মহাজাগতিক বিকিরণের উপাখ্যান

মহাশূন্যের গহিন থেকে আসে মহাজাগতিক বিকিরণ। নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিকিরণের মধ্যে এই বিকিরণ যে পৃথিবীর বাইরে থেকে আসে, তা জানার জন্য নানারকম কারিকুরি করতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের। এই রহস্যভেদ, প্রাকৃতিক কণাত্বরক যন্ত্র ও কণাবৃষ্টির কথা…

মহাশূন্যের গহিন থেকে আসে মহাজাগতিক বিকিরণ। এর রহস্যভেদ, প্রাকৃতিক কণাত্বরক যন্ত্র ও কণাবৃষ্টির কথা…

আমরা ডুবে আছি বিকিরণের সমুদ্রে। সর্বত্র এগুলোর সরব উপস্থিতি। অথচ অধিকাংশ সময়েই এগুলোর অস্তিত্ব পর্যন্ত অনুভব করতে পারি না আমরা। উদাহরণ হিসেবে আমাদের নিত্যব্যবহার্য উপকরণ মুঠোফোনে ব্যবহৃত রেডিয়েশন বা বিকিরণের কথাই ভাবুন। এগুলো এক বিশেষ ধরনের তড়িৎ-চুম্বক বিকিরণ, যার নাম বেতার তরঙ্গ। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তথ্য ও ছবি বয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুদায়িত্বটি পালন করে। আধুনিক বিশ্বের প্রত্যেক মানুষের কাছে মুঠোফোন আছে। তাই পৃথিবীর আনাচকানাচে প্রতি মুহূর্তে চলছে এগুলোর অন্তহীন ছুটে চলা। অথচ কোনো মানুষই তার ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে সামান্যতম অনুভবও করতে পারে না এগুলোকে।

অনুভব না করলেও কিছু বিশেষ ধরনের বিকিরণের সংস্পর্শ মানুষের দেহে ভয়ংকর বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। আলফা, বিটা ও গামা রশ্মির মতো আয়নাইজিং রেডিয়েশন বা আয়নিত বিকিরণগুলো এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন এই বিকিরণগুলো সহজেই পরমাণুর ভেতরে থাকা ইলেকট্রনদের ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারে। এর কারণে ভেঙে যায় রাসায়নিক বন্ধন। তৈরি হয় ফ্রি রেডিক্যাল বা মুক্তমূলক নামে অতিসক্রিয় একধরনের রাসায়নিক উপাদান। এগুলো প্রোটিনের মতো নানা জৈবিক অণুর সঙ্গে বিক্রিয়া করার মাধ্যমে ধ্বংস করে দিতে পারে সুস্থ-সবল দেহকোষকে। অবশ্য এতে খুব বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত আয়নিত বিকিরণের সংস্পর্শে এলেও মানবদেহের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। দেহের স্বয়ংক্রিয় প্রতিরোধব্যবস্থা খুব সহজেই এ ধাক্কা সামলে নিতে পারে। শুধু মাত্রাতিরিক্ত বিকিরণের সংস্পর্শে এলেই ঘটতে পারে বিপদ।

মানুষের দেহ যেসব ক্ষতিকর বিকিরণের সংস্পর্শে আসতে পারে, সেগুলোকে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। মানবসৃষ্ট বিকিরণ ও প্রাকৃতিক বিকিরণ। প্রথম ধরনের বিকিরণের প্রায় ৯০ শতাংশই আসে স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহার করা নানা যন্ত্রপাতি থেকে। যেমন এক্স-রে মেশিন, এমআরআই মেশিন ইত্যাদি। অন্যদিকে প্রাকৃতিক বিকিরণের অন্যতম প্রধান উৎস তেজস্ক্রিয় গ্যাস রেডন। এগুলোর উৎপত্তি পৃথিবীপৃষ্ঠের গভীরে থাকা ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয় ক্ষয়প্রক্রিয়া থেকে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক বিকিরণ উৎসগুলো নিয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে শুরু করেন। স্থানভেদে এগুলোর তীব্রতার তারতম্য কতটুকু হয়, সেটি নির্ধারণ করাই ছিল তাঁদের মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি মাটি থেকে ওপরের দিকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর প্রভাবে ঘটা বাতাসের আয়নাইজেশনের মাত্রা কতটুকু পরিবর্তিত হয়, সেটিও খতিয়ে দেখতে চাইলেন তাঁরা।

মানুষের দেহ যেসব ক্ষতিকর বিকিরণের সংস্পর্শে আসতে পারে, সেগুলোকে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। মানবসৃষ্ট বিকিরণ ও প্রাকৃতিক বিকিরণ। প্রথম ধরনের বিকিরণের প্রায় ৯০ শতাংশই আসে স্বাস্থ্য খাতে ব্যবহার করা নানা যন্ত্রপাতি থেকে। যেমন এক্স-রে মেশিন, এমআরআই মেশিন ইত্যাদি
আরও পড়ুন

সাধারণ বিচারবুদ্ধি অনুসারে, ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক বিকিরণের প্রভাব ক্রমাগত কমে যাওয়ার কথা। কারণ, উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মাটির গভীরে থাকা তেজস্ক্রিয় উৎস থেকে দূরত্ব বেড়ে যায়। আপাতদৃষ্টে নিখাদ এই তত্ত্বকে যাচাই করে দেখতে চাইলেন জার্মান বিজ্ঞানী থিওডোর উলফ। ১৯০৯ সালে বিশেষ ধরনের যন্ত্রপাতি নিয়ে তিনি চড়ে বসলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত আইফেল টাওয়ারের মাথায়। মাটি থেকে টাওয়ারের চূড়ার উচ্চতা ছিল প্রায় তিন শ মিটার। সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরে প্রাকৃতিক বিকিরণের প্রভাব কমে যাওয়ার অকাট্য প্রমাণ পেলেন তিনি। মাটিতে থাকা তেজস্ক্রিয় উৎসের জন্য ঘটা বাতাসের আয়নাইজেশনের মাত্রা টাওয়ারের মাথায় নেমে আসে প্রায় অর্ধেকে। কিন্তু সমস্যা বাধে অন্য জায়গায়। উলফের প্রাপ্ত মানটি প্রত্যাশিত ফলাফলের ধারেকাছেও ছিল না। উচ্চতা বিচারে আরও অনেক কমে যাওয়া যাওয়া উচিত ছিল প্রাকৃতিক বিকিরণের প্রভাব।

এরপরে দৃশ্যপটে এলেন অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ ভিক্টর হেস। তিনি হিসাব করে দেখলেন, মাটি থেকে প্রায় ৫০০ মিটার উচ্চতায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসা উচিত প্রাকৃতিক বিকিরণের প্রভাব। যাচাই করার জন্য ১৯১১ সালে বিশেষ যন্ত্রপাতিসহ তিনি একটি গ্যাসভর্তি বেলুনে চড়ে বসলেন। কিন্তু মাটি থেকে প্রায় ১১০০ মিটার উচ্চতাতেও বাতাসের আয়নাইজেশনের হার শূন্যে নেমে আসার কোনো নামগন্ধ খুঁজে পেলেন না। উচ্চতা বাড়লেও কেন যেন প্রত্যাশিত মাত্রায় কমে যাচ্ছিল না প্রাকৃতিক বিকিরণের প্রভাব। হাল ছাড়লেন না হেস। ক্রমান্বয়ে আরও উঁচুতে উঠে মাপতে থাকলেন বাতাসের আয়নাইজেশনের মাত্রা। ১৯১২ সালে তিনি বেলুন নিয়ে বেশ কয়েকবার উঠে যান প্রায় ৫ হাজার মিটার উচ্চতায়। সেই সুবিশাল উচ্চতায় তিনি এক অদ্ভুতুড়ে ঘটনার মুখোমুখি হন। খুব সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হন, বাতাসে আয়নাইজেশনের মাত্রা কমার পরিবর্তে হঠাৎ করেই অনেকখানি বেড়ে গেছে! পৌঁছে গেছে ভূপৃষ্ঠে প্রাপ্ত মানের প্রায় দ্বিগুণ পর্যন্ত। অর্থাৎ উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে কিছু দূর পর্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে প্রাকৃতিক বিকিরণের প্রভাব কমলেও পরে সেটি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। এমনকি ৯ হাজার ৩০০ মিটার উচ্চতায় বাতাসের আয়নাইজেশনের হার ভূপৃষ্ঠের তুলনায় ৪০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

হন্যে হয়ে এই অদ্ভুত ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজতে শুরু করলেন হেস। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের অজানা এক বিকিরণের আবির্ভাবের জন্য এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এই বিকিরণের উৎস কোনোভাবেই পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে পারে না। বরং এগুলো আসে পৃথিবীর বাইরে থেকে। বায়ুমণ্ডল এগুলোর বিপক্ষে ঢাল হিসেবে কাজ করে। ফলে মহাশূন্য থেকে এসে একদম ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হয় না এগুলোর পক্ষে। সে কারণেই এত দিন পর্যন্ত কেউ এগুলো খুঁজে পাননি। ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরের দিকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমণ্ডল ক্রমেই পাতলা হওয়ার সুবাদে এগুলোর উপস্থিতি দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। যথেষ্ট যৌক্তিক হওয়া সত্ত্বেও প্রথম দিকে হেসের উপসংহার বৈজ্ঞানিক সমাজে খুব একটা সাড়া ফেলতে পারেনি। তবে ১৯২৫ সালে বিখ্যাত মার্কিন এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্ট রবার্ট অ্যান্ড্রুস মিলিকানের গবেষণার সূত্র ধরে নতুন প্রাণ পায় হেসের সমাধানটি। তিনি এই অজানা বিকিরণের নামকরণ করেন কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি। দেরিতে হলেও এগুলো আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৬ সালে মর্যাদাপূর্ণ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয় ভিক্টর হেসকে।

প্রকৃতির পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর

কসমিক রশ্মিরা আসলে কী দিয়ে গঠিত? রবার্ট মিলিকানের মতে, এরা উচ্চশক্তিসম্পন্ন গামা রশ্মি। যেগুলোর উৎপত্তি আন্তনাক্ষত্রিক মহাশূন্যে থাকা হাইড্রোজেন পরমাণুর ফিউশনের মাধ্যমে। কিন্তু অচিরেই তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণ করেন ডাচ পদার্থবিদ জেকব ক্লে। তাঁর করা এক্সপেরিমেন্টে চৌম্বকক্ষেত্রের উপস্থিতিতে মহাজাগতিক রশ্মিদের বেঁকে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এগুলো এলেই যদি গামা বিকিরণ হতো, তাহলে চৌম্বকক্ষেত্র বা তড়িৎক্ষেত্রের উপস্থিতিতে এগুলোর গতিপথ সামান্যতম পরিবর্তন হতো না। শুধু চার্জিত কণাদের গতিপথই এগুলোর উপস্থিতিতে পরিবর্তিত হতে পারে।

আধুনিক যুগে এসে বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক রশ্মির গঠন রহস্য উন্মোচন করতে পেরেছেন। এগুলোর সিংহভাগ গঠিত হয় ধনাত্মক আধানবিশিষ্ট প্রোটনদের নিয়ে। শতকরা হিসাবে এগুলোর উপস্থিতি প্রায় ৮৯ ভাগ। পাশাপাশি এতে শতকরা ১০ শতাংশের কাছাকাছি হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের অস্তিত্ব থাকে। বাকি এক ভাগ অপেক্ষাকৃত ভারী নিউক্লিয়াস। প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন হতে পারে এই মহাজাগতিক কণারা। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এসে আঘাত করা কণাগুলোর শক্তির মান হতে পারে ১০২০ ইলেকট্রন ভোল্টের সমান। একটু তুলনা করলে এই শক্তির মানের মাহাত্ম্যটা বুঝতে সহজ হবে। এখন পর্যন্ত মানুষের তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী কণাত্বরক যন্ত্রের নাম লার্জ হ্যাড্রন কলাইডর। বিজ্ঞানীরা সেখানে প্রোটন কণাদের শক্তি সর্বোচ্চ ৬.৫×১০১২ ইলেকট্রন ভোল্ট পর্যন্ত উন্নীত করতে পেরেছেন। মহাজাগতিক প্রোটনদের সমান শক্তির পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে এখনো পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ।

চেরেনকভ ডিটেক্টর

আচ্ছা, একটু ভাবুন তো, প্রচণ্ড শক্তিশালী এসব মহাজাগতিক কণাদের উৎস কী? প্রকৃতির কোন ভয়ংকর শক্তিশালী পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর থেকে এগুলোর আবির্ভাব? আধুনিক যুগে এসেও প্রশ্নগুলোর নিশ্চিত কোনো উত্তর নেই বিজ্ঞানীদের কাছে। মহাজাগতিক রশ্মির মূল উৎস হিসেবে অনেকেই সূর্যের নাম প্রস্তাব করতে পারেন। কিন্তু এটি মোটেই সত্য নয়। ১৯১২ সালের বেলুন এক্সপেরিমেন্টের সময়েই ভিক্টর হেস এ সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে গেছেন। তখন প্রায় পূর্ণাঙ্গ সূর্যগ্রহণের সময়েও হাজার পাঁচেক মিটার উচ্চতায় মহাজাগতিক কণাদের স্বাভাবিক উপস্থিতি লক্ষ করেন তিনি। যদি এগুলো সত্যি সূর্য থেকে উৎপন্ন হতো, তাহলে পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময়ে অবশ্যই এগুলোর উপস্থিতিতে ভাটা পড়ত। আর বিকিরণের প্রভাবে বাতাসের আয়নাইজেশনের মাত্রা কমে যেত। কিন্তু বাস্তবে এমনটা হয় না। অবশ্য সূর্য থেকে যে একেবারেই মহাজাগতিক কণা আসে না, তা কিন্তু নয়। শুধু সর্বনিম্ন শক্তির কণাদের উৎস সূর্য। সত্যিকারের উচ্চশক্তির কণাদের উৎস অন্য কোনো ভুবনে।

আগেই বলেছি, চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে হরহামেশাই বেঁকে যেতে পারে উচ্চশক্তির মহাজাগতিক কণাদের গতিপথ। এ জন্য এগুলোর আদি ঠিকানা খুঁজে বের করা খুব কঠিন। তবে বিজ্ঞানীদের চেষ্টা থেমে নেই। মহাশূন্য থেকে আসা উচ্চশক্তির গামা বিকিরণগুলোর সূত্র ধরে এই রহস্য সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁরা। চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত না হওয়ায় গামা রশ্মির গতিপথ অপরিবর্তিত থাকে। ফলে সহজেই এগুলোর আদি উৎস শনাক্ত করা যায়। এগুলোর অন্যতম উৎস সুপারনোভা বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষগুলো। এগুলোর অমিত শক্তিশালী প্রাকৃতিক পার্টিকেল অ্যাক্সিলারেটর মহাজাগতিক কণাদের আদি উৎস হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এগুলোর বিস্ফোরণের সময়ে উৎপন্ন শক ওয়েভের ধাক্কায় অকল্পনীয় মাত্রায় ত্বরিত হতে পারার কথা কণাদের। বিজ্ঞানীদের এহেন অনুমান সত্য কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।

কণাবৃষ্টির গল্প

প্রচণ্ড শক্তিশালী মহাজাগতিক কণারা বহু পথ পাড়ি দিয়ে পৃথিবীতে পৌঁছায়। কিন্তু এই মহাজাগতিক অতিথিদের (!) একরকম দরজা থেকেই বিদায় করে দেয় পৃথিবীর বেরসিক বায়ুমণ্ডল। কারণ, এমনটা না করলে বিলীন হয়ে যেতে পারে গোটা জীবজগৎ। যাহোক, মহাজাগতিক রশ্মি ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারায় এগুলো নিয়ে সরাসরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা বা এগুলো সরাসরি শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। অবশ্য এতে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি বিজ্ঞানীদের। বুদ্ধি খাটিয়ে ঠিকই এগুলোর নাগাল পাওয়ার উপায় খুঁজে বের করে ফেলেছেন তাঁরা। আর ধরিত্রীর বুকে হরেক রকম কণাদের বৃষ্টি নামিয়ে সেই কাজ অনেকটাই সহজ করে দেয় কসমিক রশ্মিরা নিজেই। চলুন বিস্তারিত জেনে নিই, কীভাবে ঘটে এ ঘটনা।

মহাজাগতিক কণারা (যেমন প্রোটন) পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পৌঁছানোর পর সেখানে আগে থেকেই ওত পেতে থাকা পরমাণুদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফলে মহাজাগতিক কণাদের ভেতরে থাকা শক্তি রূপান্তরিত হয়ে তৈরি করে নতুন কণা ও প্রতিকণা। এগুলোও চুপচাপ বসে থাকে না। তৈরি হয়েই সংঘর্ষে জড়ায় বায়ুমণ্ডলের অন্যান্য পরমাণুর সঙ্গে। অতঃপর একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এভাবে ধাপে ধাপে কণাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে কণাদের গড় শক্তি। এই কণাগুলো বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এলাকার পরিধি কতটুকু হবে, সেটি নির্ভর করে মূল মহাজাগতিক কণাটির শক্তির ওপরে। পুরো প্রক্রিয়াটিকে অনেকটা বৃষ্টি নামার মতোই মনে হয়, যেখানে পানির ফোঁটার পরিবর্তে নেমে আসে হরেক রকম কণারা।

কণাবৃষ্টির মাধ্যমে মাটিতে পৌঁছানো কণাদের মধ্যে অন্যতম মিউওন। এগুলো আমাদের সুপরিচিত কণা ইলেকট্রনের জাত ভাই। ইলেকট্রনের চেয়ে সামান্য ভারী হলেও চার্জের মান ও প্রকৃতিতে পুরো একরকম। সংঘর্ষের মাধ্যমে খুব কম পরিমাণ শক্তি হারানোয় এগুলো খুব সহজেই ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের লেভেলে পৃথিবীর প্রতি বর্গসেন্টিমিটার এলাকায় প্রতি মিনিটে কমপক্ষে একটি করে মিউওন কণা এসে পৌঁছায়। এ সময়ে এগুলোর গতিবেগ থাকে আলোর বেগের প্রায় ৯৮ শতাংশ। মহাজাগতিক রশ্মির নিশ্চিত আগমনী বার্তা নিয়ে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছানো মিউওনগুলোকে মেঘকক্ষ বা ক্লাউড চেম্বার ব্যবহার করে খুব সহজেই শনাক্ত করা যায়। এমনকি ঘরের এক কোনায় পড়ে থাকা কফির পট ব্যবহার করে তৈরি করা ডিটেক্টরের মাধ্যমেই শনাক্ত করা যায় এগুলো।*

কণাবৃষ্টির মাধ্যমে মাটিতে পৌঁছানো কণাদের মধ্যে অন্যতম মিউওন। এগুলো আমাদের সুপরিচিত কণা ইলেকট্রনের জাত ভাই। ইলেকট্রনের চেয়ে সামান্য ভারী হলেও চার্জের মান ও প্রকৃতিতে পুরো একরকম। সংঘর্ষের মাধ্যমে খুব কম পরিমাণ শক্তি হারানোয় এগুলো খুব সহজেই ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে
আরও পড়ুন

