পৃথিবী থেকে চাঁদে - ২

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর সম্পর্ক। ‘পৃথিবী ও আকাশ’ নামে এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…

কল্পনা করো, চাঁদের দিকে মানুষের প্রথম যাত্রার দিন এসে পড়েছে। আন্তঃগ্রহ প্রথম রকেটযানের আরোহী আমরা।

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বহিঃসীমা অতিক্রম করে রকেটযান থামবে না। বরং বাধা দেওয়ার মতো বাতাস নেই বলে এর গতি হবে দ্রুততর। রকেটযানের গতিবেগ বাড়াতে হবে ক্রমে, যাতে ঝাঁকুনি বা ঝাপ্টা না লাগে। ট্রামগাড়ি হঠাৎ এগোলে কী দশা হয় জানো তো—যাত্রীরা পেছনে ছিটকে পড়ে।

পৃথিবী থেকে রেডিও-সঙ্কেতে পরিচালিত হবে আমাদের রকেট। রকেটের যন্ত্রপাতি সেসব সঙ্কেত মেনে চলবে, গতিবেগ বাড়বে মসৃণ ও নিয়মিতভাবে, সঙ্কেত-নির্দিষ্ট পথে চলবে রকেট।

মহাশূন্যে ক্রমশ দ্রুত চলেছে আমাদের রকেট। পৃথিবী পড়ে আছে অনেক পেছনে, রকেটের গতিবেগ এখন ঘণ্টায় ২৫ হাজার কিলোমিটার। এত সাংঘাতিক গতিবেগ, যাত্রীদের ক্ষতি হবে না তো? এতটুকু না। গতিবেগ যতই হোক না কেন, সমান থাকলে মানুষ অনুভব করে না। শুধু হঠাৎ ঝাঁকুনি তার পক্ষে ক্ষতিকর।

অবশেষে প্রয়োজনীয় বেগ লাভ করল রকেট, থেমে গেল মোটর, কেননা জ্বালানি খরচা করতে হবে বুঝেসুঝে। এখন প্রায় সমান বেগে চলবে রকেটের যাত্রা। বরফের আয়নার মতো চকচকে বুকে ছোটা স্কেটারের মতো।

বরফ যতই মসৃণ হোক, বাতাসের বাধা আর স্কেটের ঘষটানিতে স্কেটারের গতিবেগ কমে।

কিন্তু ফাঁকা মহাশূন্যে রকেটের বেগ কমাতে পারে, এমন কীই-বা আছে? পৃথিবীর মহাকর্ষ। পৃথিবী থেকে বহুদূরে গিয়েও পৃথিবীর টান অনুভব করছে রকেট। আর এ টান চলতে থাকবে। অবশ্য পৃথিবী আর রকেটের দূরত্ব যত বাড়বে, তত কমে যাবে সে টান। পৃথিবী ছাড়ার সময়কার টানের চেয়ে এখন অনেক কম, তবু রকেটের বেগ কমানোর পক্ষে যথেষ্ট।

পৃথিবী ও সূর্য থেকে রকেটটা যদি মহাকর্ষের আওতাবিহীন দূরে গিয়ে পড়ে, তাহলে কোটি কোটি বছর ধরে মহাশূন্যে চলবে তার উদ্দাম নিরুদ্দেশ যাত্রা, যদি না আকর্ষণকারী কোনো দেহের কাছাকাছি এসে পড়ে।

আমাদের যাত্রা কিন্তু খুব দীর্ঘ হবে না। পৃথিবী ছাড়ার সময়ে ধীরে ধীরে বেগ বৃদ্ধি আর চাঁদের কাছাকাছি এসে ক্রমশ বেগ হ্রাস, সব নিয়ে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা লাগবে।

মহাশূন্য-রকেটের গলুইয়ে ছোট ছোট গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে পারে যাত্রীরা, জাহাজের পোর্টহোল দিয়ে যেমন। বিশেষ ধাঁচের কাচে জানালাগুলো তৈরি, খুব পুরু, ইস্পাতের চেয়ে শক্ত। চাঁদের সন্নিকটে এসে সবাই ভালো করে দেখার জন্য উদগ্রীব।

তুমি আমি চলো বসি একটা জানলার ধারে। চাঁদের বহির্ভাগের মানচিত্র যেখানে টাঙানো, তার পাশের জানালাটা চমৎকার। এখান থেকে চাঁদকে দেখে মানচিত্রে আঁকা নানা জায়গা মিলিয়ে নিতে পারি।

এখন তো চাঁদকে বেশ বড় দেখাচ্ছে, পৃথিবী থেকে অত বড় ঠেকে না। এ থেকে বোঝা গেল, অর্ধেক পথ এর মধ্যে অতিক্রম করেছি। এখনো চাঁদের চেহারাটা চ্যাপ্টা চাকতির মতো, অনেক কালো ছোপসুদ্ধ প্রকাণ্ড একটা রূপার টাকা যেন। কিন্তু যত কাছে আসি, তত বেশি চোখে পড়ে চাঁদের উত্তল চেহারা। মনে হয় কেন্দ্রটা ঝুঁকে এগিয়ে আসছে। আর চাকতির কিনারাগুলো সরে যাচ্ছে। অচিরে স্পষ্ট দেখলাম চাঁদ ফাঁকা কালো মহাশূন্যে স্বচ্ছন্দে ঝুলন্ত একটা বিরাট বল বা গোলক, আর আমাদের কাছ থেকে অসম্ভব দূরে হাজার হাজার তারার দীপ্তি। 

আরেকটা মজার আবিষ্কার করা গেল। তারাগুলো দপদপ করে জ্বলছে না, ওগুলো হলো উজ্জ্বল আলোর খুদে খুদে ছোপ। এত ছোট যে তাদের ব্যাস মাপা যায় না। পৃথিবী থেকে দেখলে শুধু মনে হয়, তারাগুলো দপদপ করছে।

গ্রীষ্মের গরম দিনে হাওয়ার কাঁপন আর ঝিলিমিলি দেখেছ নিশ্চয়ই। ঝিকঝিকে হাওয়ায় মনে হয় জিনিস সব কাঁপছে, তাদের বাহির-রেখা বিকৃত হয় একটু।

তারার দিকে যখন চাই তখন একই ব্যাপার, কেননা পৃথিবীর ওপরকার বাতাস শান্ত থাকে কদাচিৎ। এতে তারার বাইরের আকার বদলে যায়, মনে হয় ছড়িয়ে পড়ে তারা আরও বড় হচ্ছে, আর তত উজ্জ্বল নয়।

মহাশূন্য-রকেট থেকে নক্ষত্রখচিত আকাশ কী সুন্দর দেখায়। এ সৌন্দর্যের তুলনা নেই কোথাও। কিন্তু আপাতত আমাদের দৃষ্টি ও মনোযোগ নিবন্ধ চাঁদে, ক্রমশ বড় হওয়া বিরাট গোলকটিতে।

অদ্ভুত এ যাত্রায় বেরিয়ে কোনো ভুল করিনি—সারাক্ষণ নতুন কিছু না কিছু আমাদের চোখে পড়ছে।

পৃথিবী থেকে খালি চোখে চাঁদের দিকে তাকালে কয়েকটা কালো ছোপ নজরে পড়ে। দূরবীক্ষণ উদ্ভাবনের আগে লোকে ঠিক জানত না এগুলো কী। নানা খেয়ালী কথা বলেছে, সবচেয়ে চলতি এই যে চাঁদ হলো মানুষের মুখ, চাঁদ-মামা। খুব পুরোনো মানচিত্রে নাক, চোখ আর মুখসুদ্ধ চাঁদের ছবি আঁকা হয়েছে।

আমাদের পোর্টহোল থেকে দেখলাম চাঁদের বুকে পাহাড়ের শ্রেণি, চূড়াগুলো আলোকিত সূর্যালোকে। মর্ত্যের মানুষ আমরা কয়েকটা অদ্ভুত পাহাড় দেখে হতবাক। এগুলো হলো আগ্নেয়গিরির মুখবিবর ও প্রাকৃতিক অ্যাম্ফিথিয়েটার। চাঁদের আগ্নেয়গিরির আকার আমাদের আগ্নেয়গিরির মতোই, কিন্তু আয়তনে তারা কয়েক ডজন গুণ বড়। চূড়া কেটে ফেলা পাহাড়ের মতো চেহারা, চূড়ার পরিবর্তে প্রকাণ্ড গোল ফাঁকা জায়গা, তার মাঝে কখনো কখনো দীর্ঘ ছাঁচালো টিলা।

আগ্নেয়গিরির মুখবিবরের চেয়েও প্রাকৃতিক অ্যাম্ফিথিয়েটারগুলো বড়, আংটির মতো উঁচু প্রাচীর ঘেরা বৃত্তাকার সমভূমি যেন। এদের কয়েকটা এত বড় যে সুইজারল্যান্ডের মতো ছোট একটা দেশ জায়গা পেতে পারে।

চাঁদের আগ্নেয়গিরি আর অ্যাম্ফিথিয়েটারগুলোর সংখ্যা গোণার চেষ্টা করি। এক, দুই, তিন... দশ... বিশ... পঞ্চাশ....

না, গোণা অসম্ভব, ওদের সংখ্যা হাজার হাজার। কিন্তু আমাদের তৈরি চাঁদের মানচিত্রে সবগুলো আছে, প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা নাম: কোপের্নিকাসের আগ্নেয়গিরি, গ্যালিলিওর আগ্নেয়গিরি, টলেমির অ্যাম্ফিথিয়েটার... অধিকাংশের নাম দেওয়া হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সম্মানার্থে।

কিন্তু এ কী? রকেটযানে আর নিঃসাড় স্তব্ধতা নেই: বিরস বিস্ফোরণে কেঁপে কেঁপে উঠছে জাহাজের খোল। একেবারে পায়ের নিচে তার শব্দ পেলাম। বলো তো কী ব্যাপার? গলুইতে রকেট মোটরগুলো চলতে শুরু করেছে, ব্রেক কষে রকেটের গতিবেগ কমানোর জন্য। চাঁদের কাছে যে গতিবেগে এসেছে, সেকেন্ডে সেই ২-৪ কিলোমিটার বেগে চাঁদে নামলে রকেটটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

গতি কমানোর হার বেড়ে যাওয়ায় সামনে অদম্য টান পড়ল আমাদের। দেয়ালে লাগানো শক্ত বেল্ট চেপে ধরলাম পড়ার ভয়ে।

চাঁদের জ্যোতি আর নেই, বিরাট কালো একটা মেঘ আকাশের প্রায় সবটা জুড়ে যেন এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।

আমরা ত্রস্ত—প্রথম যাত্রীবাহী রকেটের চাঁদে অবতরণ ব্যাপারটা দাঁড়াবে কেমন?

চাঁদ কাছে এল আরও, কিন্তু ক্রমশ মন্থর গতিতে। এখন একেবারে পায়ের নিচে এসে পড়েছে, দেখতে হলে যেতে হবে রকেটযানের মধ্য ভাগে, যেখানে কেবিনের মেঝেতে পোর্টহোল আছে।

মনে হলো, চাঁদের পিঠে রকেট পড়ে যাচ্ছে।

এখন চাঁদ থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার ঊর্ধ্বে আমরা। আমাদের নিচে বিরাট ফাটলে ইতস্তত দীর্ঘ, দূরবর্তী পাহাড়ের ছোপ গায়ে মহায়তন একটা অন্ধকার সমভূমি।

হঠাৎ লাউডস্পিকারে ক্যাপ্টেনের কণ্ঠস্বর:

‘আমরা এখন ঝড়-মহাসমুদ্রের ঠিক ওপরে। ওখানে নামব। নামার জন্য সবাই তৈরি থাকুন। বেল্টগুলো শক্ত করে বাঁধুন।’

ঝড়-মহাসমুদ্র। তার মানে জলে নামব? দেখে তো তা মনে হয় না: কোথাও কোনো হ্রদ চোখে পড়ে না, ছোট নদী পর্যন্ত নয়।

যাত্রীদের একজন হলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রফেসর। নামটার ব্যাখ্যা তিনি দিলেন।

‘চাঁদের দিকে প্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র ঘুরিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দেখেন, এটা একটা সমগ্র জগৎ, তাতে আছে পর্বতমালা, আগ্নেয়গিরির মুখবিবর আর প্রকাণ্ড কালো কালো ছোপ। কালো ছোপগুলো চাঁদের সমভূমি, কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ভাবতেন ওগুলো সাগর ও মহাসাগর। তাই আমাদের তৈরি চাঁদের মানচিত্রে আছে ঝড়-মহাসাগর, বৃষ্টি-সাগর, স্বচ্ছতা-সাগর, পচা জলাভূমি ইত্যাদি...। ইংরেজি চান্দ্র মানচিত্রে নামগুলো সাধারণত লাতিনে দেওয়া হয়েছে, যেমন Oceanus Procellarum, Mare Imbrium ইত্যাদি। আসলে কিন্তু চাঁদে ছিটেফোঁটা জল নেই। নিজের চোখেই দেখবে এখনি।’

ইতিমধ্যে চাঁদের অত্যন্ত কাছে এসে পড়েছে আমাদের রকেটযান। রকেটের দেহ থেকে প্রকাণ্ড কী সব বেরিয়ে এল, পায়ের মতো অবতরণের খুঁটি, ধাক্কার জোর কমানোর জন্য শক্তিশালী স্প্রিং শক-অ্যাবজর্বার তাতে লাগানো। অকস্মাৎ একটা ধাক্কা, বেল্ট ছেড়ে আমরা এ ওর ওপর গড়িয়ে পড়লাম মেঝেতে... রকেটযান থেমে দাঁড়িয়ে আছে।

আবার লাউডস্পিকারে ক্যাপ্টেনের উল্লসিত কণ্ঠস্বর: ‘নিরাপদ অবতরণের জন্য প্রথম চান্দ্র অভিযানকে অভিনন্দন জানাই। জাহাজ থেকে নামার জন্য তৈরি হন।’

অদ্ভুত বিজাতীয় এ দেশে কী দেখব আমরা?

(চলবে…)

মূল: আলেকজান্ডার ভলকভ, অনুবাদ: সমর সেন

* পাঠকের সুবিধার্থে বইয়ের মূলভাব ঠিক রেখে বানানরীতির কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।