সৌরজগতের কয়টি গ্রহের বলয় আছে 

শনি গ্রহছবি: সংগৃহীত

সৌরজগতের সবচেয়ে সুন্দর গ্রহ কোনটি? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য হয়তো খুব বেশি সময় নিতে হবে না। অবশ্য এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে তর্কযোগ্যভাবে শনিকে সৌরজগতের সবচেয়ে সুন্দর গ্রহ বলা যায়। কেন? কারণ এর আছে অনিন্দ্য সুন্দর বলয় বা রিং। এই বলয়ের কারণেই শনি গ্রহ চিনতে কারো অসুবিধা হয় না। ছবি দেখলেই চট করে বলে দেওয়া যায়। এটা শনির গ্রহের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এ বৈশিষ্ট্য যে আরও কিছু গ্রহের আছে, তা কি জানেন? 

এক-দুটো নয়, সৌরজগতের ৪টা গ্রহের বলয় আছে। কিন্তু সেগুলো শনির মতো এত উজ্জ্বল নয়। সে সম্পর্কে একটু পরে আসছি। বিজ্ঞানীদের মতে, অতীতে সম্ভবত পৃথিবীর বলয় ছিল। আবার, ভবিষ্যতে বলয় তৈরি হতে পারে মঙ্গল গ্রহের। এ লেখায় সে সব বিষয় নিয়েই একটুখানি জানার চেষ্টা করব। 

মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা ছোট্ট বিষয় জানা দরকার। কোনো গ্রহের চারপাশে কেন বলয় তৈরি হয়। তারও আগে জানতে হবে, বলয় আসলে কী? অনেক বস্তু যদি একটা নির্দিষ্ট বড় বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে, তাহলে সেগুলো দূর থেকে দেখতে বলয় কিংবা রিংয়ের মতো লাগে। যেমন শনি গ্রহ। এর চারপাশে অসংখ্য ছোট-বড় পাথর ও বরফখণ্ড রয়েছে। সেগুলোর আকৃতি টেনিস বল থেকে শুরু করে বিশালাকার বাসের মতো। এগুলো সবসময় শনি গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। অনেকটা পৃথিবীর চাঁদের মতো। তবে সবগুলো কিন্তু উপগ্রহ হিসেবে স্বীকৃত নয়। সে ভিন্ন বিষয়। প্রসঙ্গে ফিরি।

সৌরজগতে চারটি গ্রহের বলয় আছে। সেগুলো হলো শনি, বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুন। খেয়াল করলে দেখবেন, চারটি গ্রহই গ্যাসীয় এবং তুলনামূলক বড়।

আসলে সাধারণত গ্রহ যত বড়, তার মহাকর্ষ বল তত শক্তিশালী। কারণ, যে বস্তুর ভর যত বেশি, তার মহাকর্ষ বলও তত বেশি হয়। আর মহাকর্ষ বল বেশি হলে বড় বস্তুটির (গ্রহ) চারপাশে ঘুরতে বাধ্য হয় অন্যান্য ছোট বস্তু। তাই বড় বড় গ্রহের চারপাশে উপগ্রহ, বরফ ও পাথরখণ্ড বেশি থাকে। এগুলোকেই দূর থেকে দেখতে বলয়ের মতো লাগে। 

আগেই বলেছি, সৌরজগতে চারটি গ্রহের বলয় আছে। সেগুলো হলো শনি, বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুন। খেয়াল করলে দেখবেন, চারটি গ্রহই গ্যাসীয় এবং তুলনামূলক বড়। এদের চারপাশে উপগ্রহও সবচেয়ে বেশি। তবে শনির মতো অন্য গ্রহ তিনটির বলয় কিন্তু সেভাবে দেখা যায় না। কারণ এগুলোর বলয় অনেক পাতলা এবং বলয়ের মাঝে ফাঁকা জায়গা অনেক বেশি। শনির বলয়ের মাঝেও ফাঁকা জায়গা রয়েছে। তবে তুলনামূলক কম।

সৌরজগতের চারটি গ্রহের বলয় আছে
ছবি: সংগৃহীত

এবারে গ্রহগুলোর বলয় সম্পর্কে একটু জানা যাক। 

শনির বলয় সম্পর্কে কম-বেশি সবাই জানেন। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলি প্রথম শনির বলয় পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না গ্যালিলিওর টেলিস্কোপটি। তিনি শনির দুটি বড় উপগ্রহ থাকার কথাও বলেছিলেন। এরপর ১৬৫৫ সালে ডাচ বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস প্রথম শনির বলয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত করেন। তখনও এ বলয় সম্পর্কে মানুষের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন, এ বলয় একক কোনো কঠিন পদার্থে তৈরি। এগুলো যে অনেকগুলো ছোট বড় পাথর ও বরফের সমষ্টি, তা তাঁরা বুঝতে পারেননি। বিষয়টি পরে ১৬৭৫ সালে আবিষ্কার করেন জিওভান্নি ক্যাসিনি।

প্রথমে শনির একক বলয়ের ধারণা করা হলেও এখন বিজ্ঞানীরা জানেন, শনির চারপাশে আসলে ৭টি বলয় রয়েছে। এ ছাড়াও কিছু ছোট বলয়ও আছে।

প্রধান বলয়গুলোকে ইংরেজি অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হয়। সবচেয়ে কাছ থেকে দূরের বলয়গুলোর নাম যথাক্রমে ডি, সি, বি, এ, এফ, জি ও ই। বলয় আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে এমনভাবে সাজানো হয়েছে। এসব বলয়ের মাঝে রয়েছে বিশাল ফাঁকা স্থান। যেমন এ ও বি বলয়ের মাঝের ফাঁকা স্থানের নাম ক্যাসিনি ডিভিশন। আবার এ ও এফ বলয়ের মাঝের ফাঁকা স্থানের নাম রোশ। মূল বলয়গুলো শনি গ্রহ থেকে প্রায় ৭৩ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। 

বৃহস্পতি গ্রহ
ছবি: নাসা

সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতি। কিন্তু তারপরেও এর চারপাশের বলয় স্পষ্ট বোঝা যায় না। আসলে বৃহস্পতির যে ছবি আমরা দেখি, তাতেও নেই বলয়ের চিহ্ন। আসলে ১৯৭৯ সালে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ভয়েজার ১ নভোযান বৃহস্পতির চারপাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণাই ছিল না, বৃহস্পতির বলয় আছে। কারণ সেটি এত ক্ষীণ যে পৃথিবীর মাত্র হাতেগোনা কয়েকটা বড় টেলিস্কোপ ছাড়া দেখার উপায় নেই। অবশ্য এ গ্রহের বলয় দেখতে বেশির ভাগ সময় ব্যবহৃত হয় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। 

বৃহস্পতির বলয়ে মোট চারটি রিং আছে। প্রধান রিং, হ্যালো রিং, গসামের রিং ও হিমালিয়া রিং। বৃহস্পতির রিংগুলো প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। হ্যালো রিংয়ের পুরুত্ব ১২ হাজার ৫০০ কিলমিটার। সে তুলনায় প্রধান রিংয়ের পুরুত্ব অনেক কম। মাত্র ৩০ কিলমিটার।

ইউরেনাসের রয়েছে ১৩টি সংকীর্ণ রিং। ১৯৭৭ সালে বলয়গুলো প্রথম আবিষ্কৃত হয়। তবে এ গ্রহের রিংগুলো ছোট পাথরের টুকরো দিয়ে গঠিত। আসলে ইউরেনাসের রিংগুলো সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও বিস্তারিত জানেন না। তাই কিছুটা রহস্য এখনও রয়ে গেছে। ভবিষ্যতে আরও উন্নত টেলিস্কোপ আবিষ্কার হলে কিংবা ইউরেনাসের উদ্দেশে কোনো নভোযান পাঠালে এ রহস্যের সমাধান হতে পারে। 

ইউরেনাসের মতো বলয় আছে নেপচুনেরও। মোট ৬টি চিকন রিং। ১৯৮৪ সালে এ গ্রহের রিংগুলো সম্পর্কে প্রথম জানা যায়। এরপর ১৯৮৯ সালে ভয়েজার ২ মিশনের সাহায্যে এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যায়। তবে অন্য গ্রহের রিংগুলোর চেয়ে এ গ্রহের রিংয়ে ধুলোবালুর পরিমাণ বেশি।

নেপচুন গ্রহ
ছবি: সংগৃহীত

মজার বিষয় হলো, অতীতে পৃথিবীতেও ছিল একটা ছোট্ট বলয়। প্রায় সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে পৃথিবীর গঠনকালে এ রিং ছিল। থিয়া নামে একটি গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষ হয়েছিল বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। তখনই পৃথিবীর চারপাশে এই দুই গ্রহের অনেক ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। সেগুলো দিয়েই তৈরি হয়েছিল রিং। যদিও সে রিং শনি গ্রহের মতো স্পষ্ট বা বড় ছিল না। পরে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় টানে সেই রিং একত্রিত হয়ে তৈরি হয় চাঁদ। 

ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহের চারপাশে রিং দেখার সম্ভাবনা আছে। মঙ্গলের উপগ্রহ ফোবোস ধীরে ধীরে মঙ্গলের কাছে চলে আসছে। এই উপগ্রহটির কক্ষপথ ক্ষয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এখন থেকে ৭ কোটি বছর পরে উপগ্রহটি মঙ্গলের এত কাছে চলে আসবে যে মঙ্গলের মধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে ফোবোস। সেই ধ্বংসাবশেষেই তৈরি হবে মঙ্গলের রিং। যে রকমটা পৃথিবীর ক্ষেত্রে ঘটেছিল অতীতে। 

সবশেষে বলা যায়, বর্তমানে সৌরজগতের চারটি গ্রহের বলয় আছে। অতীতে পৃথিবীর বলয় ছিল এবং সেই বলয় একত্রিত হয়ে তৈরি হয়েছে বর্তমানের চাঁদ। আর ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে ঘটবে ঠিক উল্টো ঘটনা। মঙ্গলের চাঁদ ধ্বংস হয়ে তৈরি হবে বলয়। ভবিষ্যতে উন্নত টেলিস্কোপ ও মহাকাশযানের প্রভাবে আমরা হয়তো এই রিংগুলো সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারব।

লেখক: সদস্য, সম্পাদনা দল, বিজ্ঞানচিন্তা 

সূত্র: দ্য প্লানেটস ডট অর্গ, হাউ স্টাফ ওয়ার্কস, ইউনিভার্স টুডে ডট কম ও  কুলকসমস

এই সিরিজের আরও লেখা পড়ুন

১. সৌরজগতের আদ্যপান্ত

২. সূর্য পরিচয়

৩. সূর্যে এঁটে যাবে ১৩ লাখ পৃথিবী!

৪. সূর্য কত বড়

৫. সূর্যের চারপাশে ঘুরতে কত সময় লাগবে

৬. সূর্য কতটা গরম

৭. সৌরপৃষ্ঠ থেকে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেশি কেন?

৮. সূর্য কি ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে পারে

৯. সূর্য কত দূরে

১০. সূর্য কতটা ভারী

১১. বুধ গ্রহ কত দূরে

১২. সূর্যের বয়স কত

১৩. বুধ গ্রহ কত বড়

১৪. ২৪ ঘন্টায় কেন একদিন হয়

১৫. পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কত

১৬. কোন গ্রহে কত দিনে বছর হয়

১৭. কোন গ্রহে আপনার ওজন কত

১৮. কুইপার বেল্ট: বামন গ্রহের তীর্থস্থান, থাকতে পারে গ্রহও