প্রসঙ্গ থেকে একটু সরে গিয়ে মিউওন কণাদের নিয়ে কিছু অদ্ভুত তথ্য শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না। প্রায় আলোর বেগে চলে এগুলো। তাই এগুলোর মধ্যে সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায় আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রয়োগ। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। মিউওন কণাদের অর্ধায়ুর মান মাত্র ২ দশমিক ২ মাইক্রোসেকেন্ড। এই সময়কাল পেরোলেই এগুলো ক্ষয়প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রূপান্তরিত হয় একটি ইলেকট্রন ও দুটি নিউট্রিনোতে। প্রচণ্ড বেগে চলার পরেও এই ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে মিউওনদের খুব বেশি হলে ৬৬০ মিটার পথ অতিক্রম করতে পারার কথা। অথচ বায়ুমণ্ডলের জন্মস্থান থেকে মাটি পর্যন্ত পৌঁছাতে এগুলোর পাড়ি দিতে হয় প্রায় ১০ কিলোমিটারের বেশি পথ। তাই স্বাভাবিক নিয়মে পৃথিবীপৃষ্ঠে পৌঁছানোর অনেক আগেই ক্ষয়ে যাওয়ার কথা এগুলোর। কিন্তু বাস্তবে এমনটা হয় না। দিব্যি অবিকৃত থেকে এগুলো পৌঁছে যায় গন্তব্যে। এমনটা হওয়ার কারণ কী?

আসলে আলোর কাছাকাছি বেগে চলার দরুন এগুলোর ওপরে বেশ ভালো মতোই কাজ করে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব থেকে প্রাপ্ত কাল দীর্ঘায়ন নীতি। এই নীতি অনুসারে, পৃথিবীপৃষ্ঠে অবস্থান করা পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে গতিশীল মিউওনরা বেঁচে থাকে আরও বেশ খানিকটা সময়। তখন এগুলোর অর্ধায়ুর মান গিয়ে দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৩ মাইক্রোসেকেন্ডে। ফলে খুব সহজেই মাটিতে পৌঁছে যেতে পারে এগুলো। এই অদ্ভুত ঘটনাকে চাইলে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের দৈর্ঘ্য সংকোচন নীতির মাধ্যমেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে মিউওনদের অর্ধায়ু অপরিবর্তিত থাকবে, কিন্তু কমে আসবে ভূপৃষ্ঠ ও মিউওন কণাদের জন্মস্থানের মধ্যবর্তী দূরত্ব।

পিয়েরে এউগার অবজারভেটরি

যাহোক, আবারও ফিরে আসা যাক মহাজাগতিক কণাদের কাছে। এগুলো নিয়ে জোরেশোরে গবেষণা করতে হলে প্রথমেই দুটি মৌলিক তথ্য জানতে হবে। কণাদের গতিপথের দিক এবং এগুলোর শক্তির মান। নিখুঁতভাবে তথ্যগুলো জেনে নেওয়ার দুটি উপায় আছে বিজ্ঞানীদের হাতে। প্রথম উপায়ে আমাদের সোজা চলে যেতে হবে মহাশূন্যে। মহাজাগতিক কণারা বায়ুমণ্ডলের পরমাণুদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার আগেই জেনে নিতে হবে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে অবস্থিত এএমএস এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ঠিক এ কাজটাই করে চলেছেন। অন্যদিকে দ্বিতীয় উপায়ে আমাদের এত কাঠখড় পুড়িয়ে মহাশূন্যে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ভূপৃষ্ঠে বসে খুব ভালোভাবে কণাবৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করলেই জেনে নেওয়া যেতে পারে কাঙ্ক্ষিত তথ্যগুলো। অবশ্য এ পদ্ধতিতে একটি বড়সড় ঝামেলা আছে। সাধারণত বিশাল এলাকাজুড়ে নামে কণাবৃষ্টি। অনেক সময়ে এই এলাকার পরিধি কয়েক শ একরের চেয়েও বেশি হতে পারে। এত বিশাল এলাকা একসঙ্গে কাভার করার মতো বিশাল ডিটেক্টর তৈরি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানীরা কৌশলী হলেন। একটি বিশাল ডিটেক্টরের পরিবর্তে তাঁরা তৈরি করলেন অনেকগুলো ছোট ছোট ডিটেক্টর। তারপর নির্দিষ্ট ব্যবধান রেখে এগুলো বসানো হলো বিশাল এলাকাজুড়ে। প্রতিটি ডিটেক্টর কণাবৃষ্টির একেকটি ক্ষুদ্র অংশ পর্যবেক্ষণ করে। ফলে সামগ্রিকভাবে পুরো কণাবৃষ্টির আদ্যোপান্ত জানতে পারেন বিজ্ঞানীরা। এই ডিটেক্টরগুলো দুধরনের হতে পারে। প্রথম ধরনে থাকে বিশেষভাবে তৈরি টেলিস্কোপ। এগুলো কণাবৃষ্টি থেকে উৎপন্ন ফোটনদের শনাক্ত করতে সক্ষম। হেস, ম্যাজিক ও ভেরিটাস এক্সপেরিমেন্টে এমন ডিটেক্টর ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে দ্বিতীয় ধরনে ব্যবহার করা হয় চেরেনকভ ডিটেক্টর। পিয়েরে এউগার অবজারভেটরি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ (এখানে অবশ্য প্রথম ধরনের ডিটেক্টরও ব্যবহার করা হয়)। এখানে প্রায় ৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে স্থাপন করে হয়েছে ১ হাজার ৬০০টি ডিটেক্টর। একটি পানির ট্যাংক, একটি সোলার প্যানেল ও একটি অ্যানটেনার সমন্বয়ে তৈরি করা হয় এই ডিটেক্টরগুলো।

মহাজাগতিক বিকিরণ নিয়ে গবেষণা বরাবরই বিজ্ঞানীদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। এগুলো নিয়ে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে শুরু হওয়া গবেষণা এখনো পুরোদমে চলছে। মাঝে বেশ কিছু সফলতাও ধরা দিয়েছে বিজ্ঞানীদের কাছে। যেমন এগুলো নিয়ে গবেষণার মাধ্যমেই তাঁরা ১৯৩২ সালে প্রথম খোঁজ পেয়েছিলেন পজিট্রন নামের প্রতিকণার। পরে আরও খোঁজ পাওয়া যায় মিউওন, পায়ন, কেওনসহ বেশ কিছু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার।

মহাকাশযাত্রাকে নিরাপদ করাও মহাজাগতিক বিকিরণ গবেষণার অন্যতম লক্ষ্য। কারণ, নভোযানগুলোয় যদি পর্যাপ্ত শিল্ড বা প্রতিরক্ষা স্তর না থাকে, তাহলে শক্তিশালী মহাজাগতিক কণারা সরাসরি আঘাত করতে পারে নভোচারীদের। ফলে শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন তাঁরা। আর আমরা জানি, মহাশূন্যে তাঁদের বাঁচানোর জন্য নেই কোনো ধরনের বায়ুমণ্ডল। অবশ্য মহাজাগতিক বিকিরণের ক্ষতিকর প্রভাব দেখতে হলে যে মহাশূন্যে যেতে হবে, এমনটা নয়। উড়োজাহাজে ভ্রমণ করা সবার ওপরেই এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। সাধারণত উড়োজাহাজগুলো অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে যায়। সেখানে বায়ুমণ্ডল পাতলা হওয়ায় সহজেই ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে মহাজাগতিক কণারা। আঘাত হানতে পারে যাত্রীদের শরীরে। এতে অবশ্য খুব বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বিকিরণজনিত ক্ষতির পরিমাণ খুব সামান্য। মানুষের শরীর খুব সহজেই ধাক্কা সামলে নিতে পারে। তবে কেউ যদি উড়োজাহাজের নিয়মিত যাত্রী অথবা পাইলট বা কেবিন ক্রু হন, তাহলে অবশ্যই একটু বাড়তি সতর্ক থাকা উচিত।

* এই লিংকে গিয়ে চাইলে দেখে আসতে পারেন: kamiokanne.uni-goettingen.de

লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)

সূত্র: এ কার্টুন গাইড টু দ্য ফ্যাসিনেটিং রেলম অব ফিজিকস, ড. বেঞ্জামিন ভার, ড. বরিস লেমার, রিনা পিকলো