তাপমাত্রার কথা যদি বলেন, তবে মহাকাশ বেশ অদ্ভুত জায়গা। মহাশূন্যের তাপমাত্রা প্রায় পরম শূন্য, অর্থাৎ ০ কেলভিন বা মাইনাস ২৭৩.১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। অন্যদিকে নক্ষত্রের তাপমাত্রা হাজার থেকে কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার গ্রহের মধ্যে থাকা কোর বা কেন্দ্রের তাপমাত্রাও অনেক বেশি। মানে তাপমাত্রার রকমফের তো বটেই, আকাশ-পাতাল তফাতও দেখা যায় সহসাই।
মহাকাশের অন্যতম রহস্যময় জিনিস ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। কখনো কি জানতে ইচ্ছে করেছে, রহস্যময় এ বস্তুর তাপমাত্রা কেমন?
ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। নামের মতোই অন্ধকারে রয়েছে মহাজাগতিক এই বস্তুটি। প্রায় শত বছর আগে কার্ল শোয়ার্জশিল্ড যে অতি ভারী, অতি ঘন বস্তুর কথা চিন্তা করেছিলেন, বিজ্ঞানীরা তা বাস্তবে শনাক্ত করেছেন। এই তো কয়েকবছর আগে, ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা ছবিও তুলেছেন কৃষ্ণগহ্বরের।
মহাবিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী—আলোর তরঙ্গও শুষে নেয় ব্ল্যাকহোল। ফলে উন্নত প্রযুক্তি ও টেলিস্কোপ থাকার পরও নিজেকে রহস্যের চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে কৃষ্ণগহ্বর।
পৃথিবী থেকে ৫৫ আলোকবর্ষ দূরের মেসিয়ার ৮৭ গ্যালাক্সি। সেই গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দানবাকার কৃষ্ণগহ্বর—এম৮৭*। এই কৃষ্ণগহ্বরের ছবিই তোলা হয়েছিল ২০১৯ সালে, ইভেন্ট হরাইজন নামে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অনেকগুলো দুরবিনের সমষ্টি এক টেলিস্কোপ দিয়ে। পরে, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা স্যাজিটারিয়াস এ* কৃষ্ণগহ্বরের ছবিও তোলা হয়েছে। যাহোক, প্রসঙ্গে ফিরি।
কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোলকে বলা যায় স্থানকালের সীমাহীন বক্রতার এক অঞ্চল। সূর্যের চেয়ে অন্তত ২-৩ গুণ ভারী নক্ষত্র জীবনের শেষ পর্যায়ে কৃষ্ণগহ্বরে পরিণতে হতে পারে। সূর্য মূল ধারার নক্ষত্র। ভরের হিসাবে জীবনের শেষ পর্যায়ে এটি সাদা বামন নক্ষত্রে পরিণত হবে। এখানে চন্দ্রশেখরের সীমার কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন জ্যোতিঃপদার্থবিদ সুব্রাহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখর বলেন, সূর্যের চেয়ে অন্তত ১.৪ গুণ ভারী সাদা বামন নক্ষত্র কৃষ্ণগহ্বর বা নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হতে পারে। আসলে, এর চেয়ে বেশি ভারী হলে সাদা বামন নক্ষত্র আর ভারসাম্য রাখতে পারে না, নিজের মহাকর্ষীয় আকর্ষণে নিজেই চুপসে যেতে থাকে। এই সীমার নাম চন্দ্রশেখরের সীমা বা চন্দ্রশেখর’স লিমিট। তবে মূল ধারার আরও ভারী ও দানবীয় নক্ষত্রগুলো আরও ভারী কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়। এটাই তাদের অনিবার্য পরিণতি। অবশ্য এর সঙ্গে নক্ষত্রের ঘূর্ণন, চারপাশের মহাকর্ষ ক্ষেত্র—এরকম বেশ কিছু বিষয় জড়িত।
কোনো নক্ষত্র ব্ল্যাকহোলে পরিণত হলে এর ঘনত্ব প্রচণ্ডভাবে বেড়ে যায়। চারপাশের স্থানকাল বেঁকে যায় ভীষণভাবে। বক্রতার পরিমাণ এত বেশি হয় যে কোনো কিছু ব্ল্যাকহোলের নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে চলে এলে তা আর ফিরে আসতে পারে না। এই নির্দিষ্ট অঞ্চলকে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত। অবশ্য, খাঁটি বিজ্ঞানীরা বলবেন, শুধু বক্রতাই নয়, কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে স্থানকালের দিকও বদলে যায়। এটাও কোনো কিছু ফিরে আসতে না পারার পেছনের কারণ। মোদ্দাকথা হলো, মহাবিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী—আলোর তরঙ্গও শুষে নেয় ব্ল্যাকহোল। ফলে উন্নত প্রযুক্তি ও টেলিস্কোপ থাকার পরও নিজেকে রহস্যের চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে কৃষ্ণগহ্বর।
ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে যতটা জানা গেছে, তার বেশির ভাগ তাত্ত্বিক। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা অংক কষে সেসব বের করেছেন। ব্ল্যাকহোলের যে ছবি তোলা হয়েছে, সেটাও আসলে ঘটনা দিগন্তের। ঘটনা দিগন্তে কোনো বস্তু (গ্রহ, নক্ষত্র বা যেকোনো কিছু) এসে পড়লে সেটা প্রায় আলোর বেগে ঘুরতে থাকে। ফলে, বস্তুর কণাগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তীব্র সংঘর্ষে। তৈরি হয় তাপ ও আলো।
আলো বিশ্লেষণ করে কোনো বস্তুর তাপীয় অবস্থা আঁচ করা যায়। বিজ্ঞানীরা এতদিন ধরে ব্ল্যাকহোলের ঘটনা দিগন্ত পর্যবেক্ষণ করে যেসব তথ্য পেয়েছেন, তা থেকে ধারণা করা হয়, এখানকার তাপমাত্রা কোটি কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে।
অন্যদিকে ব্ল্যাকহোলের ভেতরের অবস্থা কোনোভাবেই পর্যবেক্ষণ করা যায় না। তবে এর ভেতরে বিপুল পরিমাণ ভর একটি বিন্দুতে জমা থাকে। তাই পদার্থের স্বাভাবিক অবস্থা বজায় থাকলে তাতে মৌলিক কণার কম্পন থাকার সম্ভাবনা খুব কম। আর কম্পন না থাকলে তাপমাত্রাও থাকবে না। এ জন্য অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, ব্ল্যাকহোলের ভেতরে খুব কম তাপমাত্রা বিরাজ করে। সূর্যের সমান ভরের একটি ব্ল্যাকহোলের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা হতে পারে পরম শূন্য তাপমাত্রার প্রায় দশ লাখ ভাগের একভাগ।
তবে এটা কিন্তু একেবারে নিশ্চিত কোনো তথ্য নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ব্ল্যাকহোলের পরম বিন্দু বা সিঙ্গুলারিটি আমাদের চেনা-জানা পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনে আচরণ করে না। এই অঞ্চলে পদার্থবিদ্যার জানা সূত্রগুলো ভেঙে পড়ে। কাজেই কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরের অবস্থা নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।