্র জন্মের হার যখন ছিল তুঙ্গে, সে সময় এটির জন্ম। নয়তো এটি কোনো বুড়ো গোলকীয় নক্ষত্রপুঞ্জ বা গ্লোবুলার ক্লাস্টার। গোলকীয় নক্ষত্রপুঞ্জ বলতে সাধারণত বোঝানো হয় একটি গ্যালাক্সির শিশুকালে জন্ম নেওয়া নক্ষত্রদের প্রাচীন সংগ্রহশালা—গ্যালাক্সির শুরুর দিকে জন্ম নেওয়া নক্ষত্ররা যেখানে দল বেঁধে গোল করে জড়ো হয় একসঙ্গে।
একসঙ্গে জড়ো হওয়া এরকম ১২টি গুটি গুটি বিন্দুদল নিয়ে গবেষণা করেছেন তাঁরা। প্রাথমিক বিশ্লেষণ শেষে তাঁদের মতামত হলো, সব সাক্ষ্য-প্রমাণ বলছে, এই ১২টির অন্তত ৫টি আমাদের জানা প্রাচীনতম নক্ষত্রপুঞ্জ।
বিজ্ঞানী লামীয়া মওলা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জেমস ওয়েবের প্রথম ডিপফিল্ড ছবিটি থেকে এই আবিষ্কার শিশু মহাবিশ্বে নক্ষত্র গঠণ নিয়ে ইতিমধ্যেই আমাদের চমৎকার ও সবিস্তার তথ্য দিয়েছে। এই নভোদুরবিনটি কতটা শক্তিশালী, এটা তারই প্রমাণ।’
তাঁদের আরেক সহকর্মী ও গবেষণাপত্রটির সহ-প্রধান লেখক কার্থিক জি আয়ার বলেন, ‘জেমস ওয়েবের প্রথম ছবিগুলো থেকে মহাবিশ্বের প্রাচীনতম নক্ষত্রপুঞ্জের সন্ধান পাওয়া এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। হাবল টেলিস্কোপ থেকে এরকম ছবি পাওয়া সম্ভব নয়।’
আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে এরকম ১৫০ গ্লোবুলার ক্লাস্টার রয়েছে। কিন্তু কখন ও কীভাবে এরকম ঘনভাবে নক্ষত্রদলের জন্ম হলো, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের সুস্পষ্ট ধারণা নেই। জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা জানেন, এসব গোলকীয় নক্ষত্রপুঞ্জ সুপ্রাচীন। কিন্তু তাদের বয়স আসলে কত, তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা শক্ত। তাছাড়া এত দূরের গোলকীয় নক্ষত্রপুঞ্জের বয়স বের করে তারা প্রথম দিককার প্রাচীন নক্ষত্র কি না, সেটা নির্ণয় করার প্রচেষ্টা এবারই প্রথম। জেমস ওয়েবের আগে এমন কিছু কখনো করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী লামীয়া মওলা বলেন, ‘প্রথম যখন মহাবিশ্বে নক্ষত্র জন্ম হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়, তার কাছাকাছি সময়ই নতুন শনাক্তকৃত এই নক্ষত্রপুঞ্জগুলো গড়ে ওঠে। দ্য স্পার্কলার গ্যালাক্সি আমাদের মিল্কিওয়ে থেকে অনেক দূরে হওয়ায় এটির গোলকীয় নক্ষত্রপুঞ্জগুলোর বয়স নির্ণয় তুলনামূলক সহজ। নয় বিলিয়ন বছর আগে এই স্পার্কলারগুলো যেরকম ছিল, আমরা তাদেরকে সেভাবেই দেখছি। সে সময় মহাবিশ্বের বয়স ছিল মাত্র সাড়ে চার বিলিয়ন বছর। বিষয়টাকে অতিসরলীকরণ করে বলা যায়, একজন মানুষের চেহারা দেখে তার বয়স নির্ণয়ের সঙ্গে। চেহারা দেখে ৫ বছর বয়সী আর ১৫ বছর বয়সী দুজন মানুষের বয়সের পার্থক্য নির্ণয় করা সহজ, কিন্তু ৫০ ও ৫৫ বছর বয়সী দুজনের মধ্যে পার্থক্য করা খুবই কঠিন।’
বলে রাখা প্রয়োজন, জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের আগে হাবলের চোখে দ্য স্পার্কলার গ্যালাক্সির এসব গুটি গুটি বিন্দুর দেখা পাওয়া সম্ভব ছিল না। জেমস ওয়েবের দারুণ রেজ্যুলুশন এবং সংবেদনশীলতার কারনে বর্তমানে এটা সম্ভব। সেজন্যই ওয়েবের প্রথম ডিপ ফিল্ড ছবিতে এই বিন্দুগুলো দেখা গেছে। সেজন্য সাহায্য নেওয়া হয়েছে মহাকর্ষীয় লেন্সিং-এর। দ্য স্পার্কলার গ্যালাক্সির অনেকটা সামনে থাকা, পৃথিবী থেকে ৪.৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের স্ম্যাকস ০৭২৩ গ্যালাক্সির মহাকর্ষ তার আশেপাশের স্থানকালে যে বক্রতা তৈরি করে, তারই সাহায্য নিয়ে বিজ্ঞানীরা এই গুটি গুটি বিন্দুসম নক্ষত্রপুঞ্জগুলোর দেখা পেয়েছেন। আরেকটা মজার বিষয়, স্ম্যাকস ০৭২৩-এর মহাকর্ষীয় লেন্সিং-এর ফলে এই গ্যালাক্সিটির তিনটি আলাদা আলাদা ছবি পাওয়া গেছে, যার ফলে গবেষণার সময় অনেক খুঁটিনাটি তথ্য জানার সুযোগ পেয়েছেন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা।
কানাডিয়ান এই গবেষকদলের নেতা, হার্জবার্গ অ্যাস্ট্রোনমি এন্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস রিসার্চ সেন্টারের ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলের গবেষক ও বিজ্ঞানী ক্রিস উইলট বলেন, ‘জেমস ওয়েবের প্রচণ্ড ক্ষমতার সঙ্গে মহাকর্ষীয় লেন্সিং-এর প্রাকৃতিক বিবর্ধন ক্ষমতা মিলেই আমাদের এই গবেষণা সম্ভব হয়েছে। আমাদের গবেষকরা জেমস ওয়েবের ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণগুলো থেকে মহাবিশ্বকে আরও ভালোভাবে জানার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন।’
এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অনেক গবেষক। গবেষণাটিকে সার্বিক সহায়তা দিয়েছে কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি এবং ন্যাচারাল সায়েন্সেস এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ কাউন্সিল অব কানাডা।
তথ্যসূত্র: সিএএনইউসিএস, নাসা, দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটারস