মহাকাশের গন্ধ কেমন

ফাঁকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে গ্যাস ও ধূলিকণা। এসবই আয়োনাইজড বা আয়নিত। কিন্তু এসব ধূলিকণা ও গ্যাস কি মহাশূন্যের সবটাই ছেয়ে আছে?

মহাকাশ মানে কী? একদম সরল কথায়, মহাকাশ মানে মহাশূন্য। এই মহাশূন্যের বেশিরভাগটাজুড়েই কিচ্ছু নেই। নেই কোনো গ্রহ-নক্ষত্র, গ্রহাণু বা ধূমকেতুর মতো মহাজাগতিক পাথরখণ্ড বা বায়ু। একদম বৈজ্ঞানিকভাবে বললে, কথাটা অবশ্য পুরোপুরি ঠিক হলো না।

আমরা জানি, দুটো নক্ষত্রের দূরত্ব অনেক। এই দূরত্ব মাপতে হয় আলোকবর্ষ বা জ্যোতির্বিদ্যাগত এককে। এক আলোকবর্ষ মানে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার। আর জ্যোতির্বিদ্যাগত একক মানে, পৃথিবী থেকে সূর্যের মধ্যকার দূরত্বের সমান। এত বিপুল দূরত্বের পুরোটা আমাদের কাছে মনে হয় ফাঁকা। তবে এই ফাঁকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে গ্যাস ও ধূলিকণা। এসবই আয়োনাইজড বা আয়নিত। কিন্তু এসব ধূলিকণা ও গ্যাস কি মহাশূন্যের সবটাই ছেয়ে আছে? আসলে তা নয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাশূন্যের বিপুল অংশ আসলেই শূন্য। অর্থাৎ কিচ্ছু নেই।

অথচ যে নভোচারীরা মহাকাশে গিয়ে ঘুরে এসেছেন, তাঁরা মহাকাশে বিচিত্র গন্ধ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন! কেমন এই গন্ধ? আসছেই-বা কোত্থেকে?

আরও পড়ুন
‘পোড়া ধাতুর মতো’, কারো মনে ‘ওজোনের মতো গন্ধ’। কেউ আবার বলেছেন ‘ওয়ালনাটের মতো’। কারো মতে, এ গন্ধ আসলে ‘বারুদের মতো’, কেউ ভেবেছেন ‘পোড়া আলমন্ডের কুকি’।

বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, মহাকাশের আসলেই গন্ধ আছে। আর আমাদের সৌরজগতের রয়েছে সুনির্দিষ্ট গন্ধ। এখানে প্রথম কথা হলো, এই গন্ধ পাওয়া গেল কীভাবে? না, কোনো নভোচারী নভোযানের বাইরে গিয়ে বোকার মতো স্পেসস্যুট খুলে গন্ধ শোঁকেননি। তাঁরা ফিরে আসার পর এয়ারলক নামের বিশেষ যে অংশে স্যুট খুলে নভোযানের ভেতরে ঢোকেন, সেখানে ফেরার পরই তাঁরা এই গন্ধ পেয়েছেন। এয়ারলকের বিশেষত্ব হলো, এই অংশটা দিয়ে নভোচারীরা মহাকাশে বেরিয়ে যান বা ফিরে আসেন। অর্থাৎ এটা মহাশূন্যের সংস্পর্শে আসে। তবে এই অংশটায় তাঁরা স্যুট খুলে রেখে আসেন, যেন মহাকাশ থেকে ভুলেও কোনো কিছু নভোযানের ভেতরে ঢুকে পড়ে। আচ্ছা, গন্ধ কীভাবে পাওয়া গেল, তা নাহয় বোঝা গেল। কিন্তু এই গন্ধটা কেমন?

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার নভোচারী ডন পেটি। একাধিকবার তিনি বিভিন্ন অভিযানে নভোযান থেকে বেরিয়ে মহাশূন্যে পা রেখেছেন, হেঁটে এসেছেন। স্পেস ডট কমকে তিনি জানিয়েছেন, একধরনের ধাতব গন্ধ পেয়েছেন মহাকাশ থেকে এয়ারলকে ফিরে স্যুট খোলার সময়। একধরনের মিষ্টি ধাতব গন্ধ। তিনি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে তিনি ওয়েল্ডিং টর্চ (ঝালাই যন্ত্র) দিয়ে ধাতু নিয়ে কাজ করার সময় এমন গন্ধ পেয়েছেন আগেও। এই গন্ধটা তাকে ঝালাইয়ের সময়কার ওয়েল্ডিং ফিউমের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।

অন্যান্য নভোচারীরাও কাছাকাছি গন্ধের কথাই বলেছেন। কেউ বলেছেন ‘পোড়া ধাতুর মতো’, কারো মনে ‘ওজোনের মতো গন্ধ’। কেউ আবার বলেছেন ‘ওয়ালনাটের মতো’। কারো মতে, এ গন্ধ আসলে ‘বারুদের মতো’, কেউ ভেবেছেন ‘পোড়া আলমন্ডের কুকি’। বেশিরভাগের কথায় ‘পোড়া’ কথাটা ফিরে ফিরে এসেছে।

আরও পড়ুন
মহাবিশ্বের জন্ম ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে। অর্থাৎ সৌরজগৎ জন্মেরও অনেক আগে থেকেই নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে তারা। এদের কেউ কেউ আবার সুপারনোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হয়।

কিন্তু এই গন্ধ আসছে কোত্থেকে? সম্ভাব্য দুটো ব্যাখ্যা আছে এর।

একটির নাম—জারণ। এ ব্যাখ্যা বলে, নভোচারীরা যখন এয়ারলকে আবার চাপের সংস্পর্ষে আসেন মহাশূন্য থেকে ফিরে, তখন সেখানে জারণ বিক্রিয়া ঘটে। মহাকাশের যেসব অক্সিজেন পরমাণু নভোচারীর স্যুটের সঙ্গে লেগে থাকে এবং দরজা খোলা থাকা অবস্থায় এয়ারলক এলাকায় ঢুকে পড়ে, সেগুলো এই চাপে একসঙ্গে মিলে দ্বিপরমাণুক (অর্থাৎ দুই পরমাণুবিশিষ্ট) অক্সিজেন অণু (O2) গঠন করে। আগুন না ধরেও, অর্থাৎ আগুনের অনুপস্থিতিতেও জারণ বিক্রিয়া ঘটতে পারে। মরিচা পড়ার ক্ষেত্রে যা হয়। এ সময় এরকম পোড়া পোড়া গন্ধ তৈরি হতে পারে।

আরেকটি ব্যাখ্যা হলো, এটা আসলে বিস্ফোরিত মুমূর্ষু নক্ষত্রের গন্ধ। আমরা জানি, সৌরজগতের জন্ম ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে। আর মহাবিশ্বের জন্ম ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে। অর্থাৎ সৌরজগৎ জন্মেরও অনেক আগে থেকেই নক্ষত্রের জন্ম হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে তারা। এদের কেউ কেউ আবার সুপারনোভা হিসেবে বিস্ফোরিত হয়। তখন একধরনের যৌগ তৈরি হয়। এর নাম, পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন। এগুলো আসলে হাইড্রোজেন এবং ছয়টি কার্বন দিয়ে গঠিত বেনজিনের সঙ্গে অন্যান্য মৌলের মিশ্রণে গঠিত একধরনের জৈবযৌগ। এ ধরনের যৌগ কিছু খাবার, কয়লা, তেল ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। কয়লা, কাঠ বা তামাক পোড়ার সময়ও এ ধরনের গন্ধ তৈরি হয়। হয়তো মহাকাশের মৃত নক্ষত্রের অবশেষের এই গন্ধই পেয়েছেন নভোচারীরা—যেন মহাজাগতিক ধূলোর বারবিকিউ!

আরও পড়ুন

এসবই আসলে সৌরজগতের ভেতরের গন্ধ। এর বাইরের বিপুল মহাশূন্যের কী অবস্থা? বিজ্ঞানীদের ধারণা, যেখানে যে ধরনের পরমাণু ভেসে বেড়াচ্ছে, তারা যে ধরনের বিক্রিয়া করছে, সে অঞ্চলের গন্ধ সেরকম। যেমন স্যাজিটারিয়াস বি২ ধূলোমেঘে ঘনতর ইথাইল ফরমেট আছে। এই যৌগটি রাসবেরি ও রাম নামের মদের গন্ধের পেছনের কারিগর। তারমানে, আপনি যদি রাসবেরি পছন্দ করেন, তাহলে মহাবিশ্বের ওই অংশটায় ঢুঁ দিয়ে আসতে পারেন।

এতক্ষণে আপনার নিশ্চয়ই আফসোসও হচ্ছে কিছুটা। কারণ, মহাবিশ্বের কোনো অংশের গন্ধ হয়তো চকলেটের মতো। সেখানে সবসময় ঘুরে বেড়াতে কী মজাই না হতো, তাই না? কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই গন্ধ আমরা কখনো পাব না।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: বিবিসি সায়েন্স ফোকাস, হাউ স্টাফ ওয়ার্কস ডট কম

আরও পড়ুন