গ্রহ কী

ছোটদের জন্য সহজ ভাষায় লেখা কঠিন। সহজ কথা যে যায় না বলা সহজে! অথচ একদম সহজ-সাবলীল ভাষায় লেখা এই বই। টেলিস্কোপ কী বলে নামের এ বই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাদুগা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। পাভেল ক্লুশান্‌ৎসেভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন অরুণ সোম। এ বইয়ে প্রচুর ছবি আছে। সেগুলো এঁকেছেন ইয়ে. ভোইশ্‌ভিল্লো, ব. কালাউশিন, ব.স্তারোদুব্‌ৎসেভ এবং ইউ. কিসিলিওভ। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে বইটি প্রকাশিত হচ্ছে…

সন্ধ্যা। সূর্য একেবারে দিগন্তে নেমে এসেছে। ঘনিয়ে আসছে অল্প-অল্প অন্ধকার। কিন্তু আকাশে এখনও বেশ আলো আছে। নীল-গোলাপী আভা ধরেছে আকাশে।

তারপর হঠাৎ তুমি দেখতে পাবে, আকাশে খানিকটা বাঁয়ে সূর্যের ওপরে অলক্ষ্যে জ্বলে উঠল একটা ছোট্ট রুপালি তারা। তারাটা একটু একটু করে আরও উজ্জল হয়ে উঠছে। অন্য তারাদের এখনও আবির্ভাব ঘটেনি। আবির্ভাব ঘটবেই বা কী করে! এখনও যে দিনের আলো আছে। অথচ এই তারাটা একা জ্বলছে একটা বাতির মতো, এমনকি মিটমিটও করছে না।

গোধূলি আসতে না আসতে তারাটা এত উজ্জল হয়ে ওঠে যে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে সে নীচে নামতে থাকে, দেখে মনে হয় যেন তার ভয় পাছে দিগন্তের ওপারে অপসৃত সূর্য থেকে সে পিছিয়ে পড়ে। সম্পূর্ণ অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে সারা আকাশে যখন হাজার হাজার তারা ঝলকে ওঠে তখন আমাদের এই সুন্দরীটি ‘পৃথিবীর ও প্রান্তে’ লুকিয়ে পড়ে।

পরদিন সন্ধ্যাবেলায় আবার দীপ্তি পায়।

এভাবে কাটবে এক মাস, দুই মাস। তারপর এই তারার দীপ্তি ক্রমেই ম্লান হয়ে আসতে থাকবে, শেষকালে তাকে আর চোখেই পড়বে না; কিন্তু কিছু দিন বাদে আবার আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকবে সকালে, প্রত্যুষের গোলাপি কিরণের মাঝখানে। সে আকাশ পথে উঠতে থাকবে—যেন যে-সূর্য শিগগিরই উঠতে চলেছে তাকে পথ নির্দেশ করছে। সব তারা অনেক আগে নিভে গেছে, কিন্তু এটা এখনো জ্বলছে। সূর্য যখন আরও একটু ওপরে ওঠে একমাত্র তখনই সে নিঃশেষে নিভে যায়।

সব নক্ষত্র তাদের নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু কয়েকটা তারা আছে যেগুলো ধীরে ধীরে ‘এক নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আরেক নক্ষত্রপুঞ্জে ভ্রমণ করে’।

রূপালি রঙের এই সুন্দরী তারাটা আসলে কী? আর সব তারাদের চেয়ে এত বেশি উজ্জলই বা সে কেন? কখনো সূর্যকে পথ দেখিয়ে তার আগে আগে কখনও বা সূর্যের পিছে পিছে আকাশ পথে সে বিচরণ করছে কেন?

সব নক্ষত্র তাদের নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে

হাজার হাজার বছর ধরে লোকে মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছে, তাকে কখনো বলে থাকে সন্ধ্যাতারা, কখনো বা শুকতারা। প্রাচীন গ্রিকরা তাদের সৌন্দর্যদেবীর নামে নাম দিয়েছিল ভেনাস, এর সম্পর্কে সুন্দর সুন্দর নানা কাহিনীও রচনা করেছিল তারা। তাদের মনে হয়েছিল এই সুন্দরী কন্যাটি তুষারধবল অশ্বচালিত রূপার রথে আকাশ পথে ভ্রমণ করেন। আচ্ছা আসলে এই শুক্র বা ভেনাস কী?

শুক্র বা ভেনাস কোন তারা নয়, আসলে একটি গ্রহ। গ্রীক ভাষায় গ্রহকে বলা হয় ‘প্ল্যানেট’, যার অর্থ হল ভ্রমণশীল।

সব নক্ষত্র তাদের নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু কয়েকটা তারা আছে যেগুলো ধীরে ধীরে ‘এক নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আরেক নক্ষত্রপুঞ্জে ভ্রমণ করে’। প্রতিবেশী তারাদের দিয়ে তাদের স্থান চিহ্নিত করে কয়েকদিন বাদে যদি যাচাই করে দেখ তাহলে সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল করবে যে তোমার তারাটা ‘সটকে পড়েছে’।

ভ্রমণশীল তারা—গ্রহ—সাদা চোখে লোকে দেখতে পায় পাঁচটি। টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখা যায় আরও বেশি। আচ্ছা, এসো এদের পরিচয় নেওয়া যাক।

কিন্তু এর জন্য আমাদের যাত্রা করতে হয় আরও দূরে মহাকাশে।

গ্রহরা নিজেরা আলো দেয় না। সূর্য জ্বলে বলেই ওরা আলো দেয়

কল্পনা করা যাক, আমরা বিরাট এক রকেটে চড়ে সূর্য থেকে অনেক অনেক দূরে চলে গেছি। এত দূরে যে সূর্য এখন আর আমাদের কাছে একটা হলুদ থালার মতো দেখাচ্ছে না, দেখাচ্ছে স্রেফ একটা খুব জ্বলজ্বলে তারার মতো। এখন দেখ, এই উজ্জল তারাটা মহাকাশে আরও দূরের অন্যান্য তারার মাঝখানে মন্থরগতিতে স্বমহিমায় ভাসতে ভাসতে চলেছে।

এবারে মন দিয়ে সূর্যটাকে একটু দেখা যাক। তার ধারেকাছে আরও কয়েকটি খুব খুদে খুদে তারা লক্ষ করা যায়। চারদিক থেকে সূর্যকে ঘিরে ধরে ওই তারাগুলো তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে।

এবারে আমরা টেলিস্কোপ দিয়ে ওগুলোকে দেখি। প্রতিটি তারা চোখে পড়ছে একেকটা ফালির আকারে, যেন একেকটা খুদে চাঁদ। কারণ সব তারার মতো এরা অগ্নিগোলক নয়, এরা হল অন্ধকার, কঠিন, পাথুরে গোলা—সূর্যের আলোয় আলোকিত মাত্র।

তাদের মধ্যে কতগুলো সূর্যের অনেকটা কাছে, কতগুলো তার থেকে দূরে। আমাদের পৃথিবীও তাদেরই একটি।

গ্রহরা নিজেরা আলো দেয় না। সূর্য জ্বলে বলেই ওরা আলো দেয়। ওরা চাঁদের মতো।

সূর্য নিভে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সব গ্রহও নিভে যাবে।

কোনো গ্রহই কখনো সূর্যকে ছেড়ে যাবে না। তাদের চিরকালের জন্য সূর্যের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা আছে। সবগুলো গ্রহ মিলেমিশে একটা সুখী পরিবার। এই পরিবারের নিয়মশৃঙ্খলা আদর্শ-স্থানীয়। সূর্য হলো পরিবারের প্রধান।

দেখা যাক, গ্রহরা কী ভাবে ঘুরছে। সব গ্রহই ঘুরপাক খাচ্ছে সূর্যের চারধারে। কিন্তু এখান থেকে, দূর থেকে দেখে মনে হয় বুঝি বড় বেশি ঢিমে তালে চলছে; এমনকি মনে হতে পারে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি গ্রহ বছরে কী ধরনের পথ যাত্রা করে তার একটা ছবি আমরা এঁকেছি। ‘চটপটে’ গ্রহ বুধ বছরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চারবার। শুক্রগ্রহ তুলনায় একটু বেশি ‘ধীরস্থির’। ওই সময়ের মধ্যে সে সূর্যের চারদিক ঘুরে আসছে মাত্র দুই বার। পৃথিবী একবার। ‘অলস প্রকৃতির’ মঙ্গল মোটে আধপাক ঘুরতে পারে। বাকিরা তার চেয়েও কম।

গ্রহে গ্রহে কখনই সঙ্ঘর্ষ লাগবে না। মহাকাশে তাদের প্রত্যেকের যার যার যাত্রাপথ আছে, আছে নিজস্ব গতিপথ—যাকে বলে ‘কক্ষপথ’।

কোনো গ্রহই কখনো সূর্যকে ছেড়ে যাবে না। তাদের চিরকালের জন্য সূর্যের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা আছে। সবগুলো গ্রহ মিলেমিশে একটা সুখী পরিবার। এই পরিবারের নিয়মশৃঙ্খলা আদর্শ-স্থানীয়। সূর্য হলো পরিবারের প্রধান। এই কারণে গ্রহ-পরিবারকে বলা হয় সৌরজগৎ।

এবারে ফিরে আসা যাক। চলো যাই গ্রহদের একেবারে ‘গহীনে’। এসো, আমাদের সাধের এই পৃথিবীতে নেমে আসি, যেখান থেকে দেখি অন্যান্য গ্রহদের। তাদের মধ্যে কোনটি পৃথিবীর কাছাকাছি, কোনটি বা দূরে। কোনটি সূর্যের দিকে, কোনটি বা বিপরীত দিকে।

কিন্তু সকলেই অনেক দূরে। এই কারণে আকাশে কোনো গ্রহকেই চাঁদের মতো গোলাকারে দেখা যায় না। তাদের সকলকে দেখা যায় কেবল উজ্জল বিন্দুরূপে। তাই তারার সঙ্গে তাদের গুলিয়ে ফেলা খুব সম্ভব।

বলাই বাহুল্য, সবচেয়ে ভালো দেখা যায় পৃথিবীর কাছাকাছি গ্রহগুলোকে—বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি আর শনি গ্রহকে।

ভালো বাইনোকুলার দিয়ে শুক্র গ্রহকে দেখা যায় একরত্তি কাস্তের মতো, অনেকটা চাঁদের কাস্তের মতো। আর তখনই বুঝতে বাকি থাকে না যে এটা কোনো তারা নয়, এটা হলো এক অন্ধকারাচ্ছন্ন গোলা, যার একটা দিক সূর্যের আলোয় আলোকিত।

বুধকে দেখতে পাওয়া আরও কঠিন। তার গতিপথ সূর্যের বড় কাছাকাছি। আর সূর্য যেহেতু উজ্জ্বল সে কারণে বুধকে চোখে পড়া কঠিন। কেবল মাঝে মাঝে, সূর্য যখন দিগন্তে অন্ত যায়, তখন গোধূলির কিরণে কিছুক্ষণের জন্য দেখা যায় একটা ছোট্ট জ্বলজ্বলে তারা—এটাই বুধ। সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে সূর্যের পেছন পেছন চলেছে, যেন তার ভয় পাছে সূর্যকে না ধরতে পারে; তারপর দেখতে দেখতে দিগন্তের ওপারে মিলিয়ে যায়। কখনো কখনো শুক্রের মতো বুধকেও সকালবেলায় দেখা যায়। শিগগিরই সূর্য যেখানে ওঠার কথা, দিগন্তের ওপার থেকে লাফিয়ে সে চলে আসে সেই জায়গায়, তারপর খানিকটা ওপরে উঠে যায়, কিন্তু আধঘণ্টা বাদেই ঊষার কিরণে মিলিয়ে যায়।

বুধ কখনও ‘স্থির হয়ে বসে থাকতে’ পারে না। সব■গ্রহের মধ্যে সে সবচেয়ে দ্রুতগামী, সবচেয়ে ছটফটে—কখনো এখানে, কখনো ওখানে; এই তাকে দেখা যায়, এই দেখা যায় না।

প্রাচীন গ্রীকরা এই গ্রহটির নাম দিয়েছিল মার্কারি। তাদের কথায়, কারো যদি কোথাও যাওয়ার তাড়া থাকে, তাহলে তাকে মার্কারির কাছে শিক্ষা নেওয়া উচিত। এই কারণে ভ্রমণকারী ও পথযাত্রীরা সকলে মার্কারিকে তাদের গুরু ও পৃষ্ঠপোষক বলে গণ্য করত। সওদাগরেরাও। সওদাগরদের তো সবসময়ই তাড়া থাকত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পসরা যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়ার। যত তাড়াতাড়ি নিয়ে যাবে তত তাড়াতাড়ি বেচতে পারবে, তত তাড়াতাড়ি টাকা পেয়ে যাবে। তাই মার্কারি বাণিজ্যেরও পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়াল।

গ্রহে গ্রহে কখনই সঙ্ঘর্ষ লাগবে না। মহাকাশে তাদের প্রত্যেকের যার যার যাত্রাপথ আছে, আছে নিজস্ব গতিপথ—যাকে বলে ‘কক্ষপথ’

মঙ্গলকে রং দেখে অন্যান্য তারার চেয়ে আলাদা করে চেনা যায়। সাদা-নীলচে তারাদের মধ্যে মঙ্গলকে মনে হয় যেন উজ্জল কমলা রঙের। স্বচক্ষে যাচাই করে দেখতে হলে প্রতিবেশী তারাদের দিয়ে আকাশে তার অবস্থান মনে করে রাখো। কয়েক দিন বাদে লক্ষ করবে কী ভাবে সে সরে গেছে।

রঙের দিক থেকে মঙ্গল আগুনের মতো, ধুনির অগ্নিশিখার মতো। এই কমলারঙের গ্রহটির দিকে তাকিয়ে মানুষের মনে হতো যেন অগ্নিকাণ্ড, যে অগ্নিকাণ্ড যুদ্ধবিগ্রহের সময় তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে।

প্রাচীন গ্রিকরা এই গ্রহটির নাম দিয়েছিল মার্স। মার্সকে তারা ভয় করত। তারা মনে করত, আকাশে তার আবির্ভাব মানেই মানুষের ওপর যুদ্ধে এবং অন্যান্য দুর্বিপাক ঘনিয়ে আসা। কিন্তু সেনানায়করা মার্সকে তাদের পৃষ্ঠপোষক বলে গণ্য করতেন, তাঁরা ভরসা করতেন যে মার্স তাদের শত্রুজয়ে সাহায্য করবেন।

মার্স বা মঙ্গলকে প্রতি বছর দেখা যায় না। সূর্যের চারধার ঘুরে আসতে পৃথিবীর দ্বিগুণ সময় লাগে তার। প্রায়ই এমন হয় যে আমাদের গ্রহ পৃথিবী সূর্যের যে দিকটায় আছে, মঙ্গল আছে তার উলটো দিকে। সেক্ষেত্রে মঙ্গলকে দেখা যায় না। উজ্জ্বল সূর্যালোক বিঘ্ন ঘটায়। দিনের বেলায় নীল আকাশে সূর্যের পাশে কি আর উজ্জ্বল তারাকেও চেনা যায়? অবশ্যই যায় না। কিন্তু মঙ্গল যখন আমাদের দিকটায় থাকে তখন রাতের বেলায় তাকে চমৎকার দেখা যায়। কখনো কখনো সে পৃথিবীর খুব কাছাকাছি চলে আসতে থাকে, তখন সে হয়ে উঠতে থাকে বড় আর জ্বলজ্বলে।

বৃহস্পতি আর তার চন্দ্রমণ্ডলী নিয়ে একটা ছোটখাটো ‘সৌরজগৎ’এর মতো। তাই বাইনোকুলার দিয়ে যখন বৃহস্পতিকে দেখ তখন মাঝখানে সূর্যসমেত আমাদের গ্রহপরিবারকে দিব্যি ধারণা করা যায়।

মঙ্গলকে দেখা যায় কেবল রাতে। দিনের বেলায় সূর্য যে পথ ধরে যায় আকাশের সেই অংশে তাকে খুঁজতে হয়। আকাশের এই অংশে রাতে বৃহস্পতিকেও দেখা যায়। বৃহস্পতি চোখ বাঁধানো উজ্জ্বল সাদা তারা। সত্যিকারের তারাদের সঙ্গে তার তফাত হল এই যে সমস্ত গ্রহের মতো সেও মিটমিট না করে লণ্ঠনের মতো সমান ভাবে জ্বলে।

বৃহস্পতির আকর্ষণ পৃথিবীর তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি

জোরালো বাইনোকুলার দিয়ে বৃহস্পতিকে দেখলে বেশ মজা পাওয়া যাবে। তখন তার দুই পাশে চোখে পড়বে সারি বাঁধা চারটি ছোট ছোট তারা—এত ছোট যে প্রায় নজরেই পড়ে না। মনে করে রেখো ওরা কোথায় আছে এবং কাল, এমনকি সম্ভব হলে আজই কয়েক ঘণ্টা বাদে তাদের দেখার চেষ্টা কর। দেখতে পাবে তারাগুলো জায়গা বদল করেছে। যেটা ছিল বৃহস্পতির বাঁয়ে সেটা এখন তার ডানে। যেটা ছিল কাছে সেটা এখন দূরে সরে গেছে। এরা হলো বৃহস্পতির উপগ্রহ, তার চাঁদ। ওরা বৃহস্পতির চারধারে ঘোরে। যতবার তুমি বৃহস্পতিকে দেখ ততবারই ওদের দেখতে পাবে নতুন জায়গায়।

বৃহস্পতির সবচেয়ে কাছাকাছি যেটা আসে সেটা ঘোরে সবচেয়ে বেশি জোরে।

বৃহস্পতি আর তার চন্দ্রমণ্ডলী নিয়ে একটা ছোটখাটো ‘সৌরজগৎ’এর মতো। তাই বাইনোকুলার দিয়ে যখন বৃহস্পতিকে দেখ তখন মাঝখানে সূর্যসমেত আমাদের গ্রহপরিবারকে দিব্যি ধারণা করা যায়।

শনিও একটা জ্বলজ্বলে সাদা তারা। তবে বৃহস্পতির চেয়ে কিছুটা ম্লান। এটা সবচেয়ে সুন্দর গ্রহ। কেন, তা পরে জানতে পারবে।

সব গ্রহকে একসঙ্গে জড় করে যদি বিরাট একটা রুলারের ওপর সার দিয়ে রাখা যেত তাহলে আমরা দেখতে পেতাম ওদের প্রত্যেকের আকার একেক রকম। কোনো কোনোটি আমাদের পৃথিবীর চেয়ে ছোট, কোনোটি বা অনেক বড়।

সবচেয়ে ছোট গ্রহ বুধ। সবচেয়ে বড় বৃহস্পতি। কিন্তু এই বৃহস্পতি পর্যন্ত সূর্যের চেয়ে বহুগুণ ছোট। সূর্য আমাদের ছবিতে আঁটবেই না। তুলনার খাতিরে আমরা পাশে চাঁদকেও এঁকেছি। চাঁদ বুধের চেয়েও ছোট। দেখতে পাচ্ছ গ্রহগুলো সব কত ভিন্ন ভিন্ন ?

আচ্ছা, তোমরা কি মনে কর বড় হোক ছোট হোক যেকোনো গ্রহে বাস করা একই কথা? নাকি মনে কর বড় গ্রহে বাস করা ভালো? সেখানে বেশি জায়গা আছে বলে? নাকি ছোট গ্রহেই ভালো? বেশ তাড়াতাড়ি ‘ভূপ্রদক্ষিণ’ করা যায়?

দাঁড়াও, আগে ভাগে কোন সিদ্ধান্ত করে বসো না। ব্যাপারটা যেমন মনে হচ্ছে আসলে মোটেই তত সোজা নয়।

গ্রহ যত বড় তত জোরে সমস্ত কিছুকে সে টানে। এই কারণে বড় গ্রহে যেকোনো জিনিসকে মাটি থেকে তোলা বেশি কঠিন। জিনিস অনেক বেশি ভারী মনে হয়।

যেমন ধর বৃহস্পতির আকর্ষণ পৃথিবীর তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। বৃহস্পতিতে আমরা পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েই থাকতে পারতাম না। আমাদের মনে হত আমরা প্রত্যেকে যেন কয়েক কিলোগ্রাম করে সুটকেসের চাপে আছি।

বলাই বাহুল্য, অমন চাপে পড়ে আমাদের পা বেঁকে যাবে। বৃহস্পতির টান যে কেবল আমাদের পক্ষেই সহ্য করা অসম্ভব তা নয়। ইটের পাকা দালান পর্যন্ত বৃহস্পতিতে ধসে পড়ে যাবে। যে ইটের ভিতের ওপর দালান দাঁড়িয়ে থাকে তা পিষে গড়িয়ে যাবে, যেহেতু বৃহস্পতিতে পাঁচতলা দালানের ওজন হবে পনেরো তলার সমান।

ছোট গ্রহে বায়ুর অবস্থাটা রীতিমতো শোচনীয় দাঁড়াচ্ছে। ছোট গ্রহগুলোর বায়ুকে ধরে রাখার মতো যথেষ্ট শক্তি নেই। বায়ু একটু একটু করে তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। এমনকি মঙ্গল গ্রহেও পৃথিবীর তুলনায় বায়ু অনেক কম।

বৃহস্পতিতে ডিজেল ট্রেনের ভারে রেল লাইন দুমড়ে মুচড়ে যাবে, এরোপ্লেনের ডানা ভেঙে পড়বে, বাসের স্প্রিং আর চাকা ফেটে চুরমার হয়ে যাবে। তাহলেই দেখতে পাচ্ছ, বড় গ্রহে বাস করা অত সহজ নয়। সেখানে দরকার ‘ফেরোকংক্রিটের’ মানুষ, ‘ইস্পাতের’ গাছপালা আর ‘পাথরের’ জন্তুজানোয়ার।

আচ্ছা, ঠিক আছে, তাই যদি হয় তাহলে তো ছোট গ্রহগুলোতে বাস করা পরম সুখের বলতে হবে। ছোট গ্রহের টান দুর্বল। সব জিনিসই সেখানে হয়ে যায় হালকা, মনে হয় যেন গ্যাস-বেলুন অবলম্বন করে আছে। সেখানে হাঁটা সহজ, দ্রুত ছোটা যায়, অনেক উচুতে লাফানো যায়। মনে আছে চাঁদের কথা?

দাঁড়াও, দাঁড়াও, অত তাড়াতাড়ি খুশি হয়ে কাজ নেই। ছোট গ্রহে মানুষের ওজন যদি কম হয় তাহলে ইট পাথর এবং অন্যান্য জিনিসেরও তো ওজন কম হবে, তাই না? ছোট গ্রহ পানি এবং বাতাসও খুব কম টানে।

তোমরা ভুলে যাওনি যে পৃথিবী বায়ুর ‘প্রলেপ’ লাগানো? কিন্তু ভেবে দেখেছ কি এই বায়ু কেন পৃথিবীর গায়ে লেগে থাকে? এই দেখ না কেন একটা ফুটবলের গায়ে যদি তামাকের ধোঁয়ার ‘প্রলেপ’ লাগাতে যাও তাহলে ধোঁয়া সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বায়ুও তো ধোঁয়ার মতোই। সেও ছড়িয়ে পড়তে চায়, পৃথিবীর ওপর থেকে ছড়িয়ে চতুর্দিকে চলে যেতে চায়। কিন্তু যায় না কেন? তার একমাত্র কারণ এই যে পৃথিবীর শক্তি আছে, পৃথিবী তার আপন জোরে বাতাস টানে, তাকে নিজের কাছে ধরে রাখে। কিন্তু পৃথিবী একটু দুর্বল হয়ে গেলেই আর দেখতে হচ্ছে না বায়ু সঙ্গে সঙ্গে মহাকাশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে, যেমন ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে তামাকের ধোঁয়া। সুতরাং ছোট গ্রহে বায়ুর অবস্থাটা রীতিমতো শোচনীয় দাঁড়াচ্ছে। ছোট গ্রহগুলোর বায়ুকে ধরে রাখার মতো যথেষ্ট শক্তি নেই। বায়ু একটু একটু করে তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। এমনকি মঙ্গল গ্রহেও পৃথিবীর তুলনায় বায়ু অনেক কম। বায়ু সেখানে একেবারে ‘পাতলা’, ‘হালকা’। বুধে বায়ু নেই বললেই চলে। আর চাঁদের কথা তো তোমরা জানই—সেখানে আদৌ বায়ু নেই। অনেক আগে চাঁদ তার সব বায়ু হারিয়েছে।

ছোট গ্রহগুলোতে বায়ুই একমাত্র সমস্যা নয়। সেখানে পানির অবস্থাও শোচনীয়। সব পানি বাষ্প হয়ে উবে যায়। বিশেষত সূর্য যখন তাকে গরম করে, তখন পানি হয়ে যায় বাষ্প, কুয়াশা, মেঘ। আর কুয়াশা ও মেঘ হলো বায়ুরই অংশ। তাকে যদি শক্ত করে ধরে রাখা না যায় তাহলে মহাকাশে ছড়িয়ে হারিয়ে যায়।

এই কারণে ছোট গ্রহগুলোতে পানিও প্রায় নেই। মঙ্গলে পানি এক আধ ফোঁটা আছে, কিন্তু চাঁদ একেবারে শুকনো খটখটে*। চাঁদে এক ফোঁটাও পানি নেই। এমনকি চাঁদে যদি বালতি করে পানি বয়ে নিয়ে এসে তার পাথরের ওপর ঢালো, দেখতে দেখতে সেই পানির ডোবাটা শুকিয়ে উবে যাবে, বাষ্প ভেসে চলে যাবে মহাকাশে, সেখানে হাওয়া হয়ে ছড়িয়ে পড়বে চতুর্দিকে।

তাহলেই দেখ, যে কোনো গ্রহে বাস করা এক কথা নয়। মোটকথা দাঁড়াচ্ছে, মাঝারি আকারের গ্রহই বসবাসের সবচেয়ে উপযোগী। এই যেমন আমাদের পৃথিবী। অন্ততপক্ষে মঙ্গল।

কিন্তু হ্যাঁ, আমরা কিন্তু তাপের কথাটা এখনো ভেবে দেখিনি। গ্রহগুলো কিন্তু দল বেধে গোল হয়ে সূর্যের চারদিকে ঘোরে না। তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে ঘোরে। কোনো কোনোটা সূর্যের কাছাকাছি, কোনোটা অনেকটা দূরে। সূর্য তার কিরণ দিয়ে গ্রহকে তাপিত করে। সূর্যের তাপ ছাড়া জীবন ধারণ করা সম্ভব নয়। যে কোন চুল্লির মতোই সূর্যও কাছ থেকে জোরাল তাপ দেয়, দূর থেকে ক্ষীণ। পৃথিবী যদি সূর্যের কাছাকাছি চলে আসত তাহলে সমুদ্র তো ডেকচির জলের মতো টগবগ করে ফুটতই, গাছপালাও গরমে জ্বলেপুড়ে যেত। আবার পৃথিবী যদি সূর্য থেকে দূরে সরে যেত তাহলে এত ঠান্ডা হতো যে সমুদ্রের তলা অবধি জমে যেত। পৃথিবীটাও পুরো ঢেকে যেত বরফে। এমনকি গ্রীষ্মকালেও গলত না।

তার মানে একেক গ্রহে একেক রকম ‘আবহাওয়া’। কোনটাতে বেজায় গরম, কোনটাতে বা বেজায় ঠাণ্ডা। তাহলে ‘লাগসই জায়গাটা’ মাঝামাঝি কোথাও হবে নিশ্চয়ই।

