সূর্য কত দূরে বলতে যে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব বোঝাচ্ছি, তা হয়ত বুদ্ধিমান পাঠককে আর বলে দিতে হবে না। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ১৫ কোটি কিলোমিটার এটা সবারই জানা। তবুও এখানে একটা কিন্তু আছে। সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী বৃত্তাকার পথে ঘোরে না। তাই সব সময় পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বও এক হয় না। পৃথিবী থেকে আসলেই সূর্যের দূরত্ব কত, চলুন তা বোঝার চেষ্টা করি।
মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। তাই মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই গতিশীল। সে গতি মোটেও কম নয়। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, প্রতি সেকেন্ডে ২০০ কিলোমিটারে বেশি বেগে ছুটছে মহাবিশ্বের বস্তুগুলো। এ কারণে মহাবিশ্বের বেশিরভাগ বস্তুই আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাহলে সূর্যও কী দূরে সরছে? দূরে সরতে সরতে কী সূর্য সৌরজগতের বাইরে চলে যাবে? এসব প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে আরও কিছু বিষয় জেনে নেওয়া দরকার।
প্রথমতে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট। মহাবিশ্বের সব বস্তুগুলো অনেক দূরে দূরে অবস্থিত। আমাদের সাধারণ পরিমাপের একক দিয়ে অত বেশি দূরত্ব প্রকাশ করা কঠিন। প্রায় অসম্ভবই বলা চলে। এজন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট (AU) নামে একটি নতুন একক তৈরি করেছেন। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বকে বলে এক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট। সূর্য থেকে মঙ্গল গ্রহের দূরত্ব ১ দশমিক ৫ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট।
তবে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব কিলোমিটারেও পরিমাপ করা যায়। প্রায় ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার। সূর্য কত দূরে আছে তা নির্ভর করে পৃথিবী কীভাবে সূর্যের চারপাশে ঘুরছে তার ওপর। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে। ফলে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব সারা বছরই পরিবর্তিত হয়। মানে বছরের একেক সময় পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব হয় একেক রকম। তবে গড় দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার বলতেই পারেন।
সূর্য থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের স্থান পেরিহেলিয়ন বা অনুসূর নামে পরিচিত। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মতে, এ সময় পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব থাকে প্রায় ১৪৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন কিলোমিটার। জানুয়ারির প্রথম দিকে (৪ জানুয়ারি) পৃথিবী ও সূর্য এ দূরত্বে থাকে। আর পৃথিবী থেকে সূর্য সবচেয়ে দূরে থাকে জুলাইয়ের শুরু দিকে (৫ জুলাই)। এ সময় দূরত্ব থাকে প্রায় ১৫২ মিলিয়ন কিলোমিটার। যা এক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট থেকে কিছুটা বেশি। এ স্থান অ্যাপিলিয়ন বা অপসূর নামে পরিচিত।
এবার শুরুর প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা যাক। মহাবিশ্বের সব বস্তুই যেহেতু দূরে সরে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে পৃথিবী কী সূর্যের দিকে এগোছে নাকি দূরে সরছে? আসলে পৃথিবী সূর্যের দিকে সরছে না। মানে আমরা সূর্যের কাছাকাছি যাচ্ছি না। বরং পৃথিবী ধীরে ধীরে সূর্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এটা আমাদের সৌভাগ্যই বলতে পারেন। কারণ সূর্য অন্য সব নক্ষত্রের মতো নিজের কেন্দ্রে জ্বালানি পোড়াচ্ছে। ফলে সূর্য প্রতিনিয়ত শক্তি ও ভর হারাচ্ছে। এতে দূর্বল হচ্ছে সূর্যের মধ্যাকর্ষণ শক্তি। তাই একটু একটু করে পৃথিবী সূর্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
নভোযানটি যদি ঘন্টায় ২ লাখ ৪৬ হাজার ৯৬০ কিলোমিটার বেগে ছোটে, তাহলে সূর্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ৬০৬ ঘন্টা। প্রায় ২৫ দিনের সমান।
কিন্তু কতটা দূরে সরছে? আমরা তা বুঝতে পারি না কেন? বা দূরে সরলেও আমরা কেন প্রতিবছর পৃথিবী ও সূর্যের দূরত্ব নতুন করে লিখি না। এসব প্রশ্ন এখন মাথায় আসা স্বাভাবিক। আসলে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরে সরে যাওয়ার হার খুবই কম। তাই আমরা বুঝতে পারি না বা প্রতিবছর আনুষ্ঠানিকভাবে দূরত্ব পরিবর্তন করি না। পৃথিবী প্রতি বছর সূর্য থেকে মাত্র ১৫ সেন্টিমিটার দূরে সরে। এটা কতটা কম তা বোঝা দরকার। এই হারে পৃথিবী যদি সূর্য থেকে দূরে সরতে থাকে, তাহলে পৃথিবী ১ হাজার বছরে সূর্য থেকে মাত্র ১৫০ মিটার দূরে সরবে। বুঝুন তাহলে!
এবার জানা যাক, সূর্য দূরে সরতে সরতে সৌরজগতের বাইরে পালিয়ে যেতে পারবে কি-না। সূর্যের পক্ষে এটা সম্ভব নয়। কারণ আরও ৫০০ কোটি বছর পরে সূর্য পরিণত হবে একটি লোহিত দানবে।
পৃথিবী ও সূর্যের দূরত্ব তো জানা হলো। কিন্তু আপনি কি আসলেই বুঝতে পারছেন সূর্য আসলে কত দূরে? অনেক সময় শুধু সংখ্যা দিয়ে দূরত্ব অনুভব করা যায় না। তাই চলুন, আরও একটু সহজভাবে বোঝার চেষ্টা করি। যদিও সূর্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবুও কল্পনা করতে ক্ষতি কী। আপাতত আপনি এমন একটি নভোযান কল্পনা করুন, যেটা আপনাকে সূর্যের বুকে নামিয়ে দেবে (যদিও বাস্তবে তা সম্ভব নয়)। নভোযানটি যদি ঘন্টায় ২ লাখ ৪৬ হাজার ৯৬০ কিলোমিটার বেগে ছোটে, তাহলে সূর্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ৬০৬ ঘন্টা। প্রায় ২৫ দিনের সমান। যদিও এমন নভোযান উৎক্ষেপণ করা সম্ভব নয়, যা শুরু থেকে সর্বোচ্চ গতিতে ছুটতে পারে। কারণ নভোযান উৎক্ষপণের পরে সর্বোচ্চ গতিতে পৌঁছাতে কয়েক মিনিট বা ঘন্টা সময় লাগে।
পৃথিবী থেকে এখন পর্যন্ত যতগুলো দ্রুততম নভোযান উৎক্ষেপণ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে পার্কার সোলার প্রোব অন্যতম। সূর্য গবেষণায়র জন্য এ নভোযান পাঠিয়েছে নাসা। এই প্রোবটির বেগ ছিল ঘন্টায় ৬ লাখ ৯২ হাজার ১৭ কিলোমিটার। অর্থাৎ, পার্কার সোলার প্রোব সূর্যে পৌঁছাতে সময় লেগেছে প্রায় ২১৬ ঘন্টা। ৯ দিনের সমান।
ধরুন, আপনি একটি গাড়িতে চড়ে পাড়ি দেবেন সূর্যে। শুনতে হাস্যকর লাগলেও কল্পনা করে নিন। ধরুন, আপনার গাড়িটি ঘন্টায় ১০০ মাইল বেগে টানা ২৪ ঘন্টা ছুটতে পারে। এমন একটি কাল্পনিক গাড়িতে চড়ে আপনি ১০৬ বছরে সূর্যে পৌঁছাতে পারবেন।
অবশ্য নভোযানে করে সূর্যে পাড়ি দেওয়ার হিসেবে একটু সমস্যা আছে। কারণ প্রথমেই বলেছি, মহাবিশ্বের কোনো বস্তুই স্থির নয়। ফলে আমরা পৃথিবী থেকে যখন নভোযানটি উৎক্ষেপণ করবো, সূর্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সূর্য আর সেখানে থাকবে না। একটু হলেও দূরে সরে যাবে। সেক্ষেত্রে প্রথমে সূর্যের গতির ওপর নির্ভর করে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হবে, সূর্য কখন কোথায় থাকতে পারে।
এবার আপনার কল্পনার ডানাটা আরও একটু মেলে দিন। ধরুন, আপনি একটি গাড়িতে চড়ে পাড়ি দেবেন সূর্যে। শুনতে হাস্যকর লাগলেও কল্পনা করে নিন। ধরুন, আপনার গাড়িটি ঘন্টায় ১০০ মাইল বেগে টানা ২৪ ঘন্টা ছুটতে পারে। এমন একটি কাল্পনিক গাড়িতে চড়ে আপনি ১০৬ বছরে সূর্যে পৌঁছাতে পারবেন। অবশ্য ততদিন যদি বেঁচে থাকেন আরকি। গাড়ির পরিবর্তে জাম্বো জেট নিয়ে যেতে চাইলে সূর্যে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১৯ বছর। জাম্বো জেট ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৩৬০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারে। আশাকরি পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বটা আগের থেকে একটু ভালোভাবে অনুভব করতে পারছেন।
লেখক: সদস্য, সম্পাদনা দল, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: নাইন প্ল্যানেটস ডট ওআরজি, স্পেস ডট কম ও নাসা