এক্সোপ্লানেট সমাচার

বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই সৌরজগতের ভেতর ও বাইরে পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য গ্রহের সন্ধান করছেন। সূর্যের মতো বড় তারাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এমন গ্রহকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তাঁরা। এমন গ্রহের বেশিরভাগের আকার এবং ঘনত্ব অনেকটা পৃথিবীর মতোই। এমনকি সেসব গ্রহে পানিকে তরল অবস্থায় ধরে রাখবার মতো কাছাকাছি উষ্ণতাও রয়েছে। এগুলো আসলে এক্সোপ্ল্যানেট বা বহিসৌরগ্রহ। অবশ্য সৌরজগতের বাইরে যেকোনো গ্রহকেই এক্সোপ্ল্যানেট বলে।

প্রথম এক্সোপ্ল্যানেটের সন্ধান পাওয়া যায় গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে। কিন্তু তখন প্রযুক্তি-স্বল্পতার কারণে গ্রহগুলোকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়নি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৯৪৬টি এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

গ্রহগুলোকে শনাক্ত করার অনেক পদ্ধতির মধ্যে ট্রান্সমিট ফটোমেট্রি এবং ডপলার স্পেক্ট্রোসকপি উল্লেখযোগ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একাধিক এক্সোপ্ল্যানেট একটি তারাকে কেন্দ্র করে ঘুরে। ধারণা করা হয়, প্রায় ২০০ বিলিয়ন তারা রয়েছে মিল্কিওয়েতে। সেখানে প্রায় ১১ বিলিয়ন সম্ভাব্য পৃথিবীর মতো আকৃতির বাসযোগ্য গ্রহ থাকতে পারে।

২০১৪ সালে ড্রাউর নামে বিশালাকৃতির একটি এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কৃত হয়। এটি পিএসআর বি১২৫৭+১২এ নামেও পরিচিত। নাসার আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় এক্সোপ্ল্যানেট এইচআর ২৫৬২বি, যা আকৃতিতে বৃহস্পতির প্রায় ৩০ গুণ।

পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের এক্সোপ্ল্যানেট প্রক্সিমা সেন্টিউরাই। এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৪.২ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী নিক্কু মধুসূদন এবং তাঁর সহকর্মীরা নতুন শ্রেণির হ্যাবিটেবল প্ল্যানেটের সন্ধান পান। তাঁদের ধারণা, সেখানে পৃথিবীর মতো সাগরও থাকতে পারে। কিন্তু সেটা যে পৃথিবীর সাগরের মতো হবে, এমনটা ভাববার কোন কারণ নেই। এই গ্রহগুলো আকারে পৃথিবী থেকে বড়। কিন্তু সম্ভবত নেপচুনের চেয়ে ছোট হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, এদের বায়ুমণ্ডল হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ।

মধুসূদন এবং তাঁর সহকর্মীরা পৃথিবীর বাইরের এই জগতের নাম দিয়েছেন হাইসিয়ান। হাইড্রোজেন এবং ওশান বা সমুদ্র, এই দুইটি শব্দের সমন্বয়ে হাইসিয়ান শব্দটির জন্ম। তাঁরা বলেন, এই জগতের আকার পৃথিবীর প্রায় ২.৬ গুণ, যা দশ গুণ পর্যন্ত বেশি হতে পারে।

বিজ্ঞানীরা এই হাইসিয়ান হ্যাবিটেবল জোন নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন। মাতৃনক্ষত্র থেকে এদের এই দুরত্বের কারণেই এমন দূরত্বের গ্রহে তরল পানি পাবার সম্ভাবনা অনেকাংশেই বেড়ে যায়। এই অঞ্চলে সাম্যবস্থায় তাপমাত্রা থাকে অনেক বেশি। প্রায় ২২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রহের একপাশে সবসময় সূর্যের আলো থাকে। সে পাশের তাপমাত্রা অনেক বেশি। অন্যপাশে সূর্যের আলো কম পড়ে। তাই সেখানে তরল পানি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

এই সব গ্রহে আসলেই প্রাণের অস্তিত্ব থাকবার সম্ভব কি-না, এটিই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তাঁরা কি আদৌও কোনো বায়োসিগনেচার দেখাতে সক্ষম? মধুসূদন এবং তাঁর দল এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে চলেছেন।

পৃথিবীতে বায়োসিগনেচার বলতে মূলত অক্সিজেন, মিথেন বা ওজোনকে বোঝায়। এগুলো কোনো না কোনোভাবে প্রাণ ও প্রাণীর সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু হাইসিয়ান জগতে এই উপাদানগুলো যে প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়, তার সাথে প্রাণের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। মূলত অজৈব প্রক্রিয়ায় এখানে এই যৌগগুলো তৈরি হয়। তাই তাদের এই হাইসিয়ান জগতের জন্য বায়োসিগনেচার হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।

পৃথিবীতে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আরও কিছু রাসায়নিক পদার্থের সৃষ্টি হয়। এগুলোকে খুব সহজেই হাইড্রোজেন সমৃদ্ধ আবহাওয়ামণ্ডলে পাওয়া করা যায়। এদের মধ্যে রয়েছে ডাইমিথাইল সালফাইড, ডাইমিথাইল ডাইসালফাইড, মেথানেথিয়ল এবং কার্বানাইলসালফাইড।

টেরিস্ট্রিয়াল গ্রহগুলোর তুলনায় হাইসিয়ান জগৎ অনেক বড় হওয়ায় সহজেই একে নিয়ে গবেষণা করা যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে এমন সম্ভাব্য বেশ কিছু প্রার্থীকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। সেক্ষেত্রে আমরা কে ২-১৮ বি-এর কথা বলতে পারি। এটি পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ৮ গুণ বড়। গ্রহটি আমাদের পৃথিবী থেকে প্রায় ১২৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি লাল বামনকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। বর্তমানে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে গ্রহটির খুঁটিনাঁটি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কে ২-১৮ বি এবং অন্যান্য হাইসিয়ান জগৎ যদি বায়োসিগনেচারের কোন ধরনের চিহ্ন দেখায়, তাহলে আগামী কয়েক বছরের ভেতরেই হয়ত মহাবিশ্বের অন্যত্র প্রথম জীবনের লক্ষণ আমরা খুঁজে পেতে পারি।

এসব এক্সোপ্ল্যানেটের আবিষ্কার আমাদের সামনে বর্হিজাগতিক প্রাণ সন্ধানের নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন সেই সকল গ্রহের ব্যাপারে যা হ্যাবিটেবল জোন এর ভেতর পড়েছে। কারণ সেক্ষেত্রে তরল পানি পাবার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়।

এ ধরনের এক্সোপ্ল্যানেট ছাড়াও কিছু গ্রহ রয়েছে, যারা কোনো তারাকে কেন্দ্র করে ঘোরে না। যেমন, ওয়াইজ ০৮৫৫-০৭১৪ নামের এমনই একটি গ্রহে বিজ্ঞানীরা বহির্জাগতিক প্রাণের আশা করছেন। তবে এ ধরনের হ্যাবিটেবল জোনের গ্রহগুলোতে প্রাণ থাকলে তারাও যে আমাদের মতো করে জীবনধারণ করবে, এমনটা ভাবার কোন যৌক্তিকতা নেই। হয়ত, তাদের গ্রহে অক্সিজেনের পরিবর্তে রয়েছে হাইড্রোজেন, মিথেন, সালফার বা এমন অনেক জানা অজানা মৌল বা যৌগ। হয়ত এসব উপাদান ব্যবহার করেই তারা জীবনধারণ করে চলেছে। হতে পারে, তারা দেখতে আমাদের চেনাজানা প্রাণীর বাহ্যিক রূপ থেকে আলাদা। আমরা চলচ্চিত্র, সায়েন্স ফিকশন, ভিডিও গেমে এলিয়েনদের যে রূপ দেখি তারা এমন নাও হতে পারে। তারা অ্যামিবার মতো এককোষী প্রাণীও হতে পারে।

অদূর ভবিষতে তাদের সম্পর্কে আমরা আরও নতুন কিছু জানতে পারব। এখন ধৈর্য ধরা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেদিন হয়ত বেশি দূরে নয়, যখন মানবজাতি তার কাছের কোন হ্যাবিটেবল জোনের এক্সোপ্ল্যানেটে পাড়ি জমাবে, বসতি গড়বে পৃথিবীর কোন প্রতিবেশির বুকে।

লেখক: সহকারী সার্জন, কুষ্টিয়া

সূত্র: নাসা, বিবিসি