উল্কার জানা-অজানা ৬

কখনও কি রাতের আকাশে উজ্জ্বল আলোর রেখা দেখেছেন? ওগুলো আসলে উল্কা। অনেকে খসে পড়া তারা বা শুটিং স্টারও বলেন। মহাকাশ থেকে আসা এসব পাথরখণ্ড পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার সময় জ্বলে ওঠে। প্রাচীনকালের মানুষদের মনে এই উল্কা নিয়ে নানা ধারণা প্রচলিত ছিল। আজ সেসব ধারণা বদলেছে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের কল্যাণে উল্কা নিয়ে জানা গেছে অনেক অজানা তথ্য। চলুন, আজ সেরকম ৬টি অবাক করা তথ্য জেনে নেওয়া যাক।

১ / ৬
মহাকাশ থেকে ছুটে আসা পাথর বা ধাতুখণ্ড

১. খসে পড়া তারা

উল্কা হলো মহাকাশ থেকে ছুটে আসা পাথর বা ধাতুখণ্ড। এগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় ঘর্ষণের ফলে উত্তপ্ত হয়ে জ্বলে ওঠে। ফলে আকাশে তৈরি হয় উজ্জ্বল আলোর রেখা। দেখে মনে হয় যেন খসে পড়া তারা। উল্কা শব্দটা এসেছে মিটিওরয়েড থেকে। এর মানে গ্রহাণুর চেয়ে ছোট কোনো কঠিন বস্তু। উল্কা সাধারণত ধূমকেতু বা গ্রহাণুর ছোট্ট টুকরো থেকে তৈরি হয়। উল্কা যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন এটি অতি দ্রুত গতিতে চলে। এই দ্রুত গতির কারণে বায়ু ও উল্কার মধ্যে ঘর্ষণ হয়। এই ঘর্ষণের ফলে উল্কা অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং জ্বলে ওঠে। এই জ্বলন্ত অবস্থায় এটি আকাশে একটি উজ্জ্বল আলোর রেখা তৈরি করে। যাকে আমরা সাধারণত ‘শুটিং স্টার’ বলি।

২ / ৬
বেশিরভাগ উল্কা আকারে খুবই ছোট

২. বালির দানার আকারের উল্কা

বেশিরভাগ উল্কা আকারে খুবই ছোট। উল্কার আকার সাধারণত ৩০ মাইক্রোমিটার থেকে ১ মিটার ব্যাসের হয়। মিটিওরয়েড বা উল্কা উৎপন্ন হয় কোনো গ্রহাণু থেকে অথবা ধূমকেতুর কোনো অংশ কক্ষপথ বিচ্যুত হয়ে, যা বালির দানার চেয়ে বড় নয়। এই ক্ষুদ্র উল্কাগুলো আমরা প্রায়ই রাতের আকাশে উজ্জ্বল আলোর ফোটা হিসেবে দেখতে পায়।

৩ / ৬
প্রতি বছর এপ্রিল মাসে কিছু দিন একটা উল্কাবৃষ্টি দেখা যায় রাতের আকাশে
ছবি: উইকিপিডিয়া

৩. প্রতি বছর উল্কাবৃষ্টি হয়

উল্কা হলো মহাকাশ থেকে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসা ছোট ছোট গ্রহাণু, ধূমকেতু ইত্যাদির টুকরা। যখন এই টুকরাগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণে এটি উত্তপ্ত হয়ে জ্বলে উঠে। এই জ্বলন্ত অবস্থায় আমরা একে উল্কাপাত হিসেবে দেখি। আর যখন একসঙ্গে অনেক উল্কাপাত দেখা যায়, তখন এ ঘটনাকে বলে উল্কাবৃষ্টি। উল্কাবৃষ্টির নামকরণ সাধারণত সেই নক্ষত্রমণ্ডলের নামানুসারে করা হয়, যেখান থেকে উল্কাগুলো জ্বলতে দেখা যায়।

প্রতি বছর এপ্রিল মাসে কিছু দিন একটা উল্কাবৃষ্টি দেখা যায় রাতের আকাশে। এর নাম লাইরিড উল্কাবৃষ্টি। লাইরিড উল্কাবৃষ্টি বাংলাদেশ থেকেও দেখা যায়। প্রতি বছর আগস্ট মাসে দেখা যায় পারসেইড উল্কাবৃষ্টি। উল্কাবৃষ্টির নামকরণ সাধারণত সেই নক্ষত্রমণ্ডলের নামানুসারে করা হয়, যেখান থেকে উল্কাগুলো জ্বলতে দেখা যায়। পারসেইড উল্কাবৃষ্টি পার্সিয়াস নক্ষত্রমণ্ডল থেকে আসে বলে আকাশের উত্তর-পূর্ব দিকে এর দেখা মেলে। কোনো খোলা জায়গা থেকে খালি চোখেই উল্কাবৃষ্টির দেখা পাওয়া যেতে পারে। তবে ধৈর্য্য ধরে তাকিয়ে থাকতে হবে আকাশে।

৪ / ৬
হোবা উল্কা

৪. পৃথিবীতে পাওয়া সবচেয়ে বড় উল্কাপিণ্ড

যখন উল্কা বায়ুমণ্ডলে ঘর্ষণে সম্পূর্ণ ধ্বংস না হয়ে পৃথিবীতে পড়ে তখন একে উল্কাপিণ্ড বলে। পৃথিবীতে পাওয়া সবচেয়ে বড় উল্কাপিণ্ড হলো ১৯২০ সালে নামিবিয়াতে আবিষ্কৃত হোবা উল্কা। হোবা উল্কাটির ওজন প্রায় ৫৪ হাজার কিলোগ্রাম। হোবা উল্কাপিণ্ডটি এত বড় ও ভারী যে এটি যেখান থেকে পাওয়া গেছে সেখান থেকে সরানো হয়নি। বেশিরভাগ উল্কাপিণ্ড দেখতে অনেকটা পৃথিবীতে পাওয়া পাথরের মতো। ধারণা করা হয়, হোবা উল্কাপিণ্ডটি ৮০ হাজার বছরেরও আগে পৃথিবীতে এসে পড়ে।

৫ / ৬
প্রায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার প্রশস্ত গ্রহাণুর আঘাতের পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যায়

৫. ডাইনোসর যুগের বিলুপ্তির পেছনে উল্কাপাত

কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীতে বিচরণ করত ডাইনোসর। বিজ্ঞানীদের ধারণা ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে প্রায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার প্রশস্ত গ্রহাণুর আঘাতের পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু ২০২০ সালে ডাইনোসরের জীবাশ্মের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গবেষণায় দেখা গেছে, ডাইনোসরদের বিলুপ্তির প্রক্রিয়া গ্রহাণুর আঘাতের অন্তত ৫ কোটি বছর আগেই শুরু হয়েছিল। গবেষণাটি করে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব রিডিং ও ব্রিস্টলের বিজ্ঞানীরা। উল্কাপাতের ফলে পৃথিবীর জলবায়ু ও পরিবেশ ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন ডাইনোসরদের জন্য বেঁচে থাকা কঠিন করে তুলেছিল তখন। অবশেষে গ্রহাণুর আঘাতে ডাইনোসরা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

৬ / ৬
অ্যান হজেস

৬. উল্কাঘাতে বেঁচে যাওয়া একমাত্র ব্যক্তি

১৯৫৪ সালের ৩০ নভেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের আলবামার সিলাকগা শহরে অ্যান হজেস নামে ৩৪ বছর বয়সী এক নারী একটি উল্কাঘাতে আহত হয়। তখন তিনি তাঁর বিছানাতে ঘুমাচ্ছিলেন। উল্কাপিন্ডের ওজন ছিল প্রায় সাড়ে ৮ পাউন্ড বা প্রায় ৪ কেজি। উল্কাপিণ্ডটি এখন রাখা আছে যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান’স ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে। ইতিহাসের একমাত্র উল্কাঘাতে বিক্ষত মানুষ এই অ্যান হজেস। আর কেউ এরকম আঘাত পেয়েছে বলে জানা যায় না। তবে উল্কাপাত খুব দুর্লভ ঘটনা নয়। মানুষ না হলেও ১৯৭২ সালে ভেনিজুয়েলায় একটি গরু মারা যায় উল্কাঘাতে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরও বড় পরিসরের একটি ঘটনা ঘটে রাশিয়ার চেলইয়াবিনস্কে। একটি উল্কা তৈরি করে সনিক বুম বা শব্দ-নিনাদ। অর্থাৎ প্রচন্ড বেগে শব্দ তরঙ্গ ছুটে যায় চারদিকে। এর আঘাতে ভেঙে পড়ে জানালার কাচসহ আরও নানা কিছু। এ ঘটনায় সেবার আহত হয় প্রায় ১ হাজার মানুষ।

আরও পড়ুন

সূত্র: নাসা, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক