মহাবিশ্বের চূড়ান্ত নিয়তি

মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি কী এটা নিয়ে তাঁর আগে অন্য কোনো বিজ্ঞানী সেভাবে ভাবেননি। এ বিষয়ে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে জামাল নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন বিশ্ব বিখ্যাত এক বই- দ্য আল্টিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স। সেই বইয়ের একটা অংশ অনুবাদ করা হলো বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য।

অন্তিম পরিণতিতে এই মহাবিশ্বের ভাগ্যে কী ঘটবে? বুদ্ধিমত্তা বিকাশের পর থেকেই এই প্রশ্ন আন্দোলিত করেছে এক মানুষ থেকে আরেক মানুষের মন। এই প্রশ্ন থেকে মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে আরও কিছু প্রশ্ন। এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী? কিংবা এই মানবজাতির ভবিষ্যৎ কী? বর্তমানে প্রশ্নগুলো খুব সহজ মনে হলেও অনেক কাল পর্যন্ত এদের কোনো বিজ্ঞানসম্মত ও গ্রহণযোগ্য উত্তর ছিল না। এ ধরনের প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য ও বিজ্ঞানসম্মত উত্তর দেওয়ার জন্য জ্যোতির্বিদ্যা ও সৃষ্টিতত্ত্বে যে পরিমাণ উন্নতি অর্জিত হওয়া দরকার, তা অর্জিত হয়েছে মাত্র কয়েক দশক আগে।

মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি ঘটতে অবশ্যই অনেক অনেক সময় লাগবে। ব্যাপক সময়ের ব্যবধানে এই মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নির্ভর করে দুটি বিষয়ের ওপর: (১) মহাবিশ্বের বর্তমান গঠন কেমন এবং (২) মহাবিশ্ব কীভাবে এই গঠনে এসেছে। এ দুটি প্রশ্নের উত্তর জানলে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কী, সে সম্পর্কে জানা যাবে। মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভালোভাবে আলোচনা করতে গেলে আস্ত একটা বই রচনা করার প্রয়োজন হবে। এখানে পাঠকদের সংক্ষেপে একটি সামগ্রিক ধারণা (Bird’s eye view) দেওয়ার চেষ্টা করব।

সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে বলা যায় মহাবিশ্বের মূল গাঠনিক উপাদান হলো গ্যালাক্সি। মহাবিশ্বের সীমাহীন শূন্যতার ‘সাগরে’ কোটি কোটি ‘দ্বীপ’সদৃশ নক্ষত্রের সমন্বয়ে এক–একটি গ্যালাক্সি গঠিত। সাধারণ একটি গ্যালাক্সিতে প্রায় ১০০ বিলিয়নের (১০১১) মতো নক্ষত্র থাকে। আমাদের সূর্য এ রকমই একটি নক্ষত্র।

পৃথিবী, সূর্য ও সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ নিয়ে আমরা যে গ্যালাক্সিতে বসবাস করি, তাকে বলা হয় মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। এটিকে শুধু ‘গ্যালাক্সি’ বা ‘ছায়াপথ’ নামেও ডাকা হয়। পর্যবেক্ষণযোগ্য সব গ্যালাক্সি এবং গ্যালাক্সির সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বস্তুর সমন্বয়ে এই মহাবিশ্ব গঠিত। জোরালো প্রমাণ আছে যে গড়পড়তাভাবে মহাবিশ্বের সব অংশেই এসব বস্তু ও গ্যালাক্সি সমানভাবে ছড়িয়ে আছে।

বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্নের মধ্যে একটি হচ্ছে মহাবিশ্বের এই প্রসারণ কি চিরকাল চলতেই থাকবে, নাকি ভবিষ্যতে কোনো একসময় প্রসারণ বন্ধ হয়ে সংকোচন শুরু হবে?

পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এটা প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হয়েছে যে গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই বলা যায় মহাবিশ্ব স্থির অবস্থায় নেই। গতিশীল বা চলমান অবস্থায় আছে। গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এর মানে হলো মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। গ্যালাক্সিগুলো যেহেতু একটি নির্দিষ্ট হারে একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তাই সেখান থেকে অনুমান করা হয়, অনেক অনেক আগের কোনো একসময় এসব গ্যালাক্সি নিশ্চয়ই একত্র অবস্থায় ছিল। ধারণা করা হয়, সময়টা ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে।

ধারণা করা হয়, ওই সময়ে কল্পনাতীত বিশাল এক বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়। ওই বিস্ফোরণে একত্রে পুঞ্জিভূত থাকা মহাবিশ্বের সব পদার্থ প্রচণ্ড বেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে এসব পদার্থ আলাদা আলাদাভাবে ঘনীভূত হয়। গ্যালাক্সি হিসেবে বর্তমানে আমরা যাদের দেখতে পাই, তারা সবাই আসলে সেসব ঘনীভূত পদার্থের ফল। আলাদা আলাদা অঞ্চলে ঘনীভূত হয়ে জন্ম নিয়েছে আলাদা আলাদা গ্যালাক্সি। যে বিস্ফোরণের ফলে গ্যালাক্সিগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে এবং পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, সেই বিস্ফোরণটিকে বলা হয় ‘বিগ ব্যাং’।

বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্নের মধ্যে একটি হচ্ছে মহাবিশ্বের এই প্রসারণ কি চিরকাল চলতেই থাকবে, নাকি ভবিষ্যতে কোনো একসময় প্রসারণ বন্ধ হয়ে সংকোচন শুরু হবে? এর স্পষ্ট কোনো উত্তর এখনো জানা নেই। মহাবিশ্ব যদি চিরকাল প্রসারিত হতেই থাকে, তাহলে এ ধরনের মহাবিশ্বকে বলে ‘উন্মুক্ত মহাবিশ্ব’। যদি প্রসারণ বন্ধ হয়ে যায় এবং সংকোচন শুরু হয়, তাহলে এ ধরনের মহাবিশ্বকে বলে ‘বদ্ধ মহাবিশ্ব’।

আমাদের এই মহাবিশ্ব কি বদ্ধ নাকি উন্মুক্ত?—এই মহা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের তাড়িয়ে তাড়িয়ে বেড়ায় সব সময়। মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি, মহাবিশ্বের চূড়ান্ত নিয়তি নির্ভর করে এই প্রশ্নের উত্তরের ওপর। বেশ কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক সাক্ষ্য-প্রমাণ বলে, মহাবিশ্ব উন্মুক্ত। তবে এটি পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।

ধরে নিলাম মহাবিশ্ব উন্মুক্ত। যদি উন্মুক্ত হয়, তাহলে এর চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে? গ্যালাক্সিগুলো যেহেতু মহাবিশ্বের মূল উপাদান, তাই প্রশ্নটিকে আমরা গ্যালাক্সির সাপেক্ষেও করতে পারি। এভাবে মহাবিশ্ব যদি উন্মুক্ত হয়, তাহলে অতি দীর্ঘ সময় পর গ্যালাক্সিগুলোর কী পরিণতি হবে? একটি সাধারণ (Typical) গ্যালাক্সির কথা বিবেচনা করি। এ ধরনের একটি গ্যালাক্সি মূলত অনেকগুলো নক্ষত্রের সমন্বয়ে গঠিত। প্রতিটি নক্ষত্রই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। সময় শেষ হলে, আয়ু ফুরিয়ে গেলে সেসব নক্ষত্র মারাও যায়। এটাকে বলা যায় ‘নক্ষত্রের চূড়ান্ত পর্যায়’। এই পর্যায়ে পৌঁছার পর নক্ষত্রের মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন আসে না। যা হয়, তা খুবই সামান্য। এই সামান্যটুকু হতেও অতি বিশাল সময়ের প্রয়োজন হয়। কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন বছর লাগে।

নক্ষত্রের তিন ধরনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছি। আরও উল্লেখ করেছি মৃত পর্যায়ে চলে গেলে নক্ষত্রের মধ্যে সামান্যতম কোনো পরিবর্তন ঘটতেও ১০ বিলিয়ন বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগে।

তিন উপায়ে নক্ষত্রের মৃত্যু হতে পারে। শ্বেত বামন, নিউট্রন নক্ষত্র ও ব্ল্যাকহোল। এই তিন পর্যায়ে নক্ষত্রের উপাদানগুলো অত্যন্ত ঘনীভূত অবস্থায় থাকে। এদের মধ্যে যে নক্ষত্রে উপাদানগুলো সবচেয়ে বেশি ঘনীভূত অবস্থায় থাকে, সেগুলোকে বলা হয় ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণবিবর।

যদি যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়, তাহলে একসময় না একসময় একটি গ্যালাক্সির সব নক্ষত্রই মারা যাবে। সেসব নক্ষত্রের কোনো কোনোটি শ্বেত বামন হবে, কোনো কোনোটি নিউট্রন নক্ষত্র হবে আর কোনো কোনোটি হবে কৃষ্ণবিবর। কোনো নক্ষত্র যদি শ্বেত বামন, নিউট্রন ও কৃষ্ণবিবর—এই তিন অবস্থার কোনোটিতে উপনীত হয়, তাহলে আমরা সেই নক্ষত্রকে বলতে পারি মৃত নক্ষত্র। কোনো গ্যালাক্সির সব কটি নক্ষত্র মরে যেতে ১০০ বিলিয়ন থেকে ১ হাজার বিলিয়ন বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে। মোটামুটিভাবে ১ হাজার বিলিয়ন বছরের ভেতর একটি গ্যালাক্সি মৃত নক্ষত্র দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। নক্ষত্রের উত্তাপের অনুপস্থিতিতে পুরো গ্যালাক্সিজুড়ে বিরাজ করবে শীতলতা আর শীতলতা। গ্রহ, উপগ্রহ ও অন্যান্য ক্ষুদ্র বস্তুর মধ্যে তখনো পারস্পরিক আকর্ষণ বিদ্যমান থাকবে। উন্মুক্ত মহাবিশ্বে গ্যালাক্সিগুলো তখনো একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে। ফলে গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে পারস্পরিক দূরত্বও বেড়ে যাবে অনেক।

এই অবস্থায় পৌঁছানোর পর গ্যালাক্সিগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে আরও অতি বিশাল সময় পার হয়ে যাবে। মৃত নক্ষত্রগুলো অন্যান্য নক্ষত্রের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে গ্যালাক্সি থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে। এই প্রক্রিয়ায় গ্যালাক্সির প্রায় ৯৯ শতাংশ মৃত নক্ষত্র নিক্ষিপ্ত হয়ে বের হয়ে যাবে। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে বিলিয়ন বিলিয়ন (১০১৮) বছর বা বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন (১০২৭) বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে।

অবশিষ্ট ১ শতাংশ মৃত নক্ষত্র মিলে অতি ঘন ও অতি সংকুচিত একটি অবস্থা সৃষ্টি করবে। এরা পরস্পর একত্র হয়ে একটি অতি ভারী ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি করবে, যার ভর হবে সূর্যের ভরের চেয়ে বিলিয়ন গুণ বেশি। এই ব্ল্যাকহোলকে আমরা বলতে পারি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল বা দানবীয় কৃষ্ণবিবর।

এখানে গ্যালাক্সির যে ক্রমপরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ‘গ্যালাক্সির পরিবর্তন গতিবিদ্যা’ বা ডাউনামিক্যাল ইভল্যুশন অব গ্যালাক্সি।

নক্ষত্রের তিন ধরনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছি। আরও উল্লেখ করেছি মৃত পর্যায়ে চলে গেলে নক্ষত্রের মধ্যে সামান্যতম কোনো পরিবর্তন ঘটতেও ১০ বিলিয়ন বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগে। আসলে সময়ের ব্যবধান যখন কয়েক বিলিয়ন বছর হয়, তখন চূড়ান্ত অবস্থার মধ্যেও কমবেশি পরিবর্তন সম্পন্ন হয়। ব্ল্যাকহোল সাধারণত সবকিছু নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে ভারী হয়। কিন্তু বিলিয়ন বিলিয়ন বছর সময়ের ব্যবধানে বিবেচনা করলে দেখা যাবে মৃত ব্ল্যাকহোলও বিকিরণ করতে করতে ধীরে ধীরে ভর হারাতে থাকে। এই ধীর প্রক্রিয়ায় বিকিরণের মাধ্যমে আস্ত ব্ল্যাকহোলও নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। হোক সেটা অসীমতুল্য সময়, কিন্তু তারপরও এটি নিঃশেষ হবে। সূর্যের ভরের সমান কোনো ব্ল্যাকহোল এই প্রক্রিয়ায় ১০৬৫ বছরের ভেতর নিঃশেষ হয়ে যাবে (সূর্যের সমান ভরের নক্ষত্র সাধারণত ব্ল্যাকহোল হয় না। হিসাবের সুবিধার জন্য একক হিসেবে মাঝেমধ্যে সূর্যের ভর ব্যবহার করা হয়)।

সময়টা অত্যন্ত বেশি। আস্ত একটি গ্যালাক্সি অত্যন্ত ধীরগতিতে ধুঁকে ধুঁকে একটি কৃষ্ণবিবরে পরিণত হতে অত্যন্ত বেশি সময় লাগে। কিন্তু সূর্যের ভরের সমান ছোট একটি কৃষ্ণগহ্বর বিকিরণের মাধ্যমে নিঃশেষ হতে তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি সময় লাগবে। এর বিকিরণের মাত্রা একদমই কম। স্বল্পমাত্রার কারণেই নিঃশেষ হতে এত বেশি সময় লাগে।

গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এক বা একাধিক কৃষ্ণগহ্বর থাকে। এ ধরনের কেন্দ্রীয় কৃষ্ণবিবর অতি বৃহৎ ও অতি ভারী (সুপারম্যাসিভ) হয়। কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারে, এ ধরনের কেন্দ্রীয় ব্ল্যাকহোলের বেলায় কী ঘটবে? এটি কি চিরকাল অস্তিত্ববান থাকবে, নাকি এটিও পরিবর্তনের চক্রে ক্ষয়ে গিয়ে তার রাজসুলভ জৌলুশ হারাবে? হ্যাঁ, এরও ক্ষয় হবে। এ ধরনের কেন্দ্রীয় সুপারম্যাসিভ কৃষ্ণগহ্বর ১০৯০ বছরের ভেতর ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এর চেয়েও বড় ও ভারী ব্ল্যাকহোল আছে। সেগুলোকে বলা হয় সুপার গ্যালাকটিক ব্ল্যাকহোল। কোনো ক্লাস্টারে থাকা কয়েকটি গ্যালাক্সি একত্র হয়ে এ ধরনের ব্ল্যাকহোল তৈরি করে। এ ধরনের অতি বৃহৎ ও অতি ভারী ব্ল্যাকহোলও ১০১০০ বছরে বিকিরণের মাধ্যমে ক্ষয়ে নিঃশেষিত ও বাষ্পীভূত অবস্থায় পরিণত হয়ে যাবে।

এই প্রক্রিয়াতে ১০১০০ বছরের মধ্যে গ্যালাক্সিগুলোর সব ব্ল্যাকহোল বিকিরণের মাধ্যমে ক্ষয়ে ক্ষয়ে সম্পূর্ণরূপে উবে যাবে। এরপর মহাবিশ্বে থাকবে শুধু শান্ত–শিষ্ট নিউট্রন নক্ষত্র ও শ্বেতবামন নক্ষত্র। আর থাকবে মহাজাগতিক মাপকাঠিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু বস্তু। এই বস্তুগুলো গ্যালাক্সির ঘটনাবহুল সংঘর্ষের মুহূর্তে সেখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এই বস্তুগুলো আর মৃত নক্ষত্রগুলো তখন চির অন্ধকারময় মহাবিশ্বে অনন্তকালব্যাপী একা একা দিন পার করবে।

এই অবশিষ্ট বস্তুগুলোর মধ্যেও সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন ঘটবে। তবে তা খুব ধীরগতির। সময়ও লাগবে খুব বেশি। ১০১০০ বছরে যেখানে পুরো মহাবিশ্ব স্তিমিত হয়ে যাবে, সেখানে এসব অবশিষ্ট বস্তুর মধ্যে সামান্য পরিবর্তন আসতে তার চেয়েও বেশি সময় লাগবে। তাহলে অবশিষ্ট বস্তুগুলোর চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে?

এখানে এসে আমরা আরেকটা সংকটে পড়ে যাই। এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিতভাবে এখনো জানা নেই। কিছু আনুমানিক ধারণা আছে। একটি সম্ভাবনা হচ্ছে, শ্বেতবামন ও নিউট্রন নক্ষত্রগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে কৃষ্ণবিবরে পতিত হবে এবং পরে বিকিরণের মাধ্যমে তারাও নিঃশেষ হয়ে যাবে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কিছু নিয়মনীতি এমনটাই বলে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগবে (১০১০)^৭৬ বছর। এই সংখ্যাটি কল্পনাতীত পরিমাণ বিশাল। ‘বিলিয়ন’ শব্দটিকে এক বিলিয়ন বার লিখলে সেটি যত বড় সংখ্যা হবে তা-ও (১০১০)^৭৬–এর তুলনায় একদম নস্যি।

মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করার সময় মানবজাতি, মানব সভ্যতা ও প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা চলে আসে। উন্মুক্ত মহাবিশ্বে অতি বৃহৎ সময়ের প্রেক্ষাপটে মানুষের ভবিষ্যৎ কী? সুদূর ভবিষ্যতে প্রাণ ও সভ্যতা কীভাবে নিজেদের টিকিয়ে রাখবে? টিকে থাকার জন্য জীবন্ত প্রাণেরা কোন প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেবে, তা বলা মোটামুটি অসম্ভব। তবে প্রাণ ও সভ্যতার টিকে থাকা নির্ভর করে শক্তির উৎসের ওপর। যেমন পৃথিবীর ক্ষেত্রে শক্তির উৎস হচ্ছে সূর্য। পৃথিবীর সব প্রাণ ও সভ্যতা পুরোপুরি নির্ভর করে আছে সূর্যের ওপর। সূর্য না থাকলে কোনো প্রাণও টিকে থাকতে পারত না, কোনো সভ্যতারও জন্ম হতো না।

আগামী ১০১০০ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণ শক্তির উৎস বিদ্যমান থাকবে। তত্ত্ব অন্ততপক্ষে সে কথাই বলে। সভ্যতা যদি সে সময় পর্যন্ত টিকে থাকে, তাহলে এরপর থেকেই সভ্যতাকে শক্তি সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। সীমাবদ্ধ কিছু শক্তি নিয়ে অনিশ্চিত দিন পার করতে হবে। এ সময়ের পর কী ঘটবে কিংবা এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার উপায় কী, তা এখনো অমীমাংসিত রহস্য। তবে এ ব্যাপারে কিছু অনুমান ও সম্ভাবনা আছে। পরবর্তী সময়ে এসব সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

মহাবিশ্ব সম্বন্ধে ওপরে যে ধারণা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো উন্মুক্ত মহাবিশ্ব মডেলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। উন্মুক্ত না হয়ে এই মহাবিশ্ব যদি বদ্ধ হয়, তাহলে কী হবে? মহাবিশ্ব যদি বদ্ধ হয়, তাহলে এর প্রসারণ একটা নির্দিষ্ট সীমায় গিয়ে থেমে যাবে। বর্তমানে গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে গড় যে দূরত্ব বিদ্যমান, তা ধীরে ধীরে দ্বিগুণ হবে। এ অবস্থায় এটি ৪০ বা ৫০ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। এরপরই প্রসারণের উল্টো প্রক্রিয়ায় সংকুচিত হওয়া শুরু করবে। একটি সিনেমাকে যদি ব্যাকওয়ার্ড-এর মাধ্যমে উল্টো করে টেনে শেষ থেকে শুরুতে আনা হয়, তাহলে যে রকম হবে, মহাবিশ্বের সংকোচনের ঘটনাও সে রকমই হবে। ৯০ থেকে ১১০ বিলিয়ন বছর পর মহাবিশ্বের ঘনত্ব অত্যন্ত বেড়ে যাবে। পাশাপাশি প্রচণ্ড উত্তপ্তও হয়ে যাবে। এর পরপরই বিগ ক্রাঞ্চ বা বৃহৎ সংকোচন সংঘটিত হবে। প্রচণ্ড উত্তাপে মহাবিশ্বের সব বস্তু একত্রে মিলে যাবে। তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ফাঁকা থাকবে না, সব দিক থেকে পূর্ণ হয়ে যাবে। এ যেন অনেকটা গ্রহ–নক্ষত্র–গ্যালাক্সির ‘সংঘবদ্ধ সংকোচন’। এই পরিস্থিতিতে কোনো প্রকার প্রাণ টিকে থাকার সম্ভাবনা একদমই ক্ষীণ। বিগ ক্রাঞ্চের পর কী ঘটবে কিংবা সেখানে ‘পরে’ বলতে আদৌ কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকবে কি না, তা কেউ জানে না।

উন্মুক্ত মহাবিশ্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে অনেক কিছু উল্লেখ করা হয়েছে এখানে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের করা গবেষণায় এমন কিছু বেরিয়ে এসেছে, যা একটু গোলমেলে। একে সঠিক হিসাবে ধরে নিলে উন্মুক্ত মহাবিশ্ব সম্পর্কে এখানে যে ধারণা দেওয়া হয়েছে তাতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। পদার্থের অন্যতম গাঠনিক উপাদান প্রোটন। এরা পরমাণুর মধ্যে একত্র অবস্থায় থাকে। পদার্থবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, অতি দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রোটন স্থায়ী নয়, ভারসাম্যহীন। পদার্থবিজ্ঞানীদের এই অনুমান সত্য হলে এটা মেনে নিতে হবে যে একসময় না একসময় প্রোটনগুলো পরস্পর থেকে বিশ্লিষ্ট হয়ে যাবে। সব প্রোটন যদি আলাদা হয়ে যায়, তাহলে তা মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতিতে প্রভাব রাখবে।

প্রোটনগুলো একত্রে না থেকে আলাদা হওয়ার মানে হচ্ছে অণু-পরমাণুর রূপ পাল্টে যাওয়া। তেজস্ক্রিয় ভারী মৌলে প্রোটনগুলো দুই দলে ভাগ হয়ে যায় বলেই এ ধরনের পরমাণু ভেঙে গিয়ে স্বতন্ত্র দুটি পরমাণু তৈরি হয়। আর অণু-পরমাণু দিয়েই পুরো মহাবিশ্ব গঠিত। প্রোটন তথা অণু-পরমাণুতে পরিবর্তন সম্পন্ন হওয়া মানে মহাবিশ্বের পরিবর্তন হওয়া। অণু-পরমাণুর সম্মিলিত ক্ষুদ্র পরিবর্তন পুরো মহাবিশ্বের আচার–আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে এত মাথা ঘামানোর প্রয়োজন কী? এই প্রশ্নের উত্তর অন্য একটি প্রশ্নের উত্তরের মতো। বিপদ ও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে মানুষ কেন এভারেস্টে আরোহণ করে? কারণ চ্যালেঞ্জ আছে, সমস্যা আছে। যেখানে সমস্যা আছে, সেখানেই মানুষ সমাধান খুঁজে নিতে চেষ্টা করে। মানব মনের প্রকৃতিই হচ্ছে অবিরতভাবে অনুসন্ধান করে যাওয়া এবং জ্ঞানের নতুন সীমানা তৈরি করা। মহাবিশ্ব ও মানব সভ্যতার চূড়ান্ত পরিণতি, এটা বেশ আগ্রহোদ্দীপক সমস্যা। এই চূড়ান্ত পরিণতির সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও জ্ঞানের অন্যান্য শাখার মৌলিক কিছু প্রশ্ন জড়িত। মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি কেমন হবে, তার ওপর ভিত্তি করে এসব মৌলিক বিষয়ের উত্তর নির্ধারিত হবে। মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি সম্বন্ধে ধারণা পরিষ্কার হওয়ার মাধ্যমে জ্ঞানের এসব শাখার প্রভূত উন্নতি হতে পারে।

ভাষান্তর: সিরাজাম মুনির

*লেখাটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত