খসে পড়া তারার গল্প

তারাগুলো নিয়ে প্রাচীনকালে বানানো গল্পগুলো এখন প্রায় সবাই বোঝে

অন্ধকার রাতের আকাশে তারার মিটিমিটি যেকোনো মানুষের জন্য চমৎকার অভিজ্ঞতা। সেই আকাশেই যখন হুট করে একটা তারা খসে পড়ে, দেখতে রূপকথার গল্পের মতোই মনে হয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই আকাশের দিকে তাকিয়ে মানুষ এই তারা ও তারাগুলোর খসে পড়া দেখেছে। মানুষ আকাশের তারাগুলো নিয়ে যেমন শত শত গল্প বানিয়েছে, খসে পড়া তারাগুলো নিয়েও আছে এমন অনেক গল্প। বিশ্বজুড়ে নানা প্রান্তে নানা রকম এসব গল্প। কিন্তু প্রায় সব গল্পেই খসে পড়া তারা সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

এখন আমরা জানি, খসে পড়া তারার সঙ্গে তারার কোনো সম্পর্ক নেই, এগুলো আসলে গ্রহাণু বা ধূমকেতুর টুকরা। মহাকাশে ইতস্তত ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর অভিকর্ষের টানে বায়ুমণ্ডলের দিকে ছুটে আসে। বাতাসের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় বিপুল তাপের উৎপত্তি হয়, জ্বলে ওঠে। ঘটনাটা যখন রাতের আকাশে ঘটে, অন্ধকারে ছুটতে থাকলে মনে হয় জ্বলজ্বলে কিছু একটা আকাশ থেকে খসে পড়ছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যাকে ডাকেন উল্কা বলে, সাধারণ মানুষের কাছে অবশ্য জনপ্রিয় শুটিং স্টার বা খসে পড়া তারা নামেই।

তারাগুলো নিয়ে প্রাচীনকালে বানানো গল্পগুলো এখন প্রায় সবাই বোঝে, সেগুলো আসলে বানানো গল্প, বাস্তবতার কিছু নেই। কিন্তু এই খসে পড়া তারা নিয়ে একটা মিথ এখনো অনেকের বিশ্বাসে রয়ে গেছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশে। ইউরোপ- আমেরিকার বহু মানুষের বিশ্বাস, খসে পড়া তারাগুলোর আছে ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতা। আপনি যদি আকাশ থেকে একটা উল্কা পড়তে দেখেন, তাহলে ওই মুহূর্তে আপনি যা উইশ বা ইচ্ছা করবেন, সে ইচ্ছা পূরণ হবে।

আরও পড়ুন
কানাডার মিকমাও আদিবাসীদের বিশ্বাসটা আবার অন্য রকম। তাদের ধারণা, কোনো একসময় দুই বোন ছিল, যারা আকাশের তারা দেখতে খুব পছন্দ করত। একদিন ঘুরতে ঘুরতে তারা বনের মধ্যে পথ হারায়। সন্ধ্যা হয়ে গেলে অভ্যাসমতো তারা দেখতে শুরু করে তারা।
খসে পড়া তারা হারিয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে, অনেকের বিশ্বাস, উইশটা করে ফেলতে হবে খুবই দ্রুত

কীভাবে ইচ্ছাটা জানাতে হবে, তা নিয়ে অবশ্য এককজনের একেক রকম বিশ্বাস। কেউ কেউ খসে পড়া তারা দেখলেই চোখ বন্ধ করে ইচ্ছাটা জানিয়ে দেন। অনেকে ওই মুহূর্তে একটা পাথর তুলে নেন এবং উইশ করেন। যাঁদের ধারণা, পাথর হাতে নিয়ে ইচ্ছাটা জানাতে হয়, তাঁদের অবশ্য অধিকাংশ সময় ইচ্ছা জানানোর ইচ্ছাটাই পূরণ হয় না, কারণ, হঠাৎ করে একটা পাথর তাঁরা পাবেনই–বা কোথায়? আরেক দলের ইচ্ছা পূরণ করতে হাতে একটা হাতরুমাল থাকতে হয়। হাতরুমালে একটা গিঁট্টু দিয়ে ইচ্ছাটা জানালেই পূর্ণ হবে তাঁদের ইচ্ছা, এমনটাই তাঁদের বিশ্বাস। এই ইচ্ছাপূরণের ক্ষেত্রে অবশ্য আরও একটা শর্ত আছে, উল্কা দেখে যে উইশটা করা হয়েছে, তা গোপন রাখতে হবে সবার কাছ থেকে। কাউকে বলে দিলে আর ইচ্ছাপূরণ হবে না।

খসে পড়া তারা হারিয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে, অনেকের বিশ্বাস, উইশটা করে ফেলতে হবে খুবই দ্রুত। কোনো কোনো জায়গার মানুষ ভাবে, তারা খসে পড়তে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তিনবার ‘টাকা’ বলতে হবে। তারাটা ভ্যানিশ হয়ে যেতে যেতে যদি তিনবার টাকা বলে ফেলা যায়, তাহলেই হবে, দারিদ্র্য দূর হয়ে ধনসম্পদের বিপুল প্রবাহ শুরু হবে। খসে পড়া তারা হারিয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে, অনেকের বিশ্বাস উইশটা করে ফেলতে হবে এর মধ্যেই।

পশ্চিমা সংস্কৃতির অধিকাংশের বিশ্বাস, উল্কা পড়ার মুহূর্তে ইচ্ছা পূরণ হয়। আমরা দেখতেই পাচ্ছি, তাঁদের এই বিশ্বাসে নানা রকমফের আছে। এত রকমফেরের পেছনের কারণটাও অবশ্য বোধগম্য। কারণ, অন্তত দুই হাজার বছর ধরেই তাঁদের এই সংস্কৃতি চলে আসছে। ধারণা করা হয়, উল্কাপাত দেখে ইচ্ছা জানানোর শুরু টলেমির আমলে। দ্বিতীয় শতকে গ্রিক গণিতবিদ উল্কাপাতের উৎপত্তির একটা তত্ত্ব দিলেন। তখন তো সব গ্রহ-নক্ষত্রকেই ভাবা হতো স্বর্গীয় বস্তু। উল্কাপাতও স্বর্গীয় ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত। টলেমির মত ছিল, ঈশ্বর কখনো কৌতূহলে বা কখনো একঘেয়েমি থেকে স্বর্গের গোলক থেকে পৃথিবীর গোলকের দিকে তাকান। যখন পৃথিবীর আকাশ ভেদ করে পৃথিবীকে দেখেন, তখন ওই ছিদ্র দিয়ে দুয়েকটা তারা পৃথিবীতে খসে পড়ে।

আরও পড়ুন
বাল্টিক অঞ্চল ও মধ্য ইউরোপের কিছু দেশে খসে পড়া তারা নিয়ে বিশ্বাসটা মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত। তাদের ধারণা, প্রত্যেক মানুষের নামে একটা তারা আছে আকাশে। মানুষটা মরে গেলে ওই তারাটা আকাশ থেকে খসে পড়ে, যাকে আমরা দেখি খসে পড়া তারা হিসেবে।

ধারণা করা হয়, টলেমির এই তত্ত্ব থেকেই ইচ্ছা জানানোর সংস্কৃতির শুরু। যেহেতু ওই সময়ে ঈশ্বর পৃথিবীর দিকেই তাকিয়ে থাকেন, ঠিক সেদিকে তাকিয়েই যদি ইচ্ছা জানানো হয়, ইচ্ছাটা নিশ্চয়ই পূরণ হবে। এমন বিশ্বাস হাজার দুয়েক বছর যেহেতু চলছে, এই লম্বা সময়ে ইচ্ছা জানানোর পদ্ধতিতে নানা রকমফের হবে, এটাই স্বাভাবিক।

খসে পড়া তারা নিয়ে কিন্তু সব সৌভাগ্যের বিশ্বাসই শুধু প্রচলিত নয়, কোনো কোনো জায়গায় উল্কাপাতকে দেখা হয় দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে

কিন্তু উল্কাপাতের পেছনে শুধু যে টলেমির ধারণা থেকেই গল্পের জন্ম, তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন সভ্যতায়, বিভিন্ন আদিবাসীদের মধ্যে আরও নানা ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। যেমন ধরা যাক, যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যের পাওনি নেশনের আদিবাসীদের কথা। পাওনিয়ানরা বিশ্বাস করে, কোনো একসময় পাহোকাতা নামের একজনকে হিংস্র প্রাণীগুলো খেয়ে ফেলেছিল। কিন্তু ঈশ্বর পাহোকাতাকে আকাশ থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন খসে পড়া তারার আকারে। তাদের কাছে তাই উল্কাপাত অত্যন্ত সৌভাগ্যের ঘটনা। উল্কাপাত দিয়ে পুনর্জন্ম ঘটে, এটাই তাদের বিশ্বাস।

কানাডার মিকমাও আদিবাসীদের বিশ্বাসটা আবার অন্য রকম। তাদের ধারণা, কোনো একসময় দুই বোন ছিল, যারা আকাশের তারা দেখতে খুব পছন্দ করত। একদিন ঘুরতে ঘুরতে তারা বনের মধ্যে পথ হারায়। সন্ধ্যা হয়ে গেলে অভ্যাসমতো তারা দেখতে শুরু করে তারা। এক বোন একটা তারায় ইগল দেখতে পায়, আরেকটা তারায় অন্য বোন দেখে একটা বাজপাখি। পাখি দুটো ছোঁ মেরে দুই বোনকে স্বর্গে তুলে নিয়ে যায়। স্বর্গে গিয়ে দুই বোনের প্রচণ্ড একাকিত্ব অনুভূত হয়। তখন ওই আদিবাসীদের প্রথম প্রাণ ক্লুসকাপ অনুরোধ করে তাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিতে। ক্লুসকাপ দুই বোনকে একটা শর্ত দেয়, তাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তবে ফেরার পথে কোনোভাবেই পেছনে তাকানো যাবে না। শর্তে রাজি হয়ে দুই বোন পৃথিবীর দিকে যাত্রা শুরু করে। ফেরার পথে ছোট বোনের মনে হয়, আসলেই তার বোনকেও পেছনে পাঠিয়েছে কি না দেখা দরকার। ছোট বোন পেছনে তাকায়, মুহূর্তের মধ্যে সে আগুনে পরিণত হয়। সেই আগুনের টুকরাকেই দেখা যায় আকাশের খসে পড়া তারা হিসেবে। মিকমাওরা মনে করে, উল্কা আসলে ওই ছোট বোন।

আরও পড়ুন
সৌভাগ্যটা এমনিতেই আসবে না, গ্রহণ করতে হবে। গ্রহণ করার পদ্ধতি হলো, তাদের ঐতিহ্যবাহী কোর্তা কিমোনোর কলারটা খুলে ধরতে হবে। এখনকার দিনে এই পদ্ধতিতে সহজে নিশ্চয় সৌভাগ্যটা ধরা যায় না।

খসে পড়া তারা নিয়ে কিন্তু সব সৌভাগ্যের বিশ্বাসই শুধু প্রচলিত নয়, কোনো কোনো জায়গায় উল্কাপাতকে দেখা হয় দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে। যেমন ক্যালিফোর্নিয়ার আদিবাসী কাওয়াইসুরা মনে করে, আকাশ থেকে তারা খসে পড়া মানে রোগবালাই ও মৃত্যু আসছে। তবে এমন বিশ্বাস নিয়ে থাকা কিন্তু অনেক কঠিন। ধৈর্য ধরে প্রতি রাতে পরিষ্কার আকাশে তাকালে উল্কাপাত দেখা এমন কোনো বিরল ঘটনা নয়। এই আদিবাসীরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে তাদের পুরো জীবনটাই দুর্বিষহ হয়ে যাওয়ার কথা, অন্তত দুর্বিষহ হওয়ার আশঙ্কায় ছেয়ে যাওয়ার কথা।

বাল্টিক অঞ্চল ও মধ্য ইউরোপের কিছু দেশে খসে পড়া তারা নিয়ে বিশ্বাসটা মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত। তাদের ধারণা, প্রত্যেক মানুষের নামে একটা তারা আছে আকাশে। মানুষটা মরে গেলে ওই তারাটা আকাশ থেকে খসে পড়ে, যাকে আমরা দেখি খসে পড়া তারা হিসেবে। অন্য এমন অঞ্চল আছে, যেখানে আবার ধারণা করা হয়, খসে পড়া তারা আসলে মানুষের আত্মা। যখন কোনো বাচ্চার জন্ম হয়, ওই বাচ্চার আত্মা স্বর্গ থেকে খসে পড়া তারার আকারে পৃথিবীতে আসে।

জার্মান আদিবাসী সাওবিয়ানদের বিশ্বাসটা আবার একটু আলাদা। খসে পড়া তারাতেই আছে সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য। কেউ যদি একটা উল্কাপাত দেখে, তবে তার পরবর্তী এক বছর সৌভাগ্যময়। কিন্তু একই রাতে যদি তিনটা উল্কাপাত দেখে, তাহলে বড়ই দুঃসংবাদ। অচিরেই সে মরে যাবে। এই আদিবাসীরা নিশ্চয় কোনো এক রাতে একটা উল্কা দেখে ফেললে সোজা ঘরে গিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকে, কী দরকার আরও দুটো উল্কা দেখার রিস্ক নেওয়ার।

আরও পড়ুন

জাপানি হাওয়াইয়ান অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস, কখনো যদি খসে পড়া তারা কারও দিকে মুখ করে আসতে থাকে, তাহলে ওই মানুষের বড়ই সৌভাগ্য। কিন্তু সৌভাগ্যটা এমনিতেই আসবে না, গ্রহণ করতে হবে। গ্রহণ করার পদ্ধতি হলো, তাদের ঐতিহ্যবাহী কোর্তা কিমোনোর কলারটা খুলে ধরতে হবে। এখনকার দিনে এই পদ্ধতিতে সহজে নিশ্চয় সৌভাগ্যটা ধরা যায় না। কারণ, বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান ছাড়া কেউ কিমোনো পরে না। তাই উল্কাপাত দেখে কিমোনোর কলারও হয়তো খুলে ধরা হয় না কারও।

রাতের আকাশের সুন্দর যেকোনো ছবি আঁকলেই মানুষ একটা উল্কাপাতের উজ্জ্বল রেখা দিয়ে দেয়। নানা মিথ থাকলেও উল্কাপাত নিয়ে মানুষের বর্তমান আগ্রহ আসলে এর সৌন্দর্য।

শুধু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা মিথই না, উল্কাপাত নিয়ে আছে সাম্প্রতিক গল্পও। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে লেখা সুপারম্যানের কমিকসে আছে, সুপারম্যানের গ্রহ ক্রিপটন থেকে ছুটে আসা উল্কা ক্রিপ্টোনাইটের কথা, যে ক্রিপ্টোনাইট আবার তেজস্ক্রিয়। কাল্পনিক এই ক্রিপ্টোনাইটে পৃথিবীবাসীর কিছু না হলেও সুপারম্যানের জন্য বড়ই ক্ষতিকর, অসুস্থ করে দিতে পারে সুপারম্যান এবং অন্য ক্রিপটন গ্রহবাসীদের।

পপুলার কালচার আর বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি, সব জায়গাতেই ছড়িয়ে আছে খসে পড়া তারা। রাতের আকাশের সুন্দর যেকোনো ছবি আঁকলেই মানুষ একটা উল্কাপাতের উজ্জ্বল রেখা দিয়ে দেয়। নানা মিথ থাকলেও উল্কাপাত নিয়ে মানুষের বর্তমান আগ্রহ আসলে এর সৌন্দর্য। কোনো এক অন্ধকার রাতে পরিষ্কার আকাশে মোটামুটি ধৈর্য ধরে তাকালে উল্কাপাতের সৌন্দর্য দেখা বিরল কোনো ঘটনা নয়, যে কেউ চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াইওমিং, যুক্তরাষ্ট্র

*লেখাটি ২০২০ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন