নভোচারী ১০ প্রাণী

ছবি: নিউ সায়েন্টিস্ট

১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে অ্যাপোলো ১১ মিশনে প্রথমবারের মতো চাঁদে পা রাখেন নীল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন। পৃথিবীর বাইরের গ্রহ-উপগ্রহ-গ্রহাণু—সব মিলে এটাই মানুষের প্রথম অবতরণ। উল্লেখ্য, এ সময় অ্যাপোলো ১১ নভোযানে চাঁদের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করছিলেন মাইকেল কলিন্স। তবে চন্দ্রজয়ের এই সফলতা একবারে আসেনি। এ জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে অনেক প্রাণীকে। মানুষ প্রথম মহাকাশে যাওয়ার আগে বেশ কিছু প্রাণীকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। এর পরেও বারেবারে মহাকাশ অভিযানের আগে বিভিন্ন প্রাণীকে পাঠানো হয়েছে মহাকাশে। মূলত মহাকাশে প্রাণীদের বাসযোগ্যতা পরীক্ষা করার জন্যই এ কাজ করা হয়েছে নানা সময়। অর্থাৎ এসব প্রাণী ছিল, যাকে বলে, ‘গিনিপিগ’। এগুলোর বেশির ভাগই মারা গেছে। চলুন, সেসব প্রাণীর সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।

১. মাছি

ছবি: হাউ স্টাফ ওয়ার্কস

মহাকাশে প্রথম প্রাণী পাঠানো হয় ১৯৪৬ সালের ৬ জুলাই। সেই প্রাণীটি ছিল ছোট্ট মাছি। মানুষের ওপর মহাজাগতিক বিকিরণ কেমন প্রভাব ফেলে, তা পরীক্ষা করার জন্য মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা মহাকাশে মাছি পাঠিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে নাৎসিদের হাত থেকে উদ্ধার করা একটা ভি-২ ফ্লাইট রকেটে একগাদা মাছি বোঝাই করা হয়। তারপর সেগুলো পাঠানো হয় ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০৯ কিলোমিটার ওপরে। মহাকাশ বলতে আমরা যা বুঝি, তা এই দূরত্ব থেকেই শুরু হয়। যাহোক, ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মাছিগুলো পৃথিবীতে ফিরেয়ে আনা হয়। ক্যাপসুল খোলার পর জীবিত পাওয়া যায় মাছিগুলো। তেজস্ক্রিয়তারও কোনো প্রভাব পাওয়া যায়নি। এগুলোই ছিল মহাকাশে যাওয়া প্রথম প্রাণী।

২. বানর ও বানরজাতীয় প্রাণী

ছবি: রেডিও ফ্রি ইন স্পেস

এখন পর্যন্ত ৩২টি বানর ও বানরজাতীয় প্রাণী মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রেসাস বানর, পিগ-টেইল বানর ও শিম্পাঞ্জিসহ নানা প্রজাতির বানর। এর মধ্যে প্রথমবার সফলভাবে মহাকাশে যায় দ্বিতীয় আলবার্ট নামে একটি রেসাস বানর। ১৯৪৯ সালে ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৩৪ কিলোমিটার ওপরে গিয়েছিল বানরটি। কিন্তু প্যারাসুট খারাপ হয়ে যাওয়ায় পৃথিবীতে অবতরণের সময় বানরটি মারা যায়। এর এক বছর আগে, ১৯৪৮ সালে প্রথম আলবার্ট বানরটি রকেট উৎক্ষেপণের সময় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। এরপর ১৯৬১ সালের ৩১ জানুয়ারি নাসা হ্যাম নামে একটি শিম্পাঞ্জি পাঠায় মহাকাশে। হ্যাম নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসে এবং ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিল।

৩. ইঁদুর

ছবি: সায়েন্স

মহাকাশ ভ্রমণে মানবদেহে কী প্রভাব পড়ে, তা আরও বিস্তারিত জানতে দীর্ঘদিন ইঁদুর ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকা ইঁদুর নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে নাসা। গবেষণায় দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের ইঁদুরগুলো দ্রুত মাইক্রোগ্র্যাভিটির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে। মহাকাশে প্রথম ইঁদুর পাঠানো হয় ১৯৫০ সালে। ইঁদুরটি ১৩৭ কিলোমিটার উচ্চতায় পৌঁছেছিল। কিন্তু এটি প্যারাসুট নষ্ট হওয়ার ফলে মারা যায়।

৪. কুকুর

ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

মহাকাশে যেসব প্রাণী গেছে, এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটা কুকুর। নাম লাইকা। সম্ভবত সবাই এই কুকুরের নাম একবার হলেও শুনেছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বেশ কয়েকটি কুকুরকে মহাকাশে পাঠিয়েছে। এর প্রথমটি এই লাইকা। কুকুরটি মহাকাশে যায় ১৯৫৭ সালে। মস্কোর রাস্তা থেকে কুকুরটিকে তুলে এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কারণ, রাস্তার কুকুর তুলনামূলক বেশি প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে। এ জন্যই নামীদামী কুকুর না পাঠিয়ে পাঠানো হয় রাস্তার একটি সাধারণ কুকুর। এর আগে যেসব কুকুর মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল, সেগুলো পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেনি। পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা প্রথম প্রাণী ছিল লাইকা। কিন্তু লাইকাও আর ফিরে আসেনি। মাত্র একবেলার খাবার খাইয়ে, সাত দিনের অক্সিজেনের ব্যবস্থা করে পৃথিবী থেকে বিদায় দেওয়া হয়েছিল কুকুরটিকে। সোভিয়ের সরকার দাবি করে, লাইকা ৭ দিন মহাকাশে বেঁচে ছিল। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, ক্যাপসুলের মধ্যকার অতিরিক্ত গরম হিসাবে নিলে মাত্র ৫ ঘণ্টার মধ্যেই মারা যাওয়ার কথা লাইকার।

৫. কচ্ছপ

ছবি: ডিসকভার ম্যাগাজিন

খরগোশ ও কচ্ছপের কাহিনি নিশ্চয়ই সবাই জানেন। ধীরগতির কচ্ছপ দৌড়ে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু কচ্ছপের কাহিনি এখানেই শেষ নয়। মহাকাশে পর্যন্ত চলে গেছে কচ্ছপ। ১৯৬৮ সালে চাঁদে মানুষ পাঠানো নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সে সময় মাটি, বীজের নমুনা, কিছু কীট ও দুটি কচ্ছপসহ ‘জন্ড ৫’ মিশন পরিচালনা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। পৃথিবীর চারপাশে একবার চক্কর দিয়ে কচ্ছপ দুটি আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। মহাকাশযানটির অবতরণ করার কথা ছিল কাজাখস্তানে। কিন্তু ক্যাপসুলের গতিপথ বদলে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ভারত মহাসাগরে গিয়ে পড়ে। সৌভাগ্যক্রমে তখনো কচ্ছপ দুটি বেঁচে ছিল। তবে ওজন কমে গিয়েছিল ১০ ভাগ।

৬. ব্যাঙ

ছবি: দ্য ভার্জ

মহাকাশে ব্যাঙ পাঠানোর জন্য গবেষণা শুরু হয় ১৯৫৯ সালে। তবে মহাকাশে ব্যাঙ পাঠানো হয় ১৯৭০ সালে। নাসা সেবার দুটি ব্যাঙ পাঠিয়েছিল। পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালানোর জন্য ব্যাঙের শরীরে নানা যন্ত্র লাগানো হয়েছিল। গবেষণা শেষে দেখা গেছে, ৬ দিন পর ব্যাঙগুলো মহাকাশের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিল।

৭. মাকড়সা

ছবি: সায়েন্স টেক ডেইলি

১৯৬৯ সালে চাঁদে প্রথম মানুষ পাঠানোর পর মহাকাশে প্রাণী পাঠানোর দিকে আরও জোর দেওয়া হয়। প্রাণীদের ওপর মাইক্রোগ্র্যাভিটি কেমন প্রভাব ফেলে, তা বোঝার জন্য আরও প্রাণী মহাকাশে পাঠানোর উদ্যোগ নেয় নাসা। ১৯৭৩ সালে অনিতা ও আরাবোলা নামে দুটি মাকড়সা পাঠানো হয় মহাকাশে। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেমন, মহাকাশেও মাকড়সা জাল বুনতে পারে কি না। এ পরীক্ষা করার বুদ্ধিটা এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস হাই স্কুলের ছাত্র জুডিথ মাইলসের মাথা থেকে। সে পরীক্ষায় পাস করেছিল মাকড়সা দুটি। তবে মহাকাশে বোনা জাল পৃথিবীর চেয়ে কিছুটা সূক্ষ্ম ছিল।

৮. মাছ

ছবি: নিউ সায়েন্টিস্ট

১৯৭৩ সালে মামিচোগ নামে একটা মাছ পাঠানো হয়েছিল মহাকাশে। সঙ্গে ছিল ৫০টি মাছের ডিম। এ মাছটা ছিল লবণাক্ত জলাভূমির। এরপর ২০১২ সালে জাপানি স্পেস এজেন্সি (জাক্সা) মেডাকা নামে আরও একটি মাছ পাঠায় মহাকাশে। অ্যাকুয়ারিমে মাছের সঙ্গে ছিল খাবার ও একটা এলইডি লাইট। মাছ মহাকাশে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পারে কি না এবং বিকিরণ মাছের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে, তা পরীক্ষা করাই ছিল মিশনের উদ্দেশ্য। পরীক্ষায় দেখা গেছে, মহাকাশে যাওয়ার পর মেডাকা মাছের হাড়ের ঘনত্ব কমে গেছে। শেষদিকে এদের চলার গতিও কমে যায়। এ ছাড়া শারীরবৃত্তিয় কিছু পরিবর্তনও দেখা গেছে। মানুষের ওপর মাইক্রোগ্রাভিটি যেমন প্রভাব ফেলে, এ মাছের ওপরও তেমন প্রভাব পড়েছিল।

৯. টার্কিগ্রেড

ছবি: নিউ সায়েন্টিস্ট

২০০৭ সালে প্রথম টার্কিগ্রেড মহাকাশে পাঠানো হয়। এটি একটি অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এরা জলজ ভালুক নামেও পরিচিত। মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে দেখতে হয়। এই প্রাণীর পৃথিবীর যেকোনো পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা আছে। এমন একটা প্রাণী মহাকাশে কীভাবে টিকে থাকবে, তা পরীক্ষার করার জন্যই টার্কিগ্রেড পাঠানো হয়েছিল মহাকাশে। মহাকাশ থেকে ফেরার পর দেখা গেছে, ৬৮ শতাংশ টার্কিগ্রেড মহাকাশীয় বিকিরণ থেকে বেঁচে ছিল।

১০. নেমাটোডা

ছবি: দ্য কনভার্সেশন

কলাম্বিয়া স্পেস শাটল ২০০৩ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়। সে মিশনে ৭ নভোচারীর সঙ্গে পরীক্ষা করার জন্য ৮০টি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দিয়ে দেওয়া হয় সঙ্গে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে পৃথিবীতে ফেরার পথে দুর্ঘটনা ঘটে। এতে মারা যান ৭ নভোচারী। কিন্তু নেমাটোডার একটা দল (গোলকৃমি) এই প্রচণ্ড উত্তাপেও বেঁচে ছিল। বর্তমানে মহাকাশে প্রায়ই এই নেমাটোডা বা গোলকৃমি পাঠানো হয় গবেষণার জন্য।

সূত্র: ডিসকভার ওয়াইল্ড লাইফ ডট কম ও নাসা