টলেমি ও তাঁর বিশ্বতত্ত্ব

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর সম্পর্ক। পৃথিবী ও আকাশ নামের এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…

টলেমির ধারণায় আকাশমণ্ডলছবি: উইকিমিডিয়া

তোমরা জানো যে পুরাকালে লোকে ভাবত আকাশ একটা কঠিন স্বচ্ছ স্ফটিক পাত্র। সে পাত্রে হাতুড়ি দিয়ে গাঁথা পেরেকের জ্বলজ্বলে মাথার মতো সব নক্ষত্র পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। ধারণা ছিল যে নক্ষত্রগুলো এক জায়গায় আবদ্ধ, তাদের নিজেদের গতি নেই। পরে দেখব এ ধারণাটা ঠিক নয়।

কিন্তু আকাশে যারা নজর রাখে, তারা দেখত নক্ষত্রের মধ্যে চলমান দেহ, কয়েকটির দ্রুতগতি, কয়েকটির মন্থর যাত্রা। প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটা ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়লেন—আকাশপথে যাত্রায় দেহগুলো প্রথমে যায় একদিকে, তারপর ঘুরে চলে উল্টো দিকে, বিপরীত পথে।

পেরেকের ঝকঝকে মাথাগুলোর মধ্যে যেন গুড়ি গুড়ি চলেছে কয়েকটা জোনাকি; আকাশের একদিকে প্রথমে, তারপর অন্যদিকে তাদের আবির্ভাব। তাই গ্রিকরা তাদের বলত ‘প্ল্যানেট’, যার অর্থ ‘ভ্রাম্যমাণ নক্ষত্র’।

কয়েক শ বছর আগের ড্রয়িং। পৃথিবীকে ঘেরা চাঁদোয়ায় যাত্রী পৌঁছিয়ে একটা ফাঁক পেয়েছে, সেখান থেকে অ্যারিস্টটলের স্ফটিক মণ্ডলগুলোর তারিফ করছে

আজ যেসব বস্তু নিজের আলোয় আলোকিত নয়, সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়, তাদের গ্রহ বলি। হঠাৎ যদি সূর্য বিদায় নেয় তাহলে চাঁদ, শুক্র, মঙ্গল এবং অন্যান্য গ্রহ আর আলোকিত হবে না।

নক্ষত্রগুলো নিজের আলোয় ভাস্বর। আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র সূর্য। এই সূর্য থেকে আমরা আলো ও তাপ পাই, তাতে সম্ভব হয় জীবনযাত্রা। আগের দিনে ভুল করে সূর্যকে লোকে গ্রহ বলত।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গঠনের কী ব্যাখ্যা অ্যারিস্টটল দেন, তা আগেই বলেছি। তাঁর মৃত্যুর ৫০০ বছর পরে আরেকজন গ্রিক পণ্ডিত টলেমি নতুন একটি বিশ্বতত্ত্ব গড়ে তোলেন।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গঠনের কী ব্যাখ্যা অ্যারিস্টটল দেন, তা আগেই বলেছি। তাঁর মৃত্যুর ৫০০ বছর পরে আরেকজন গ্রিক পণ্ডিত টলেমি নতুন একটি বিশ্বতত্ত্ব গড়ে তোলেন।

অ্যারিস্টটলের স্ফটিক টলেমি বিশ্বাস করতেন না। তিনি ভাবতেন, সব জ্যোতিষ্ক মহাশূন্যে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। টলেমীয় দর্শন এত জটিল যে টলেমি নিজে না বলে পারেননি: ‘গ্রহগুলো কী করে চলে, তা বোঝার চেয়ে আমার পক্ষে গ্রহগুলো চালানো আরও সহজ।’ তাঁর দর্শনের দৌলতে কিন্তু আকাশে গ্রহগুলোর গতির বিষয়ে আগে থেকে বলা সম্ভব হলো। তাঁর ধারণা ভ্রান্ত হলেও নিজের কালে টলেমি ছিলেন মহা জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তাঁর দর্শন অ্যারিস্টটলের চেয়ে অনেক অগ্রসর। পরে টলেমীয় দর্শনকে সত্য বলে স্বীকার করে খৃষ্টীয় চার্চ। তাঁর ধারণায় সন্দেহ করাটা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।

স্বাধীন চিন্তার সঙ্গে সংঘর্ষ হয় সে খালের খৃষ্টীয় বিশপ ও পাদ্রীদের। তাঁদের কাছে বিজ্ঞানী এবং তাদের বই—উভয়ই পরম শত্রু।

অ্যারিস্টটলের বিশ্বদর্শন: গ্রহগুলো স্ফটিক মণ্ডলে নিবদ্ধ

টলেমি থাকতেন যে আলেকজান্দ্রিয়া শহরে, সেখানে তাঁর মৃত্যুর ২০০ বছর পরে একটা ব্যাপার ঘটে। প্রাচীন কালের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি ছিল আলেকজান্দ্রিয়ায়। চার লাখের বেশি বই ছিল, সবকটি হাতে লেখা। এমনকি আজকের দিনেও এ রকম একটা গ্রন্থসংগ্রহকে বড় লাইব্রেরি মনে করা হয়।

চিকিৎসাশাস্ত্র, ইতিহাস, ভূগোল, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রাচীন কালের পণ্ডিতদের লেখা বই ছিল লাইব্রেরিতে। দেশ-বিদেশ থেকে পণ্ডিতরা আসতেন পড়তে।

৩৯১ সালে বিশপ থিওফিলাসের উস্কানিতে একদল লোক আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয় লাইব্রেরিটা। মহামূল্য সব জিনিস বিলুপ্ত হয়। স্বর্ণ বা হীরার চেয়ে দামি ছিল পুঁথিগুলো, ওগুলো তো আর ফিরিয়ে দেওয়া চলে না।

টলেমির বিশ্বদর্শন: শূন্য মহাকাশে গ্রহের চক্রপাক

প্রায় বিশ বছর পরে উন্মত্ত জনতা প্রাচীন জগতের অন্যতম উল্লেখযোগ্য মহিলা—হাইপেশিয়াকে ছিন্নভিন্ন করে। হাইপেশিয়া ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতের প্রথম শিক্ষিকা। সত্যসন্ধানী হাইপেশিয়া খৃষ্টীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের জয়লাভ চাইতেন, তাই বিশপ সিরিল তাঁর কাছে পাঠালেন খুনিদের...

টলেমীয় দর্শন কেন চার্চের সমর্থন পায়? তার কারণ বাইবেলে বলা সৃষ্টি কাহিনির সঙ্গে অনেক মিল আছে এ দর্শনের। একটা জিনিস শুধু অপছন্দ ছিল পাদ্রীদের। সেটা হলো গোলাকার পৃথিবী। তারা ধর্মভীরুদের বলে, পৃথিবী যে চ্যাপ্টা, তা মানতে হবে।

খৃষ্টীয় তত্ত্ব বাইবেলে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে ঈশ্বর শুরুতে স্বর্গ ও মর্ত্য সৃষ্টি করেন, পৃথিবীর কোনো রূপ ছিল না, ছিল মহাশূন্য। তারপর ঈশ্বর অন্ধকার থেকে আলাদা করলেন আলোককে। পৃথিবী তাই শুরু থেকে বিশ্বের কেন্দ্রে, টলেমীয় দর্শনে যেমন।

৩৯১ সালে বিশপ থিওফিলাসের উস্কানিতে একদল লোক আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেয় লাইব্রেরিটা। মহামূল্য সব জিনিস বিলুপ্ত হয়। স্বর্ণ বা হীরার চেয়ে দামি ছিল পুঁথিগুলো, ওগুলো তো আর ফিরিয়ে দেওয়া চলে না।

বাইবেল অনুসারে, দ্বিতীয় দিনে ঈশ্বর সৃষ্টি করলেন আকাশমণ্ডল, নাম দিলেন তার স্বর্গ আর এই নিরেট স্বর্গ বা আকাশমণ্ডল ওপরের জলকে আলাদা করল নিচের জল থেকে। ওপরের পানি, স্বর্গীয় পানি যা পৃথিবীতে পড়ে, তা হলো বৃষ্টি। প্রাচীন কালে লোকে ভাবত, স্বর্গলোকের কোথাও এ পানি জমে, তারপর ছোট ছোট গর্তের মধ্য দিয়ে পড়ে পৃথিবীতে।

তৃতীয় দিনে পানি থেকে শুকনো ডাঙাকে আলাদা করে গাছপালা জন্মানোর হুকুম দিলেন ঈশ্বর। শুধু চতুর্থ দিনে ঈশ্বর ‘পৃথিবীকে আলো দেওয়ার জন্য’ সূর্য, চন্দ্র এবং নক্ষত্র সৃষ্টি করলেন।

পঞ্চম দিনে তিনি সৃষ্টি করলেন সরীসৃপ, মাছ আর পাখি; আর ষষ্ঠ দিনে পশু ও মানুষ। বাইবেলের কাহিনিতে কত যে উল্টাপাল্টা কথা আছে পড়লে অবাক লাগে। সবকটি আলোচনার যোগ্যও নয়। শুধু একটা প্রশ্ন করা যাক: প্রথম দিনে দেখা দিল আলো আর চতুর্থ দিনে সূর্য, চন্দ্র এবং নক্ষত্রগুলো; তাহলে আলো এল কোথা থেকে? তা ছাড়া সূর্য নেই, চাঁদ নেই, প্রথম তিনটে দিন তাহলে কী করে গোনা হলো?

এ সব উল্টাপাল্টা জিনিসে চার্চের লোকেরা নজর দেয়নি। তারা বলে, ‘যীশুর পর আর কোনো বিজ্ঞানের প্রয়োজন নেই!’ চার্চের কর্তারা টলেমির ধ্যানধারণা গ্রহণ করল, তার কারণ, বাইবেল-কাহিনির খুব বিরোধিতা এগুলো করেনি। টলেমির নীতি ভুল প্রমাণিত যখন হলো, তখনো চার্চের মহোদয়গণ সেটা আঁকড়ে ধরে থাকে। আর অবিশ্বাসীদের ওপর নির্যাতন চালায়।

চার্চগুরুরা চেলাদের শিক্ষা দেয় যে পৃথিবীর গভীর জঠরে নরক নামের একটা জায়গা আছে, যেখানে পাপীদের ভয়ানক যন্ত্রণা দেওয়া হয়। আর দেবদূত ও মুনি ঋষিদের আবাস স্বর্গ, অ্যারিস্টটল কথিত প্রাথমিক চালিকা শক্তির জায়গায় অবস্থিত। দেবদূতদের একটা কাজ জুটিয়ে দেওয়া হলো স্বর্গে। পাদ্রীরা বলল, দেবদূতরাই গ্রহ চালায়। এমনকি পনেরো শতকে জি ফণ্টানার লেখা একটা বইয়ের নাম দেওয়া হলো, ‘পৃথিবীতে প্রাকৃতিক জিনিস এবং গ্রহচালক দেবদূতদের-বিষয়ক গ্রন্থ।’ একটা বিষয়ে শুধু চার্চের লোকেদের মতান্তর ছিল, দেবদূতরা গ্রহ চালায় কী করে?

কয়েকজন বলল: ‘চাষী যেমন শস্যের থলে নিয়ে যায় কারখানায়, ঠিক তেমনভাবে দেবদূতরা পিঠে বহন করে ভাস্বর গোলকগুলোকে।’

অন্যরা বলল: ‘না! কুলিরা মদের পিপে যেমন করে সেলারে গড়িয়ে দেয়, ঠিক সেভাবে দেবদূতরা ভাস্বর গোলকগুলোকে গড়ায়।’

প্রায় বিশ বছর পরে উন্মত্ত জনতা প্রাচীন জগতের অন্যতম উল্লেখযোগ্য মহিলা—হাইপেশিয়াকে ছিন্নভিন্ন করে। হাইপেশিয়া ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতের প্রথম শিক্ষিকা।

আর একদল বলল: ‘দুটোর কোনোটাই ঠিক নয়। গাড়িতে জোতা ঘোড়ার মতো দেবদূতরা গোলকগুলোকে টানে।’

পণ্ডিত ব্রহ্মচারী রিচোলি নক্ষত্র এবং গ্রহদের ভালো করে দেখে লেখেন: ‘নক্ষত্র চালাবার সময়ে সঙ্গীরা কী করছে, তার ওপর নজর রেখে দেবদূতরা ধাক্কাধাক্কি এড়িয়ে গ্রহকে রাখে নির্দিষ্ট একটা পথে।’

চার্চ শেখাল যে মেঘকে তৈরি রাখে দেবদূতরা বৃষ্টি আর বরফ পাঠানোর জন্য, আবহাওয়ার ভার তাদের হাতে, গরম আর ঠান্ডা ছড়ায় তারা।

টলেমির দর্শনে লোকে বিশ্বাস করে ১ হাজার ৪০০ বছর। পনেরো শতকের শেষে এবং ষোলো শতকের গোড়ায় কলম্বাস, ম্যাগেলান প্রমুখের মতো মহাঅভিযাত্রীরা সমুদ্র পথে যেসব সুদীর্ঘ যাত্রা করেন, তার ফলে তখনকার দিনে জানা পৃথিবীর সীমা অনেক বেড়ে গেল।

(চলবে…)

মূল: আলেকজান্ডার ভলকভ, অনুবাদ: সমর সেন

* পাঠকের সুবিধার্থে বইয়ের মূলভাব ঠিক রেখে বানানরীতির কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন