মিল্কিওয়ের বামন গ্যালাক্সি–রহস্যের উত্তর মিলল বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর গবেষণায়

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির পাশে ম্যাজেলানের বড় ও ছোট মেঘছবি: নিনা ম্যাককার্ডি/ নিক রাইজিংগার/ নাসা

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির আশপাশের বামন গ্যালাক্সিগুলো আসলে প্রতিবেশি অ্যান্ড্রোমিডার অংশ। সেই গ্যালাক্সিতে ঘটে যাওয়া এক সংঘর্ষের ফলে মিল্কিওয়ে উপহার হিসেবে পেয়েছে এসব বামন গ্যালাক্সি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সবচেয়ে বড় ও বিখ্যাত দুই গ্যালাক্সি-বামন—ম্যাজেলানের বড় ও ছোট মেঘ। সম্প্রতি অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এমনটাই জানা যাচ্ছে।

গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে গত ৪ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার। আর এ গবেষকদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন প্যারিস অবজারভেটরিতে কর্মরত বাংলাদেশি গবেষক এবং বিজ্ঞানচিন্তার লেখক ইশতিয়াক আকিব। এ দলের অন্য সদস্যরা হলেন ফ্রাঁসোয়া হ্যামার, ইয়ানবিং ইয়াং, মার্সেল পাভলোস্কি এবং জিয়ানলিং ওয়াং।

আমাদের মিল্কিওয়ে একটি রেগুলার বা স্বাভাবিক আকৃতির গ্যালাক্সি। এর চারদিকে রয়েছে প্রায় ৪০-৫০টি ছোট ছোট গ্যালাক্সি। ছোট বলেই এদের বলা হয় বামন গ্যালাক্সি। এই যে ছোট বামন গ্যালাক্সিরা, এরা কতটা ছোট হতে পারে? দেখা গেছে, আকারে সেগুলো মিল্কিওয়ের চেয়ে ১০ থেকে প্রায় ১০ লাখ গুণ ছোট হতে পারে। আসলে গ্যালাক্সি ক্লাস্টার বা গ্যালাক্সিপুঞ্জে মিল্কিওয়ের আকারের গ্যালাক্সির সংখ্যা কম। বরং একেকটি গ্যালাক্সিপুঞ্জে বা স্বাভাবিক আকৃতির গ্যালাক্সিদের ফাঁকে ফাঁকে ছোট গ্যালাক্সির সংখ্যাই বেশি। তবু এগুলোর আকার স্বাভাবিক (Regular) না ভেবে স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট ভাবা হয়। এর কারণ দুটি। এক, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই আমাদের বাস—এর আকারকে স্বাভাবিক ধরেই অন্য হিসাবগুলো করে মানুষ। আর দুই, ছোট বা বামন গ্যালাক্সিগুলো সাধারণত মিল্কিওয়ের আকারের গ্যালাক্সিগুলোকে কেন্দ্র করে ঘোরে। অর্থাৎ মিল্কিওয়ের আকারের গ্যালাক্সিগুলো এদের ওপরে ছড়ি ঘোরায়।

অবাক করা বিষয় হলো, এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বামন গ্যালাক্সিগুলো মিল্কিওয়ের ডিস্কের সঙ্গে প্রায় লম্বভাবে অবস্থান করছে। গাইয়া (Gaia) স্যাটেলাইট বা নভোদুরবিনের মাধ্যমে এই গ্যালাক্সিগুলোর বেগ পরিমাপ করেছেন প্যারিস অবজারভেটরির গবেষকেরা। দেখা গেছে, এদের সবার ঘূর্ণন অক্ষও বেশ কাছাকাছি। এই বামন গ্যালাক্সিগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় ভাস্ট পোলার স্ট্রাকচার (Vast POlar Structure) বা ভিপিওএস (VPOS)। এই গ্যালাক্সি কাঠামো আবিষ্কৃত হয় প্রায় ৫০ বছর আগে। কিন্তু এরা মিল্কিওয়ের পাশে এভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে কেন? কোত্থেকে এল, কীভাবে গড়ে উঠল এই কাঠামো? এসব প্রশ্নের কোনো ভালো জবাব বা ব্যাখ্যা এতদিন মেলেনি।

সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণাপত্রে এই বিজ্ঞানী দল দাবি করেছেন, অ্যান্ড্রোমিডার অন্য আরেকটি গ্যালাক্সির সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়া ও ছিটকে বেরোনো তারা ও গ্যাস থেকে গড়ে উঠেছে বামন গ্যালাক্সির ভিপিওএস কাঠামো।

মিল্কিওয়ের সবচেয়ে কাছের প্রকৃত বা স্বাভাবিক আকৃতির গ্যালাক্সি অ্যান্ড্রোমিডা। আমাদের প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বা ২৫ লাখ আলোকবর্ষ দূরের এ গ্যালাক্সি আকারে মিল্কিওয়ের চেয়ে বড়। প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ কোটি বছর আগে এর প্রায় এক-চতুর্থাংশ ছোট আকারের অন্য একটা গ্যালাক্সির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে অ্যান্ড্রোমিডা। তাতে ওই গ্যালাক্সি অ্যান্ড্রোমিডার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এ সময় অ্যান্ড্রোমিডা থেকে প্রচুর নক্ষত্র ও গ্যাস ছিটকে বেরিয়ে আসে। এই বিক্ষিপ্ত তারা ও গ্যাস মিলে লেজের মতো আকার ধারণ করে। বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ ও হিসাবনিকাশ করে দেখেন, বিক্ষিপ্ত তারা ও গ্যাসের ‘লেজ’টির মিল্কিওয়ের দিকেই আসার কথা।

সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণাপত্রে এই বিজ্ঞানী দল দাবি করেছেন, অ্যান্ড্রোমিডার অন্য আরেকটি গ্যালাক্সির সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়া ও ছিটকে বেরোনো তারা ও গ্যাস থেকে গড়ে উঠেছে বামন গ্যালাক্সির ভিপিওএস কাঠামো। এই দাবির পেছনে তাঁদের হাতে শক্ত প্রমাণও আছে। গবেষকেরা প্রথমে মিল্কিওয়ের ভর এবং বামন গ্যালাক্সিগুলোর বেগের ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন, এই বামন গ্যালাক্সিগুলো মিল্কিওয়ের চারপাশে চাঁদের মতো আজন্ম ঘুরে চলা ‘জনম জনমের সঙ্গী’ নয়। বরং সেই সংঘর্ষের পর এগুলো প্রথম মিল্কিওয়ের দিকে এসেছিল।

তারপর তাঁরা ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সিগুলোর অবস্থান ও বেগের সঙ্গে অ্যান্ড্রোমিডার সেই সংঘর্ষ ও মিলনের (Merger) আলাদা আলাদা বেশ কটি সিমুলেশন থেকে প্রাপ্ত বিক্ষিপ্ত লেজ-কাঠামোর তারাগুলোর অবস্থান ও বেগ তুলনা করে দেখেন। দেখা গেল, এই তারা ও ভিপিওএস কাঠামোর বামন গ্যালাক্সিগুলোর ত্রিমাত্রিক অবস্থান ও বেগ মিলে যায়। মানে একইরকম। যদি এই বামন গ্যালাক্সিগুলো অ্যান্ড্রোমিডার খসে পড়া লেজ থেকেই তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে মিল্কিওয়ের পাশে এদের এক সরলরেখায় থাকার সহজ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সেটি সত্যি হলে, এটাই অ্যান্ড্রোমিডা ও মিল্কিওয়ের মধ্যে ম্যাটার এক্সচেঞ্জ, তথা পদার্থ বিনিময়ের প্রথম উদাহরণ।

এ প্রসঙ্গে ইশতিয়াক আকিব বলেন, 'আমরা সম্ভবত মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একটা বড় রহস্য সমাধান করে ফেলেছি। একটি গ্যালাক্সির মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনা আরেক গ্যালাক্সিতে প্রভাব ফেলবে, এটা একদম অপ্রত্যাশিত ছিল। এই বামন গ্যালাক্সিগুলোর তারাদের বয়স এবং মেটালিসিটি যদি অ্যান্ড্রোমিডার মার্জারের (সংঘর্ষ ও মিলেমিশে যাওয়া) সঙ্গে মেলানো যায়, তাহলে এই ফলাফল আরও পোক্ত হবে। আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য সেটাই।'

এই গবেষণা বলছে, মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো নয়। বরং একটি গ্যালাক্সিতে ঘটে যাওয়া সংঘর্ষ তার প্রতিবেশী গ্যালাক্সির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। অর্থাৎ গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে একধরনের সম্পর্ক আছে। এভাবে একই গবেষণায় মিল্কিওয়ের বামন গ্যালাক্সিগুলোর উৎপত্তি, প্রতিবেশী গ্যালাক্সিদের মধ্যে পদার্থ বিনিময় ও পারস্পরিক প্রভাবের বিষয়টি তুলে এনেছেন ইশতিয়াক আকিব ও তাঁর সহগবেষকেরা।

সূত্র: অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস জার্নাল/অ্যান ইনট্রিগিং কোইনসিডেন্স বিটউইন দ্য মেজোরিটি অব ভাস্ট পোলার স্ট্রাকচার ডোয়ার্ফস অ্যান্ড আ রিসেন্ট মেজর মার্জার অ্যাট দ্য এম৩১ পজিশন। বিস্তারিত পড়তে ক্লিক করুন এখানে