দেখা গেছে একমাত্র পৃথিবীই হল সেই ‘লাগসই জায়গা’।

বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপ দিয়ে কোনো একটা গ্রহ দেখেন, দেখতে দেখতে তাঁরা হয়ত লক্ষ করলেন যে গ্রহের কলঙ্কের আকৃতি পালটাচ্ছে। তাঁরা বলেন এর মানে হলো মেঘ।
বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপ দিয়ে কোনো একটা গ্রহ দেখেন, দেখতে দেখতে তাঁরা হয়ত লক্ষ করলেন যে গ্রহের কলঙ্কের আকৃতি পালটাচ্ছে

এমনকি আমাদের প্রতিবেশী যে শুক্র, সেখানেও বেজায় গরম। আবার অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে একমাত্র মঙ্গলে কোনো রকমে বাস করা গেলেও যেতে পারে। কিন্তু সেখানেও বেশ ঠান্ডা, মোটে আরাম পাওয়া যাবে না।

এসো, এবারে আরও কাছ থেকে গ্রহগুলোর পরিচয় নেওয়া যাক।

আকাশে চাঁদ যেমন দেখা যায় টেলিস্কোপ দিয়ে গ্রহগুলোকেও অনেকটা তেমনি দেখা যায়। উজ্জ্বল চক্র আর তার গায়ে কালো কালো দাগ। এরকম একেকটি কলঙ্ক আকারে পৃথিবীর পুরো একেকটি দেশের সমান। এই দেখ না, সবচেয়ে ছোট গ্রহ যে বুধ, সে-ও একটা প্রকাণ্ড গোলক এত বড় যে পায়ে হেঁটে এক বছরেও তার চারদিক ঘোরা যায় না। বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপ দিয়ে কোনো একটা গ্রহ দেখেন, দেখতে দেখতে তাঁরা হয়ত লক্ষ করলেন যে গ্রহের কলঙ্কের আকৃতি পালটাচ্ছে। তাঁরা বলেন এর মানে হলো মেঘ। অর্থাৎ গ্রহের চারদিকে এসে জমেছে বায়ুস্তর আর তার সেই বায়ুস্তরের ভেতরে ভাসছে ধূলাবালি, কুয়াশা ও মেঘপুঞ্জ।

কিন্তু গ্রহের ওপরকার কলঙ্কগুলো যদি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একই রকম থাকে তাহলে বুঝতে হবে মেঘ নয়, গ্রহেরই নিজস্ব কিছু। হয় বিশাল নীল সমুদ্র, নয়ত বিরাট নিবিড় অরণ্য কিংবা কালো কালো শৈলমালা। বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপ দিয়ে আরও দেখতে থাকেন। কালো দাগগুলো যদি সমুদ্রই হয় তাহলে সূর্যকিরণে পানির অন্তত মাঝে মাঝে চিকচিক করার কথা। কিন্তু চিকচিক যদি না করে তাহলে বুঝতে হবে ওটা ‘শুকনো’ জায়গা যেমন, বনজঙ্গল বা পাহাড়-পর্বত।

বিজ্ঞানীরা টেলিস্কোপ দিয়ে কেবল দেখেনই না, তাঁরা টেলিস্কোপের সাহায্যে গ্রহের ছবিও তোলেন। টেলিস্কোপের ওপর নানারকম জটিল যন্ত্রপাতি লাগিয়ে সেগুলোর সাহায্যে গ্রহের তাপমাত্রা মাপেন, জানতে পারেন গ্রহের বায়ু কী দিয়ে গঠিত, গ্রহের পিঠ বালু, পাথর না উদ্ভিদ—কিসে ঢাকা। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই এইভাবে গ্রহদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেছেন। আমরা তাই অনায়াসে কল্পনায় যে কোন গ্রহে ভ্রমণের জন্য যাত্রা করতে পারি।

(চলবে...)

মূল: পাভেল ক্লুশান্‌ৎসেভ

অনুবাদ: অরুণ সোম

* সম্প্রতি চাঁদে পানি পাওয়ার কথা জানিয়েছে চীনের বিজ্ঞানীরা। চীনের পাঠানো চ্যাং ই-৫ নভোযানের সংগ্রহ করা খনিজ পদার্থে পানির আণবিক গঠন পাওয়া গেছে।

'টেলিস্কোপ ও আকাশ' বই থেকে আরও পড়ুন