কৃষ্ণগহ্বর থেকে নিউট্রিনো

পাশের নক্ষত্র থেকে গ্যাস টেনে নিচ্ছে কৃষ্ণগহ্বরনাসা

জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহী অথচ ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের কথা শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মহাকর্ষের শক্তি সেখানে আলোর বেগের চেয়েও বেশি। ফলে সেখান থেকে পালাতে পারে না কোনো কিছুই। যে খাঁচার ভেতরে অচিন পাখি একবার ঢুকলে আর বেরোতে পারে না—সহজ কথায় তা-ই কৃষ্ণগহ্বর।

কোয়াসার শব্দটা একটু কম শোনা গেলেও এটা মোটামুটি পরিচিত শব্দ। মহাকাশে মানুষের দেখা সবচেয়ে দূরবর্তী উজ্জ্বল জিনিস এই কোয়াসার। কিন্তু জিনিসটা আসলে কী? বিশাল কোনো নক্ষত্র? সুপারনোভার মতো কিছু?

কোয়াসারের ব্যাপারটা বুঝতে হলে সেই কৃষ্ণগহ্বরের কাছেই আবার ফিরে যেতে হবে। যে প্রশ্নটা থেকে শুরু করা যায়, তা হলো কৃষ্ণগহ্বর কোথায় থাকে?

কৃষ্ণগহ্বর থাকে মূলত গ্যালাক্সির কেন্দ্রে। এমনকি আমাদের মিল্কিওয়ের কেন্দ্রেও বিপুল ভরের এক কৃষ্ণগহ্বর আছে। এদের ভর মোটামুটি মিলিয়ন থেকে বিলিয়নখানেক সৌরভরের সমান হয়। আগেই বলেছি, এর ভেতরের প্রবল মহাকর্ষীয় টান আলোকেও আটকে ফেলে, গিলে নেয় অনায়াসে। আমাদের সৌভাগ্য, এই রাক্ষুসে খিদের দৌরাত্ম্য আসলে তার চারপাশের ঘটনা দিগন্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে ঘটনা দিগন্তের বাইরেও এর কিছুটা প্রভাব তো পড়েই (আসলে অনেক বেশিই পড়ে। ভুলে গেলে চলবে না, সূর্য যেমন তার ভর দিয়ে সৌরজগতকে ধরে রেখেছে, তেমনি একটা গ্যালাক্সির সবকিছুকে ধরে রাখে কৃষ্ণগহ্বর)। এই প্রভাবের ফলেই কিছু কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের একটু বাইরে চারপাশজুড়ে জমা হয় গ্যাসের দলা, ধুলাবালু এবং মহাকাশে ভেসে বেড়ানো পাথরখণ্ড। মথ যেমন আলোর বুকে আত্মাহুতি দেয়, তেমনি এরাও কৃষ্ণগহ্বরের বুকে আত্মবলি দেওয়ার অপেক্ষায় থাকে।

যখন এই গ্যাসের দলা বা চারপাশে জমা পদার্থের কিছু কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের ভেতর পড়ে যায়, শক্তির রূপান্তর ঘটে। বস্তুটির মহাকর্ষীয় শক্তি বদলে যায় আলোতে। ফলে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে প্রচণ্ড উজ্জ্বলতা তৈরি হয়। এ ধরনের গ্যালাক্সির কেন্দ্রগুলোকে বলা হয় সক্রিয় গ্যালাক্সি কেন্দ্র (Active Galactic Nuclei)। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বিপুল পরিমাণ পদার্থের কণা উগরে দেয়। এই কণারা মহাবিশ্বের মধ্য দিয়ে ছুট দেয় আলোর বেগে। এ ধরনের গ্যালাক্সি কেন্দ্রগুলোকেই বিজ্ঞানীরা বলেন কোয়াসার।

সবই তো বোঝা গেল, এর মধ্যে ব্ল্যাজার কই?

সেন্টোরাস এ গ্যালাক্সির সক্রিয় কেন্দ্র। পদার্থ উগরে দেওয়ার সময় একই সঙ্গে বেরিয়ে আসছে এক্সরশ্মি, মাইক্রোওয়েভ এবং দৃশ্যমান আলো। শিল্পীর তুলিতে সক্রিয় গ্যালাক্সি কেন্দ্র।

আসলে কোনো সক্রিয় গ্যালাক্সি কেন্দ্র যখন সোজা পৃথিবীর দিকে ফিরে থাকে এবং পদার্থের কণা উগরে দেয়, তাকে বলা হয় ব্ল্যাজার। কোয়াসার আর ব্ল্যাজারের মধ্যে এমনিতে আর কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের পাঠ্যবইতে যদি কোয়াসার আর ব্ল্যাজারের কথা থাকত, তাহলে নিশ্চিতভাবেই একটা আপ্তবাক্য লেখা থাকত, সব ব্ল্যাজারই কোয়াসার, কিন্তু সব কোয়াসার ব্ল্যাজার নয়!

কথা হলো ব্ল্যাজার নিয়ে এত ঢাক পেটানোর আছেটা কী?

নিউট্রিনো নামে এক ধরনের কণা আছে। ছলনাময়ী এই কণারা সহজে ধরা দিতে চায় না। অথচ প্রতিমুহূর্তে শত-সহস্র নিউট্রিনো পৃথিবীর মধ্য দিয়ে, এমনকি মানুষের দেহের মধ্যে দিয়েও ছুটে যাচ্ছে অবিরাম। এদের ধরার জন্য বিজ্ঞানীরা বরফের বুক খুঁড়ে ফাঁদ পাতলেন। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে বসানো হলো টেলিস্কোপ, বানানো হলো অবজারভেটরি বা পর্যবেক্ষণাগার। নাম দেওয়া হলো আইসকিউব অবজারভেটরি। বরফের বুকের ভেতরে বসে সেই টেলিস্কোপ পৃথিবীর উল্টো দিকের আকাশে তাকিয়ে রইল। নিউট্রিনোর মতো আর কোনো কণা পৃথিবীকে এমন করে পেরিয়ে যেতে পারে না। মিথস্ক্রিয়া করে সাধারণ বস্তুর সঙ্গে। কাজেই কোনো কণা যদি পৃথিবীর উল্টো দিকের আকাশ থেকে ছুটে এসে আইসকিউব অবজারভেটরির টেলিস্কোপে ধরা পড়ে, তাহলে বোঝা যাবে, এই হলো সেই নিউট্রিনো।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে আইসকিউব অবজারভেটরিতে ব্ল্যাজার থেকে ছুটে আসা নিউট্রিনো শনাক্ত করা হয়েছে।

অর্থাৎ ব্ল্যাজাররা যখন প্রবল শক্তিতে সোজা আমাদের দিকে তাক করে কামান দাগে, সেই শক্তি থেকে জন্ম নেয় বিপুল শক্তিধর নিউট্রিনো। আলোর বেগে ছুট দেয় নিউট্রিনোর দল। যেহেতু এরা সহসা কারও সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে না, ফলে আমাদের দিকে ছুটে আসার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আর এদের যখন ধরা যায়, জানা যায় দারুণ সব তথ্য। কারণ এই নিউট্রিনোরা কারও সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া না করলেও যে পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে, সে পথের সব তথ্য সে নিয়ে আসে সঙ্গে করে। আর যে নিউট্রিনোরা ব্ল্যাজার থেকে আসছে, তারা নিয়ে আসে সেই সক্রিয় গ্যালাক্সি কেন্দ্রের তথ্য। বিজ্ঞানীরা এই তথ্য বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট কৃষ্ণগহ্বরের ব্যাপারে চমৎকার সব তথ্য জানতে পারেন।

সম্প্রতি নভোটেলিস্কোপ ইভেন্ট হরাইজন কৃষ্ণগহ্বরের ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে। হয়তো বছর শেষ হওয়ার আগে পাওয়া যেতে পারে প্রথম কৃষ্ণগহ্বরের ছবি। তবে এর আগে আমাদের কৃষ্ণগহ্বর জ্ঞানের খুব গুরুত্বপূর্ণ এক উৎস ছিল ব্ল্যাজার থেকে ছুটে আসা এই নিউট্রিনোরা।

মহাবিশ্বের সবচেয়ে অন্ধকার জিনিসটির চারপাশ ঘিরে তৈরি হয় মহাবিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল জিনিসগুলোর একটি, বাতির নিচে অন্ধকারের এর চেয়ে চমৎকার উদাহরণ আর কয়টি আছে?

সূত্র: নাসা ও উইকিপিডিয়া

*লেখাটি ২০১৯ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত