ইতিহাসের প্রাচীনতম ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান মিলল জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের চোখে। প্রাচীন এই দানবীয় কৃষ্ণগহ্বরের ভর ১.৬ মিলিয়ন বা ১৬ লাখ সূর্যের সমান। বিগ ব্যাংয়ের মাত্র ৪৪০ মিলিয়ন বছর পরের শিশু গ্যালাক্সি—জিএন-জেড১১ (GN-z11)-এর কেন্দ্রে পাওয়া গেছে এই কৃষ্ণগহ্বরটি। এসব তথ্য জানা গেছে প্রিপ্রিন্ট ডেটাবেজ আরজিভ (arXiv)-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে।
এটা একা নয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আরও অনেক কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব ছিল মহাবিশ্বের সূচনার প্রায় ১০০ মিলিয়ন থেকে ১ বিলিয়ন বছর পরের সময়কালের মধ্যে। তবে এ ধরনের কৃষ্ণগহ্বরগুলো মহাবিশ্বের জন্মের পরপরই কীভাবে এত দ্রুত ফুলে-ফেঁপে বিপুল আকৃতি ধারণ করল, তা এখনো পরিষ্কার নয় বিজ্ঞানীদের কাছে। উত্তরের খোঁজ চলছে। জবাব মিললে বোঝা যেতে পারে, আজকের সুপারম্যাসিভ বা অতিকায় দানবীয় কৃষ্ণগহ্বরগুলো কীভাবে অত বিশালাকার ধারণ করে। এই কৃষ্ণগহ্বরগুলো থাকে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও রয়েছে এমনি একটি কৃষ্ণগহ্বর—স্যাজিটারিয়াস এ*। এগুলোর রহস্যভেদ করতে সাহায্য করতে পারে সদ্য সন্ধান পাওয়া প্রাচীনতম এই কৃষ্ণগহ্বর।
এদের জন্ম-প্রক্রিয়াটা নিশ্চয়ই খুব অদ্ভুত ছিল। বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিও ছিল বেশ অদ্ভুত—রবার্টো মাইওলিনো, অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ
প্রিপ্রিন্ট মানে, গবেষণাপত্রটির পিয়ার-রিভিউ এখনো সম্পন্ন হয়নি। তবে এতে গবেষকদল গবেষণায় প্রাপ্ত সব তথ্য-উপাত্ত উপাস্থাপন করেন অন্য গবেষকদের যাচাই করে দেখার জন্য। এই যাচাইকেই বলা হয় পিয়ার-রিভিউ, যাতে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নন, এমন অনেক গবেষক পুরো বিষয়টির চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন। দেখেন, সব ঠিক আছে কি না। স্বীকৃতি মিললে প্রকাশিত হয় মূল গবেষণাপত্র।
এই প্রিপ্রিন্ট গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক রবার্টো মাইওলিনো যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক। লাইভ সায়েন্সকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, শিশু মহাবিশ্বের কৃষ্ণগহ্বরগুলো আজকের মতো ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠেনি। ‘এদের জন্ম-প্রক্রিয়াটা নিশ্চয়ই খুব অদ্ভুত ছিল। বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিও ছিল বেশ অদ্ভুত।’
কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোলকে বলা যায় স্থানকালের সীমাহীন বক্রতার এক অঞ্চল। বিশাল দানবীয় নক্ষত্ররা মৃত্যু-প্রক্রিয়ায় কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়। এটাই তাদের অনিবার্য পরিণতি। অবশ্য এর সঙ্গে নক্ষত্রের ঘূর্ণন, চারপাশের মহাকর্ষ ক্ষেত্র—এরকম বেশ কিছু বিষয় জড়িত।
কোনো নক্ষত্র ব্ল্যাকহোলে পরিণত হলে এর ঘনত্ব প্রচণ্ডভাবে বেড়ে যায়। চারপাশের স্থানকাল বেঁকে যায় ভীষণভাবে। বক্রতার পরিমাণ এত বেশি হয় যে কোনো কিছু ব্ল্যাকহোলের নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে চলে এলে তা আর ফিরে আসতে পারে না। এই নির্দিষ্ট অঞ্চলকে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত। অবশ্য, খাঁটি বিজ্ঞানীরা বলবেন, শুধু বক্রতাই নয়, কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে স্থানকালের দিকও বদলে যায়। এটাও কোনো কিছু ফিরে আসতে না পারার পেছনের কারণ। মোদ্দাকথা হলো, মহাবিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী—আলোর তরঙ্গও শুষে নেয় ব্ল্যাকহোল।
জন্ম-প্রক্রিয়া তো বোঝা গেল, কিন্তু এগুলো আরও বাড়ে কীভাবে? চারপাশের গ্যাস, ধুলোবালি, কাছাকাছি থাকা কোনো নক্ষত্র বা অন্য কৃষ্ণগহ্বরকে গিলে নিয়ে বেড়ে চলে এগুলো। উদরপূর্তির ফলে ভেতরের পদার্থগুলো প্রচণ্ড মহাকর্ষ ও ঘর্ষণবলের কারণে উত্তপ্ত হতে থাকে। একসময় জ্বলে উঠতে পারে দানবীয় এসব কৃষ্ণগহ্বর, উগলে দিতে পারে জেট। এগুলোকে বলা হয় সক্রিয় গ্যালাক্সিকেন্দ্র বা অ্যাকটিভ গ্যালাক্টিক নিউক্লিয়াস (এজিএন)। ভয়ংকর এজিএনগুলোকে বলা হয় কোয়াসার।
হয়তো ভাবছেন, বিজ্ঞানীরা অত অতীতের কৃষ্ণগহ্বর, নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির সন্ধান পান কীভাবে? আলোর চিরকুট পড়ে। আলোর চিরকুটে লেখা থাকে সব তথ্য। মহাবিশ্বের সূচনার পরের কিছু কাল মহাজাগতিক চুল্লীতে পদার্থ-প্রতিপদার্থগুলো স্যুপের মতো ঘন সন্নিবিষ্ট অবস্থায় ছিল। এই স্যুপের মধ্যে ইলেকট্রন ছুটে বেড়াচ্ছিল এলোমেলো। তাই আলোর কণা ফোটন বেশি দূর যেতে পারত না। একটু দূরেই ইলেকট্রনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আবার অন্য দিকে চলে যেত। আলো কোথাও থেকে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে (বা টেলিস্কোপের ক্যামেরায়) ধরা পড়লেই কেবল তা দেখা যায়। সেই জ্বাল হতে থাকা স্যুপের মতো মহাবিশ্ব তাই দেখার কোনো উপায় ছিল না।
জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের শক্তিশালী ক্যামেরা একের পর এক চমক দেখাচ্ছে। মহাবিশ্বের অতীত খুঁড়ে বের করে আনছে একের পর এক চমকপ্রদ জিনিস। সেই তালিকায় এবার যুক্ত হলো ইতিহাসের এই প্রাচীনতম কৃষ্ণগহ্বর, এখন পর্যন্ত
প্রথম অণু গঠনের পর থেকে আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কারণ, এ সময় ইলেকট্রন বাঁধা পড়ে পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের চারপাশে। সেটা বিগ ব্যাংয়ের ৩ লাখ ৮০ হাজার বছর পরের কথা।
আলোর গতি সসীম। সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটারের মতো। এই গতির ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা দূরত্ব পরিমাপের একটি একক নির্ধারণ করেছেন আলোকবর্ষ। আলো এক বছরে যত দূরে যেতে পারে, সেটাই এক আলোকবর্ষ। বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে দেখেছেন, প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে সূচনা হয়েছিল মহাবিশ্বের। আর যত দূর থেকে আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়, তত দূর—আসলে, তত অতীতের মহাবিশ্বের ছবি দেখতে পাই আমরা।
জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের শক্তিশালী ক্যামেরা একের পর এক চমক দেখাচ্ছে। মহাবিশ্বের অতীত খুঁড়ে বের করে আনছে একের পর এক চমকপ্রদ জিনিস। সেই তালিকায় এবার যুক্ত হলো ইতিহাসের এই প্রাচীনতম কৃষ্ণগহ্বর, এখন পর্যন্ত। এরচেয়েও প্রাচীন কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধানও হয়তো মিলবে ভবিষ্যতে।
বিজ্ঞানীরা এই কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান পেয়েছেন মহাবিশ্বের শুরুর সেই কালের ম্লান আলো বিশ্লেষণ করে। তাঁরা অপ্রত্যাশিত তীব্র আলো (উচ্চকম্পাঙ্কের আলো) পেয়েছেন। বিষয়টা আরও বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশের উত্তপ্ত বস্তুগুলো থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে, মহাবিশ্বজুড়ে।
মাইওলিনো বলছেন, ‘এ ধরনের কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টির জন্য যে শুধু নক্ষত্রের নিজের ভরে সংকুচিত হয়ে পড়তে হবে, এমন নয়। কারণ, অমন ঘটনার জন্য প্রয়োজন ভারী পদার্থ সমৃদ্ধ নয়, এমন গ্যাসমেঘ। এসব পদার্থ তৈরি হতে পারে প্রথম প্রজন্মের বিশালাকার—সূর্য থেকে ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ গুণ ভারী কোনো নক্ষত্রের বুকে।’
এই গ্যাসমেঘের দ্রুত শীতল হয়ে পড়ায় বাধা দেওয়া ও দানবীয় নক্ষত্রে পরিণত হওয়ার জন্য এটিকে অবশ্যই কাছের কোনো গ্যালাক্সি বা কৃষ্ণগহ্বর থেকে আসা অতিবেগুনি আলো শুষে নিতে হবে। অর্থাৎ, মাইওলিনোর ভাষ্যে, ‘একদিকে ভারী পদার্থ যেমন থাকা যাবে না, তেমনি কাছাকাছি বিপুল পরিমাণ ফোটন নিঃসারী গ্যালাক্সিও থাকতে হবে।’
তার মানে, এভাবে এই কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হতে পারে, তবে অন্যভাবেও হতে পারে। অনেক জ্যোতির্বিদের ধারণা, বিগ ব্যাংয়ের মুহূর্ত কয় পর সৃষ্ট আদি কৃষ্ণগহ্বরের হাত ধরে এ ধরনের কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হতে পারে। তবে এরকম আদি কৃষ্ণগহ্বরের প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ প্রাচীনতম এই কৃষ্ণগহ্বর বিজ্ঞানীদের কাছে হাজির হয়েছে নতুন রহস্য হয়ে। জেমস ওয়েব নভোদুরবিন পৃথিবীর সেরা গোয়েন্দাদের চূড়ান্ত পরীক্ষা নিচ্ছে, তা আর বলতে!
সূত্র: লাইভ সায়েন্স, স্পেস ডট কম