বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে জন্ম। সেই থেকে বড় হচ্ছে মহাবিশ্ব। হচ্ছে প্রসারিত। আর ক্রমেই প্রসারণের বেগ বাড়ছে। কিন্তু আসলে কত জোরে বড় হচ্ছে মহাবিশ্ব? এই একটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর বলে দেবে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের এত দিনের ধারণা ভুল কি ঠিক।
মহাবিশ্বটা বড়। অনেক বড়। মহাবিশ্বের যেকোনো দিকে তাকালে আমার সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৬০০ কোটি আলোকবর্ষ দূর পর্যন্ত দেখতে পাই। ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে জন্মের পর থেকে মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ এতটা দূরের আলো আমাদের কাছে আসতে পেরেছে। তবে এটাও নিছক অনুমান। অন্তত আমাদের পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বটা কত বড়, তা–ও কেউই সঠিক বলতে পারবে না।
মহাবিশ্বের সঠিক বয়সও আমাদের জানা নেই। সে কারণেই আসলে মহাবিশ্ব বা পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব ঠিক কত বড়, তা–ও বলার উপায় নেই।
তবু একটি ভালো অনুমান পেতে বিজ্ঞানীরা মরিয়া। যে প্রচেষ্টারই এক হাতিয়ার হাবল ধ্রুবক। মহাবিশ্ব কত জোরে প্রসারিত হচ্ছে, তারই পরিমাপক এই সংখ্যা। মহাবিশ্বের আকার ও বয়স দুটোই সঠিকভাবে জানতে হলে এই ধ্রুবক জানার কোনো বিকল্প নেই। একটি বেলুন ফুলতে থাকলে যেমন অবস্থা হবে, তার সঙ্গে কিছুটা মিল আছে মহাবিশ্বের। ছায়াপথ ও নক্ষত্রগুলো হলো বেলুনের গায়ের বিন্দুর মতো। সব কটি বিন্দু একে অপর থেকে দূরে সরছে। যেগুলোর পারস্পরিক দূরত্ব বেশি, সেগুলো তত বেশি জোরে সরছে। তার মানে, আমাদের থেকে যে ছায়াপথ যত বেশি দূরে, সেটি এত দ্রুত দূরে হারিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু হাবল ধ্রুবক যেন এক সোনার হরিণ। বিজ্ঞানীরা যতই একে মাপেন, ততই এটি মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিচ্ছে। একভাবে মেপে একটি মান পাওয়া গেল তো আরেকভাবে মাপলে পাওয়া যাচ্ছে অন্য একটি মান। একটি উপায় হলো সরাসরি মাপা। আরেকটি উপায় হলো মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমরা যা জানি, সে জ্ঞানের ভিত্তিতে মান বের করা। এই দুই মান একমত না হওয়ার অর্থ কী? হয় পরিমাপ করতে ভুল হচ্ছে, নয়তো মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণায় গন্ডগোল আছে।
মহাবিশ্বের আদিম অবস্থায় দুটি বলের টানাটানি চলছিল। একটি মহাকর্ষ, যা মহাবিশ্বকে গুটিয়ে রাখতে চাইছিল। আরেকটি বিকিরণের বহির্মুখী চাপ। এই দুই বলের ধাক্কাধাক্কির চিহ্ন সিএমবির মানচিত্রের তাপমাত্রার তারতম্য হিসেবে আজও দেখা যায়। এই তারতম্য থেকে বের করা যাবে বিগ ব্যাংয়ের ঠিক পরে মহাবিশ্ব কত জোরে প্রসারিত হচ্ছিল
