সৌরজগতে আরেকটা নক্ষত্র ঢুকে পড়লে কী হতো?

মহাবিশ্বের সীমাহীন বিশালতার মাঝে সবকিছুকে অনেক দূরে দূরে মনে হয়। তবে, বাস্তবে মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে সবকিছু আসলে খুব একটা দূরে নয়।

সৌরজগতের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র সিস্টেমের নাম প্রক্সিমা সেন্টুরাই। সূর্য থেকে এর গড় দূরত্ব প্রায় সোয়া ৪ আলোকবর্ষ। এই বিশাল দূরত্বের মাঝের অংশটুকু আপাতদৃষ্টিতে শূন্য। কিন্তু, সবসময়ের জন্য নয়।

ওর্ট ক্লাউড নামে বরফাচ্ছাদিত গ্রহাণুর একটি বেষ্টনীকে বিবেচনা করা হয় সৌরজগতের সীমানা প্রাচীর হিসেবে। সৌরজগৎ সৃষ্টির পর থেকে এখন পর্যন্ত অনেক মহাজাগতিক বস্তু ওর্ট ক্লাউড অর্থাৎ সৌরজগতের সীমান্তের কাছ দিয়ে চলে গেছে, প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

কেমন হতো যদি কোন ভবঘুরে নক্ষত্র আমাদের সীমানা প্রাচীর ভেঙে ঢুকে পড়তো সৌরপরিবারের মাঝে? সেই নক্ষত্রটি যদি তার দলবল, অর্থাৎ গ্রহগুলো নিয়ে সৌরজগতে হাজির হতো তাহলেই বা সেটা আমাদের গ্রহ নক্ষত্রের জন্য কতোটা ভয়াবহ হতো? যৌক্তিক কল্পনার মধ্যে দিয়ে চলুন তাই জানার চেষ্টার করা যাক আজ।

ঘুরতে ঘুরতে নক্ষত্রটি একেবারে ওর্ট ক্লাউডে মাঝে চলে এসেছিলো। সূর্য থেকে তখন এর দূরত্ব ছিলো মাত্র ০.৮ আলোকবর্ষ।

আসলে জানেন কি, এমন একটি ভবঘুরে নক্ষত্র প্রায় ঢুকে পড়েছিলো আমাদের সৌরজগতের মাঝে। সেটা অবশ্য প্রায় ৭০ হাজার বছর আগের ঘটনা। মিটমিটে লোহিত দানব নক্ষত্রটির পোষাকি নাম, শোলজের নক্ষত্র। ঘুরতে ঘুরতে নক্ষত্রটি একেবারে ওর্ট ক্লাউডে মাঝে চলে এসেছিলো। সূর্য থেকে তখন এর দূরত্ব ছিলো মাত্র ০.৮ আলোকবর্ষ। পরে অবশ্য নক্ষত্রটি তার গতিপথ পরিবর্তন করে উলটো দিকে ছুট দেয়। ফলে বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি সৌর-পরিবারকে।

এই মুহূর্তে গ্লিজ ৭১০ নামের আরেকটি ভবঘুরে নক্ষত্র এগিয়ে আসছে সৌরজগতের দিকে। এর ভর সূর্যের চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি। গ্যালাক্সিজুড়ে নক্ষত্রটি ঘন্টায় প্রায় ৫২ হাজার কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলছে। প্রশ্ন হলো, সৌরজগতের কাছাকাছি আসতে কতো সময় লাগবে নক্ষত্রটির? তার চেয়েও বড় কথা, সৌরজগতে ঢুকে পড়লে ঠিক কতোখানি ক্ষতি করবে সেটা?

বাইরের কোনো নক্ষত্র সৌরজগতের মাঝে ঢুকে পড়লে কতোটুকু ক্ষতি করবে, তা নির্ভর করে সেই নক্ষত্রের আকার এবং গতিপথের ওপর। শোলজ’স নক্ষত্রটি যখন ওর্ট ক্লাউডের মাঝ দিয়ে যাচ্ছিলো, তখন সেটা আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র সিস্টেম প্রক্সিমা সেন্টুরাই থেকে প্রায় ৫ গুণ কাছাকাছি ছিল।

সরাসরি পৃথিবীতে নক্ষত্রটি কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে ওই একই সময়ে ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতের ফলে পৃথিবীর থেকে মানুষ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছিলো। বিষয়টি কাকতালীয় হতে পারে। যাই হোক, বিজ্ঞানীদের হিসেব অনুযায়ী শোলজ’স নক্ষত্রটি তার গতিপথ পরিবর্তনের আগে সৌরজগতের প্রায় ১০ শতাংশ ধুমকেতু এবং গ্রহাণুর কক্ষপথ পরিবর্তন করে দিয়েছিলো।

শোলজ’স নক্ষত্রটি সূর্যের তুলনায় অনেক ছোট ছিলো, তাই ক্ষতিও তেমন একটা হয়নি। কিন্তু নক্ষত্রটি যদি গ্লিজ ৭১০ এর মতো বড় নক্ষত্র হয়, তাহলে?

আগেই বলেছি, নক্ষত্রটি সৌরজগতের দিকেই আসছে ঘন্টায় ৫২ হাজার কিলোমিটার গতিতে। তবে, একথা শুনে ভয় পাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞানীদের মতে, আগামী প্রায় ১২ লাখ ৯০ হাজারের বছরের আগে এটি সৌরজগতের আশেপাশে আসছে না। ততদিনে এই পৃথিবী বা মানব সভ্যতার কী হবে সেটাই একটা বড় প্রশ্নের বিষয়। তাই, নক্ষত্রটিকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

সূর্যের চেয়ে বড় এই নক্ষত্রটি সৌরজগতের কাছাকাছি এলে প্রথমেই আঘাত হানবে ওর্ট ক্লাউডের সেই বরফে ঢাকা গ্রহাণুপুঞ্জের ওপর। সৌরজগত জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে এসব পাথরখণ্ড।

তখন প্রতিদিন প্রায় ১৭০টি উল্কা, ধুমকেতু ও গ্রহাণু আঘাত হানবে পৃথিবীর বুকে। বর্তমানের চেয়ে সংখ্যাটা প্রায় ১০ গুণ বেশি। পৃথিবীতে সাধারণত জনমানবহীন অঞ্চলে উল্কাপাত ঘটতে দেখা যায়। আকারেও বেশ ছোট থাকে এসব উল্কাপিণ্ড। সে দিক থেকে উল্কাপাতকে নিরীহ ঘটনা মনে হতে পারে।

কিন্তু, আসলে তা নয়। ধারণা করা হয়, পৃথিবী থেকে ডায়নোসর বিলুপ্ত হয়েছিলো গ্রহাণুর আঘাতেই। ডাইনোসরের ঘটনার সময় মানুষ সাক্ষী হতে পারেনি। কিন্তু তারপর গ্রহাণু বা উল্কা কী পরিমাণ ভয়ানক হতে পারে পৃথিবীর জন্য তা আমরা দেখেছি। এই তো শ খানেক বছর আগে, ১৯০৮ সালে সাইবেরিয়ার বনাঞ্চলের প্রায় ৮০ হাজার গাছ উপড়ে গিয়ে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে পড়ছিলো একটি মাত্র গ্রহাণুর আঘাতে। একই সাইজের গ্রহাণু বাংলাদেশের ঢাকায় কিংবা অন্যকোনো জনবহুল এলাকায় পড়লে কী ভয়ানক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

এতো কেবল শুরুর দিককার কথা। ওর্ট ক্লাউডের মাঝ দিয়ে আরেকটু এগোলেই আমাদের সবগুলো গ্রহের কক্ষপথ পরিবর্তিত হওয়া শুরু করবে। তবে, এ ঘটনাগুলোর প্রভাব টের পেতে সময় লাগবে কয়েক লাখ বছর। কক্ষপথ বদলের কারণে গ্রহে গ্রহে সংঘর্ষ হওয়ারও ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। তবে, গ্রহের সংঘর্ষও শেষ কথা নয়। ভারী নক্ষত্রটির সঙ্গে যদি তার সাঙ্গপাঙ্গ অর্থাৎ গ্রহ উপগ্রহগুলো থাকে, তাহলে মহাবিশ্বের এক ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে সৌরজগতে। গ্রহের কক্ষপথ বিচ্যুতি বা গ্রহ-উপগ্রহ সংঘর্ষের মতো ঘটনা তো ঘটবেই। নতুন নক্ষত্রসহ পুরো সৌরজগতের কাঠামোই বদলে যেতে পারে চিরতরে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় এ অবস্থাকে বলা হয় গ্যালাক্টিক স্যুপ।

শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও, সৌরজগৎ তৈরি হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার নক্ষত্র ওর্ট ক্লাউডের পাশ দিয়ে চলে গেছে। তবে সেসব নক্ষত্রের কারণে তেমন কোনো প্রভাব সৌরজগতে পড়েনি। গ্যালাক্সির চারপাশে নক্ষত্র প্রদক্ষিণ করার সময় এরকম কাছে চলে আসা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। গ্রহের বেলায় তো হর হামেশাই আমরা ব্যাপারটি দেখি।

বিজ্ঞানীদের মতে, অদূর ভবিষ্যতে কোনো সৌরজগতের আশেপাশে হুট করে কোনো নক্ষত্র আসার আশঙ্কা নেই। সৌরজগতের মাঝে অনাহুত কোনো নক্ষত্র ঢুকে পড়ার আশঙ্কাও প্রায় শূন্যের কোটায়। তাই, এসব নিয়ে ‌আপাতত দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই মানবজাতির।

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াটইফশো ডট কম, উইকিপিডিয়া, ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস