মহাকাশ
পৃথিবীর শেষ কোথায়
ছোটদের জন্য সহজ ভাষায় লেখা কঠিন। সহজ কথা যে যায় না বলা সহজে! অথচ একদম সহজ-সাবলীল ভাষায় লেখা এই বই। টেলিস্কোপ কী বলে নামের এ বই রাশিয়ার রাদুগা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। পাভেল ক্লুশান্ৎসেভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন অরুণ সোম। বইয়ে প্রচুর ছবি আছে। সেগুলো এঁকেছেন ইয়ে. ভোইশ্ভিল্লো, ব. কালাউশিন, ব.স্তারোদুব্ৎসেভ এবং ইউ. কিসিলিওভ। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে বইটি প্রকাশিত হচ্ছে…
গ্রীষ্মকালে মাঠে দিব্যি লাগে! ফুলের সুগন্ধ, নির্মল বায়ু আর চারধারে অনেক অনেক দূর পর্যন্ত চোখে পড়ে।
আর যদি ছুটে কোনো টিলার ওপর গিয়ে উঠতে পারো, তাহলে দেখতে পাবে আরও অনেক দূর। ওই ওখানে মাঠের শেষ। মাঠের ওপারে ঘন বন। পাশে ঝলমল করছে সরোবর, এঁকেবেঁকে পথ চলে গেছে। তারও পরে আবার মাঠ, অন্য একটা মাঠ। আর তার ওপারে সম্ভবত আবার বন, আবার পথ, সরোবর, নদী, নগর।
মনে হয় পৃথিবীটা যেন একটা বিশাল চ্যাপ্টা গোল রুটি—তাই না?
আর এই রুটিটার মাথার ওপর ছেয়ে আছে আকাশ, যেন একটা বিশাল ছাউনি। দিনের বেলায় ছাউনিটা দেখায় নীল, রাতের বেলায় কালো। আর তার গায়ে একে একে জ্বলে ওঠে তারা—যেন দূরের বাতি।
থিয়েটার হলের মাথার ওপরকার ছাদটা বড় বটে। কিন্তু তার সঙ্গে এ ছাউনিটার কোনো তুলনাই চলে না। এটা হাজার হাজার গুণ বড় আর উঁচু।
এই ছাউনিটা দেখে মনে হয় যেন গোল, একটা বিশাল গম্বুজের মতো। যেন এর কানাগুলো সোজা এসে স্পর্শ করেছে এই চ্যাপ্টা রুটিটাকে—আমাদের পৃথিবীকে। আর পৃথিবীর বুকে যদি একটা দিক ধরে খুব বেশিক্ষণ হাঁটা যায়, তাহলে বুঝি একসময় আমরা সেই জায়গাটায় পৌঁছে যেতে পারব, যেখানে আকাশ পৃথিবীর সঙ্গে এসে মিলেছে। ঠিক এরকমই একটা বর্ণনা আছে ‘কুঁজো টাট্টু’ রূপকথায়:
...কাছে নাকি দূরে, নিচে না ওপরে
কোথা দিয়ে কোথা জানা নেই, ওড়ে।
যে-কথাটা শুধু বলি শোনো জানা—
ঘোড়া নাকি ছুট দিল মেলে ডানা
সেথায়, যেখানে শুনি লোকমুখে
আকাশ মিলেছে পৃথিবীর বুকে।
কিষানীরা সেথা সুতো কাটা হলে
চরকা যে যার আকাশেতে তোলে।
উঠল আকাশে ইভান সেথায়,
ধরা জননীরে জানিয়ে বিদায়।
চলল যেন সে রাজার কুমার,
উৎসাহ, তেজ ধরে নাক আর!