তবে বিজ্ঞানীদের এখন বিশ্বাস, তাঁরা সঠিক মানের খুব কাছে চলে এসেছেন। এ আত্মবিশ্বাসের কারণ নতুন কিছু পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা। এতে প্রধান একটি অসুবিধা হলো প্রকৌশলগত দিক। আমাদের যন্ত্রপাতি দিয়ে আমরা কত নিখুঁত ও নির্ভুলভাবে মাপতে পারি, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য শুধু একগাদা উপাত্ত সংগ্রহ করাই যথেষ্ট নয়। পরিমাপ পদ্ধতির নির্ভুলতা যত উপায়ে সম্ভব যাচাই করতে হবে। সূত্রহীন কোনো খুনের ঘটনার কিনারা করাও যেন আরও সহজ।
ধ্রুবকটি প্রথম মাপেন হাবল নিজে, যাঁর নাম থেকে ধ্রুবকের এই নাম। ১৯২৯ সালে মেপে তিনি এর মান পান প্রতি মেগাপারসেকে প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ কিলোমিটার বা ৩১০ মাইল। এর অর্থ হলো প্রতি ১ মেগাপারসেক দূরের ছায়াপথ আমাদের থেকে সেকেন্ডে ৫০০ কিলোমিটার বেশি বেগে দূরে সরে যাচ্ছে। ১ পারসেক হলো আলোর বেগের ৩.২৬ আলোকবর্ষের সমান। আর মেগা হলো তার ১০ লাখ গুণ। ১ মেগাপারসেককে কিলোমিটারে বুঝতে হলে ৩০৯ লিখে তার ডানে ১৭টি শূন্য বসিয়ে নিন।
গত প্রায় ১০০ বছরে হাবলের পরিমাপকে অনেকবার সংশোধন করা হয়েছে। প্রাপ্ত মান কমেছে অনেক। বিংশ শতাব্দীর বেশির ভাগ সময়জুড়ে মান ছিল ৫০ থেকে ৯০ এককের মধ্যে। নব্বইয়ের দশকে মহাবিশ্বের ল্যামডাসিডিএম মডেল ও মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণের পর্যবেক্ষণ কাজে লাগিয়ে দেখা যায়, ধ্রুবকের মান ৭০-এর কাছাকাছি। ২০১৮ সালে প্ল্যাঙ্ক মিশনের পরিমাপ বলে, ৬৭.৪৪–এর আশপাশে হবে এই মান। কিন্তু আবার ২০১৯ সালের মার্চে হাবল স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে পরিমাপ করে পাওয়া যায় ৭৪.০৩–এর আশপাশের মান। আশপাশের মান বলার কারণ হলো, অনেক নমুনা ব্যবহার করে বের করা এই মানগুলোতে সব সময় একটু পারিসংখ্যানিক অনিশ্চয়তা থাকে। যেমন সঠিক করে বললে সর্বশেষ পরিমাপ বলছে, ধ্রুবকের মান ৭৪.০৩ ±১.৪২। বর্তমানে ধ্রুবকটির মান ৬৭ থেকে ৭৪ ধরা হয়।
একটি সমস্যা হলো, কীভাবে মাপা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে পাল্টে যায় মান। পরিমাপের একটি উপায় হলো, কাছের ছায়াপথগুলো আমাদের কাছ থেকে কত দূরে সরে যাচ্ছে, সেটা বের করা। আরেকটি উপায় হলো, মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বা সিএমবি (CMB)। এটা হলো বিগ ব্যাংয়ের ধ্বংসাবশেষ। জন্মের পর প্রথম যে আলো ছড়িয়ে পড়েছিল মহাবিশ্বে,আজও সেই আলো আছে। তবে তার শক্তি অনেক কমে গেছে। ১৯৬৫ সালে আকস্মিকভাবে আবিষ্কৃত হয় এ দুর্বল আলো। তবু মহাবিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন এটাই।
মহাবিশ্বের আদিম অবস্থায় দুটি বলের টানাটানি চলছিল। একটি মহাকর্ষ, যা মহাবিশ্বকে গুটিয়ে রাখতে চাইছিল। আরেকটি বিকিরণের বহির্মুখী চাপ। এই দুই বলের ধাক্কাধাক্কির চিহ্ন সিএমবির মানচিত্রের তাপমাত্রার তারতম্য হিসেবে আজও দেখা যায়। এই তারতম্য থেকে বের করা যাবে বিগ ব্যাংয়ের ঠিক পরে মহাবিশ্ব কত জোরে প্রসারিত হচ্ছিল। আর সেটা থেকে কসমোলজির স্ট্যান্ডার্ড মডেল ব্যবহার করে জানা যাবে হাবল ধ্রুবক বা বর্তমান প্রসারণ হার। মহাবিশ্বের সূচনা ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে এই স্ট্যান্ডার্ড মডেল অন্যতম ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারে।
কিন্তু সমস্যা একটি রয়ে গেছে। কাছের ছায়াপথগুলোর দূরে সরার গতি থেকে ধ্রুবকটিকে মাপলে পাওয়া যায় অন্য একটি মান। স্ট্যান্ডার্ড মডেল সঠিক হয়ে থাকলে দুই উপায়ে পাওয়া মান সমান হওয়ার কথা। এখানেই বিপত্তি।
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইসা) প্ল্যাঙ্ক উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত সিএমবির উপাত্ত দিয়ে মাপা মান পাওয়া গেছে ৬৭.৪। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে একই মান পাওয়া যায় এভাবে। কিন্তু এই মান ছায়াপথের বেগ থেকে পাওয়া মানের ৯ শতাংশ কম। ২০২০ সালে আতাকামা কসমোলজি টেলিস্কোপ ব্যবহার করে সিএমবির পরিমাপ থেকে পাওয়া মান প্ল্যাঙ্কের সুরেই কথা বলছে। তার মানে প্ল্যাঙ্ক উপগ্রহের বিভিন্ন উৎস থেকে আসা নিয়মতান্ত্রিক সমস্যা না থাকাই প্রমাণ হচ্ছে। সিএমবির পরিমাপ সঠিক হলে দুটো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। ছায়াপথের বেগ পরিমাপের যন্ত্রপাতি ভুল অথবা কসমোলজির স্ট্যান্ডার্ড মডেল সঠিক নয়।
মজার ব্যাপার হলো, আমরা যেমন জানি, মহাবিশ্ব তার চেয়ে বেশি জোরে প্রসারিত হয়ে থাকলে মহাবিশ্বের বয়স আমাদের জানা ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছরের চেয়ে কম হবে।
শিকাগো ইউনিভার্সিটির জ্যোতিঃপদার্থবিদ ওয়েন্ডি ফ্রিডম্যান হাবল ধ্রুবকের মান বের করতে করতেই জীবন কাটাচ্ছেন। তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা এ জন্য সিফিড বিষম নামে একধরনের নক্ষত্র ব্যবহার করছেন। ১০০ বছর আগে জ্যোতির্বিদ হেনরিয়েটা লেভিট এ নক্ষত্রগুলো আবিষ্কার করেন। কয়েক দিন বা সপ্তাহের ব্যবধানে এ নক্ষত্রগুলোর উজ্জ্বলতায় পরিবর্তন ঘটে যায়। লেভিট আবিষ্কার করেন, নক্ষত্র যত বেশি উজ্জ্বল, এর উজ্জ্বল হতে, অনুজ্জ্বল হতে ও আবার উজ্জ্বল হতে তত বেশি সময় লাগে। এখন উজ্জ্বলতার এই স্পন্দন কাজে লাগিয়ে নক্ষত্রের প্রকৃত উজ্জ্বলতা বা দীপ্তি জানা যায়। এরপর নক্ষত্রটি পৃথিবী থেকে কতটা উজ্জ্বল দেখায়, মানে দূরত্বের সঙ্গে কতটা অনুজ্জ্বল হচ্ছে, সেটা থেকে নক্ষত্রের নিখুঁত দূরত্ব জানা যায়।
ফ্রিডম্যানরাই প্রথম হাবল স্পেস টেলিস্কোপের উপাত্ত থেকে প্রাপ্ত সেফাইড বিষম তারার উপাত্ত থেকে হাবল ধ্রুবকের মান বের করেন। ২০০১ সালে প্রাপ্ত মান ছিল ৭২ একক। এরপর অন্য একটি দল একই পদ্ধতিতে মান পায় ৭৪ একক। কয়েক মাস পরই আরেকটি দল পেল ৭৩।
এই পরিমাপগুলো সঠিক হয়ে থাকলে হয়তো মহাবিশ্ব স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অনুমানের চেয়ে জোরে প্রসারিত হচ্ছে। তার মানে মহাবিশ্বের মৌলিক বৈশিষ্ট্য জানার জন্য আমাদের সেরা হাতিয়ার এই মডেলকে সংশোধন করতে হবে। এটা হবে বড় একটি ঘটনা। ফ্রিডম্যানের মতে, এর অর্থ হচ্ছে মডেলে কিছু একটার ঘাটতি আছে।
স্ট্যান্ডার্ড মডেল ভুল মানে অনেক কিছু ভুল। মহাবিশ্বের উপাদান বস্তু সম্পর্কে আমাদের ধারণা হয়ে যাবে ভুল। সাধারণ বস্তু, ডার্ক ম্যাটার, ডার্ক এনার্জি ও বিকিরণ সম্পর্কে আমাদের ধারণাগুলো ভুল প্রমাণিত হবে। আর মহাবিশ্বের বয়স আমরা এত দিন যা ভেবেছি, তার চেয়ে হবে কম।
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিদ র৵াচেল বিটনের মতে, হাবল ধ্রুবকের পরিমাপে প্রাপ্ত মানের পার্থক্যের আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে। আমরা মহাবিশ্বের যে অংশে বাস করছি, তা হয়তো বাকি অংশ থেকে ভিন্ন। আর সে কারণেই পরিমাপে ভুল হচ্ছে। তিনি বলছেন, পুরোপুরি সঠিক না হলেও তুলনাটা একটু এমন: পাহাড়ে ওঠা ও নামার সময় গাড়ির অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিলে একই বেগ পাওয়া যাবে না। কারণটা জোরালো না হলেও সম্ভাব্য কারণ হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ফ্রিডম্যানের আশা, দু–এক বছরের মধ্যেই হাবল ধ্রুবক সমস্যার সমাধান হবে। নতুন নতুন উপাত্ত আসছে, যেগুলো ধ্রুবকের নির্ভুলতা অনেক বাড়িয়ে দেবে।
২০১৩ সালে ইসার গেইয়া মহাকাশ পর্যবেক্ষণকেন্দ্র উৎক্ষেপিত হয়। প্রায় ১০০ কোটি নক্ষত্রের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করছে পর্যবেক্ষণকেন্দ্রটি। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা প্যারালাক্স পদ্ধতিতে নক্ষত্রের দূরত্ব মাপছেন। এক চোখ বন্ধ রেখে বাকি চোখ দিয়ে কোনো জিনিস দেখলে যে অবস্থানে দেখা যায়, অপর চোখ দিয়ে দেখলে সেটা থেকে একটু ভিন্ন অবস্থানে দেখা যায়। এই পার্থক্যই বস্তুর সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করতে সহায়তা করে। নক্ষত্রের দূরত্ব মাপতেও এই কৌশল কাজে লাগানো হয়। এরই নাম প্যারালাক্স। এই কৌশলের নির্ভুলতা বাড়াতে গেইয়া ঘুরছে সূর্যের চারপাশে। সূর্যের চারপাশের কক্ষপথের বিপরীত বিন্দু ব্যবহৃত হচ্ছে দুই চোখের মতো। এর মাধ্যমে জানা যাবে, সৌরজগৎ থেকে নক্ষত্রগুলো কত জোরে সরে যাচ্ছে।
একই কাজে ব্যবহার করা হবে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। ২০২১ সালে এটি নিক্ষিপ্ত হবে মহাশূন্যে। অবলোহিত তরঙ্গদৈর্ঘ্য পর্যবেক্ষণ করে এটি মাঝে থাকা ধুলা এড়িয়ে নক্ষত্রগুলোর দূরত্ব মাপবে। এখান থেকে প্রাপ্ত মান আগের উপাত্তকে সমর্থন করলে পদার্থবিদ্যার গতিপথ পাল্টে যাবে। নতুন করে ভাবতে হবে অনেক কিছু।
দুই পরিমাপের পার্থক্যের অনেক ব্যাখ্যা দেওয়া হলেও কোনোটিই ত্রুটিমুক্ত নয়। যেমন হতে পারে আদিম মহাবিশ্বে অন্য রকম কোনো বিকিরণের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু সিএমবি অনেক নিখুঁত করে মাপা হয়েছে। ফলে সে সম্ভাবনা কম। আবার এমনও হতে পারে, ডার্ক এনার্জি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে–বাড়ে। সত্যিকারের ব্যাখ্যা জানতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ফ্রিডম্যান, বিটনদের মতো বিজ্ঞানীরা।