পৃথিবী ও আকাশ: ভূগোল ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের কথা

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর সম্পর্ক। আকাশ ও পৃথিবী নামের এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…

পূর্ণিমার সময় খোলামেলা জায়গায় গিয়ে রাতের আকাশের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখ। চাঁদের নরম রূপালী আলোয় পৃথিবী প্লাবিত, কিন্তু সে আলো সূর্যালোকের চেয়ে অনেক ক্ষীণ। কাছাকাছির জিনিস চোখে পড়ে, কিন্তু দূরের জিনিস নীলাভ আবছায়ায় অস্পষ্ট।

আকাশ আলো জোগায়, চাঁদও। আশপাশের তারাগুলো সে উজ্জ্বল আলোয় চোখে পড়ে না, এমন কি দূরের তারাগুলোকেও চাঁদহীন রাতে তত উজ্জল দেখায় না। আবহাওয়া ভালো থাকলে রাতের আকাশ প্রকৃতির অপরূপ একটি দৃশ্য চাঁদের ঝকঝকে মুখ, কালো আকাশে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হাজার হাজার তারার ফুলকি দেখে আশ মেটে না।

তারপর দিগন্তের দিকে নামতে শুরু করে চাঁদ, শেষ পর্যন্ত একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়। অন্ধকার আকাশে দেখা দেয় নতুন সব নক্ষত্র, মনে হয় তাদের জৌলস বেড়ে গেছে।

মূল বইয়ের প্রচ্ছদ

আকাশ দেখার সবচেয়ে ভালো সময় হলো গ্রীষ্মের উষ্ণ রাতে নদীর তীরে ছিপ নিয়ে বসে বা খোলা মাঠে নিঃসঙ্গ টিলায় শুয়ে। সংক্ষিপ্ত রাত কেটে যায় তাড়াতাড়ি, পূর্বদিকে উষার রক্তাভা। একের পর এক তারাগুলো মিলিয়ে যায়। সবচেয়ে উজ্জলগুলো টিকে থাকে সবচেয়ে বেশি।

দূরে পূর্বের দিগন্তে ওঠে সূর্যের প্রান্তদেশ। চোখ ধাঁধানো আলোয় সূচনা হয় আর একটি নতুন দিনের। আকাশের দিকে তাকিয়ে আদিমকাল থেকে মানুষ মনে মনে কত না প্রশ্ন করেছে! মাথার ওপরে এই যে বিরাট মণ্ডল, কী সেটি? স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো শক্ত কোনো জিনিসের তৈরি? মণ্ডলের প্রান্তদেশ কি পৃথিবী হয়েছে? অগণিত দপদপে তারাগুলোই বা কি? যেমন দেখায় সত্যি কি তেমন ছোট ওগুলো? ওগুলো কি আকাশমণ্ডলে আবদ্ধ না স্বাধীনভাবে চলে?

তারাগুলোর মধ্যে চাঁদের বিহার কেন? কেন তার আকার বদলে যায় মাঝেমধ্যে চাকতির মতো, কখনো আবার বাঁকা কান্তে, কখনো একেবারে অগোচর?

গ্রীষ্মকালে সূর্য কেন অনেক ওপরে ওঠে আর পৃথিবীকে উত্তাপ জোগায়, আর শীতে দিগন্তের কাছাকাছি থেকে তাড়াতাড়ি মুখ ঢাকার চেষ্টা করে, যেন তুষারাবৃত মাঠ আর বরফে ঢাকা নদী দেখা তার অনিচ্ছা?

নক্ষত্র নিয়ে যার কারবার সেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের বয়স অত্যন্ত প্রাচীন। গ্রিক শব্দ এ্যাস্টন অর্থাৎ তারা এবং নমোস অর্থাৎ নিয়ম থেকে অ্যাস্ট্রোনমি কথাটার উদ্ভব।

আমাদের আদিপুরুষেরা কেন আকাশ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, কেন তাঁরা গতি নিয়ম আবিষ্কারের প্রয়াস করেছেন? এতে তাঁদের কী ফয়দা?

মূল বইয়ের ভেতরের এক পৃষ্ঠার ছবি

এ নিরীক্ষা শুধু যে কাজের তা নয়, বরং অপরিহার্য। অনেক অনেক দিন আগে লোকে চাষ ও পশুপালন শুরু করে। কখন বসন্ত আসবে, কখন শুরু হবে গ্রীষ্ম, কখন দেখা দেবে বৃষ্টি, হেমন্ত—তা না জানলে চলতো না পশুপালকের ও চাষীর। আর তাই সূর্যের ওপর নজর রাখতে আরম্ভ করলো মানুষ। বেশ ওপরে উঠেছে সূর্য, গরম লাগছে তার মানে শীত শেষ, উজ্জল উষ্ণ বসন্ত দিনের শুরু।

সূর্যের গতিবিধি নিরীক্ষার যথেষ্ট কারণ ছিল প্রাচীন মিশর, চীন ও ভারতের লোকেদের। এ সব দেশে অনেক বড় নদী রয়েছে। কূল ছাপিয়ে তারা মাঠে রেখে যায় উর্বর পলি। নদী উপত্যকার বাসিন্দেদের সঠিক জানা দরকার ছিল কখন বন্যা আসবে। শুধু বীজ বপনের প্রস্তুতির জন্য নয়, বন্যার হাত থেকে জিনিসপত্র, পশু, এমনকি ঘরবাড়ি বাঁচানোর তাগিদেও।

সাধারণ লোকের পক্ষে, পশুপালক বা চাষীর পক্ষে এ নিরীক্ষা চালানো সম্ভব নয়; এ কাজের ভার ছিল পুরোহিতদের ওপর। তাই পুরোহিতরা হলো প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানী। নক্ষত্রগুলোর গতি নজরে রেখে তারা বলতো কখন বন্যা নামবে, কখন সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই দখলের কারণে জনগণের ওপর জোর কর্তৃত্ব ছিল পুরোহিতদের। এতো ক্ষমতাবান তারা ছিল যে রাজারা পর্যন্ত তাদের মেনে চলত।

শুধু পশুপালক ও চাষী নয়, সমুদ্রে বা স্থলপথে দূরের যাত্রীরা নক্ষত্র নিয়ে মাথা ঘামাত। দিনের বেলায় তাদের পথ দেখাত সূর্য আর রাতে তারার আলো। জ্যোতির্বিজ্ঞানের দৌলতে প্রাচীন পৃথিবীর প্রথম মানচিত্র তৈরি করতে পারে পুরাকালের মানুষ। এমন কি এখনো এ বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে সঠিক মানচিত্র। এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে মহাশূন্য বিজ্ঞানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে লোকিক প্রয়োজনের।

(চলবে…)

* পাঠকের সুবিধার্থে বইয়ের মূলভাব ঠিক রেখে ভাষাগত কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।