আহা, সত্যিই যদি এমনটা হতো! দিব্যি চললে আপন মনে পৃথিবীর বুকে হাঁটতে হাঁটতে, একটা পাহাড়ের ওপর গিয়ে উঠলে, কিংবা কোনো একটা ছোট্ট নালা ডিঙোলে—ব্যস, তারপরই চললে মেঘমুলুকের ভেতর দিয়ে। ওপর থেকে কেবল তারিফ করো বন আর মাঠের, তার মধ্য থেকে খুঁজে বের করো তোমার বাড়ি।
আফসোসের কথা, এটা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রাচীনকালে লোকে মনে করত সম্ভব। সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করত। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত, আকাশ হলো একটা বিরাট উপুড় করা পেয়ালা। আর পৃথিবীটা এক বিশাল চাপাটি, যে-কোনো চাপাটির মতো তারও কিনারা আছে। বলা বাহুল্য, এর পরে, ‘পৃথিবীর সীমানার ওপারে’, ‘আকাশের অন্য ধারে’ কী আছে—এসব জানতে বড় কৌতূহল হতো তাদের।
কিন্তু পায়ে হেঁটে, গাড়িতে চেপে মানুষ যত দূরেই যাক না কেন, ‘পৃথিবীর সীমানা’ দেখার সাধ্যি তার কোনো কালেই হলো না—এমনকি দূর থেকেও না।
লোকে তখন এটাই ধরে নিল, এই যে চাপাটি-আকারের জিনিসটার ওপর আমরা বাস করি, সেটা সম্ভবত অনেক বড়। হয়তো অনেক দূরে, উঁচু উঁচু পাহাড়-পর্বতের ওধারে, বনজঙ্গল ও সাগর-মহাসাগর ছাড়িয়ে কোথাও তার কিনারা আছে এবং ‘কুঁজো টাট্টুর’ সাহায্য ছাড়া ওখানে পৌঁছানো খুব কঠিন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের কৌতূহল যাবার নয়। লোকে ভাবল, আচ্ছা, চাপাটিমাত্রেই তো কিছু-না-কিছুর ওপরে থাকে—শূন্যে তো আর ঝুলতে পারে না! এমন কথা ভাবলেও হাসি পায়। তার মানে, পৃথিবীও কিছু না কিছু একটার ওপরে আছে। কিন্তু কীসের ওপরে যে আছে, সেটা কোনোমতেই জানা গেল না।
এদিকে আবার মাঝে মাঝে ভূমিকম্প হওয়ায় ব্যাপার আরও ঘুলিয়ে যায়। পৃথিবী তখন দুলতে থাকে, পাহাড়-পর্বত ফেটে যায়, ধসে পড়ে; সমুদ্রের বিরাট বিরাট ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরের ওপর। তোমার গায়ের কম্বলের ওপরে যদি কয়েকটা বেড়ালছানা থাকে, আর তুমি যদি কম্বলের নিচে হঠাৎ পাশ ফিরে শুতে যাও, তখন তাদের যে দশা হয়, ভূমিকম্পের সময় মানুষের অবস্থাটাও হয় সেরকম।
এ থেকে লোকের ধারণা হলো, পৃথিবী হয়তো অবস্থান করছে শক্তিশালী ও প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড দৈত্য-দানবের পিঠের ওপর। ওই দৈত্য-দানবেরা যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে, ততক্ষণ সব ঠিক আছে; কিন্তু যে মূহূর্তে তারা নড়েচড়ে ওঠে, তখনই শুরু হয় ভূমিকম্প।
লোকে এই সিদ্ধান্তে এল যে, পৃথিবী অবস্থান করছে তিনটি প্রকাণ্ড তিমির ওপর। কেননা তিমির চেয়ে বড় কোনো প্রাণী দুনিয়ায় নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, পৃথিবী যদি তিমির ওপর অবস্থান করে, তাহলে তিমি অবস্থান করছে কীসের ওপর?
লোকে মনে মনে ভাবল, তিমি মহাসাগরে সাঁতার কাটে। তিমিরা যে চিরকালই মহাসাগরে সাঁতার কাটে! আচ্ছা, মহাসাগর তাহলে কীসের ওপরে আছে?
আছে পৃথিবীর ওপর।
আবার বলা হচ্ছে কি না, পৃথিবী আছে তিমির ওপরে?
না, না, এটা যেন কেমন গোলমেলে ঠেকছে। এর কোনো শেষ নেই। এ যেন মুরগী আর ডিমের গল্পের মতো—কোনটা আগে, কোনটা পরে?
তখন লোকে বলতে শুরু করল, ‘পৃথিবী আছে তিনটি তিমির ওপরে—এই হলো মোদ্দা কথা। এটা যদি তোমার যথেষ্ট বলে মনে না হয়, তাহলে যাও, নিজে গিয়ে দেখে এসো।’
আজকের দিনে আমাদের দৃষ্টিতে যত হাস্যকরই মনে হোক না কেন, সেকালে লোকে কিন্তু এসব আজগুবি গল্পে বিশ্বাস করত; কারণ লোকে স্পষ্ট ভাবে কিছুই জানত না। আর এমন কেউ ছিলও না যার কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে।
প্রাচীনকালে মানুষ পৃথিবীর বুকে বড় বড় দূরত্ব পাড়ি দিতে পারত না। রেলগাড়ি আর অ্যারোপ্লেন তো দূর, পথঘাটই ছিল না। না ছিল মোটরগাড়ি, না জাহাজ। এই কারণে তিমি-সংক্রান্ত গল্পকথার সত্যতা যাচাই করে দেখার জন্য যে ‘পৃথিবীর শেষপ্রান্তে’ যাবে, সে উপায়ও ছিল না।
তা সত্ত্বেও লোকে একটু-আধটু করে ভ্রমণ করতে লাগল। উটের পিঠে চেপে তারা বেশ দূর দূর জায়গার অভিযানে যেতে শুরু করল, বড় বড় নৌকায় চেপে নদ-নদী ও সাগর-মহাসাগর পার হতে লাগল।
পথ যাতে গোলমাল না হয়, তার জন্য ভ্রমণকারীরা এখন থেকে তাদের পায়ের নিচে না তাকিয়ে মাথার ওপরের আকাশ দেখে। নইলে সমুদ্রের বুকে যেখানে চারদিকে কেবল পানি আর পানি, সেখানে লোকে কী করেই-বা পথ খুঁজে পাবে? কিংবা ধরো, মরুভূমিতে যেখানে চারদিকে কেবল বালি আর বালি—একই বালি? কিন্তু সূর্য, চন্দ্র ও তারা কী সাগরে, কী মরুভূমিতে—সর্বত্রই দেখা যায়। দেখা যায় বনজঙ্গলের ভেতর থেকে, এমনকি পাহাড়ের খাদের তলা থেকে। তা ছাড়া সূর্য-চন্দ্র-তারা সব সময় নিজের নিজের জায়গায় আছে। এই সময় ‘ধ্রুবতারা’ কথাটির উদ্ভব।
সূর্য-চন্দ্র-তারা সব সময় একই পথে আকাশে চলে। যেমন ধরো, এমন কখনই হয় না যে, সূর্য চলে গেল পেছনে, ডান দিক থেকে বাঁয়ে; কিংবা চাঁদ উঠে আকাশে স্থির হয়ে থেকে গেল; অথবা তারাগুলো লাফিয়ে অন্য জায়গায় গিয়ে উঠল। প্রতিদিন, প্রতিবছর সূর্য-চন্দ্র-তারা আকাশপথে চলে ধীরস্থির শান্ত গতিতে, ঘড়ির কাঁটার মতো।
বজ্রবিদ্যুৎ, ঝড়ঝক্কা, তুফান—যা-ই হোক না কেন, সূর্য-চন্দ্র- তারার তাতে কিছুই আসে যায় না, কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ওরা ঠিক কাঁটায় কাঁটায় আকাশপথে চলে বেড়ায়।
লোকে মনে মনে ভাবল, আকাশের ওপারে কোথাও হয়তো খুব জটিল ও মাথাওয়ালা কোনো যন্ত্র লুকানো আছে। এই যন্ত্রটা হয়তো ঘড়ির যন্ত্রব্যবস্থার মতো। সেখানে হয়তো পাহাড়প্রমাণ বিশাল বিশাল খাঁজকাটা চাকা ধীরে ধীরে ঘুরছে। আর ওগুলোই এই প্রকাশ্য ভারী জিনিসটাকে—তারাদল-সমেত গোটা আকাশকে স্বচ্ছন্দ গতিতে ঘুরিয়ে পৃথিবীর মাথার ওপর তোলে। আকাশটা নিশ্চয়ই বেজায় ভারী। যা প্রকাণ্ড!
আহা, একবার যদি ‘পৃথিবীর শেষপ্রান্তে’ পৌঁছানো যেত, কোনো কিছু দিয়ে আকাশটা ফুটো করে একবার যদি দেখা যেত, ওখানে কী আছে! কী দারুণই না হতো!
তোমরা হাসবে না। লোকে কিন্তু সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করত যে আকাশের ওধারে এইরকম ‘চাকা’ আছে।
কিন্তু সে যাই হোক না কেন, লোকের মনে এই ধারণাই বদ্ধমূল হয়ে গেল যে আকাশে চিরকাল পরিপূর্ণ নিয়মশৃঙ্খলার রাজত্ব চলছে এবং জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর ওপর নির্ভর করা যায়—এরা কখনও মানুষকে ডোবাবে না। এই বিশ্বাসের ফলে মানুষের পক্ষে দূর দূর দেশে যাত্রা সম্ভব হলো।
যেমন দিনের পর দিন অন্তগামী সূর্যের দিক লক্ষ করে চলেছে ভ্রমণকারীরা, তারা জানে যে সর্বক্ষণ চলেছে একই দিকে, আর বলাই বাহুল্য ভুল তাদের কখনো হতো না।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে যখনকার কথা বলছি, সেই সময় না ছিল দিগদর্শনযন্ত্র, না কোনো মানচিত্র, না আলোকস্তম্ভ।
এই ভাবে তারার দিকে দৃষ্টি রেখে ভ্রমণ করতে গিয়ে লোকে এক অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করল।
লোকে হয়তো তাদের জন্মস্থান থেকে উটের পিঠে চড়ে বেরিয়েছে দূর যাত্রায়, কোনো একটা উজ্জ্বল তারাকে যাত্রার সময় মনে করে রেখেছে; পথে যাত্রীদের একদিন-দুদিন করে সপ্তাহ কাটে, ওরা লক্ষ করে যে প্রতি রাতেই ওদের সেই তারাটা দিকচক্রবালের আরও বেশি ওপরে দেখা যাচ্ছে। দেখে-শুনে মনে হয় যাত্রীরা চ্যাপ্টা সমতল ভূমির ওপর দিয়ে যাচ্ছে না, যেন একটা বিশাল গড়ানে টিলা পার হয়ে চলেছে, যত সামনে চলেছে, ততই তার ওপারে আরও বেশি দূরে তাদের চোখে পড়ছে। আবার বাড়ি ফেরার পথে ঘটে তার উল্টোটা—তারাটা রোজই একটু একটু করে নিচে নামছে, মনে হয় যেন ওরা ভারাটা থেকে টিলার ওপারে ফিরে চলে যাচ্ছে।
লোকে তখন বিবেচনা করল, তাহলে একটা বিশাল গোল রুটির মতো পৃথিবীর পিঠটাও ফোলা, বাঁকানো।
আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, দেখা গেল সমুদ্রের পানিও ওই রকম বাঁকানো। কেবল সমুদ্রযাত্রী নাবিকেরা নয়, সমুদ্রতীরে বসবাসকারী লোকেরাও এটা লক্ষ করে। জাহাজ যখন সমুদ্রের বুকে যাত্রা করে, তখন সেখান থেকে লক্ষ করলে তারা সব সময় প্রথমে দেখতে পায় গোটা জাহাজটা, তারপর কেবল জাহাজের পাল, পরে কেবল মাস্তুলের মাথা। আর সব শেষে জাহাজটা একেবারে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায়। মনে হয় যেন পাহাড় পেরিয়ে ওধারের ঢাল বয়ে নেমে গেল।
কোনো সমুদ্র বা হ্রদের ধারে দাঁড়ালে তোমরা নিজেরাও অনায়াসে এটা যাচাই করে দেখতে পারো। তবে হ্যাঁ, খেয়াল রাখতে হবে পানি যেন শান্ত থাকে, বড় বড় ঢেউ যেন না থাকে। পানির দিকে নিচু হয়ে জাহাজের ওপর নজর রাখবে। দেখবে, পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে জাহাজের নিচের অংশ পানিতে ঢাকা পড়ে যেতে শুরু করেছে। আর ডজন কয়েক কিলোমিটার দূরে যাওয়ার পর একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল।
এই কারণে দুরবিন দিয়ে দেখা ভালো। সমুদ্র যে উত্তল, এটা মেনে নেওয়া সে কালের মানুষের কাছে শক্ত ছিল। কিন্তু শেষ কালে না মেনে আর উপায় রইল না। এরপর থেকে লোকে পৃথিবীকে আর চ্যাপ্টা চাপাটি বলে ভাবে না; এখন তাদের ধারণ্য হলো পৃথিবীটা একটা অর্ধগোলকের মতো, আর তার পিঠটা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সমুদ্র দিয়ে ‘লেপা’।
কিন্তু অর্ধগোলক হলেও তার প্রান্ত তো থাকবে। অথচ লোকে সমুদ্রের বুকে কত দূরে গেছে, পায়ে হেঁটে কত দূর দূর দেশেই না ভ্রমণ করেছে, কিন্তু কারও পক্ষেই ‘পৃথিবীর শেষপ্রান্ত’ নামে অভিশপ্ত জায়গাটা দেখা সম্ভব হয়নি। এমনকি দূর থেকেও না।
আরও একটা ব্যাপারে লোকে মাথা ঘামিয়ে কূল পায় না। আচ্ছা, সূর্য-চন্দ্র-তারা—এরা তো রোজ কোথায় যেন নেমে যায়, পৃথিবীর ও প্রান্তে ডুব দেয়, আবার পরদিন অন্য দিক থেকে উঠে আসে। শুধু তা-ই নয়, এমন কখনই ঘটে না যে পৃথিবী যার ওপর ভর দিয়ে আছে, সেই ঠেকনাটার গায়ে ধাক্কা খেয়ে ওরা আটকে গেল। তারাগুলোও সবাই যে যার জায়গায় আছে। আর সূর্য ও চাঁদ এরাও ঠিক সময়মতো নিয়মিত পূর্ব দিকে উঠছে।
লোকে তখন ভাবতে শুরু করল, আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে, পৃথিবীর ঠেকনা বলে আদৌ কিছু নেই?
পৃথিবীটাও অর্ধগোলক নয়, আসলে একটা গোলক? আর এই গোলকটা কোনো এক মায়াবলে বিনা অবলম্বনে ঝুলছে?
তা-ই যদি হয়, তাহলে পৃথিবীর কোনো কিনারা নেই কেন? কেনই-বা সূর্য রাতের বেলায় অমন স্বচ্ছন্দে পৃথিবীর নিচে চলে যায়—এসব রহস্যের সমাধান অনায়াসে হয়ে যায়।
দুর্বোধ্য থেকে যায় কেবল একটা জিনিস—পৃথিবীর ওপাশে মানুষ তাহলে কী অবলম্বন করে আছে? তাদের তো মাথা নিচের দিকে করে ঝুলে থাকার কথা!
শত শত বছর কেটে গেল—লোকে শেষকালে বড় বড় জাহাজ বানাতে শিখল। ওই সব জাহাজে চেপে মহাসাগর পাড়ি দেওয়া ভয়ের ব্যাপার নয়। লোকে এখন জাহাজে চড়ে ভূ-প্রদক্ষিণ করতে পারে। এভাবে ভূ-প্রদক্ষিণ করতে গিয়েই শেষ পর্যন্ত মানুষের দৃঢ় প্রত্যয় হলো যে পৃথিবী একটা গোলক। মানুষ বুঝতে পারল, পৃথিবীতে কেউই মাথা নিচের দিকে করে ঝুলে থাকে না। কারণ এই যে ‘নিচ’ বলতে যা বোঝায়, সেটাও এই পৃথিবীই।
এখন অবশ্য আমরা সবাই একেবারে ছোট বয়স থেকে জানি, পৃথিবী হলো গোলক। যেকোনো বাড়িতে, যেকোনো স্কুলে ভূ-গোলক আছে। অথচ গোড়ায় মানুষের পক্ষে এটা অনুমান করা কী শক্তই না ছিল!