চাঁদের ধুলো থেকে সৌর প্যানেল বানাবেন বিজ্ঞানীরা

চাঁদে স্থায়ী ঘাঁটি তৈরির পরিকল্পনা মানুষের বহুদিনের। মহাকাশ অনুসন্ধানের জন্য চাঁদে একটা বেস ক্যাম্প বানাতে পারলে মন্দ হয় না। সমস্যা একটাই। চাঁদে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠানো হবে কীভাবে? মহাকাশে এসব জিনিস পাঠানোর খরচ অনেক। তাই চাঁদেই যদি দরকারি উপাদান পাওয়া যায়, তাহলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হতে পারে।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, চাঁদের পৃষ্ঠে থাকা ধূলিকণা দিয়েই সৌর প্যানেলের জন্য প্রয়োজনীয় কাচ তৈরি করা সম্ভব। চাঁদের এই ধূলিকণাকে বলে ‘লুনার রেগোলিথ’। এই নতুন উপায়ে পৃথিবী থেকে পুরো সৌর প্যানেল পাঠানোর বদলে শুধু বিশেষ উপাদান পাঠিয়ে চাঁদেই প্যানেল তৈরি করা যেতে পারে। চাঁদে যে কাচ তৈরি হবে, বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন মুনগ্লাস। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক ডিভাইস জার্নালে গত ৩ এপ্রিল এ বিষয়ক প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। 

গবেষকরা বলছেন, চাঁদের ধূলিকণা দিয়ে কাচ বানানো সম্ভব। এই কাচই পরে সৌর প্যানেলের সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হবে। এতে ব্যয় অনেক কমবে। কারণ পৃথিবী থেকে বিশাল কাচের প্যানেল চাঁদে পাঠানোর দরকার হবে না। শুধু এক কেজি পারোভস্কাইট উপাদান ব্যবহার করেই প্রায় ৪০০ বর্গমিটার সৌর প্যানেল তৈরি করা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন
চাঁদে নানা ধরনের সৌররশ্মি সরাসরি আঘাত করে। কারণ চাঁদে পৃথিবীর মতো বায়ুমণ্ডল নেই। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আমাদের বেশির ভাগ বিকিরণ থেকে বাঁচায়। কিন্তু চাঁদে সেই সুবিধা নেই।

পারোভস্কাইট একধরনের বিশেষ উপাদান, যা সূর্যালোক থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অত্যন্ত কার্যকর। এটি প্রচলিত সিলিকনভিত্তিক সৌর কোষের তুলনায় অনেক হালকা। এই প্রযুক্তি পৃথিবীতেও আলোড়ন তুলেছে। তবে গবেষকরা এখন চাইছেন এটিকে মহাকাশে ব্যবহার করতে।

এই গবেষণার লেখক ও পটাসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমির টলারেন্ট ইলেকট্রনিকস উইথ সফট সেমিকন্ডাক্টরস গ্রুপের প্রধান ফেলিক্স ল্যাং। তিনি বলেন, ‘পৃথিবী থেকে উন্নত মানের পেরোভস্কাইট নিয়ে গিয়ে চাঁদে তৈরি কাঁচের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যাবে। এতে অনেক খরচ বাঁচিয়ে সহজে চাঁদে সৌর প্যানেল বানানোর কাজ করা যাবে।’

চাঁদ
প্রতীকী ছবি

তবে এই ধারণা বাস্তবে কতটা রূপ দেওয়া যাবে, তা নির্ভর করে বেশ কিছু বিষয়ের ওপর। এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, চাঁদের মাটি কাঁচ তৈরির জন্য কতটা উপযুক্ত, তা জানা। চাঁদের মাটির গঠন বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম হয়। চন্দ্রপৃষ্ঠের উঁচু অঞ্চলের মাটি আর বিষুবরেখার কাছাকাছি অঞ্চলের মাটিতে সামান্য পার্থক্য দেখা যায়। তাই গবেষকরা বিভিন্ন ধরনের ধূলিকণার কৃত্রিম নমুনা তৈরি করে পরীক্ষা চালিয়েছেন। এতে দেখা গেছে, চাঁদের উচ্চভূমির অঞ্চলে পাওয়া যায়, এমন ধূলিকণা দিয়ে তৈরি কাচ অতিরিক্ত সুবিধা দিতে পারে। কারণ এই মাটিতে থাকে লৌহযুক্ত যৌগ। এই ধূলিকণা থেকে তৈরি কাচ স্বাভাবিক কাচের মতো সহজে অস্বচ্ছ হয়ে যায় না। 

তা ছাড়া চাঁদে নানা ধরনের সৌররশ্মি সরাসরি আঘাত করে। কারণ চাঁদে পৃথিবীর মতো বায়ুমণ্ডল নেই। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আমাদের বেশির ভাগ বিকিরণ থেকে বাঁচায়। কিন্তু চাঁদে সেই সুবিধা নেই। এ কারণে সূর্যের বিকিরণ পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ২০০ গুণ বেশি। তাই চাঁদের কাচ যদি এই বিকিরণের বিরুদ্ধে টেকসই হয়, তবে তা হবে বিশাল সাফল্য।

আরও পড়ুন
পৃথিবীতে এগুলো সহজেই বাতাস ও আর্দ্রতার কারণে নষ্ট হয়ে যায়। চাঁদে বাতাস নেই, তবে প্রবল তাপমাত্রার পরিবর্তন ও অতিবেগুনি রশ্মি সমস্যা তৈরি করতে পারে।

তবে এটি বাস্তবায়নের জন্য আরও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চাঁদে একটি বেস বসানোর খরচ তো কম নয়। উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করতে দরকারি যন্ত্রপাতি পৃথিবী থেকে নিয়ে যেতে হবে, যা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। গবেষকরা হিসাব করে দেখছেন, ঠিক কী পরিমাণ সৌরশক্তি উৎপাদন করলে এই পদ্ধতি লাভজনক হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি ৩-১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়, তাহলে এই পদ্ধতি পৃথিবী থেকে সরাসরি সৌর প্যানেল পাঠানোর তুলনায় বেশি কার্যকর হবে।

চাঁদেই যদি দরকারি উপাদান পাওয়া যায়, তাহলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হতে পারে

পারোভস্কাইট সৌর প্যানেলের কিছু দুর্বল দিকও রয়েছে। পৃথিবীতে এগুলো সহজেই বাতাস ও আর্দ্রতার কারণে নষ্ট হয়ে যায়। চাঁদে বাতাস নেই, তবে প্রবল তাপমাত্রার পরিবর্তন ও অতিবেগুনি রশ্মি সমস্যা তৈরি করতে পারে। গবেষকরা মনে করছেন, চাঁদে কাচ দিয়ে মোড়ানো হলে পারোভস্কাইট প্যানেলগুলোর স্থায়িত্ব অনেকটাই বাড়বে। তাই ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি সফলভাবে কাজে লাগানো গেলে চাঁদের ওপর টেকসই সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব হবে। চাঁদে স্থায়ী মানব বসতি স্থাপনের পথে এটি বড় অগ্রগতি হতে পারে।

সূত্র: পপসায়েন্স ডটকম

আরও পড়ুন