ঘটনার শুরু ২০০১ সালের ২১ জানুয়ারি। নিউইয়র্ক টাইমস–এ একটি খবর প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির রোজ সেন্টার ফর আর্থ অ্যান্ড স্পেসের একটি প্রদর্শনীতে প্লুটোকে সৌরজগতের গ্রহদের সঙ্গে না রেখে আলাদাভাবে প্রদর্শন করা হয়েছে। এই বিচিত্র সংবাদ প্রকাশের পর শুরু হয় নানা জল্পনা। তবে কি প্লুটোকে গ্রহ-পরিবার থেকে বাদ দেওয়া হলো? পক্ষে এবং বিপক্ষে নানা আলাপ চলে। অবশেষে ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থা প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে সরাসরি বাদ দেয়।
আইএইউ (IAU) ২০০৬ সালে প্রাগে অনুষ্ঠিত সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত (resolution B5) নেয় যে গ্রহ এবং সৌরজগতের অন্য বস্তুগুলোকে (উপগ্রহ ছাড়া) তিনটি ভাগে ভাগ করা হবে। সেগুলো হলো—
১. গ্রহ হলো সেই জ্যোতিষ্ক যা—
ক) সূর্যের চারদিকে ঘোরে
খ) যথেষ্ট ‘ভর’বিশিষ্ট হবে, যেন এটি উদস্থৈতিক সাম্যাবস্থায় (প্রায় গোলাকার) থাকে এবং
গ) নিজ কক্ষপথের পরিপার্শ্বে অন্য কোনো জ্যোতিষ্ক থাকতে দেবে না।
২. বামন গ্রহ হলো সেই জ্যোতিষ্ক, যা—
ক) সূর্যের চারদিকে ঘোরে
খ) যথেষ্ট ‘ভর’বিশিষ্ট হবে যেন এটি উদস্থৈতিক সাম্যাবস্থায় (প্রায় গোলাকার) থাকে
গ) নিজ কক্ষপথের পরিপার্শ্বে অন্য কোনো জ্যোতিষ্ক থাকতে দেবে না এবং
ঘ) কারও উপগ্রহ হতে পারবে না
৩. সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণমান বাকি সব জ্যোতিষ্ককে বলা হয় ‘ক্ষুদ্র সৌরজাগতিক বস্তু’।
এই সংজ্ঞা অনুযায়ী প্লুটোর গ্রহত্ব খারিজ হয়ে যায়। ১৯৩০ সালে ক্লাইড টমবাউ প্লুটো আবিষ্কার করেছিলেন। তখন থেকে প্লুটো সৌরজগতের নবম গ্রহ হিসেবে পরিচিত ছিল, বিশেষ করে সূর্যের পরিবারের একদম বাইরের দিকে অবস্থিত (সূর্য থেকে ৫.৯ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে) এবং কাইপার বেল্ট বা নেপচুন-পরবর্তী জ্যোতিষ্কদের সম্পর্কে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সদস্য ছিল প্লুটো। অবশ্য এর মধ্যে জল অনেক গড়িয়েছে, কাইপার বেল্টের ভেতর অনেক জ্যোতিষ্ক আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি তো প্লুটোর একদম তুতো ভাই অর্থাৎ আকারে প্রায় সমান ও কিছুটা হয়তো বড়ই। যেমন এরিসের ব্যাস ২৩২৬ কিমি। প্লুটো কিন্তু আমাদের চাঁদের থেকেও ছোট, মাত্র ২৩৭৪ কিমি চওড়া। আকারে যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক। এর আবার ৫টি উপগ্রহ আছে, যার মধ্যে ক্যারন প্লুটোর সঙ্গে ‘টাইডাল লক’ অবস্থায় রয়েছে। পৃথিবী-চাঁদ যেমন একটি টাইডালি-লকড ব্যবস্থা, চাঁদের একটি মুখই কেবল পৃথিবীর দিকে থাকে সর্বদা, প্লুটো-ক্যারনও তেমনি। প্লুটোর মাধ্যাকর্ষণও সংগত কারণে পৃথিবীর ১/১৫ ভাগ। পৃথিবীতে কারও ওজন ৬০ কেজি হলে প্লুটোতে তার ওজন হবে ৪ কিলো। প্লুটোর এক দিন পৃথিবীর সাড়ে ছয় দিন। কিন্তু প্লুটোর এক বছর পৃথিবীর ২৪৮ বছর।
প্লুটোর গ্রহত্ব হারিয়ে ফেলার ব্যাপারটা খুবই মর্মান্তিক। সাধারণ মানুষ অনেকটাই আত্মীয় হারানোর মতো ব্যথা পেয়েছে। তবে সম্প্রতি বিতর্ক উসকে দিয়ে নাসাপ্রধান জিম ব্রিন্ডেনস্টাইন বলেছেন, ‘এখানে দাঁড়িয়ে আমি আপনাদের বলতে চাই, নাসাপ্রধান হিসেবে, প্লুটোকে গ্রহ বলেই আমি বিশ্বাস করি।’ এটা তিনি বলেছেন ২০১৯ সালে ন্যাশনাল অ্যাস্ট্রনটিকাল কংগ্রেসে। তিনি বলেছেন, গ্রহ হিসেবে কোনো জ্যোতিষ্ককে বিবেচনা করতে হলে তার অন্তর্মূল্য দিয়েই তাকে বিচার করতে হবে। অবশ্য প্লুটোর কী অন্তর্মূল্য আছে, সেটা তিনি বিশদে বলেননি। তবে নাসার নিউ হরাইজনস মিশনের (১৪ জুলাই ২০১৫) পর থেকেই গ্রহ-বিজ্ঞানীদের একাংশ প্লুটোর গ্রহত্বে পুনরায় বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। ওই মিশনের মাধ্যমে প্লুটোর অনেক চমৎকার জিনিসই আমরা জানতে পেরেছি। প্লুটোর যে একটা মিহি বাতাবরণ আছে, সেটা জেনেছি। আমরা জেনেছি, এর পৃষ্ঠে রয়েছে জৈব যৌগ, এর অভ্যন্তরে আছে ১০০ কিলোমিটার পুরু তরল সমুদ্র। প্লুটোর পৃষ্ঠের একটা বড় অংশ হলো নাইট্রোজেনের বরফ। নিউ হরাইজনস আরও জানিয়েছে, ক্যারনের মেরু অঞ্চলে থোলিন নামের জৈব যৌগ আছে। দেখে যেন মনে হয়, প্লুটো-ক্যারন একটা ছোট পরিবারের মতো, যেখানে আরও তিনজন সদস্য আছে।
কিন্তু প্লুটোর ভর তার কক্ষপথে অবস্থানরত অন্যান্য জ্যোতিষ্কের সম্মিলিত ভরের মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ৭ গুণ। পৃথিবীর ক্ষেত্রে এটা ১৭ লাখ গুণ (চাঁদ বাদে)। একই রকমভাবে ট্রান্স-নেপচুনিয়ান জ্যোতিষ্কদের মধ্যে এরিস প্লুটোর প্রায় সমান, মাকিমাকি তার তুলনায় কিছুটা ছোট। সৌরজগতের অন্যান্য উপগ্রহ, যেমন চাঁদ, গ্যানিমিড কিংবা টাইটানের তুলনায় প্লুটো বেশ ছোট। ফলে প্লুটোর গ্রহত্ব নিয়ে কিছু সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। আবার আইএইউর সংজ্ঞা নিয়ে সমস্যা আছে। সেখানে বলা হয়েছে গ্রহের একটি ‘পরিষ্কার’ কক্ষপথ থাকবে। এটা পৃথিবী, বা বৃহস্পতির ক্ষেত্রেও কিংবা বলা যায় সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের ক্ষেত্রেও স্পষ্টভাবে প্রয়োগ করা যায় না। এমনকি কাইপার বেল্টে যদি পৃথিবীর থেকেও বড় গ্রহ থেকে থাকে, তবে তার কক্ষপথও এমন পরিষ্কার হওয়ার কথা নয়।
কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মতে, গ্রহের একটি ভূতাত্ত্বিক সংজ্ঞা এমন হতে পারে: গ্রহ হলো এমন জ্যোতিষ্ক, যার ভর নক্ষত্রের তুলনায় ছোট এবং এখানে কখনোই নিউক্লিয় ফিউশন বিক্রিয়া চলেনি এবং জ্যোতিষ্কের যথেষ্ট মাধ্যাকর্ষণ আছে। ফলে এটি একটি স্ফেরয়েড আকৃতিপ্রাপ্ত হয়, যাকে একটি ত্রি-অক্ষীয় ইলিপ্সয়েড দিয়ে বর্ণনা করা যায়। সহজে বললে, গ্রহ হলো যেকোনো গোল বস্তু, যা নক্ষত্রের তুলনায় ছোট। গ্রহের এই সংজ্ঞা মেনে নিলে সৌরজগতে ১১০টির বেশি গ্রহ হবে। এ সংখ্যা আরও বাড়বে, কেননা কাইপার বেল্ট বা উর্টের মেঘ অঞ্চলে আরও কী রহস্য আছে, তা কেউ বলতে পারে না।
প্লুটোর গঠন পাথুরে চারটি গ্রহ (বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল) থেকেও আলাদা, গ্যাস দানব চারটি থেকেও (বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন) আলাদা। পাথুরে গ্রহগুলো সূর্যের তাপে উত্তপ্ত থাকে, ফলে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম এদের বাতাবরণ থেকে বিদায় নিয়েছে আগেই। ওদিকে উল্টো অবস্থা বাইরের গ্যাস-দানবদের ক্ষেত্রে, সূর্য থেকে দূরত্ব বেশি হওয়ার কারণে এদের তাপমাত্রা খুবই শীতল, ফলে ওই সব উদ্বায়ী গ্যাস সহজেই ধরে রাখতে পারে। প্লুটোর কক্ষপথও ঝামেলার। নেপচুনের কক্ষপথের সঙ্গে এর ছেদ আছে, গ্রহ হিসেবে এটা অমার্জনীয় অপরাধ। তা ছাড়া এর কক্ষীয় তল অন্য গ্রহদের তলের সঙ্গে ১৭ ডিগ্রি কোণে হেলে থাকে। ১৯৯২ সালের পর থেকে কাইপার বেল্টের এমন অনেক জ্যোতিষ্ক পাওয়া গেছে, যাদের কক্ষপথ, গঠন ও কক্ষের উৎকেন্দ্রিকতা—সবই প্লুটোর মতো। কাজেই কাইপার বেল্টের অধিবাসীদের সঙ্গেই প্লুটোকে ফেলতে হয়, যদিও তাদের মধ্যে প্লুটোই সবচেয়ে বড় এবং কিছুটা ভিন্ন, কিন্তু কোনোমতেই অন্য গ্রহগুলোর মতো নয়। এই বেল্টের অন্য জ্যোতিষ্করা নেপচুনের সঙ্গে কক্ষীয় আবর্তনে ৩: ২ অনুনাদ অনুসরণ করে, প্লুটোও তাই। অর্থাৎ প্লুটোসহ অন্যরা সূর্যের চতুর্দিকে তিনবার আবর্তন যে সময়ে দেয়, সেই সময়ে নেপচুন দেয় দুবার। এ জন্যই প্লুটোকে কাইপার বেল্টের অন্যান্য জ্যোতিষ্কের সঙ্গে ফেলাই যুক্তিসংগত, যারা মূলত তুষারিত পাথরখণ্ড।
ফলে সৌরপরিবারে জ্যোতিষ্কের ধরন মোটা দাগে পাঁচ রকমের। পাথুরে গ্রহ (পৃথিবীসহ ভেতরের চারটি গ্রহ), গ্যাসীয় দানব (বৃহস্পতিসহ বাইরের চারটি), কাইপার বেল্টের জ্যোতিষ্ক (প্লুটো, এরিস ইত্যাদি), গ্রহাণুপুঞ্জ (সেরেস—বৃহত্তম গ্রহাণু), ভেস্তা ইত্যাদি) ও উল্কাজাতীয় বস্তু (উর্ট মেঘের বাসিন্দা)। লক্ষণীয়, কাইপার বেল্টের সব অধিবাসীই চাঁদের তুলনায় ছোট। তবে এদের মধ্যে প্লুটো, সেরেস, এরিস, মাকিমাকি, হাউমিয়া বামন গ্রহ নামেই পরিচিত।
মন খারাপ হলেও প্লুটো গ্রহদের ভাই-বেরাদরিতে আর থাকছে না। সে সৌরপরিবারের বাইরের দিকটাই আপাতত সামলাক, বরফের চাদরে ঢেকে একবুক সমুদ্র বুকে নিয়েও।
লেখক: অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল ও ইলেকট্রনিক বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: ১. কে ডি রুনিয়ান এবং অন্যান্য, ‘আ জিওফিজিকাল প্ল্যানেট ডেফিনিশন, লুনার অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্স, খণ্ড ৪৮, পৃষ্ঠা ১৪৪৮, ২০১৭। ২. ওয়েলকাম টু দ্য ইউনিভার্স, নিল ডি-গ্রাস টাইসন, মাইকেল ক্রাউস ও রিচার্ড গট