প্রথমবারের মতো একটি এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার করল জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। এই এক্সোপ্ল্যানেট বা সৌরজগতের বাইরের গ্রহটির নাম এলএইচএস ৪৭৫ বি (LHS 475 b)। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার গবেষকেরা সম্প্রতি এ তথ্য জানিয়েছেন। এই গবেষণা দলের নেতৃত্ব ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের লরেল শহরের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির অ্যাপ্লায়েড ফিজিকস ল্যাবরেটরির কেভিন স্টিভেনসন ও জ্যাকব লুস্টিগ-ইয়াগার।
পৃথিবী থেকে প্রায় ৪১ আলোকবর্ষ দূরের এই গ্রহটির আকার প্রায় আমাদের পৃথিবীর সমান। এর ব্যাস পৃথিবীর প্রায় ৯৯ শতাংশ। নাসার ট্রানজিটিং এক্সোপ্ল্যানেট সার্ভে স্যাটেলাইট বা সংক্ষেপে টেস (TESS) থেকে পাওয়া ছবিগুলোর সঙ্গে জেমস ওয়েবের পাঠানো ছবিগুলোর তুলনা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করে গবেষণা দলটি সিদ্ধান্ত নেয়, ‘এলএইচএস ৪৭৫ বি’ গ্রহটির অস্তিত্ব আছে। জেমস ওয়েবের নিয়ার-ইনফ্রারেড স্পেকট্রোগ্রাফের (NIRSpec) সাহায্যে সহজে ও স্পষ্টভাবে গ্রহটির ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে।
গবেষণা দলের প্রধান জ্যাকব লুস্টিগ-ইয়াগার বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে গ্রহটি সেখানে আছে। জেমস ওয়েবের পুরাতন তথ্যও গ্রহটির অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়।’ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্টিভেনসন আরও যোগ করেন, ‘এটি একটি ছোট পাথুরে গ্রহ। নভোদুরবিন বা অন্যান্য মানমন্দিরে দেখতে দারুণ লাগে।’
এখন পর্যন্ত পাঠানো টেলিস্কোপগুলোর মধ্যে শুধু জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের পৃথিবীর আকারের গ্রহের বায়ুমণ্ডল চিহ্নিত করার ক্ষমতা আছে। সদ্য আবিষ্কৃত এক্সোপ্ল্যানেটটির বায়ুমণ্ডল আছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। গবেষক দলটি সদ্য আবিষ্কৃত গ্রহের ট্রান্সমিশন স্পেকট্রাম বিশ্লেষণ করে গ্রহের বায়ুমণ্ডল আছে কি না, তা বোঝার চেষ্টা করছেন।
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স ল্যাবরেটরির এরিন মে বলেন, ‘টেলিস্কোপের তথ্যগুলো খুব সুন্দর। টেলিস্কোপটি এতটাই সংবেদনশীল যে এটি সহজেই বিভিন্ন অণু শনাক্ত করতে পারে। তবে আমরা এখনও গ্রহের বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।’
ওই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে কী কী উপাদান আছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত না হতে পারলেও গ্রহটিতে কী থাকার সম্ভাবনা নেই, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত। তাঁরা বলেছেন, গ্রহটিতে শনির উপগ্রহ টাইটানের মতো ঘন মিথেন নেই। তবে সেখানে বিশুদ্ধ কার্বন ডাই-অক্সাইড থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
জেমস ওয়েবের পাঠানো তথ্য থেকে আরও জানা গেছে, গ্রহটির পৃষ্ঠের তাপমাত্রা পৃথিবী থেকে কয়েক শ ডিগ্রি বেশি। সুতরাং ওই গ্রহের মেঘ শনাক্ত করা গেলে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন যে গ্রহটি হয়তো শুক্রের মতো উষ্ণ। হয়তো গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে আছে কার্বন ডাই-অক্সাইড ঘন মেঘ।
মাত্র দুই দিনে গ্রহটি নিজ সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসে। অর্থাৎ ওই গ্রহে এক বছর হয় মাত্র দুই দিনে। আর আমাদের সৌরজগতের যেকোনো গ্রহের তুলনায় ওই গ্রহটির অবস্থান তার নিজের নক্ষত্র—এলএইচএস ৪৭৫ এর অনেক কাছের একটি কক্ষপথে। এটি একটি লাল বামন নক্ষত্র। এর তাপমাত্রা আমাদের সূর্যের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। তবে গবেষকরা অনুমান করছেন, গ্রহটিতে বায়ুমণ্ডল থাকতে পারে।
আসলেই বায়ুমণ্ডল আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন আরও গবেষণা। সময়ই সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে। সত্যিই যদি এক্সোপ্ল্যানেটটির বায়ুমণ্ডল নিশ্চিত করা যায় জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের মাধ্যমে, তাহলে এটা হবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য এক বিশাল আবিষ্কার। নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে অচিরেই।
এর আগেও সৌরজগতের বাইরে এ ধরনের গ্রহের সন্ধান পান বিজ্ঞানীরা। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫ হাজার ২৯৭টি এক্সোপ্ল্যানেটের সন্ধান পাওয়া গেছে।
লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: নাসা