কম্পাসের পয়েণ্ট

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর সম্পর্ক। পৃথিবী ও আকাশ নামের এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…

বোনার পাতলা ছুঁচ একটা জোগাড় করে আপেলের মধ্যে এমন ভাবে ঢোকাও যাতে ঠিক মাঝে হয়ে যায়। সবচেয়ে ভালো হলো বৃন্তের কাছে ঢুকিয়ে দেওয়া। তাহলে আপেলের অক্ষ হবে ছুঁচটা, অক্ষদণ্ডের ওপরে যেমন চাকা ঘোরে তেমন ভাবে এর ওপর আপেলটাকে ঘোরানো যাবে। আপেল নড়বে, অক্ষ কিন্তু নিশ্চল।

যেখানে ছুঁচ ঢুকেছে এবং যেখান থেকে ফুঁড়ে বেরিয়েছে, সেগুলো হলো মেরু। উত্তর ও দক্ষিণ মেরু। বৃন্তের পয়েণ্টাকে বলা যাক উত্তর মেরু। তাহলে দুটো মেরুর মধ্যে তফাৎটা স্পষ্ট থাকবে। এখন আপেলের মধ্যখান ঘিরে এমনভাবে একটা লাইন টানো যাতে দুটি মেরু থেকে দূরত্ব সমান থাকে। এটা হলো ভূ-বিষুবরেখা, এটি আপেলকে দুই গোলার্ধে ভাগ করেছে। উত্তর মেরুর গোলার্ধ উত্তর গোলার্ধ আর অন্যটি দক্ষিণ গোলার্ধ।

পিজবোর্ডের একটি ক্ষুদে মানুষ বানিয়ে ভূ-বিষুবরেখার ওপরে রাখো উত্তর মেরুর দিকে মুখ করে বা আরও সহজে বলতে গেলে, উত্তরমুখো করে। লোকটার ডান হাত পূর্ব দিকে থাকবে, বাঁ হাত পশ্চিম দিকে।

এবার উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত একটা লাইন টানো। এটির নাম মেরিডিয়ান বা মধ্যরেখা, অর্থাৎ মধ্যদিনের রেখা। নামটা এল কোথা থেকে? আপেলে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু ঘিরে একটা সুতো জড়ানো সহজ, কিন্তু পৃথিবীর বেলায় নয়। সেটা করতে গেলে বিশ হাজার কিলোমিটার লম্বা একটা সুতো নিয়ে যেতে হবে উত্তুঙ্গ পাহাড়, সমুদ্র ও মরুভূমি পেরিয়ে। যা-ই হোক, ছোট একটা মধ্যরেখা টানা যায় এভাবে:

আরও পড়ুন
খুঁটির দিকে পিছন ফিরে আর গজালের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে তুমি দেখবে উত্তর দিক, দক্ষিণ দিক থাকবে তোমার পেছনে, ডানে পূর্ব আর বাঁয়ে পশ্চিম। কম্পাসের চারটে প্রধান পয়েণ্ট বের করার উপায় হলো এটা।

লম্বা একটা খুঁটি এমনভাবে মাটিতে বসাও যাতে একেবারে খাড়া হয়ে থাকে। তারপর দরকার হলো রোদের দিনে খুঁটিটির ছায়ার নড়ন দেখা। সকালে ছায়া হবে দীর্ঘ, তারপর সূর্য উঠলে ক্রমশ ছোট হতে থাকবে। মধ্যদিনে (দিনের মাঝামাঝি সময়ে) সবচেয়ে ছোট, তারপর আবার দীর্ঘ হওয়ার পালা।

ছায়া যখন সবচেয়ে ছোট তখন একটা গজাল মাটিতে পোঁতো। গজাল থেকে খুঁটি পর্যন্ত লাইন টানলে সেটা হবে মধ্যরেখার একটা অংশ; উত্তর গোলার্ধে তোমার বাস হলে খুঁটিটা হবে তোমার লাইনের দক্ষিণ প্রান্ত আর গজালটা উত্তর প্রান্ত। লাইনটার নাম মধ্যরেখা বা মধ্যদিনের রেখা, কেননা মধ্যদিনে তুমি সেটা টেনেছো।

খুঁটির দিকে পিছন ফিরে আর গজালের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে তুমি দেখবে উত্তর দিক, দক্ষিণ দিক থাকবে তোমার পেছনে, ডানে পূর্ব আর বাঁয়ে পশ্চিম। কম্পাসের চারটে প্রধান পয়েণ্ট বের করার উপায় হলো এটা। এদের মধ্যখানে অন্যান্য পয়েণ্টও আছে উত্তর-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পশ্চিম।

দিকনির্ণয়

স্থল ও জলপথের যে সব যাত্রীদের দিকনির্ণয় বিষয়ে আরও সঠিক হতে হয়, তারা এদের মধ্যে আরও অনেক পয়েণ্ট বসায়, যেমন উত্তর-উত্তর-পূর্ব, পূর্ব-উত্তর-পূর্ব ইত্যাদি। কথাগুলোর অর্থ তোমাদের কাছে এখন সহজবোধ্য হয়েছে মনে হয়।

কিন্তু মেঘলা বা বাদলা দিনে দিকনির্ণয় চলে কেমন করে? তখন কম্পাসের চুম্বক কাঁটা ব্যবহার করতে হয়—এর একটা দিক উত্তরমুখী, অন্যটা দক্ষিণ। কম্পাসের ছোট গোল কার্ডে সব কটা পয়েণ্ট বসানো আছে—সেজন্য তাদের নাম কম্পাসের পয়েণ্ট।

নির্মেঘ রাত্রে ধ্রুবতারার দিকে তাকিয়ে কম্পাস বিনাই উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম বের করা চলে।

উত্তর গোলার্ধের বাসিন্দাদের কাছে একটি নক্ষত্রমণ্ডল পরিচিত, এর নাম সপ্তর্ষিমণ্ডল বা বড়ো ভালুক। অবশ্য চেহারাটা মোটেই ভালুকের মতো নয়, বরং হাতাওয়ালা বাটির মতো। আগেরদিনে লোকে বলত বড় হাতা, সবচেয়ে যুতসই নাম বোধহয় সেটা।

আরও পড়ুন
কাজাখরা মজার নাম দিয়েছে বড় ও ছোট ভালুকের। আগে তারা ছিল রাখালিয়া লোক, ভেড়া, উট আর ঘোড়া পালন করে জীবিকা চালাত। ভাবত আকাশেও পশুপালক আছে। নিশ্চল ধ্রুবতারাকে তারা বলত খাঁটি, যে খুঁটিতে ৬টা ঘোড়া অর্থাৎ ছোট ভালুকের অন্য নক্ষত্রগুলো বাঁধা।

হাতার শেষ দুটো তারার মাঝখান দিয়ে একটা লাইন যদি টানো এবং আরো পাঁচ গুণ এগিয়ে নিয়ে যাও, তাহলে সেটা প্রায় ধ্রুব বা উত্তর তারার মধ্য দিয়ে যাবে।

ধ্রুবতারা কখনো স্থান পরিবর্তন করে না। আর সব তারা এটিকে প্রদক্ষিণ করে যেন তাদের কেন্দ্র এটি, কিন্তু ধ্রুবতারা নিজের জায়গায় অটল।

উত্তর দিক দেখিয়ে দেয় ধ্রুবতারা। এর মুখোমুখি দাঁড়ালে কম্পাসের অন্য সব পয়েণ্ট বের করা চলে।

অন্য একটি নক্ষত্রপুঞ্জের—ছোট ভালুক বা শিশুমারের শেষ তারা হলো ধ্রুবতারা। শিশুমারের আকার অনেকটা সপ্তর্ষির মতো।

কাজাখরা মজার নাম দিয়েছে বড় ও ছোট ভালুকের। আগে তারা ছিল রাখালিয়া লোক, ভেড়া, উট আর ঘোড়া পালন করে জীবিকা চালাত। ভাবত আকাশেও পশুপালক আছে। নিশ্চল ধ্রুবতারাকে তারা বলত খাঁটি, যে খুঁটিতে ৬টা ঘোড়া অর্থাৎ ছোট ভালুকের অন্য নক্ষত্রগুলো বাঁধা। সারা রাত তারা খুঁটির চারপাশে ঘোরে আর স্বর্গের ঘাস খায়। বড় ভালুক বা সপ্তর্ষির যে সাতটি তারা সারা রাত খুঁটি আর ঘোড়ার চারপাশে চক্কর দেয় তাদের তারা বলত সাত ঘোড়াচোর—স্বর্গের ঘোড়া চুরির মতলব তাদের।

আকাশে ধ্রুবতারাকে বের করতে শিখলে পরে কাজ দেবে।

(চলবে…)

মূল: আলেকজান্ডার ভলকভ, অনুবাদ: সমর সেন

* পাঠকের সুবিধার্থে বইয়ের মূলভাব ঠিক রেখে বানানরীতির কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।

‘পৃথিবী ও আকাশ’ বই থেকে আরও পড়ুন