গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট কী

মহাকর্ষীয় সহায়তা নিয়ে নিজের গতি বাড়ায় নভোযানছবি: নাসা

ব্যাটার দাঁড়িয়ে আছেন। চারপাশে ফিল্ডাররা প্রস্তুত। আম্পায়ার তীক্ষ্ম চোখে খেয়াল করছেন সবকিছু। ফাস্ট বোলার ছুটে আসছেন। বল বেরিয়ে গেল হাত থেকে, গড়পড়তা ঘণ্টায় ১৩২ কিমি বেগে ড্রপ খেল পিচের মাঝখান থেকে খানিকটা সামনে। শর্ট বল। বলে বাউন্স ছিল, লাফিয়ে উঠে পড়ল অনেকটা ওপরে। ব্যাটার অনেক কষ্ট করে মারার চেষ্টা করলেন না। আলতো করে ব্যাট ছুঁইয়ে দিয়ে হালকা বদলে দিলেন বলের গতি। আপারকাট। উইকেটকিপারের কাঁধের ওপর দিয়ে বল ছুটে গেল, ড্রপ খেল বাউন্ডারির একটু সামনে, তারপর পেরিয়ে গেল বাউন্ডারি। আম্পায়ার ডানে-বাঁয়ে হাত নাড়িয়ে সংকেত দিলেন—চার।

এত বড় করে এই ঘটনা বর্ণনা করার কারণটা হয়তো বুঝতে পারছেন শিরোনাম থেকেই। হ্যাঁ, ঠিক এভাবেই কাজ করে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট, যার আরেকটু সুন্দর নাম স্লিংশট। ব্যবহারিকভাবে এর কোনো বাংলা নাম নেই। তবে আমরা একে ‘মহাকর্ষীয় সহায়তা’ বলতেই পারি। বিষয়টা তা-ই—কোনো গ্রহ বা উপগ্রহের মতো মহাজাগতিক বস্তুর সহায়তা নেয় নভোযানগুলো, সেই গতি ব্যবহার করে সামনে ছোট আরও দ্রুত গতিতে, অথবা দিক পাল্টায়, কিংবা গতি কমিয়ে নেয় প্রয়োজনমতো। কাজটা করার পেছনে মূল লক্ষ্য একটাই—অল্প জ্বালানিতে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় গতি তোলা। কথাটা আরও সঠিকভাবে বললে বলা উচিত, লক্ষ্যে পৌঁছাতে গতি বা দিক পাল্টে নেওয়া মহাজাগতিক কোনো বস্তুর সহায়তায়।

১৯৭৭ সালে যাত্রা করে ভয়েজার এক আন্তঃনাক্ষত্রিক স্থানে পৌঁছেছে ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট
ছবি: উইকিপিডিয়া

এ কাজ মানুষ অনেক আগে থেকেই করে আসছে। ইতিহাসে প্রথম গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট বা মহাকর্ষীয় সহায়তা নেয় সোভিয়েত নভোযান লুনা ৩। চাঁদের মহাকর্ষ ব্যবহার করে এর উল্টো যে পাশটি কখনোই পৃথিবী থেকে দেখা যায় না, তার ছবি তোলে নভোযানটি। ইতিহাসখ্যাত মহাকর্ষীয় সহায়তা নিয়েছে ভয়েজার ১ ও ২। মানুষের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দূরত্ব পাড়ি দেওয়া এই দুই নভোযান ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গেছে সৌরজগতের সীমা। ১৯৭৭ সালে যাত্রা করে ভয়েজার এক আন্তঃনাক্ষত্রিক স্থানে পৌঁছেছে ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট। একই সময় যাত্রা করে ভয়েজার ২ সৌরজগতের সীমা পেরিয়ে গেছে ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর। সে জন্য ভয়েজার ১ পেয়েছে বৃহস্পতি ও শনি গ্রহের সহায়তা। আর ভয়েজার ২ পেয়েছে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের সাহায্য।

আরও পড়ুন
কোনো কিছু নভোযানের বেগ কমিয়ে দিতে ষড়যন্ত্র করবে না। বলপ্রয়োগও করবে না। ফলে নভোযানটি ছুটতে থাকবে, সরলরেখায়। আর দিক পাল্টাতে চাইলে জ্বালানি পোড়াবে, জেট ছুড়ে দেবে পেছনের সরু নল দিয়ে—ডানে জেট ছুড়লে নভোযান মোড় নেবে বাঁয়ে, আর বাঁয়ে ছুড়ে দিলে যাবে ডানে।

এসবই ইতিহাস। কিন্তু ঘটনাটা কীভাবে ঘটে? সেটা হয়তো খানিকটা বুঝেছেন পাঠক ওপরের উদাহরণটি থেকে। মহাজাগতিক বস্তুদের এই ঘটনার নেপথ্যে মূল কারিগরের নাম মহাকর্ষ। ব্রিটিশ পদার্থবিদ স্যার আইজ্যাক নিউটন বলেছেন এর মূল কথাটি—মহাবিশ্বের যেকোনো দুটো বস্তু পরস্পরকে আকর্ষণ করে। তবে এই আকর্ষণের নেপথ্যের কারিকুরিটা ফাঁস করে দিয়েছেন আলবার্ট আইনস্টাইন। আপেক্ষিকতার সাধারণ বা সার্বিক তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন, ভারী বস্তু এর আশপাশের স্থান-কাল বাঁকিয়ে দেয়। কালের কথা এ আলোচনায় আপাতত প্রয়োজন নেই মহাকর্ষীয় সহায়তা বোঝার জন্য। কাজেই স্থান ও এতে বস্তুর গতি নিয়ে আলাপেই সীমাবদ্ধ থাকব আমরা।

ভয়েজার ২ সৌরজগতের সীমা পেরিয়ে গেছে ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর
ছবি: উইকিপিডিয়া

পৃথিবীর চারপাশে চাঁদ ঘুরছে। আসলে ঘুরছে না, পড়ছে। মহাকাশে তো কোনো ওপর নিচ নেই। কাজেই চাঁদ সরলরেখা বরাবর ছুটতে চায়, পড়তে থাকে, আর প্রতিমুহূর্তে পৃথিবী তাকে নিজের দিকে টানে। কিংবা বলা চলে—নিজের চারপাশের স্থান বাঁকিয়ে ফেলে। এই বাঁকা পথে পড়তে পড়তে চাঁদ ঘুরে চলে পৃথিবীর চারপাশে। এভাবে চাঁদ একটা উপবৃত্তাকার গতি পায়। একই ঘটনা ঘটে কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর বেলায়। কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে থেকে ঘুরে চলে—একইভাবে।

এই ঘটনাটাই ঘটে, আরেকটু বিস্তৃত পরিসরে, গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্টের ক্ষেত্রে। চাঁদের গতি আর ব্যাটারের ব্যাট চালানোর কারিকুরির কথাটা মাথায় রাখুন। তারপর ভাবুন, একটা নভোযান। ছুটছে। প্রথমে তো একে উৎক্ষেপণ করতে হলো। তারপর সেটা ছিন্ন করল পৃথিবীর বাঁধন। যেকোনো বড় মহাজাগতিক বস্তুর বাঁধন বা মহাকর্ষীয় আকর্ষণ ছিন্ন করার একটা নিয়ম আছে। মুক্তিবেগের চেয়ে বেশি বেগে যেকোনো বস্তুকে ছুড়ে দিতে হয়। মুক্তিবেগ মানে, যে বেগে ছুড়ে দিলে বড় বস্তুটির মহাকর্ষ তাকে আর আটকে রাখতে পারে না।

যেমন আপনি একটা বল ছুড়ে দিলেন ওপর দিকে। পৃথিবী বলটাকে টেনে ফের মাটিতে নামিয়ে আনবে। কিন্তু বলটা যদি এত বেশি বেগে ছুড়ে দেন যে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় আকর্ষণের চেয়েও বলটির বেগ বেশি হয়? তাহলে বলটা আর ফিরে আসবে না। এর নামই মুক্তিবেগ। এটা আমরা সবাই জানি। জানি, পৃথিবীর জন্য এই মুক্তিবেগের মান সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটার। অর্থাৎ এই বেগ বা আরও বেশি বেগে বলটাকে ছুড়ে দিলে সেটা পেরিয়ে যাবে পৃথিবীর মহাকর্ষ।

আরও পড়ুন

তারপর? সেটা ছুটতে থাকবে। নভোযানে জ্বালানির পরিমাণ নির্দিষ্ট। কিন্তু সেটা কোনো সমস্যা নয়। কারণ, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে গেলে আর কোনো বাধা নেই। কোনো কিছু নভোযানের বেগ কমিয়ে দিতে ষড়যন্ত্র করবে না। বলপ্রয়োগও করবে না। ফলে নভোযানটি ছুটতে থাকবে, সরলরেখায়। আর দিক পাল্টাতে চাইলে জ্বালানি পোড়াবে, জেট ছুড়ে দেবে পেছনের সরু নল দিয়ে—ডানে জেট ছুড়লে নভোযান মোড় নেবে বাঁয়ে, আর বাঁয়ে ছুড়ে দিলে যাবে ডানে। এই তো!

পৃথিবীর জন্য এই মুক্তিবেগের মান সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটার। অর্থাৎ এই বেগ বা আরও বেশি বেগে বলটাকে ছুড়ে দিলে সেটা পেরিয়ে যাবে পৃথিবীর মহাকর্ষ
ছবি: উইকিপিডিয়া

কিন্তু যেতে হবে বহু দূর। ভয়েজার ১-এর কথাই ভাবুন। সৌরজগতের সীমা পেরোনো যার লক্ষ্য, তাকে পাড়ি দিতে হবে কত পথ! ভয়েজার ১ পেরিয়ে গেছে ২৩.৩৮১ বিলিয়ন কিলোমিটার। এত পথ যাওয়ার মতো জ্বালানি কোথায়। আর সদ্য পৃথিবী পেরিয়ে সামান্য যে বেগে ছুটছে, তাতে অত পথ পাড়ি দেওয়া কোনো কাজের কথা না। কাজেই, ধার করে নিতে হবে কোনো গ্রহ বা উপগ্রহের মহাকর্ষীয় সাহায্য।

বিষয়টা কিন্তু খুব সহজ। ধরুন, পথে চলতে চলতে সিএনজি হঠাৎ থেমে গেছে। বা গতি উঠছে না ঘণ্টায় ২ কিলোমিটারের বেশি। বাজে অবস্থা। এ সময় কী করতে হয়? টো-ট্রাক ডাকা হয়। সেটা সিএনজিটাকে বেঁধে নিয়ে চলে নিকটস্থ গ্যারাজে। কিংবা পেছন থেকে ধাক্কা দেয় অন্য একটা সিএনজি। কিংবা কোনো বাস। চাইলে ভাবতে পারেন, সেই বাসের পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে—যেটা টো-ট্রাক করে সাধারণত। তারপর টেনে নেওয়া। এই তো!

বৃহস্পতির সঙ্গে এর কক্ষপথের অর্ধেকটা ঘুরবেন নভোযানে। বৃহস্পতির এক বছর মানে পৃথিবীর ৪ হাজার ৩৩৩ দিন। এর অর্ধেক, ২ হাজার দিনই ধরুন, মানে তো প্রায় সাড়ে ৫ বছর! কিংবা চাঁদকে ঘিরেই ঘুরলেন, সেও তো প্রায় এক মাসের ধাক্কা।

ভয়েজার ১ চলে গেল বৃহস্পতির কাছাকাছি। বৃহস্পতি ঘুরছে উপবৃত্তাকার পথে, সূর্যের চারপাশে। বিশাল তার কক্ষপথ। ভয়েজার বা কোনো নভোযান এর কাছাকাছি গেল। মুক্তিবেগের বেশি বেগে না ছুটলে বৃহস্পতির মহাকর্ষীয় জালে আটকা তো পড়তে হবেই। হ্যাঁ, তাই হলো। এবারে নষ্ট সিএনজি যেমন দড়িতে বদ্ধ, অনুসরণ করে ছুটছে বাসের পিছুপিছু, বাস যেদিকে যাচ্ছে, সেও ওদিকে—এভাবেই ভয়েজার বৃহস্পতির উপবৃত্তাকার পথে ছুটল, পিছুপিছু, মহাকর্ষের দড়িতে বাঁধা। বিপুল ভারী গ্যাসদানব গ্রহটি নিজের সবটা মহাকর্ষীয় আকর্ষণে বদলে দিল ভয়েজারের গতিপথ, বাড়িয়ে দিল গতি—ঠিক যেভাবে ফাস্ট বোলারের ছুড়ে দেওয়া বলের গতি বদলে দেন ব্যাটার, সেভাবে। তারপর, লক্ষ্য পূরণ হতেই—পর্যাপ্ত গতি উঠে গেছে বৃহস্পতির সহায়তায়, সঙ্গে বদলেও গেছে দিক—এবারে, খানিকটা জেট ব্যবহার করে বৃহস্পতির জাল ছিড়ে নিজের পথে এগোতে লাগল নভোযানটি।

আরও পড়ুন

এভাবেই মহাকর্ষীয় সহায়তা নিয়ে নিজের গতি বাড়ায় নভোযান। এ জন্য বৃহস্পতি যে পথে ছুটছে, যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকমুখী যাত্রা করতে হয় নভোযানটিকে।

মানবহীন মিশনগুলোতে অবশ্য হরহামেশাই ব্যবহৃত হচ্ছে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট
ছবি: উইকিপিডিয়া

গতি কমাতে চাইলে? যেতে হবে উল্টোপথে। গতি বাড়ানোকে যদি ভাবেন পাহাড়ের ঢালু পথে নিচে ছুটে চলা, তবে গতি কমানোর জন্য ভাবতে পারেন উল্টোটি। ব্রেক আপনাকে করতে হবে না, ঢালু পাহাড়ি পথই সে কাজ করে দেবে। এ ক্ষেত্রে নভোযানের ব্রেকটা চেপে দেয় বৃহস্পতি গ্রহ, মহাকর্ষীয় জালে স্থান-কালজুড়ে ছুড়ানো সে ব্রেক মহাজাগতিক।

কল্পনা হয়তো করতে পারছেন, সঙ্গের ছবিগুলো দেখলে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

ভয়েজার ১ পেরিয়ে গেছে ২৩.৩৮১ বিলিয়ন কিলোমিটার। এত পথ যাওয়ার মতো জ্বালানি কোথায়। আর সদ্য পৃথিবী পেরিয়ে সামান্য যে বেগে ছুটছে, তাতে অত পথ পাড়ি দেওয়া কোনো কাজের কথা না।

এভাবে গতি বাড়াতে-কমাতে বা দিক বদলাতে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্টের জুড়ি নেই। তবে মানবমিশন, অর্থাৎ নভোচারীদের নিয়ে এ ধরনের গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট করা মুশকিল। ধরুন, বৃহস্পতির সঙ্গে এর কক্ষপথের অর্ধেকটা ঘুরবেন নভোযানে। বৃহস্পতির এক বছর মানে পৃথিবীর ৪ হাজার ৩৩৩ দিন। এর অর্ধেক, ২ হাজার দিনই ধরুন, মানে তো প্রায় সাড়ে ৫ বছর! কিংবা চাঁদকে ঘিরেই ঘুরলেন, সেও তো প্রায় এক মাসের ধাক্কা। অত সময় অপচয় করে নভোযানের ভেতরে বসে থাকাটা নভোচারীদের জন্য একটু কঠিনই। কাজেই মানব মিশনে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট ব্যবহৃত হবে কি না আদৌ, সন্দেহ আছে।

মানবহীন মিশনগুলোতে অবশ্য হরহামেশাই ব্যবহৃত হচ্ছে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট। সম্প্রতি বৃহস্পতির উদ্দেশে ছুটে চলা জুস (জুপিটার আইসি মুনস এক্সপ্লোরার) নভোযানও এ কাজ করেছে। মহাকর্ষীয় সহায়তা নিয়েছে চাঁদ থেকে। স্বল্প জ্বালানি খরচ করে বহু দূর দ্রুত গতিতে পাড়ি দিতে চাইলে আসলে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্টের বিকল্প নেই।

সূত্র: নাসা, ইসা, উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন