মহাকাশ
গ্রীষ্মকালে সূর্যের তাপ বেশি কেন?
ছোটদের জন্য সহজ ভাষায় লেখা কঠিন। সহজ কথা যে যায় না বলা সহজে! অথচ একদম সহজ-সাবলীল ভাষায় লেখা এই বই। টেলিস্কোপ কী বলে নামের এ বই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রাদুগা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। পাভেল ক্লুশান্ৎসেভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন অরুণ সোম। এ বইয়ে প্রচুর ছবি আছে। সেগুলো এঁকেছেন ইয়ে. ভোইশ্ভিল্লো, ব. কালাউশিন, ব.স্তারোদুব্ৎসেভ এবং ইউ. কিসিলিওভ। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে বইটি প্রকাশিত হচ্ছে…
শীতকালের চেয়ে গ্রীষ্মকালে সূর্যের তাপ বেশি হয় কেন? গ্রীষ্মকালে পৃথিবী কি তাহলে সূর্যের খানিকটা কাছে চলে আসে? তাই যদি হতো, তাহলে গ্রীষ্মকালে আকাশে সূর্য শীতকালের চেয়ে বড় দেখাত। যেকোনো জিনিস কাছ থেকে বড় দেখায়, দূর থেকে ছোট। অথচ আকাশে সূর্যের আকার কী গ্রীষ্মে কী শীতে—সব সময় এক।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, যে ‘চুল্লির আগুন’ থেকে আমরা তাপ পাচ্ছি, সেটা কত দূরে অবস্থান করছে, ব্যাপারটা আসলে সেখানে নয়।
তোমাদের মনে আছে কি সূর্য গ্রীষ্মকালে আকাশের কোন জায়গায় থাকে, শীতকালেই-বা কোন জায়গায়? গ্রীষ্মকালে অনেকটা ওপরে ওঠে। আর সূর্য আকাশের যত ওপরে থাকে, তার কিরণও তত প্রখর হয়। এই দেখ না কেন, দিনের বেলায় সকালের চেয়ে বেশি উত্তাপ দেয়, তাই না? শুধু তা-ই নয়, গ্রীষ্মকালের দিন শীতকালের দিনের চেয়ে অনেক বেশি বড়। গ্রীষ্মকালে সূর্য অনেক সকাল-সকাল ওঠে, অস্ত যায় বেশ দেরি করে। দিন বড় বলে সূর্য বায়ু আর পৃথিবীকে এবং তোমাকে-আমাকেও ভালো মতো গরম করে তোলার সময় পায়। এ কারণে শীতকালের তুলনায় গ্রীষ্মকালে তাপ বেশি।
গ্রীষ্মের পর আসে শরৎকাল। দিনে দিনে সূর্য আকাশের আরও নিচে দিয়ে চলতে থাকে। সে ক্রমেই দেরি করে উঠতে থাকে, দিগন্তের ওপারে অস্ত যেতে থাকে আরও আগে আগে। দিন দিন সে আরও কম তাপ আর আলো দেয়। আরও বেশি ঠান্ডা, আরও বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসতে থাকে।
শীত নামে। ডিসেম্বরে আকাশে সূর্যের আবির্ভাব ঘটে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য, তাও আবার সব সময় তাকে চোখে দেখা যায় না। আকাশের গায়ে একেবারে নিচে সে অবস্থান করছে—ঘরবাড়ি ও গাছপালার আড়ালে কোথাও লুকিয়ে পড়ছে।
উত্তরের দেশগুলোতে অবস্থা আরও খারাপ। সেখানে শীতকালে সূর্য হয়ে পড়ে আরও দুর্বল। কোনোরকমে দিগন্তের ওপরে গিয়ে ওঠে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তার ওঠার আর কোনো শক্তিই যেন থাকে না। কেবল ঘণ্টাখানেকের মতো আকাশে আলো দেয়—এর বেশি সামর্থ্য তার থাকে না। আবার ফিরে আসে রাত। তারপর কয়েক দিন বাদে আকাশে আলো দেওয়াও বন্ধ করে দেয়। এর পরে কয়েক সপ্তাহের মতো ঘনিয়ে আসে নিশ্ছিদ্র রাত। প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে। সর্বত্র অন্ধকার, কালিমা।
কিন্তু নিজেকে যতই সান্ত্বনা দাও না কেন, প্রতিবারই আতঙ্কে শিউরে উঠতে হয়। আচ্ছা, যদি হঠাৎ সূর্য আমাদের একেবারে ছেড়ে চলে যায়? যদি এই অন্ধকার আর ঠান্ডা কখনো শেষ না হয়? তাহলে মানুষ বাঁচবে কী করে? আমাদের উদ্ধারের উপায় তাহলে কী?
জানুয়ারি আমাদের সবচেয়ে ঠান্ডা মাস। এটাতেই আমরা অভ্যন্ত। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার কথাই ধরো না কেন, সেখানে জানুয়ারি ভর গ্রীষ্মকাল।
অতীতে লোকে আরও আতঙ্ক বোধ করত। কোন পুঁথিপত্র ছিল না, স্কুল-কলেজ ছিল না। লোকে কিছু বুঝে উঠতে পারত না। কারও কাছে যে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে, সে উপায়ও ছিল না।
তারা বিষণ্ণ মনে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত—সূর্য চলে যাচ্ছে, শৈলচূড়া কালো হয়ে আসছে, অরণ্য তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। এই দেখে তারা নানা কাহিনি রচনা করত।
শীতকালে যেখানে সূর্য দীর্ঘ সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়, ওসব কাহিনিতে সেই উত্তরের দেশ হলো অন্ধকার আর ঠান্ডার এক ভয়ঙ্কর দেশ—পোহিওলা। পোহিওলায় রাজত্ব করত লৌহি নামে এক খল ডাইনি বুড়ি।
তার সামান্য দূরে সূর্যের দেশ কালেভালায় বাস করত তিনজন ভালো মানুষ মহাবীর।
প্রথম জন জ্ঞানী, বৃদ্ধ ভিয়াইনেমেইনেন। সে এত সুন্দর গান গাইতে পারত যে বনের পশুপাখিরা পর্যন্ত ভিড় করে শুনতে আসত।
দ্বিতীয় জন ইলমারিনেন, এক কামার। ভালো কারিগর। কাজে তার ক্লান্তি নেই। তার হাতের কাজের কোনো তুলনা হয় না।
তৃতীয় জন লেম্মিন্কিয়াইনেন, এক নির্ভীক, ফুর্তিবাজ শিকারী।
ভয়ঙ্কর দেশ পোহিওলা এই তিন মহাবীরকে প্রলুব্ধ করে। প্রলুব্ধ করে এ জন্য যে বুড়ি লৌহির এক বড় সুন্দরী মেয়ে আছে। সুন্দরী আকাশে, সাতরঙা রামধনুর ওপরে বসে বসে রূপোর তাঁতে সোনার কাপড় বোনে।
মহাবীরেরা একে একে সুন্দরীর পাণিপ্রার্থনা করল (বিয়ে করার ইচ্ছে প্রকাশ করল)। কিন্তু সুন্দরী ছিল খামখেয়ালি। তিনজনকেই সে ফিরিয়ে দিল। বুড়িও পাত্রদের নাকাল করতে ছাড়ল না। তাদের যে সব পরীক্ষার মধ্যে ফেলতে লাগল, সেগুলো একটা আরেকটার চেয়ে শক্ত। তারপর ভাগিয়ে দিতে লাগল নানা অজুহাতে।
কেবল ডাইনি শেষ পর্যন্ত কামার ইলমারিনেনের হাতে তার মেয়েকে সমর্পণ করল। কারণ হলো, লোভী ডাইনির জন্য কামার তৈরি করে দিয়েছিল এক মায়া যাঁতাকল—সাম্পো। এই যাঁতাকলে কিছুই পোরার দরকার হতো না, তাকে ঘোরাতেও হতো না। আপনাআপনিই কল ঘুরতে থাকে আর সেখান থেকে ময়দা, নুন, এমনকি দরকার হলে টাকাপয়সা পর্যন্ত, অর্থাৎ লৌহি যা চায়, তাই ঝরে পড়ে।
ইলমারিনেন তো তার তরুণী বধূটিকে নিজের বাড়িতে এনে তুলল। কিন্তু দেখা গেল, মেয়েটি মোটেই সুবিধের নয়, বদমেজাজী। একবার সে তার রাখালের জন্য রুটি সেঁকতে গিয়ে সেই রুটির মধ্যে পাথর পুরে রাখল। রাখাল রেগে গিয়ে গরুর পালকে এক পাল নেকড়ে করে ফেলল। নেকড়ের পাল সঙ্গে সঙ্গে বদমেজাজী কর্ত্রীটিকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল।
বুড়ি বুঝতে পারল, মহাবীরদের সঙ্গে তার কোনো জারিজুরি খাটবে না। পৃথিবীতে চির আঁধার ও ঠান্ডার মতো ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে? কিন্তু তাতেও ওরা মরল না। হতাশ হয়ে সে উড়ে চলে গেল পোহিওলায়, নিজের বাড়িতে।
মহাবীরেরা তখন ঠিক করল, বুড়ি লৌহির কাছ থেকে ওই মায়া যাঁতাকল সাম্পো নিয়ে নেওয়া উচিত। বুড়ি কেবল নিজের জন্য ধন-সম্পদ জমাচ্ছে, কিন্তু যাঁতাকলটা ওদের হাতে থাকলে পৃথিবীর সব মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি আনতে পারে।
পোহিওলার সব যোদ্ধা মহাবীরদের মোকাবিলা করার জন্য বেরিয়ে এল। কিন্তু ভিয়াইনেমেইনেন তার গান ধরতেই ওরা সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। মহাবীরেরা তখন বুড়ির ভাণ্ডারের দরজা খুলে ফেলল, যাঁতাকল সাম্পো বের করে এনে নৌকোয় করে সমুদ্রপথে বাড়ি নিয়ে চলল।
ইতিমধ্যে বুড়ির ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম ভেঙে দেখে সাম্পো নেই। ডাইনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে কাঁপতে কাঁপতে মহাবীরদের পিছু ধাওয়া করল। ওদের ওপর কুয়াশা ছেড়ে দিল। কুয়াশা জড়িয়ে ধরল মহাবীরদের নৌকো। মহাবীরেরা কিন্তু তাতে ভয় পেল না। ভিয়াইনেমেইনেন ঝট করে তলোয়ার বের করে তাই দিয়ে কুয়াশা কেটে ফেলল। দুষ্ট ডাইনি তখন নৌকোর গায়ে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর ঢেউ ছাড়তে লাগল। কিন্তু সে বিপদও কাটিয়ে উঠল মহাবীরেরা। তখন লৌহি সাহায্যের জন্য বাতাসকে ডেকে আনল। বাতাস ঝড় তুলে আছড়ে পড়ল নৌকোর ওপর। কিন্তু দুঃসাহসী বীরেরা তাকেও কাবু করে ফেলল।
বুড়ি ডাইনি রাগে অন্ধ হয়ে উঠে পোহিওলার সব লোকজনের মধ্যে হুলস্থুল ফেলে দিল। আগন্তুকদের প্রতি ঘৃণার বশে তারা সবাই বুড়ি ডাইনির সঙ্গে মিলে পিছু ধাওয়া করল ওদের। ও! কী তুমুল লড়াইটাই না হলো! কিন্তু সে যা-ই হোক না কেন, মহাবীরদের বিনাশ করা গেল না।
মাঝখান থেকে কেবল যাঁতাকলটাই সমুদ্রে পড়ে গিয়ে ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কিন্তু জ্ঞানবৃদ্ধ ভিয়াইনেমেইনেন যাঁতাকলের ভাঙা টুকরোগুলোকে জড়ো করল। বনের ভেতরকার একটা ফাঁকা জায়গায় এসে সেগুলো এক সঙ্গে জোড়া দিয়ে বলল: ‘কালেভালা দেশের সুখ-সমৃদ্ধি হোক!’
সঙ্গে সঙ্গে বাতাস মাঠের ফসল মাড়ানো বন্ধ করে দিল, হিম বন্ধ করল নবাঙ্কুর নষ্ট করা, মেঘ করুণাময় সূর্যের ওপর থেকে তার আবরণ সরিয়ে নিতে লাগল।
এদিকে বুড়ি ঠিক করল মহাবীরদের ওপর চরম প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবে। মনে মনে এমন একটা ফন্দি আঁটল, যার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এমন সাধ্য কারো নেই।
ভিয়াইনেমেইনেন যখন বনের ভেতরে গান গাইছিল, বুড়ি সেই সময়টা বেছে নিল। ভিয়াইনেমেইনেন এত চমৎকার গান গাইছিল যে সূর্য-চন্দ্র পর্যন্ত তার গান শোনার জন্য নিচে নেমে এসে ফার গাছের ঝাঁকড়া ডালপালার ওপর বসল।
ঠিক এই সুযোগে পাজি বুড়িটা গুড়ি মেরে এগিয়ে এসে খপ করে সূর্য আর চাঁদকে চেপে ধরল, তাদের ধরে নিয়ে গেল নিজের বাড়িতে, বন্ধ করে রেখে দিল মাটির তলার কুঠরিতে।
নেমে এল অন্ধকার আর কনকনে ঠান্ডা। সূর্য আর ওঠে না। পৃথিবীকে কেউ উত্তাপ দেয় না। হিম এসে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। এমনকি চাঁদও বন-জঙ্গল ও পাহাড়-পর্বতকে আলো দেয় না।
কালেভালা দেশের দুঃসময় ঘনিয়ে এল।
ঘন আঁধারে ও ভয়ঙ্কর ঠান্ডায় লোকে কাবু হয়ে পড়ল। সূর্য না থাকায় অবস্থা হলো কঠিন। বড় কঠিন সে অবস্থা! এদিকে বুড়ি মহাবীরদের ওপর প্রতিশোধ নিল বটে, কিন্তু তাদের সম্পর্কে ভীতি তার গেল না।
অন্ধকারে ও ঠান্ডার মধ্যে মহাবীরেরা কী করে দেখার জন্য সে একটা বাজপাখির রূপ ধরে উড়ে চলল। তার কৌতূহল হলো, ওরা মারা গেছে নাকি তখনও ভয়ে থরথর কাঁপছে।
উড়তে উড়তে নিচে নেমে এল সে। এসে কী দেখল? দেখে কী, কামার ইলমারিনেন বহাল তবিয়তে আছে, কামারশালায় কী যেন একটা গড়ছে। বুড়ি জিজ্ঞেস করল, ‘কী তৈরি করছ তুমি?’
ইলমারিনেন বলল, ‘আমি? আমি লোহা পিটিয়ে পাজি বুড়ি লৌহির জন্য একটা গলার বেড়ি বানাচ্ছি। ওটাকে আমি শেকলে বেঁধে তামার পাহাড়ের পাথুরে চূড়ার সঙ্গে আটকে রাখতে চাই।’
বুড়ি বুঝতে পারল, মহাবীরদের সঙ্গে তার কোনো জারিজুরি খাটবে না। পৃথিবীতে চির আঁধার ও ঠান্ডার মতো ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে? কিন্তু তাতেও ওরা মরল না। হতাশ হয়ে সে উড়ে চলে গেল পোহিওলায়, নিজের বাড়িতে। মাটির তলার কুঠুরি খুলে ছেড়ে দিল সূর্য আর চাঁদকে। কালেভালা দেশে আবার আলো দেখা দিল, ছড়িয়ে পড়ল উত্তাপ।
এখন আর তাই শীতকালে সূর্য পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেও লোকে ভয় পায় না। ভয়ঙ্কর দেশ পোহিওলার কর্ত্রী, দুষ্ট ডাইনি হার মানল। তাকে হার মানতে হলো মানুষের কাছে, যে মানুষ অন্ধকার বা ঠান্ডা—কোনোটাকেই ডরায় না।
সুন্দর গল্প, তাই না?
আচ্ছা এসো, এবারে দেখা যাক, আসলে কেন এমন হয়। কেন সূর্য শীতকালে ও গ্রীষ্মকালে একইভাবে আকাশে চলাচল করে না? অথচ দেখ, পৃথিবী কিন্তু সব সময় একইভাবে ঘুরছে।
সব কিছুর জন্য দায়ী ‘পৃথিবীর অক্ষদণ্ড’। অক্ষদণ্ডটি আসলে হেলানো। এ কারণে পৃথিবী ঠিক নাগরদোলার মতো সোজা দাঁড়িয়ে ঘুরপাক না খেয়ে পাক খাচ্ছে সামান্য কাত হয়ে। আর পৃথিবী হেলে আছে সব সময় একই পাশে। এখানেই হলো আসল রহস্য।
আমাদের আঁকা ছবিতে পৃথিবীর অক্ষদণ্ড ডান দিকে হেলানো। পৃথিবী সূর্যের চারধারে উড়ে চলেছে, এর ফলে তার ওপরের অর্ধেকটা, উত্তর গোলার্ধ কাত হয়ে কখনো সূর্যের দিকে আসে, কখনো-বা সূর্যের কাছ থেকে সরে যায়।
একবার দেখ, উত্তর গোলার্ধ যখন সূর্যের দিকে কাত হয়ে থাকে, তখন কী হয়।
পৃথিবী ধীরে ধীরে ঘোরে। আমরা তার ওপরে আছি। আমরা যখন আলো ও অন্ধকারের সীমানার কাছাকাছি চলে আসি, তখন সূর্যোদয় দেখতে পাই। ছবিতে এই জায়গায় লেখা আছে ‘সকাল’।
তারপর আমরা পৃথিবী-নাগরদোলায় চেপে সারাদিন ধরে সূর্যকিরণের নিচ দিয়ে চলতে থাকব। দুপুরবেলায় সূর্য আকাশে ঝুলতে থাকবে প্রায় সরাসরি আমাদের মাথার ওপরে।
আরও কিছু সময় পরে সূর্য চলে যাবে দিগন্তরেখার পেছনে। যেখানে ‘সন্ধ্যা’ শব্দটি লেখা আছে, আমরা যখন তার কাছাকাছি চলে আসব, তখন সূর্য আমাদের আর আলো দেবে না।
এবারে দেখ, রাত কী ছোটই-না হবে।
গ্রীষ্মকালে সূর্যকিরণের নিচ দিয়ে আমরা কত দীর্ঘ পথই-না যাত্রা করি, আর কত অল্প পথই-না আমাদের যেতে হয় ছায়ার নিচ দিয়ে!
অতএব দিন এত বড় আর রাত এত ছোট হয় বলেই এবং সূর্য যেহেতু ওপর থেকে, সরাসরি আমাদের মাথার ওপর কিরণ দেয়, সে কারণে গরম লাগে। গ্রীষ্মকাল শুরু হয়। একেবারে উল্টোটা ঘটে যখন পৃথিবী সরে যায় অন্য দিকটায়। উত্তর গোলার্ধ তখন আর সূর্যের দিকে কাত হয়ে না থেকে সূর্যের কাছ থেকে কাত হয়ে সরে যায়। নিজের কক্ষপথে পৃথিবীর প্রতিবার আবর্তনের সময় আমাদের অনেকক্ষণ ছায়ায় বসে থাকতে হচ্ছে। পৃথিবী নামক নাগরদোলাটি মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাদের নিয়ে আসে সূর্যকিরণের নিচে, তারপর আবার অনেকক্ষণের জন্য নিয়ে যায় ছায়ায়।
কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে আমাদের এখানে যখন গ্রীষ্মকাল, দক্ষিণ গোলার্ধে তখন শীতকাল। আবার আমাদের এখানে যখন শীত, তখন ওখানে নামে গ্রীষ্ম।
আমাদের রাতের পথ হয় দীর্ঘ, আর দিনের পথ ছোট। দিনের বেলায়ও এখন আর গ্রীষ্মকালের মতো সূর্য খাড়া ভাবে আমাদের ওপর আলো ফেলে না, ফেলে পাশ থেকে। তার রশ্মি হয় ম্লান। পৃথিবীর ওপর সূর্যরশ্মি তেরছাভাবে পিছলে পড়ে। পৃথিবীকে তেমন একটা গরম করতে পারে না।
আমাদের ঠান্ডা লাগে। শীত নামে।
আমরা যদি বিষুবরেখার কাছাকাছি কোথাও বাস করতাম, তাহলে আমাদের কখনোই ঠান্ডায় জমে যেতে হতো না, ওভারকোট গায়ে দিতে হতো না। বছরের যেকোনো ঋতুতে সেখানে সূর্য সরাসরি ওপর থেকে কিরণ দেয়। সূর্য অনেক অনেক ওপরে উঠে যায়।
তাই বিষুবরেখার কাছাকাছি দেশগুলোতে সব সময়ই বেজায় গরম। ওই দেশগুলোকে বলাও হয় ‘গরম দেশ’।
ঠান্ডা কাকে বলে, বরফ কী—এ সব সে দেশের অধিবাসীরা জানেই না।
আবার বিষুবরেখার ওপারে, ভূমণ্ডলের নিচের অর্ধাংশে ফের পাবে শীত ও গ্রীষ্মকাল।
কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে আমাদের এখানে যখন গ্রীষ্মকাল, দক্ষিণ গোলার্ধে তখন শীতকাল। আবার আমাদের এখানে যখন শীত, তখন ওখানে নামে গ্রীষ্ম।
তোমরা এতক্ষণ সম্ভবত অনুমান করতে পেরেছ, কেন এমন হয়। পৃথিবীর ওপরের অর্ধাংশ যখন সূর্যের দিকে হেলে থাকে, তখন নিচের অর্ধাংশ তার দিক থেকে ঘুরে যায়। আবার ওপরের অর্ধাংশ যখন মুখ ঘুরিয়ে থাকে, তখন নিচের অর্ধাংশ সূর্যের কিরণে গরম হয়ে যায়।
জানুয়ারি আমাদের সবচেয়ে ঠান্ডা মাস। এটাতেই আমরা অভ্যন্ত। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার কথাই ধরো না কেন, সেখানে জানুয়ারি ভর গ্রীষ্মকাল। মে মাস সেখানে শরৎকাল, জুলাইতে কঠিন শীত, আর সেপ্টেম্বরে কিশলয় দেখা দেয়, সর্বত্র সবুজের সমারোহ, তখন বসন্তের সমাগম।
সেখানে সবই উল্টো। তার কারণ এই যে আমাদের দেশ আর অস্ট্রেলিয়া ভূমণ্ডলের দুই ভিন্ন ভিন্ন অর্ধাংশে অবস্থান করছে। আমরা আছি উত্তর গোলার্ধে, আর অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ গোলার্ধে।
শিগগিরই বাজারে আসছে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যা। অর্ডার করুন আজই।
তাহলেই বুঝে দেখ, পৃথিবীর অক্ষদণ্ড কাত হয়ে থাকার ফলে কী মজার ব্যাপার ঘটছে! কিন্তু পৃথিবী যদি সত্যিকারের নাগরদোলার মতো ‘খাড়া দাঁড়িয়ে থেকে’ ঘুরপাক খেত, তাহলে গোটা জিনিসটা হতো একেবারে অন্যরকম।
সূর্য তাহলে সারা বছর আমাদের একভাবে উত্তাপ দিত। ঋতু বলে আর কিছু থাকত না। দুই মেরুর কাছাকাছি জায়গায় হতো চির শীত, বিষুবরেখার কাছাকাছি জায়গায় চির গ্রীষ্ম। আর ইউরোপে সব সময় কাদা প্যাচপ্যাচ করত—না বসন্ত, না শরৎ।
তখন আর টিলার ওপর থেকে স্কি করার মতো অবস্থা থাকত না, সাগরবেলায় সূর্যস্নানও করা যেত না। না এদিক, না ওদিক অবস্থা হতো। বারো মাস রবারের বুট পরে ছাতা হাতে পথ চল। বড় বিশ্রী লাগত, তাই না?
পৃথিবীর অক্ষদণ্ড যে হেলানো, সেটা ভালোই বলতে হবে!