পূর্ণগ্রহণের বিস্ময়

পূর্ণগ্রহণের সময় চাঁদ সূর্যকে ঢেকে দেয়, তার ছায়া পৃথিবীর বুকে ভ্রমণ করে প্রচণ্ড গতি নিয়ে। সেই ছায়ার প্রতীক্ষায় বসে থাকা এক অপূর্ব অনুভব। তেমনই গ্রহণের সময় সূর্যের হীরক দ্যুতি, প্রমিনেন্স ও করোনা, দিনের আলোয় শুক্র গ্রহের আবির্ভাব, বাতাসের শীতলতা—সবই এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। মানুষের সঙ্গে আমাদের সৌরজগতের মেলবন্ধন ঘটাতে পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না। যাঁদের সেটা দেখার অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা জানেন এটা কী রকম আবেগপূর্ণ ব্যাপার।

যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকে ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট একটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছিল। সেই গ্রহণ দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় লিখেছিলেন জ্যোতিঃপদার্থবিদ দীপেন ভট্টাচার্য

চাঁদ যেন হঠাৎ সূর্যকে ঢেকে ফেলল

২০১৭ সালের ১৯ আগস্ট আমি যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেটে ছিলাম। আমার পরিকল্পনা ছিল আইওয়া থেকে দক্ষিণে মিজৌরি কিংবা পশ্চিমে নেব্রাস্কা স্টেটে ছয়-সাত ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে গিয়ে পূর্ণগ্রহণ দেখার। কিন্তু ১৯ তারিখ গভীর রাতে আবহাওয়ার খবরে দেখলাম মিজৌরি ও নেব্রাস্কার আকাশ ২১ তারিখ মেঘাচ্ছন্ন থাকার সম্ভাবনা। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম নেব্রাস্কারও পশ্চিমে ওয়াইওমিং স্টেটে যাওয়ার। আমরা যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে ওয়াইওমিং প্রায় ১ হাজার ৩৫০ কিলোমিটার দূরে। ২০ তারিখ সারা দিন গাড়ি চালিয়ে সাউথ ডাকোটার র‍্যাপিড সিটিতে পৌঁছালাম। চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে আবার ভোররাত সাড়ে তিনটায় রওনা দিয়ে পরদিন সকাল আটটা নাগাদ ওয়াইওমিংয়ের ডগলাস নামের একটা শহরে পৌঁছালাম। পথে দেখলাম লোকজন রাস্তার ধারেই তাদের গাড়ি পার্ক করে ক্যামেরা ইত্যাদি বের করে গ্রহণ দেখার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের ভাগ্য ভালো যে ডগলাস শহরে একটা বড় মাঠে গাড়ি পার্ক করে গ্রহণ দেখার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে ক্যামেরা ইত্যাদি বসানোর জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিল।

আমার সঙ্গে দুটো ক্যামেরা ছিল। প্রথমটি হলো Canon 6D। এই ক্যামেরার সঙ্গে যে লেন্সটা ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা ১৩৫ মিমি ফোকাল দূরত্বের Rokinkon লেন্স। এটি শুধু পূর্ণগ্রহণের জন্য ব্যবহার করা হবে বলে প্রস্তুত করা হয়েছিল। সূর্যের করোনার ছবিটা যাতে আসে, সে জন্য কম ফোকাল দূরত্বের লেন্স ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিই। ফোকাস দূরত্ব ঠিক করতে আগেই রাতের তারাদের ছবি তুলে যে সেটিংয়ে তারাদের ছবি সবচেয়ে স্পষ্ট হয়, ক্যামেরা সেটিং ঠিক করা হয়েছিল। এ ছাড়া ISO 200 ও অ্যাপেরচার f/5.6 ঠিক করে রাখা হয়। গ্রহণ শুরুর সময় থেকে বিভিন্ন সময়ের এক্সপোজারও ব্যবহার করা হয়, যেমন ১/১০০০, ১/২৫০, ১/৬০, ১ সেকেন্ড ইত্যাদি। সূর্যের কাছের করোনা ও প্রমিনেন্সকে ধরার জন্য অল্প সময়ের এক্সপোজার ও দূরের করোনাকে ধারণ করার জন্য বেশি সময়ের এক্সপোজার দরকার। এই ক্যামেরার সঙ্গে একটা রিমোট নিয়ন্ত্রণ লাগানো ছিল, যাতে দূর থেকে শাটার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ফলে শাটার টেপার ঝাঁকুনি থেকে ক্যামেরাকে মুক্ত রাখা যায়।

পূর্ণ গ্রহণের ছবি তোলার জন্য এখানে আমি ক্যামেরার স্র্ব্যাপ খুলছি। বাতাসে স্র্ব্যাপ নড়লে সেটা ক্যামেরাকেও নাড়াবে। যে স্ট্যান্ডের ওপর ক্যামেরা বসানো হচ্ছে, সেটা যত ভারী হয় তত ভালো, সেটা না হলে স্ট্যান্ডটাকে ছোট করতে হবে, যাতে ক্যামেরা মাটির কাছাকাছি থাকে

অন্য ক্যামেরাটি ছিল একটি Nikon P900। এটির লেন্সকে বিভিন্ন ফোকাল দূরত্বে পরিবর্তন করা যায়, মোটামুটি ২৫০ মিমি ফোকাল দূরত্ব ঠিক রেখে এই ক্যামেরাটা আংশিক গ্রহণ রেকর্ড করতে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই ক্যামেরার ওপর একটা কালো পলিমারের বিশেষ সৌরীয় ফিল্টার ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের ছিল ফিল্টারসহ চশমা ও বাইনোকুলার।

একটা কথা ঠিক যে সূর্যগ্রহণের জন্য যতই প্রস্তুতি থাক না, পূর্ণগ্রহণের সময়টা এত দ্রুত যায় যে মনে হয়, মাত্র কয়েক সেকেন্ড ছিল তার স্থায়িত্ব। এবারও এই অভিজ্ঞতার অন্যথা হয়নি। অন্যদিকে গ্রহণ সময়কার কোনো ছবিই চাক্ষুষ দেখার অভিজ্ঞতাকে পুরোপুরি তুলে ধরতে পারে না। যেমন ধরুন, গ্রহণের সময় আকাশের রং। দিগন্তজুড়ে যে সন্ধ্যাকালীন লাল আলো থাকবে, সেটা আমরা জানি। কারণ, দিগন্ত চাঁদের ছায়ার বাইরে থাকে, কাজেই সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায়। কিন্তু দিগন্ত ছাড়াও ছায়ার বাইরে ওপরের বায়ুমণ্ডলে সূর্যের আলো বিচ্ছুরিত হয়। এর জন্য আকাশ পুরোপুরি কালো হতে পারে না, বরং একধরনের কালচে নীল হয়ে যায়। আধুনিক স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল ক্যামেরা সঠিকভাবে আকাশটা কত অন্ধকার হয়ে যায়, সেটা ধরতে পারে না। কারণ, পৃথিবী যত অন্ধকার হতে থাকে, সেই ক্যামেরা তার এক্সপোজারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আরেকটা ব্যাপার হলো ছায়া। আংশিক গ্রহণের সময় সূর্য যে ছায়া ফেলে, সেটাও যেন অন্য রকম। কারণ সূর্যের শক্তি তখন অপেক্ষাকৃতভাবে কম। সেই ছায়া স্পষ্ট কিন্তু একই সঙ্গে কেমন জানি নরম।

আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানে চাঁদ সকাল ১০টা ২৩ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডে সূর্যকে প্রথম স্পর্শ করে। আর পূর্ণগ্রহণ শুরু হয় ১১টা ৪৪ মিনিট ২৫ সেকেন্ডে। পূর্ণগ্রহণের স্থায়িত্বকাল ছিল ২ মিনিট ২২ সেকেন্ড। আগেই বলেছি, গ্রহণের জন্য যতই প্রস্তুতি থাকুক না কেন, চাঁদ যেন হঠাৎ করে ঢেকে ফেলে সূর্যকে, যদিও আংশিক গ্রহণ ঘণ্টা দেড়েক আগেই শুরু হয়েছে। চাঁদের ছায়াটা পশ্চিম দিক কালো করে এসে পড়ে মুহূর্তেই। ক্যামেরায় ফটো তুলব না খালি চোখে গ্রহণ দেখব—এই দ্বন্দ্বেই সময় চলে যায়, যদিও রিমোট শাটার অনেকটা সময় বাঁচায়। তবে এটা ঠিক, খালি চোখে দেখার কোনো বিকল্প হতে পারে না। তবু অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি ছবি তোলা গেছে, সেগুলোর কয়েকটি এখানে দিচ্ছি।

গ্রহণের কলকবজা

সূর্যগ্রহণের সময় পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য একই সরলরেখায় আসে। এই চাঁদ হলো অমাবস্যার চাঁদ। অথচ প্রতিটি অমাবস্যায় কিন্তু সূর্যগ্রহণ হয় না। কারণ, চাঁদ সাধারণত সূর্যের একটু ওপরে না হয় একটু নিচ দিয়ে সূর্যকে পাড়ি দেয়। ১ নম্বর চিত্রে আমরা দেখছি পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের কক্ষপথ সৌরীয় তল বা অয়নপথকে (Ecliptic) প্রায় ৫ ডিগ্রি কোণে ছেদ করে। পৃথিবীর উত্তর মেরুর অনেক ওপর থেকে সৌরমণ্ডলের দিকে তাকালে যা দেখা যায়, এই চিত্র সেভাবে আঁকা হয়েছে। চাঁদ যখন দক্ষিণ থেকে উত্তরে যায় এবং অয়নপথের সঙ্গে ০ ডিগ্রি অবস্থানে আসে, সেই বিন্দুকে উচ্চপাত (Ascending node) এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়ার সময় অয়নপথের ছেদবিন্দুকে নিম্নপাত (Descending node) বলা হয়। শুধু সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদের উচ্চপাত বা নিম্নপাত (যেকোনো একটি নোড) যখন একটা সরলরেখায় আসে, তখনই সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ হতে পারে। নিচের চিত্রে দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ সময় চাঁদের ছায়া পৃথিবীতে পড়ে না এবং আমরা গ্রহণ দেখতে পাই না।

চিত্র ১: সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদের উচ্চপাত বা নিম্নপাত (যেকোনো একটি নোড) একটি সরলরেখায় এলে সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হতে পারে। শুধু চাঁদ যখন একটি নোডে থাকে, তখনই গ্রহণ হতে পারে। এই শর্ত সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য

প্রতি ২৭.২১২২ দিন (যাকে ড্রাকোনিক মাস বলে) পরপর চাঁদ উচ্চপাত বা নিম্নপাতে (Node) ফিরে আসে। তবে ঠিক একই জায়গায় ফিরে আসে না, পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে দেখলে সে আগের পূর্ববর্তী নোডের একটু পশ্চিমে অয়নপথকে ছেদ করে। এক ড্রাকোনিক মাসে চাঁদ আগের ছেদবিন্দুর তুলনায় ১.৪৪ ডিগ্রি ও এক বছরে ১৯.৩৬ ডিগ্রি সরে, ১৮.৬০ বছর পর পুনরায় তার নোড একই বিন্দুতে ফিরে আসে।

চিত্র ৩: মানচিত্রে গত ২১ আগস্ট আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আংশিক ও পূর্ণ সূর্যগ্রহণের গতিপথ

সারোস চক্র

একবার গ্রহণ হলে এর পরবর্তী গ্রহণটি আগাম বলা সম্ভব। গ্রহণের পুনরাবৃত্তি কেন হয়, সে জন্য তিন ধরনের মাস ও বছরকে আমাদের বুঝতে হবে। প্রথমটি হলো এক অমাবস্যা (বা পূর্ণিমা) থেকে পরবর্তী অমাবস্যা (বা পূর্ণিমা)। একে জ্যোতির্বিদেরা বলেন সাইনোডিক (synodic) মাস। এর গড় দৈর্ঘ্য ২৯.৫৩০৫৯ দিন। দ্বিতীয়টি হলো একটি উচ্চপাত (বা নিম্নচাপ) যে জায়গায় সূর্যের সঙ্গে একটি সরলরেখায় মিলিত হয়েছিল, সেখানে বছর শেষে সূর্যের ফিরে আসতে যে সময় লাগে। একে বলে ড্রাকোনিক বছর। যেহেতু চাঁদের নোড বছরে ১৯.৩৬ ডিগ্রি পেছনে সরে আসে, সে জন্য ড্রাকোনিক বছর সৌরীয় বছর থেকে কয়েক সপ্তাহ ছোট। এক ড্রাকোনিক বছর ৩৪৬.৬২০০৫ দিনের সমান। তৃতীয়ত, এক অনুভূ (Perigee) থেকে আরেক অনুভূ পর্যন্ত যেতে চাঁদের যত সময় লাগে। অনুভূ হচ্ছে পৃথিবীর কাছে চাঁদের সবচেয়ে নিকটবর্তী অবস্থান। একে বলে Anomalistic মাস, যার পর্যায়কাল হলো ২৭.৫৫৪৫৫ দিন।

চিত্র ৪: পূর্ণগ্রহণের শুরুতে, যখন চাঁদ সূর্যকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে, তখন সূর্যের এক অংশের আলো আমাদের চোখে পৌঁছায়, যা কিনা একটা আংটির দ্যুতিমান অংশের মতো মনে হয়। এই দৃশ্যকে হিরের আংটি নামে অভিহিত করা হয়

এই তিনটি পর্যায়কাল (ড্রাকোনিক মাস, ড্রাকোনিক বছর ও আনোমালিস্টিক মাস) প্রতি ১৮ বছর ১১ দিন (৬৫৮৫ দিন) অন্তর সূর্য, চাঁদ ও পৃথিবীকে একই সরলরেখায় আনে। কারণ, ১.২২৩ সাইনোডিক মাস = ৬৫৮৫ দিন ৭.৭২ ঘণ্টা, ২.১৯ ড্রাকোনিক বছর = ৬৫৮৫ দিন ১৮.৮ ঘণ্টা এবং ৩.২৩৯ আনোমালিস্টিক মাস = ৬৫৮৫ দিন ১২.৯ ঘণ্টা। এই সমাপতনের কারণে একবার গ্রহণ হলে ৬৫৮৫.৩২২ বছর বা ১৮ বছর ১১ দিন ৮ ঘণ্টা পর আবার গ্রহণ হবে। এই পর্যায়কালকে সারোস পর্যায়কাল বলা হয় (Saros Cycle) বলা হয়। সারোস পর্যায় সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। একটি সারোস পর্যায়কালের পর আরেকটি অমাবস্যা (সূর্যগ্রহণ) বা পূর্ণিমা (চন্দ্রগ্রহণ) হবে। পৃথিবী ও চাঁদের দূরত্ব এবং চাঁদ ও সূর্যের দূরত্ব মোটামুটি একই হবে। তবে এখানে দুটি পার্থক্য থাকবে—একটি হলো অতিরিক্ত ৮ ঘণ্টা আবর্তনের ফলে পরবর্তী গ্রহণটি আগের গ্রহণের জায়গা থেকে ১২০ ডিগ্রি দূরে হবে, দ্বিতীয়টি হলো পরের গ্রহণটির অক্ষাংশ (Latitude) বদলাবে।

চিত্র ৫: বেইলির বিন্দু—সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দেওয়ার মুহূর্তে চাঁদের অমসৃণ অংশের ওপর দিয়ে আমাদের চোখে পৌঁছায় সূর্যের যে আলো—যা কিনা বিন্দু বিন্দু আকারে দেখা যেতে পারে

গত ২১ আগস্টের গ্রহণটি ছিল সারোস ১৪৫ চক্রের। ১৪৫ চক্রের আগের গ্রহণটি হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ১১ আগস্ট, আর পরেরটি হবে ২ সেপ্টেম্বর ২০৩৫ সালে। প্রতিবছরই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও অন্তত একটি আংশিক, বলয় বা পূর্ণগ্রহণ দেখা যায়। তার মানে একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি সারোস চক্র বিদ্যমান। যেমন ২০০৯ সালের ২২ জুলাই বাংলাদেশ থেকে যে গ্রহণ দেখা গিয়েছিল, সেটা ছিল সারোস ১৩৬ চক্রের অংশ। একই সময়ে প্রায় ৪০টি সারোস চক্র চলতে পারে, আবার একটি সারোস চক্রের শুরু ও শেষও আছে। যেমন ২১ আগস্টের ১৪৫ সারোস চক্র শুরু হয়েছিল ১৬৩৯ সালের ৪ জানুয়ারি এবং সেটি শেষ হবে ৩০০৯ সালের ১৭ এপ্রিল। অর্থাৎ প্রায় ১৩৭০ বছর সারোস চক্রটি স্থায়ী হবে। এর প্রথম গ্রহণটি হয়েছিল দক্ষিণ মেরুর কাছে আর শেষ গ্রহণটি হবে উত্তর মেরুর কাছে। শেষ গ্রহণের ১৮ বছর পর গ্রহণটি হওয়ার কথা, সেই সময় চাঁদের ছায়া পৃথিবীকে আর স্পর্শ করবে না। একটি সারোস চক্রে ৭০টির মতো গ্রহণ হতে পারে। সারোস চক্র যেমন সূর্যগ্রহণের বেলায় প্রযোজ্য, তেমনি চন্দ্রগ্রহণের বেলাতেও। সঠিকভাবে সূর্যগ্রহণের ভাবীকথন কঠিন কাজ, কিন্তু বর্তমানের বিজ্ঞান সেটি করতে পেরেছে।

চিত্র ৬: প্রমিনেন্স—সূর্যের পৃষ্ঠদেশে সৃষ্ট বক্রাকৃতি লাল রঙের প্লাজমা, যা কিনা সৌরীয় চৌম্বকক্ষেত্র অনুসরণ করে

চাঁদের ছায়ার গতিবেগ

২১ আগস্টের পূর্ণ সূর্যগ্রহণের স্থায়িত্ব ছিল দুই থেকে আড়াই মিনিট। চাঁদের ছায়া আমেরিকার পশ্চিমে ওরিগনের উপকূল দিয়ে প্রবেশ করে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পূর্ব উপকূল দিয়ে প্রস্থান করে। সূর্যগ্রহণের সময় একটা প্রশ্ন সবাই করে সেটা হলো, চাঁদ পশ্চিম থেকে সূর্যকে ঢাকবে নাকি পূর্ব থেকে। আমরা উত্তর মেরুর ওপর থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখব, পৃথিবী তার অক্ষের চারদিকে বামাবর্তী বা ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরছে। এই ঘূর্ণনের গতিবেগ বিষুবরেখায় প্রায় ০.৫ কিলোমিটার সেকেন্ডে, আর ঢাকায় প্রায় ০.৪ কিমি/সেকেন্ডে। পৃথিবীর উচ্চতর অক্ষাংশে এ মানটি কমতে থাকে এবং মেরুতে শূন্য হয়ে যায়। তাই বিষুবরেখায় অবস্থিত একটি বিন্দু প্রতি ঘণ্টায় পূর্ব দিকে ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার বেগে ছুটছে। অন্যদিকে পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের গতি হলো ঘণ্টায় প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কিমি। উত্তর মেরু থেকে দেখলে চাঁদের গতিও বামাবর্তী। এবার ধরা যাক, আমরা বিষুবরেখার কোনো বিন্দুতে অবস্থিত। তাহলে পৃথিবী স্থির থাকলে পৃথিবীর বুকে চাঁদের ছায়া ঘণ্টায় ৩ হাজার ৭০০ কিলোমিটার বেগে পূর্ব দিকে সরত (চাঁদের কক্ষপথ ও ভূপৃষ্ঠ বক্র হলেও কয়েক মিনিটের জন্য আমরা ওই কক্ষপথকে একটা সরলরেখা বলে কল্পনা করে নিতে পারি)। কিন্তু যেহেতু পৃথিবী ওখানে ঘণ্টায় ১ হাজার ৭০০ কিমি বেগে সেই পূর্ব দিকেই সরছে, সে জন্য আমাদের কাছে মনে হবে, চাঁদের ছায়া বিষুবরেখার কাছে ৩ হাজার ৭০০ - ১ হাজার ৭০০ = ২,০০০ কিমি বেগে পৃথিবীর বুকে ভ্রমণ করছে। বিভিন্ন অক্ষাংশে এই মান বিভিন্ন হবে। যেমন ২১ আগস্টের গ্রহণের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমে যেখানে গ্রহণের শুরু, সেখানে ছায়ার গতি ছিল ঘণ্টায় ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটার, আবার গ্রহণের মাঝামাঝি জায়গায় ঘণ্টায় ২ হাজার ৪০০ কিমি। এই বিভিন্ন গতিবেগের কারণ পৃথিবীর অক্ষাংশ ও বক্রতা, গ্রহণ শুরু হয় পশ্চিমের বক্র দিকে আর শেষ হয় পূর্বের বক্র দিকে। আর মাঝামাঝি সময়ে ছায়া মোটামুটি সমতলভূমিতে ভ্রমণ করে। আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে এই ছায়া প্রায় ৫ হাজার কিমি পথ প্রায় দুই ঘণ্টা সময়ে পাড়ি দিয়েছে।

চিত্র ২: সারোস ১৩৬ চক্রের কয়েকটি গ্রহণপথ। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে যে সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছিল, সেটা ছিল সারোস ১৩৬ চক্রের অংশ। এই চক্রের পরবর্তী গ্রহণ হবে ২০২৭ সালের ২ আগস্ট, কিন্তু সারোস পর্যায়ের বাড়তি আটটি ঘণ্টার জন্য ওই গ্রহণপথটি ১২০ ডিগ্রি সরে যাবে। এমনকি ১৮ x ৩ = ৫৪ বছর পরে যে গ্রহণটি হবে, অক্ষাংশের পরিবর্তনের কারণে সেটিকেও বাংলাদেশ থেকে দেখা যাবে না

অন্যদিকে চাঁদের ব্যাস হলো ৩ হাজার ৪৭৪ কিমি। যেহেতু পৃথিবী থেকে দেখলে চাঁদ ও সূর্যের উভয়েরই কৌণিক ব্যাস ০.৫ ডিগ্রি, তাই আংশিক ও পূর্ণগ্রহণ মিলিয়ে মোট (৩৪৭৪ x ২)/২৪০০ = ৩ ঘণ্টা (প্রায়) সময় লাগবে। এখানে আমরা চাঁদের ছায়ার গতি ঘণ্টায় ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার ধরেছি। ছায়ার গতিবেগ যত কম হবে, পূর্ণগ্রহণের সময়ও তত বেশি হবে। তাই আমেরিকার পশ্চিমে পূর্ণগ্রহণের সময় ছিল ২ মিনিট আর মাঝখানে ছিল ২ মিনিট ৪০ সেকেন্ড। যেহেতু এবারকার ছায়ার ব্যাস হলো ১০০ কিলোমিটারের মতো, সে জন্য মাঝামাঝি জায়গায় পূর্ণগ্রহণ মাত্র ১০০/২,৪০০ = ০.০৪২ ঘণ্টা বা ২.৫ মিনিট স্থায়ী হয়।

চিত্র ৭: সূর্যপৃষ্ঠের অনেক ওপরে করোনা, যার দৃশ্যমান আলো ইলেকট্রনের ওপর বিচ্ছুরিত সূর্যের আলো ও আয়োনিত লোহা থেকে উত্পন্ন। করোনার তাপমাত্রা প্রায় ১ মিলিয়ন কেলভিন

সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব

১৯১৯ সালে আর্থার এডিংটন ও তাঁর দল পশ্চিম আফ্রিকার কাছে প্রিন্সিপে দ্বীপে সূর্যগ্রহণের ছবি তুলেছিল আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রমাণের জন্য। ওই ছবিতে সূর্যের পাশের কয়েকটি তারার অবস্থান বিশ্লেষণ করে এডিংটন দেখিয়েছিলেন, তাদের আলো আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে স্থান-কালের বক্রতা অনুসরণ করে। এভাবে প্রথমবারের মতো আপেক্ষিক তত্ত্বের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়। পরে যদিও এডিংটনের ওই গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, কিন্তু ১৯৭৯ সালে ১৯১৯-এ তোলা ছবিগুলো আবার বিশ্লেষণ করে এডিংটনের দাবির সত্যতা প্রতিষ্ঠা করা গেছে। বর্তমানে সূর্যের কাছাকাছি অবস্থানে থাকার সময় শুক্র ও বুধ গ্রহের পৃষ্ঠ থেকে পৃথিবী থেকে প্রেরিত রাডার বেতারতরঙ্গের প্রতিফলনের সময় থেকেই আপেক্ষিকতার সূত্রকে প্রমাণ করা যায়। অনেক শৌখিন জ্যোতির্বিদ এবারকার সূর্যের গ্রহণের ছবি তুলে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী তারাদের স্থান পরিবর্তন দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রেগুলাস ছাড়া অন্য কোনো তারা ছবিতে উঠেছে কি না, সেটা আমার জানা নেই (চিত্র ৮)। একটিমাত্র তারা ব্যবহার করে স্থান-কালের বক্রতা নির্ধারণ করা কঠিন।

চিত্র ৮: এই ছবিতে সূর্যের নিচে বাঁ দিকে রেগুলাস তারাকে দেখা যাচ্ছে

ভবিষ্যৎ

আমার আবছাভাবে মনে পড়ে ১৯৬৫ সালের ২৩ নভেম্বরের গ্রহণ। মা-বাবা কালিঝুলি মাখা কাচ দিয়ে দেখিয়েছিলেন গ্রহণ, কিন্তু সেটা ছিল বলয়গ্রহণ; পূর্ণগ্রহণ নয়। বলয়গ্রহণের সময় চাঁদ আমাদের থেকে দূরে থাকে, সূর্যকে পুরোপুরি ঢাকতে পারে না। সূর্য আংটির মতো চাঁদের কালো চাকতির চারদিকে জেগে থাকে। ফলে পূর্ণগ্রহণের আবহ পাওয়া যায় না। ১৯৯৫ সালের ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে একটি পূর্ণগ্রহণের পথ গিয়েছিল, আধুনিক সময়ে সেটাই ছিল প্রথম গ্রহণ। বাংলাদেশের জ্যোতির্বিদ্যায় উত্সাহীরা সেটা দেখতে গিয়েছিলেন সুন্দরবনে। এরপর পূর্ণগ্রহণ হয়েছিল ২০০৯ সালের ২২ জুলাই। অনুসন্ধিত্সু চক্রের একটা বড় দলকে নিয়ে সেবার পঞ্চগড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। সেখানে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ পঞ্চগড় স্টেডিয়ামে জড়ো হয়েছিল। সেই সকালে আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন, বৃষ্টি পড়ছিল। তবু পূর্ণগ্রহণের সময় আমরা যখন সম্পূর্ণ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিলাম, সেই সময়ের আবেগ স্টেডিয়ামে উপস্থিত সবাইকে এক অনুভূতির সূত্রে আবদ্ধ করেছিল। আমরা সবাই প্রকৃতির এই চমকপ্রদ প্রদর্শনীতে সমবেতভাবে হাততালি দিয়েছিলাম। এবারও তার অন্যথা হয়নি।

আমরা নক্ষত্রের সন্তান এবং আমাদের সবার ভবিষ্যৎ যে সূর্য নামক নক্ষত্রটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেটা গ্রহণের মাহেন্দ্রমুহূর্তে যেন ক্ষণিকের জন্য হলেও বুঝতে পারি। মহাবিশ্বে এমন কিছু জিনিস আছে, যা কিনা সব ধরনের মানুষকে এক করতে পারে, পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হলো এমনই একটি ঘটনা। আমরা এমন একসময়ে বাস করছি, যখন চাঁদের কৌণিক আকার সূর্যের কৌণিক আকারের সমান, যাতে পূর্ণগ্রহণ হতে পারে। কিন্তু জোয়ার-ভাটা ইত্যাদির কারণে চাঁদ প্রতিবছর পৃথিবী থেকে প্রায় ৪ সেন্টিমিটার দূরে সরে যাচ্ছে। এর ফলে ধীরে ধীরে গ্রহণের সংখ্যা কমবে। তবে শেষ পূর্ণগ্রহণ হতে অন্তত ৬০০ মিলিয়ন বছর থেকে ১ বিলিয়ন বছর লাগবে। বিশেষজ্ঞরা তা-ই বলেছেন। সেটা সুদূর ভবিষ্যতে, কিন্তু সূর্যগ্রহণ সব সময়ই একটি বিরল ঘটনা—ঢাকা শহর থেকে শেষ পূর্ণগ্রহণ দেখা গিয়েছিল ১৮৯০ সালের ১৭ জুন।বাংলাদেশে আরেকটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ২১১৪ সাল পর্যন্ত। এই বিরলতাই প্রতিটি পূর্ণগ্রহণকে করেছে মূল্যবান।

লেখক: জ্যোতিঃপদার্থদি ও অধ্যাপক, রিভারসাইড কলেজ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত