সৌরজগতে সর্বোচ্চ কয়টি গ্রহ থাকতে পারে

সৌরজগতছবি: ফ্রিপিক

সৌরজগতে গ্রহ রয়েছে মোট আটটি—বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন। সূর্যের প্রবল মহাকর্ষ শক্তির কারণে এরা নির্দিষ্ট কক্ষপথে থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সংখ্যাই কি সর্বোচ্চ? নাকি সূর্যকে কেন্দ্র করে আরও বেশি গ্রহ ঘুরতে পারে? এই ধারাবাহিকতায় আরেকটি প্রশ্ন চলে আসে, আমাদের সৌরজগতেই কি সবচেয়ে বেশি গ্রহ আছে?

উত্তর খুঁজতে তাকাতে হবে অন্যান্য গ্রহ ব্যবস্থার দিকে। দ্য এক্সট্রাসোলার প্ল্যানেটস এনসাইক্লোপিডিয়ার তথ্যানুসারে, বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত ৮১২টি ভিন্ন গ্রহব্যবস্থা শনাক্ত করেছেন। বেশির ভাগ গ্রহব্যবস্থায় তিন বা তার বেশি গ্রহ রয়েছে। তবে কেপলার-৯০ গ্রহ ব্যবস্থায় শনাক্তকৃত গ্রহের সংখ্যা আমাদের সৌরজগতের সমান, অর্থাৎ আটটি। সম্ভবত এমন অনেক গ্রহব্যবস্থা আছে, যেগুলোর কক্ষপথে ছোট ছোট গ্রহ আছে। সেগুলো আমরা দেখতে পাই না। আসলে পৃথিবী থেকে অনেক দূরের ছোট গ্রহ শনাক্ত করা কঠিন। তাই আমাদের সৌরজগতই যে সবচেয়ে বেশি গ্রহের আবাসস্থল, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। কিন্তু স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গঠিত গ্রহব্যবস্থায় আটের বেশি গ্রহ থাকা কঠিন।

সূর্যের চারপাশে সর্বোচ্চ কতগুলো গ্রহ ঘুরতে পারে, তা জানতে হলে আমাদের একটু তাত্ত্বিক আলোচনা  করতে হবে। সে জন্য মনে মনে আমরা একটা সৌরজগৎ তৈরি করব। যেহেতু কাজটা করব শুধু মনে মনে, তাই এখানে প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতাগুলো উপেক্ষা করব। চলুন, শুরুতে একটা সৌরজগৎ তৈরির পরিকল্পনা করা যাক।

আমাদের নিজেদের তৈরি এই সৌরজগতে গ্রহ তৈরির জন্য অসীম পরিমাণ উপাদান থাকবে এবং সেগুলো কৃত্রিমভাবে নিজের ইচ্ছামতো বসানো যাবে। উপগ্রহ, গ্রহাণু, ধূমকেতু এবং অন্যান্য যত বাধা আছে, সব দূর করা সম্ভব।

পরিকল্পিতভাবে একটা সৌরজগত তৈরি করতে হলে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করতে হবে। সেগুলোর একটা তালিকা করি।

১. নক্ষত্রের আকার

২. গ্রহের আকার

৩. গ্রহের ধরন (গ্রহ পাথুরে হবে নাকি গ্যাসীয়)

৪. প্রতিটি গ্রহের চারপাশে উপগ্রহের সংখ্যা

৫. বড় গ্রহাণু ও ধূমকেতুর অবস্থান (বৃহস্পতি ও মঙ্গলের মাঝে যেমন গ্রহাণু বেষ্টনী, নেপচুনের বাইরে কুইপার বেল্ট)

৬. গ্রহগুলোর কক্ষপথের দিক 

৭. গ্রহ তৈরির জন্য সূর্যের গঠন থেকে অবশিষ্ট পদার্থের পরিমাণ। মানে সূর্যের জন্মের সময় যে উপাদানগুলো অবশিষ্ট ছিল, তা থেকে নতুন গ্রহ গঠনের সম্ভাবনা। 

স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যেভাবে সৌরজগত গঠিত হয়, তাতে কোটি কোটি বছর ধরে বিভিন্ন সংঘর্ষ এবং মহাকর্ষীয় প্রভাব কাজ করে। এরপর একটি স্থিতিশীল কাঠামো তৈরি হয়। কিন্তু আমরা যেহেতু অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন সৌরজগৎ তৈরি করব, তাই অনেক সীমাবদ্ধতা পাশ কাটিয়ে সৌরজগতে আরও বেশি গ্রহ রাখার ব্যবস্থা করব।

আরও পড়ুন

আমাদের নিজেদের তৈরি এই সৌরজগতে গ্রহ তৈরির জন্য অসীম পরিমাণ উপাদান থাকবে এবং সেগুলো কৃত্রিমভাবে নিজের ইচ্ছামতো বসানো যাবে। উপগ্রহ, গ্রহাণু, ধূমকেতু এবং অন্যান্য যত বাধা আছে, সব দূর করা সম্ভব। শুধু দুটি সীমাবদ্ধতা আমরা মেনে নেব। এক, গ্রহ ও সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি স্বাভাবিক থাকবে; দুই, গ্রহগুলোকে এমনভাবে ঘুরতে হবে যাতে তারা পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে না জড়ায়।

প্রথমে গ্রহের আকার দিয়ে শুরু করা যাক। একটি গ্রহকে গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার তিনটি শর্ত আছে—

১. এটি সূর্যের চারপাশে ঘুরতে হবে। 

২. গ্রহটির ভর এত বেশি হতে হবে যে নিজ মহাকর্ষীয় বলের কারণে সেটি গোলাকার হবে। 

৩. গ্রহটি নিজ কক্ষপথের আশপাশের অন্যান্য বস্তু সরিয়ে ফেলতে পারবে। 

প্লুটোকে একসময় গ্রহের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে প্লুটোর গ্রহত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। বামন গ্রহ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এটিকে। কারণ ওপরের শেষ শর্তটি প্লুটো পূরণ করতে পারেনি।

যাই হোক, আমাদের কৃত্রিম সৌরজগতে সর্বোচ্চ কতগুলো গ্রহ জায়গা দিতে পারব, তা নির্ভর করে সূর্যের চারপাশে কতগুলো স্থিতিশীল কক্ষপথ তৈরি করা যায়, তার ওপর। একটি পরিকল্পিত সৌরজগতে সর্বাধিক গ্রহকে জায়গা দিতে চাইলে গ্রহগুলোর কক্ষপথের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত কক্ষপথের দূরত্ব খুব কমে গেলে গ্রহগুলোর মহাকর্ষীয় টানাপোড়েন তাদের কক্ষপথকে অস্থির করে তোলে। ফলে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে অথবা সৌরজগৎ থেকে ছিটকে যেতে পারে। একে বলা হয় কক্ষপথের অস্থিতিশীলতা।

গ্রহের আকার পরিবর্তন ছাড়াও আরও একধরনের সৌরজগতে বেশি গ্রহকে জায়গা দেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী কক্ষপথ ব্যবহার করতে হবে

একটি স্থিতিশীল গ্রহ ব্যবস্থায় কক্ষপথের নূন্যতম দূরত্ব কতটুকু হতে হবে, তা নির্ভর করে হিল ব্যাসার্ধের ওপর। একটি গ্রহের চারপাশে যত দূর পর্যন্ত তার মহাকর্ষ প্রভাব বিস্তৃত থাকে, সেটাই ওই গ্রহের হিল ব্যাসার্ধ। বৃহস্পতির মতো বিশাল গ্রহগুলোর হিল ব্যাসার্ধ অনেক বেশি হয়। তাই এর কক্ষপথের সঙ্গে অন্য গ্রহগুলোর কক্ষপথের দূরত্বও অনেক বেশি। ছোট গ্রহের ক্ষেত্রে এই দূরত্ব কমে যায়। ফলে একই স্থানে বেশি গ্রহ রাখা সম্ভব।

একটা উদাহরণ দিই। আমাদের সৌরজগতে যদি বৃহস্পতি গ্রহ না থাকত, তাহলে ওটার জায়গায় পৃথিবীর সমান আরও অন্তত ১০টি ছোট গ্রহ থাকতে পারত। অর্থাৎ আমাদের কৃত্রিম সৌরজগতে ছোট আকৃতির গ্রহ ব্যবহার করলে বেশি গ্রহকে জায়গা দেওয়া যাবে।

গ্রিক এবং ট্রোজান নামে বৃহস্পতির দুটি গ্রহাণু গুচ্ছ আছে। এই গ্রহাণুগুলো বৃহস্পতির কক্ষপথ ধরেই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন, গ্রহগুলোও একইভাবে কক্ষপথ ভাগ নিতে পারে।

তবে গ্রহের আকার পরিবর্তন ছাড়াও আরও একধরনের সৌরজগতে বেশি গ্রহকে জায়গা দেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী কক্ষপথ ব্যবহার করতে হবে। মানে গ্রহগুলোর ঘূর্ণনের দিক পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের সৌরজগতের প্রায় সব গ্রহ সূর্যকে একই দিকে প্রদক্ষিণ করে। কারণ এই গ্রহগুলো একটা নির্দিষ্ট ঘূর্ণনশীল ধূলিকণার মেঘ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তবে শুক্র ও ইউরেনাস অবশ্য উল্টোদিকে ঘোরে। এভাবে কল্পিত সৌরজগতে আমরা বিকল্প কিছু গ্রহকে বিপরীত দিকে ঘোরাতে পারি। একে বলে ‘রেট্রোগ্রেড কক্ষপথ’। দুটি গ্রহ বিপরীতমুখী হলে তারা হয়তো পরস্পরের কাছাকাছি আসবে। কিন্তু একে অপরের ওপর খুব অল্প সময়ের জন্য মহাকর্ষীয় প্রভাব ফেলতে পারবে। তা ছাড়া গ্রহ  দুটি বিপরীত দিকে ঘোরার কারণে এদের মহাকর্ষ শক্তিও কিছুটা দুর্বল হয়ে যাবে। এভাবে কক্ষপথের নিরাপদ দূরত্ব আরও কমানো সম্ভব। এতে সৌরজগতে আরও বেশি গ্রহকে জায়গা দেওয়া যাবে।

আরও পড়ুন

আমরা এতক্ষণ ধরে নিয়েছি, কৃত্রিম সৌরজগতের প্রতিটি কক্ষপথে একটি করে গ্রহ থাকবে। কিন্তু একই কক্ষপথে একাধিক গ্রহও থাকতে পারে। গ্রিক এবং ট্রোজান নামে বৃহস্পতির দুটি গ্রহাণু গুচ্ছ আছে। এই গ্রহাণুগুলো বৃহস্পতির কক্ষপথ ধরেই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন, গ্রহগুলোও একইভাবে কক্ষপথ ভাগ নিতে পারে। কৃত্রিম সৌরজগতে গ্রহের সংখ্যা বাড়াতে চাইলে যত বেশি সম্ভব ট্রোজান গ্রহকে জায়গা দিতে হবে। 

ভাবছেন, সর্বোচ্চ কতটি ট্রোজান গ্রহ একটা কক্ষপথে জায়গা দেবেন? সে চিন্তা আমাদের না করলেও চলবে। একটি কক্ষপথে সর্বোচ্চ কতগুলো গ্রহ থাকতে পারবে, তা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ২০১০ সালে হিল ব্যাসার্ধ ব্যবহার করে বের করেছেন। এই গবেষণা তখন প্রকাশিত হয়েছিল নেদারল্যান্ডসের সেলেস্টিয়াল মেকানিকস অ্যান্ড ডায়নামিকক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি জার্নালে। এই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, একটি কক্ষপথে পৃথিবীর আকারের ৪২টি গ্রহ থাকতে পারে। গ্রহের আকার যত ছোট হবে, কক্ষপথে তত বেশি গ্রহ বসানো যাবে। 

তবে প্রাকৃতিকভাবে এতগুলো গ্রহের একটি কক্ষপথ ভাগ করার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। কারণ প্রতিটি গ্রহকে একই আকারের হতে হবে এবং একই সময়ে গঠিত হতে হবে যাতে সেগুলো স্থিতিশীল থাকে। কিন্তু কৃত্রিম সৌরজগতে এ  ধরনের শর্তের বালাই নেই। 

দ্য এক্সট্রাসোলার প্ল্যানেটস এনসাইক্লোপিডিয়ার তথ্যানুসারে, বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত ৮১২টি ভিন্ন গ্রহব্যবস্থা শনাক্ত করেছেন। বেশির ভাগ গ্রহব্যবস্থায় তিন বা তার বেশি গ্রহ রয়েছে।

তাহলে আমাদের কৃত্রিম সৌরজগতে সর্বোচ্চ কয়টি গ্রহকে জায়গা দিতে পারব? গবেষক শন রেমন্ড একটি কম্পিউটার মডেল তৈরি করে দেখিয়েছেন, আমরা যদি কৃত্রিমভাবে একটি সৌরজগৎ তৈরি করি, তাহলে সেখানে পৃথিবীর আকারের সর্বাধিক ২ হাজার ৩৯৪টি গ্রহ থাকতে পারে। কিন্তু যদি আমাদের গ্রহগুলোর আকার পৃথিবীর দশ ভাগের এক ভাগ হয়, তাহলে গ্রহ রাখা যাবে ১০ হাজার ৭৬৯টি। আর যদি চাঁদের আকারের গ্রহ রাখি,  তাহলে আঁটানো যাবে ৬৫ হাজার ৮১৩টি। এই সিমুলেশনে রেমন্ড কৃত্রিম সৌরজগৎ বিস্তৃত করেছেন ১ হাজার অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট বা সৌরজাগতিক দূরত্ব পর্যন্ত। আমাদের সৌরজগতের শেষসীমা হিসেবে পরিচিত হেলিওস্ফিয়ারের দূরত্ব সূর্য থেকে প্রায় ১০০ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট (এইউ)। অর্থাৎ রেমন্ডের কাল্পনিক সৌরজগত আমাদের বাস্তব সৌরজগতের চেয়ে ১০ গুণ বড়! আপনি চাইলে একে আরও বড় কল্পনা করতে পারেন। আর এই মডেলে কিন্তু সব গ্রহের আকার সমান ধরা হয়েছে এবং বিপরীতমুখী কক্ষপথও ব্যবহৃত হয়েছে।

কৃত্রিম সৌরজগতের প্রতিটি কক্ষপথে একটি করে গ্রহ থাকবে। কিন্তু একই কক্ষপথে একাধিক গ্রহও থাকতে পারে

প্রিয় পাঠক, বুঝতেই পারছেন—এটা নিছক এক কল্পনার খেলা। প্রকৃতিতে এত বিশৃঙ্খল সৌরজগৎ গঠিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে এই বিশ্লেষণ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, সৌরজগতে মাত্র আটটি গ্রহ থাকার পেছনে প্রকৃতির কঠোর নিয়ম রয়েছে। আমরা যতই কল্পনায় সৌরজগৎ সাজাই না কেন, প্রকৃতি শেষ পর্যন্ত তার নিজস্ব নিয়মেই চলে।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স ডটকম

আরও পড়ুন