নভোচারীদের খাওয়া দাওয়া

বেঁচে থাকতে গেলে খাবার খেতে হয়। সে আপনি আকাশে থাকুন, আর পাতালে থাকুন, খাবার ছাড়া বেঁচে থাকা যায় না। কাজেই নভোচারীদেরও যে নিয়মিত খেতে হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নভোচারীরা আসলে কী খান?

পৃথিবীতে আমরা নিয়মিত যেসব খাবার খাই, বর্তমানে মহাকাশে গিয়েও নভোচারীরা প্রায় একই খাবার খেতে পারেন। আন্তর্জাতিক মহাকাশ ষ্টেশনের মেনুতে প্রায় শতাধিক খাবারের আইটেম থাকে। শাকসবজি, ফলমূল থেকে শুরু করে মিষ্টি জাতীয় খাবারও আছে এ তালিকায়। নভোচারীরা প্রতিদিন তিন বার রুটিন মেনে খাওয়া-দাওয়া করেন। এছাড়াও যেকোনো সময় তাঁরা হালকা খাবার খেতে পারেন। তবে মহাকাশ সংস্থাগুলোর নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিদিন তাঁদের ২ হাজার ৫০০ ক্যালরি শক্তি নিশ্চিত করতে হয়।

বর্তমানে প্রতিটি মিশন শুরু হওয়ার আগেই নভোচারীদের খাবার তালিকা প্রস্তুত করা হয়। আর সেটা তৈরি করেন টিম ম্যানেজার এবং ওই মিশনের নভোচারীরা। মিশন শুরুর আগে নভোচারীরা যুক্তরাষ্ট্রের নাসার হিউস্টন জনসন স্পেস সেন্টারে খাবারের স্বাদ পরীক্ষা করতে যান। তাঁদের নিজ দেশের কিছু খাবারও এই তালিকায় যোগ করতে পারেন নভোচারীরা।

খাবার তৈরির জন্য বিজ্ঞানীদের বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়। কারণ দীর্ঘদিন মহাকাশে থাকায় খাবার নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। সাধারণত নভোচারীদের জন্য হালকা, সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও খেতে সহজ, এমন খাবার বাছাই করা হয়। শুকনো খাবারগুলো মহাকাশযানে পাঠানো হয় প্যাকেট করে। তবে শুকনো খাবারের পাশাপাশি প্রায় ২০ ধরনের পানীয়ের ব্যবস্থা থাকে। বর্তমানে বেশির ভাগ খাবার পানিযুক্ত থাকে। এছাড়া খাবার গরম করার জন্য একটি ওভেনও দেওয়া হয়।

আগে নভোচারীদের খাওয়া-দাওয়ার প্রক্রিয়া এতটা সহজ ছিল না। শুরুর দিকে খাবার বাছাই করার সুযোগও পেতেন না তাঁরা। ১৯৬০-এর দশকে নভোচারীরা শুধু বিশুদ্ধ খাবার খেতেন। যেমন শাকসবজি ও মাংস। খাবারগুলো ভালো রাখার জন্য একটি অ্যালুমিনিয়ামের টিউবে রাখা হতো। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এয়ার অ্যাণ্ড স্পেস মিউজিয়ামের তথ্য মতে, তখন নভোচারীদের খাবার ছিল শুষ্ক ও প্রায় স্বাদহীন। ১৯৬০-এর দশকের পরে নভোচারীদের জন্য হিমায়িত শুকনো খাবার সরবরাহ করা শুরু করে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে নভোচারীদের কাছে রিহাইড্রেটেড খাবার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

মহাকাশে মহাকর্ষ কম থাকায় সেখানে খাওয়া-দাওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং। আবার প্যাকেট থেকে খাবার বের করে মুখে পোরাও মুশকিল। এছাড়াও আছে নানাবিধ সমস্যা। এর মধ্যে স্বাস্থ্য সমস্যা অন্যতম। দীর্ঘদিন মহাকাশে অবস্থান করলে হাত ও পায়ের পেশি এবং হাড়ের ঘনত্ব ২০ শতাংশ কমে যেতে পারে। অবশ্য মহাকাশে থাকা অবস্থায় এই সমস্যার কারণে খুব বেশি ভুগতে হয় না নভোচারীদের। কিন্তু পৃথিবীতে ফিরে আসার পরে অধিকাংশ নভোচারীদের হাড়ে ফ্র্যাকচার ধরা পড়ে। এই সমস্যা থেকে বাঁচতে নভোচারীরা নিয়মিত ব্যায়াম করেন, ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার খান। এছাড়া খাবারের স্বাদ মহাকাশে বদলে যায়। পৃথিবীতে মাংস খেয়ে আপনি যে স্বাদ পাবেন, মহাকাশে গিয়ে সেই স্বাদ পাবেন না। খাবারের স্বাদ ধরে রাখার জন্য নভোচারীদের মরিচ ও মশলাযুক্ত খাবার বেশি দেওয়া হয়।

নভোচারীরা কীভাবে খান?

খাবার এবং পানীয় প্যাকেট করা হয় একই পদ্ধতিতে। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় যেভাবে খাবার প্যাকেট করা হয়, অনেকটা সেভাবেই নভোচারীদের জন্য খাবার প্যাকেট করা হয়। প্যাকেজিংয়ের দায়িত্বে থাকেন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা। সাধারণত মাইক্রোওয়েভ এবং প্রচলিত ওভেন ব্যবহার করে খাবার প্রস্তুত করা হয়। এরপর খাবারের পেছনে থাকা বারকোড স্ক্যান করে নভোচারীরা তাঁদের পছন্দের খাবার সংগ্রহ করেন। নভোচারীদের কে কী ধরনের খাবার খাচ্ছেন, সেই তথ্য রাখার জন্যই বারকোড স্ক্যান করে খাবার নিতে হয়। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে খাবার খাওয়ার জন্য মেঝের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত টেবিল-চেয়ারসহ একটি ডাইনিং রুম থাকে। নভোচারীরা তাঁদের পায়ের সাহায্যে চেয়ারের সঙ্গে নিজেদের আটকে রাখেন। এরপর কাঁটাচামচ এবং ছুরি ব্যবহার করে চুম্বকীয় ট্রে থেকে খাবার খান।

নভোচারীরা মহাকাশে কী ধরনের খাবার খান?

আগে মহাকাশে শুধু ডিহাইড্রেটেড বা শুকনো খাবার সরবরাহ করা হতো। এখন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নতুন ও তুলনামূলক সহজভাবে খাবার বানানো যায়। ফলে পৃথিবীর মতো একইরকম খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে নভোচারীদের জন্য।

মহাকাশে খাবার পাঠানোর আগে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মহাকাশে নভোচারীদের সবচেয়ে বড় লড়াই টাটকা শাকসবজি এবং ফলমূল নিয়ে। কারণ তাঁরা মহাকাশে টাটকা খাবার পান না। মহাকাশযানে খাবার ঢুকানোর দুই দিন আগে গাছ থেকে শাকসবজি ও ফল সংগ্রহ করা হয়। তবে এই টাটকা খাবার শুধু নভোচারীদের মনোবল ঠিক রাখার জন্য পাঠানো হয়। সাধারণত নভোচারীরা তাঁদের প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও পুষ্টি অন্যান্য খাবার থেকেই পান। তবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের নভোচারীরা মহাকাশে রোমেইন লেটুস উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন। এটি উৎপাদন করতে প্রায় ৩০ দিনের মতো সময় লেগেছে। তবু দীর্ঘ মিশনে এটি একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। ভবিষ্যতে হয়ত নভোচারীদের টাটকা খাবারের অভাবে ভুগতে হবে না। মহাকাশেই গ্রিন হাউস সিস্টেমে তৈরি হবে নানা রকম শাকসবজি ও ফলমূল।

২০১৭ সালে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল পিৎজা আর আইসক্রিম। সাধারণত মহাকাশে আইসক্রিম পাঠানো হয় না। কারণ আইসক্রিমের জন্য রেফ্রিজারেশন এবং ফ্রিজার প্রয়োজন। তারপরেরও নভোচারীদের অনুরোধে নাসার বিজ্ঞানীরা মহাকাশে পিৎজা ও আইসক্রিম পাঠিয়েছিল।

এছাড়াও মহাকাশে মাংস ও দুগ্ধজাত খাবার খাওয়ার সুযোগ আছে। এ ধরনের খাবার প্যাকেজিং করার আগে আয়নাইজিং করা হয়। ফলে খাবার অনেকদিন ভালো থাকে। এছাড়া অল্প পানিসমৃদ্ধ কিছু খাবার পাঠানো হয় মহাকাশে। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি কিছু খাবারও থাকে তালিকায়। যেমন বাদাম, বিস্কুট ও সুস্বাদু চকলেট।

তবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে প্রতি দুই মাস অন্তর টাটকা ফল, পানি এবং আগে থেকে প্যাকেট করা খাবার পাঠানো হয়। এজন্য ব্যবহার করা হয় ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির অটোমেটেড ট্রান্সফার ভেহিকল বা রাশিয়ান প্রগ্রেস মহাকাশযান। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে বিভিন্ন দেশের নভোচারীরা থাকেন। আগেই বলেছি, তাঁরা নিজ দেশের কিছু কিছু খাবার বাছাই করতে পারেন। প্রত্যেকের পছন্দের দুয়েকটি খাবার তাঁদের কাছে পৌছে দেওয়া হয়। একটি মিশনে থাকা সকল নভোচারীরা সেই খাবার ভাগ করে খান। এতে তাঁদের মুখের স্বাদেরও পরিবর্তন হয়। ২০১৪ সালে ইতালীয় স্পেস এজেন্সি মহাকাশের জন্য একটি বিশেষ কফি মেশিন তৈরি করে। মহাকাশের কম মহাকর্ষের কথা মাথায় রেখে মেশিনটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। ফলে এখন কফি পানের সুযোগ পাচ্ছেন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের নভোচারীরার।

নভোচারীরা আমাদের মতো বোতল বা মগে পানি পান করতে পারেন না। এতে সব পানি ওপরে ভেসে যাবে। তাই তাঁদের জন্য একটি বিশেষ ব্যাগ তৈরি করা হয়। ব্যাগের থেকে পানি চুষে খেতে হয়। নভোচারীরা নিয়মিতই সাধারণ পানি পান করেন। এছাড়া পানীয়র মধ্যে চা, কফি, কমলার রস ও লেবুর জুসের ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলোও বিশেষ ব্যাগে পুরেই খেতে হয়। তবে কোনো অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় মহাকাশে সরবরাহ করা হয় না।

কে প্রথম মহাকাশে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করেছেন? ইউরি গ্যাগারিন ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল ভস্টক-১ মহাকাশযানে প্রথম ব্যক্তি হিসাবে মহাকাশে গিয়েছেলেন। তিনিই প্রথম মহাকাশে খাওয়া দাওয়া করেছেন। তাঁর খাবারের তালিকায় ছিল গরুর মাংস, চকলেটের সস এবং যকৃতের পেস্ট।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সূত্র: নাসা ও সায়েন্স ডট ওআরজি