আলোর গতি বির্তক ও বিজ্ঞানী রোমারের কীর্তি

আলোর বেগ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক। সসীম না অসীম? গ্যালিলিও গ্যালিলি সে জন্য একটা পরীক্ষার কথা ভাবলেন। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান মিলল ওলে রোমারের হাত ধরে। বৃহস্পতির উপগ্রহ, আলোর বেগ ও বিজ্ঞানের ইতিহাসের অন্যতম বড় বিতর্কের সমাধান...

ঝড় ও বজ্রপাতের সময় আকাশ চেরা বিদ্যুৎ ঝলক কে না দেখেছে! এককালে একে দেবতাদের রোষ বলে বিশ্বাস করত মানুষ। কিন্তু বিজ্ঞান এসব কুসংস্কার দূর করেছে অনেক আগেই। আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে, বিদ্যুৎ ঝলক আসলে একধরনের বৈদ্যুতিক প্রবাহ। ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জের ভয়াবহ এক খেলা। এই প্রবাহ মেঘ থেকে ভূপৃষ্ঠে কিংবা এক মেঘ থেকে আরেক মেঘে ছুটে যায় চোখের পলকে। তাতেই দেখা যায় আচমকা আলোর ঝলক। তার কিছুক্ষণ পরই শোনা যায় কান ফাটানো গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ।

বজ্রপাত একদম কাছে হলে বিদ্যুৎ ঝলকের আলো দেখা এবং ওই শব্দ শোনা যায় প্রায় একই সময়ে। সে শব্দ কান ফাটানো। মেঘ গর্জনের মতো উচ্চনাদে। একে আমাদের দেশে বলা হয় মেঘ ডাকা। অবশ্য বজ্রপাতের আলো দেখা ও শব্দ শোনা—এই দুইয়ের মধ্যে সময়ের কিছুটা হেরফের থাকে। কিন্তু বজ্রপাত অনেক দূরে হলে, আলোর ঝলক খুব বেশি উজ্জ্বল দেখায় না। শব্দও শোনা যায় কম। তার ওপর শব্দটা শোনা যায় বেশ কিছুক্ষণ পরে। প্রশ্ন আসতে পারে, দূরের বজ্রপাতের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ঝলক দেখার পর, বাজ পড়ার শব্দ শুনতে কিছুটা সময় লাগে কেন?

এর কারণ, শব্দ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে সময় নেয়। শব্দের বেগ মেপে দেখা গেছে, বায়ু মাধ্যমে এর বেগ ঘন্টায় ১ হাজার ১৯০ কিলোমিটার (বা প্রায় ৭৪০ মাইল)। মানে, এক সেকেন্ডে শব্দ পেরোতে পারে প্রায় ৩৩১ মিটার (বা ১ হাজার ৮৬ ফুট) দূরত্ব। এভাবে মাত্র পাঁচ সেকেন্ডে শব্দ পাড়ি দিতে পারে প্রায় এক মাইল বা ১.৬৫ কিলোমিটার। তাহলে এক মাইল দূরে কোথাও বজ্রপাত আঘাত হানলে, সেই বজ্রধ্বনি শুনতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পাঁচ সেকেন্ড। কারণ এই পাঁচ সেকেন্ড পরেই কেবল শব্দটা কানে এসে পৌঁছাতে পারবে। বজ্রপাতটা যদি দুই মাইল দূরে আঘাত হানে, তাহলে তা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ১০ সেকেন্ড। আলোর ক্ষেত্রেও কি তাই ঘটে? আলোও কি আমাদের কাছে পৌঁছাতে কিছুটা সময় নেয়?

এ বইয়ে আল হাজেন আলো সম্পর্কে গ্রিকদের অনেক ভুল ধারণা যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে খণ্ডন করেন। পাশাপাশি যুক্তি দেখান, আলোর বেগ অসীম নয়, সসীম। ঘনবস্তুতে আলোর বেগ কম বলেও যুক্তি দেন তিনি

হয়তো তাই ঘটে। কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলেও তা চলাচল করে অবশ্যই শব্দের চেয়ে দ্রুত গতিতে। কারণ আমরা নিশ্চিত জানি, বজ্রপাতের শব্দের চেয়ে আলোটা বেশ কিছুক্ষণ আগে দেখা যায়। সেটা না হয় মানলাম, কিন্তু আলোর বেগ আসলে কত? সেই বেগ কি মাপার কোনো উপায় আছে?

এ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বির্তক দীর্ঘদিনের। সেই প্রাচীনকাল থেকে। সেকালে সাধারণভাবে মনে করা হতো, আলোর বেগ মাপা সম্ভব নয়। সে যুগের কয়েকজন পণ্ডিত বিশ্বাস করতেন, আলো এত দ্রুত চলাচল করে যে দূরত্ব যতই হোক না কেন, তা যেকোনো দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে চোখের পলকে। এভাবে গ্রিক পণ্ডিতদের ধারণা হয়েছিল, আলোর বেগ সম্ভবত ‘অসীম’। অর্থাৎ আমরা যে গতি বা বেগ কল্পনা করতে পারি, আলোর বেগ তার চেয়ে অনেক বেশি। এমন ভাবনা ছিল গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টটলেরও।

তবে পরিস্থিতি বদলে যায় মধ্যযুগে এসে। এ সময় আলো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন আরবের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ইবনে সিনা এবং ইবনে আল হাইসাম (পুরো নাম, আবু আলি আল হাসান ইবনে আল হাইসাম। ‘আল হাসান’ ইংরেজিতে এসে ‘আল হাজেন’ হয়ে গেছে। অনেকের কাছে তিনি এই আল হাজেন নামে পরিচিত)। ১০২১ সালে আলো নিয়ে প্রকাশিত হয় ইবনে আল হাইসামের লেখা কিতাব আল মানজির নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। সেটি ইউরোপের বিজ্ঞানীদের কাছে পরিচিত বুক অব অপটিকস নামে। এ বইয়ে আল হাজেন আলো সম্পর্কে গ্রিকদের অনেক ভুল ধারণা যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে খণ্ডন করেন। পাশাপাশি যুক্তি দেখান, আলোর বেগ অসীম নয়, সসীম। ঘনবস্তুতে আলোর বেগ কম বলেও যুক্তি দেন তিনি। ১১ শতকে একই মত প্রকাশ করেন আরবের আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী আবু রায়হান আল বিরুনিও। তবে এদের কেউই আলোর সত্যিকারের বেগ মেপে দেখার চেষ্টা করেননি।

ইতিহাসে প্রথমবার আলোর বেগ মাপার চেষ্টা করেন ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি। কথিত আছে, ১৬৩০-এর দশকে সেরকম একটা চেষ্টা করেন তিনি। অবশ্য অনেকের ধারণা, পিসার হেলানো মিনার থেকে দুটি ভিন্ন ভরের বস্তু ফেলা নিয়ে গ্যালিলিওকে নিয়ে যেরকম কাল্পনিক গল্প চালু আছে, এই গল্পটাও অনেকটা সেরকম। অর্থাৎ স্রেফ গালগল্প। তবে বিষয়টা বোঝার সুবিধার্থে সেই গল্পটাই এখানে সংক্ষেপে বলছি।

কথিত আছে, সেবার এক সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে একটা পরীক্ষা চালান গ্যালিলিও। পরীক্ষায় দুটি বিশেষ ধরনের লণ্ঠন ব্যবহার করা হয়েছিল। লণ্ঠনের ভেতর মোমবাতি ঢেকে রাখা যেত। প্রয়োজনে তা খুলে ফেলা যেত, যাতে একটা নির্দিষ্ট সময় আলোর সংকেত পাঠানো যায়।

গ্যালিলিও গ্যালিলি
কিন্তু ফলাফল পাওয়া গেল বিস্ময়কর। দেখা গেল, আলোর কোনো বাড়তি সময় লাগছে না। প্রথমবার কাছাকাছি দুটো পাহাড়চূড়ায় চালানো পরীক্ষায় আলোর জন্য যে সময় পাওয়া গিয়েছিল, পাহাড়চূড়া দুটো দূরে হলেও মধ্যবর্তী দূরত্ব পাড়ি দিতে আলোর বাড়তি কোনো সময় লাগছে না। দুক্ষেত্রেই সময় লাগছে একই পরিমাণ

পরীক্ষাটার জন্য এক অন্ধকার রাত বেছে নেন গ্যালিলিও। দূর থেকে ছোট্ট আলোর ঝলক যাতে সহজে দেখা যায়, সে জন্যই রাতে চালানো হয় পরীক্ষাটা। কাছাকাছি দুটি পাহাড়ের চূড়ার একটাতে ওঠেন গ্যালিলিও। আরেকটায় তাঁর সহকারী। চূড়ায় উঠে প্রথমেই নিজের লন্ঠনের ঢাকনা খুলে দেন গ্যালিলিও। মানে আলোর সংকেত পাঠান তাঁর সহাকারীকে। অন্য পাহাড়ের চূড়া থেকে তাঁর সহকারী গ্যালিলিওর লন্ঠনের আলোর ঝলক দেখতে পান। সঙ্গে সঙ্গে গ্যালিলিওর সহকারী নিজের লণ্ঠনের ঢাকনা খুলে দেন। যাতে আলোর ঝলক দেখতে পান গ্যালিলিও।

এবার নিজে আলোর সংকেত পাঠানোর মুহূর্ত এবং সহকারীর আলোর ঝলক দেখার মুহূর্তের মধ্যবর্তী সময় মেপে ফেলেন গ্যালিলিও। সেদিন পরীক্ষাটি করা হলো বেশ কয়েকবার। পরে দুই ঝলক দেখার মধ্যবর্তী সময়গুলো গড় করা হলো। কিন্তু ফলাফল যা পাওয়া গেল, তা মোটেও সন্তোষজনক নয়।

এখানে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, এক পাহাড়ের চূড়া থেকে আরেক চূড়ায় আলো যেতে এবং ফিরে আসতে যে সময় লেগেছিল, অন্তত তার কিছু অংশ লেগেছিল দুজনের প্রতিক্রিয়ার কারণে। অর্থাৎ গ্যালিলিওর পাঠানো সংকেত দেখে তাঁর সহকারীর লন্ঠনের ঢাকনা খুলতে এবং সেই সংকেত দেখে সময় গণনা করতে কিছুটা সময় লেগেছিল। সেটুকু আসলে বাড়তি সময়।

নিজেদের প্রতিক্রিয়ার এই সময়টুকু বাদ দিতে এরপর আবারও পরীক্ষাটি করেন গ্যালিলিও। এবার এমন দুটি পাহাড়ের চূড়া বেছে নেন, যেগুলো আগের দুটোর চেয়ে বেশ দূরে অবস্থিত। গ্যালিলিও ধারণা করলেন, তাঁর সহকারীর প্রতিক্রিয়া আগের মতোই হতে পারে। কিন্তু এবার আলোকে আগের চেয়ে বেশি দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে। তাই আশা করলেন, বাড়তি যে সময়টুকু লাগবে, তার মধ্যেই আলো ওই বাড়তি দূরত্বটুকু অতিক্রম করবে।

কিন্তু ফলাফল পাওয়া গেল বিস্ময়কর। দেখা গেল, আলোর কোনো বাড়তি সময় লাগছে না। প্রথমবার কাছাকাছি দুটো পাহাড়চূড়ায় চালানো পরীক্ষায় আলোর জন্য যে সময় পাওয়া গিয়েছিল, পাহাড়চূড়া দুটো দূরে হলেও মধ্যবর্তী দূরত্ব পাড়ি দিতে আলোর বাড়তি কোনো সময় লাগছে না। দুক্ষেত্রেই সময় লাগছে একই পরিমাণ। পরীক্ষায় যে অতিরিক্ত সময় লাগছে, সেটা আসলে দুজনের প্রতিক্রিয়ার সময়, আর কিছু নয়। আসলে আলো এত দ্রুত চলাচল করে যে লম্বা দূরত্বের জন্য যেটুকু বাড়তি সময় লাগে, তা এত ছোট যে গ্যালিলিওর পক্ষে সে যুগে তা মাপা অসম্ভব ছিল। কারণ ভগ্নাংশ সময় মাপার মতো প্রযুক্তি গ্যালিলিওর যুগে ছিল না। এমনকি সম্ভব ছিল না সঠিকভাবে সময় মাপাও। কারণ তখনও ভালো ঘড়ি উদ্ভাবিত হয়নি। কাজেই পরীক্ষা শেষে গ্যালিলিও শুধু এটুকুই বলতে পারলেন যে আলো খুব খুবই দ্রুত চলাচল করে।

আরও পড়ুন

বিজ্ঞানের ইতিহাসবিদদের ধারণা, গ্যালিলিও সশরীরে এমন কোনো পরীক্ষা কখনও করেননি। তবে এরকম একটা পরীক্ষার কথা তিনি সত্যি সত্যিই ভেবেছিলেন। ১৬৩৮ সালে আলোর বেগ মেপে দেখার একটা উপায় প্রস্তাব করেন গ্যালিলিও। পরীক্ষাটা এরকম: বাতি নিয়ে দুই পর্যবেক্ষক পরস্পর থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়াবে। প্রথম পর্যবেক্ষক বাতির আলো ব্যবহার করে দ্বিতীয় জনের কাছে একটা সংকেত পাঠাবে। সংকেত পেয়ে দ্বিতীয় পর্যবেক্ষক আলোর একটা ফিরতি সংকেত পাঠাবে। প্রথম পর্যবেক্ষক তার পাঠানো সংকেত এবং ফিরতি সংকেত পাওয়ার মধ্যবর্তী সময় মেপে আলোর গতি নির্ণয় করতে পারবে। এতক্ষণ যে পরীক্ষার কথা বললাম, সেটাই আরকি।

কিন্তু গ্যালিলিও নিজে কখনও এ পরীক্ষা করে দেখতে পারেননি। কারণ তিনি তখন গৃহবন্ধী। প্রায় অন্ধ। চোখে ঝাপসা দেখেন। আসলে গ্যালিলিওর মৃত্যুর প্রায় ২৫ বছর পর, ১৬৬৭ সালে পরীক্ষাটি করে দেখেন ইতালির ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত সায়েন্টিফিক সোসাইটি অ্যাকাডেমিয়া দেল কিমেন্টো। এ পরীক্ষায় রাতের অন্ধকারে প্রায় এক মাইল দূরে দুজন পর্যবেক্ষক রাখা হয়, যাঁদের হাতে ছিল দুটি বাতি। তবে এতে আলোর চলাচলে কোনো বিলম্ব খুঁজে পাননি পর্যবেক্ষকেরা। তবে এ পরীক্ষা থেকে সিদ্ধান্ত টানা হয়, আলোর গতি ঘন্টায় ১০ হাজার কিলোমিটার থেকে অসীমের মাঝখানের কোনো একটা সংখ্যা।

২.

আলোর গতির পরিমাপ নিয়ে গ্যালিলিওর কথিত এই পরীক্ষার প্রায় তিন দশক আগের ঘটনা। ১৬০৯ সালের দিকে টেলিস্কোপ ব্যবহার করে প্রথম আকাশ পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। সেটি করতে গিয়ে বৃহস্পতি গ্রহের চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার করেন গ্যালিলিও। দেখেন, উপগ্রহগুলো বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সেগুলো এখনও গ্যালিলিওর স্যাটেলাইট নামে পরিচিত। তিনি দেখতে পান, প্রতিটি উপগ্রহ বৃহস্পতির সামনের দিকে সরে যাচ্ছে, তারপর একদিকে আরও সরে চলে যাচ্ছে বৃহস্পতির বাইরের দিকে। তারপর সেগুলো কাছাকাছি ফিরে এসে বৃহস্পতির পেছনে চলে যাচ্ছে, পরে বিপরীত দিকে বাইরে চলে যাচ্ছে। এরপর আবারও কাছাকাছি ফিরে আসছে বৃহস্পতির সামনে। এভাবেই বারবার একই চক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

প্রতিবার কোনো উপগ্রহ যখনই বৃহস্পতির পেছনে চলে যাচ্ছে, তখন তাতে গ্রহণ ঘটছে। মানে উপগ্রহগুলোর ওপর বৃহস্পতির ছায়া পড়ছে। একে বলা যায়, বৃহস্পতির চন্দ্রগ্রহণ। উপগ্রহগুলোর প্রতিটিই একটা নির্দিষ্ট বা স্থির গতিতে বৃহস্পতির চারপাশে ঘুরছে। তাই তাদের প্রতিটির গ্রহণও ঘটে একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে। বৃহস্পতির সবচেয়ে কাছের উপগ্রহ আইও সবচেয়ে কম সময়ে একবার ঘূর্ণন পূর্ণ করে। এর গ্রহণ ঘটে প্রতি  দিনে। এর পরেরটির নাম ইউরোপা। এর গ্রহণ ঘটে প্রতি  দিনে। পরেরটি—গ্যানিমেডের গ্রহণ ঘটে প্রতি  দিনে। আর সবচেয়ে দূরে রয়েছে ক্যালিস্টো, যার গ্রহণ ঘটে প্রতি  দিনে।

বৃহস্পতি এবং গ্যালিলিও আবিষ্কৃত এর চারটি উপগ্রহ

এসব আবিষ্কার ছাড়াও পেন্ডুলাম নিয়েও গবেষণা করেছিলেন গ্যালিলিও। এভাবে আবিষ্কার করেন পেন্ডুলামের বেশ কিছু ধর্ম। এ গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ১৬৫৬ সালে পেন্ডুলাম ঘড়ি উদ্ভাবন করেন ডাচ জ্যোতির্বিদ ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস। একেই বলা যায় সে যুগের সঠিক সময় দেওয়া প্রথম ঘড়ি। এর মাধ্যমে সঠিকভাবে মিনিট মাপা সম্ভব ছিল। কাজেই বৃহস্পতির উপগ্রহগুলোর গ্রহণ লাগার মতো ঘটনাগুলোর সঠিক সময় মাপার জন্য এই ঘড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে।

ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স

সেই কাজটি করার চেষ্টা করলেন ডাচ জ্যোতির্বিদ ওলে রোমার। অবশ্য এ বিষয়ে গবেষণায় তাঁকে উৎসাহিত করেন ইতালীয় জ্যোতির্বিদ জিওভানি ক্যাসিনি। বৃহস্পতি ও তার উপগ্রহ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে একটা ধাঁধার মুখোমুখি হয়েছিলেন সে যুগের জ্যোতির্বিদেরা। বিশেষ করে, আইও উপগ্রহটি নিয়ে। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ। পৃথিবীর চারপাশে ঘূর্ণনে চাঁদ একটা নিয়ম মেনে চলে। ২৭.৩ দিনে এক পাক ঘুরে আসে চাঁদ। বৃহস্পতির চাঁদগুলোর ঘূর্ণনেও একটা নিয়ম পাওয়া যাবে বলে আশা করেছিলেন জ্যোতির্বিদেরা। কিন্তু সেগুলো নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হলেন তাঁরা। দেখা গেল, বৃহস্পতির চারপাশে আইওর ঘূর্ণনে একটা নিয়মবিরুদ্ধ ব্যাপার আছে। মাঝেমধ্যে বৃহস্পতির পেছন থেকে নির্ধারিত সময়ের আগেই দৃষ্টিসীমায় এসে হাজির হয় আইও। আবার অন্য কিছু সময় হাজির হয় কয়েক মিনিট পর। কোনো গ্রহের উপগ্রহের এরকম আচরণ করা উচিত নয় বলে মনে করতেন জ্যোতির্বিদেরা। আইওর এহেন উদাসীন আচরণে ধাঁধায় পড়ে গেলেন তাঁরা।

এই রহস্য ভেদ করতে ক্যাসিনির তালিকাবদ্ধ করা আইওর অবস্থান এবং দৃষ্টিসীমায় তার হাজির হওয়ার সময় নিয়ে বিশদভাবে গবেষণা করেন রোমার। তিনি দেখতে পান, বছরের অর্ধেক সময় আইওসহ বৃহস্পতির উপগ্রহগুলোর গ্রহণ লাগে ক্রমেই নির্ধারিত সময়ের পরে পরে। আর বছরের বাকি অর্ধেক সময় গ্রহণ লাগতে থাকে ক্রমেই নির্ধারিত সময়ের আগে আগে। সারা বছর ধরে গ্রহণগুলো গড়ে সঠিক সময়ে লাগে, কিন্তু গ্রহণ লাগার এমন কিছু সময় ছিল, যেগুলো গড় সময় থেকে প্রায় ৮ মিনিটের মতো এগিয়ে ছিল এবং কিছু সময় ছিল গড় সময় থেকে প্রায় ৮ মিনিটি পিছিয়ে। এর কারণ কী? এরকম ঘটে কেন? ভেবে কুল পান না রোমার।

পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। এভাবে এক বছরে একটা বৃত্ত তৈরি করে (তখনও সূর্যের চারপাশের গ্রহদের উপবৃত্তাকার গতিপথ সম্পর্কে জ্যোতির্বিদেরা জানেন না)। পৃথিবীর তুলনায় বৃহস্পতি সূর্য থেকে আরও দূরে অবস্থিত। তাই বছরে বৃহস্পতি সূর্যের চারপাশে ঘুরতে গিয়ে যে বৃত্ত তৈরি করে, তা আরও বড়। সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে বৃহস্পতির সময় লাগে পৃথিবীর হিসেবে ১২ বছর। কাজেই বৃহস্পতি সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরতে যে সময় নেয়, সেই সময়ে সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘুরে আসে ১২ বার। তার মানে, বছরের অর্ধেক সময় বৃহস্পতি ও পৃথিবী সূর্যের একই পাশে থাকে। আর বাকি অর্ধেক সময় বৃহস্পতি সূর্যের যে পাশে থাকে, পৃথিবী থাকে তার উল্টো পাশে।

সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ও বৃহস্পতি

অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রোমার সিদ্ধান্তে এলেন, এই রহস্য ভেদ করা সম্ভব, যদি ধরে নেওয়া হয় আলোর গতি সসীম। অর্থাৎ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় আলোর পৌঁছাতে একটা নির্দিষ্ট সময় লাগে। ঠিক শব্দের মতো। রোমার যুক্তি দেখান, আইও বা বৃহস্পতির অন্য উপগ্রহের গ্রহণের আপাত অনিয়মিত হওয়ার কারণ আসলে একটি দৃষ্টিবিভ্রম। কারণ আইও থেকে ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে থাকা পৃথিবীতে পৌঁছাতে আলোর ভিন্ন ভিন্ন সময় লাগে। আলো সসীম বলেই সেটা ঘটে।

বিষয়টা বোঝার জন্য একটা উপমা ব্যবহার করা যাক। কল্পনা করুন, আপনি একটা কামানের কাছে আছেন। কামানটা প্রতি ঘন্টায় একটা করে গোলা ছোড়ে। কামান থেকে প্রথম গোলার শব্দ শোনার পর, একটা স্টপওয়াচ চালু করুন। এরপর ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে সোজাসুজি একটা গাড়ি চালানো শুরু করুন। কামান থেকে দ্বিতীয় গোলাটা ছোড়া হবে এক ঘন্টা পরে। ততক্ষণে কামান থেকে আপনি চলে গেছেন ১০০ কিলোমিটার দূরে। গাড়িটা ওখানে থামান। দ্বিতীয় গোলাটা ছোড়ার পর একটা ক্ষীণ শব্দ শুনতে পাবেন। কারণ তখন আপনি কামান থেকে অনেক অনেক দূরে। তবে আপনার হাতের স্টপওয়াচে তাকালে হয়তো অবাক হবেন। কারণ তখন দেখতে পাবেন, প্রথম গোলা এবং দ্বিতীয় গোলা ছোড়ার মধ্যবর্তী সময় এক ঘন্টা বা ৬০ মিনিট নয়। বরং ৬৬ মিনিট। এখানে ধরে নিয়েছি, শব্দের গতিবেগ ঘন্টায় ১০০০ কিলোমিটার। সসীম গতির কারণেই ১০০ কিলোমিটার দূর থেকে দ্বিতীয় গোলা ছোড়ার ৬ মিনিট পর তার ক্ষীণ শব্দটা শুনতে পাবেন। কারণ আপনার কাছে গোলার শব্দটা পৌঁছাতে ওই বাড়তি সময়টা লাগবে।  

বৃহস্পতির উপগ্রহ থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছাতেও প্রায় একই ব্যাপার ঘটে। পৃথিবী ও বৃহস্পতি যখন সূর্যের একই পাশে থাকে, তখন স্বভাবতই গ্রহ দুটি যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকে। তখন বৃহস্পতি এবং তার উপগ্রহগুলো থেকে আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে একটা নির্দিস্ট দূরত্ব পাড়ি দেয়। অর্ধ বছর বা ছয় মাস পর, পৃথিবী চলে যায় বৃহস্পতির উল্টো পাশে। তখন সূর্যের এক পাশে বৃহস্পতি এবং আরেক পাশে পৃথিবী। কাজেই এখন বৃহস্পতি ও তার উপগ্রহগুলো থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আগের ছয় মাসের চেয়ে বেশি। এখন বৃহস্পতি ও তার উপগ্রহগুলোর আলোকে পৃথিবীতে পৌঁছাতে আগের দূরত্ব তো পাড়ি দিতে হবেই, সেই সঙ্গে বাড়তি কিছু দূরত্বও পাড়ি দিতে হবে। আর এই বাড়তি দূরত্বটা হবে সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর কক্ষপথের প্রস্থ। মানে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব।

রোমারের পরীক্ষার ডায়াগ্রাম

পৃথিবীর পুরো প্রস্থ পাড়ি দিতে আলোর একটি নির্দিষ্ট সময় লাগবে। পৃথিবীর জ্যোতির্বিদদের তাই বৃহস্পতির উপগ্রহগুলোর গ্রহণ দেখতে অপেক্ষা করতে হয় বাড়তি কিছু সময়। এ কারণেই সেখানে গ্রহণ লাগে গড় সময়ের চেয়ে কয়েক মিনিট দেরিতে। আবার পৃথিবী ও বৃহস্পতি যখন সূর্যের একই পাশে থাকে, তখন আলো তুলনামূলক কম পথ পাড়ি দিয়ে পৃথিবীতে পৌঁছে। তাই এ সময় গ্রহণগুলো ঘটে গড় সময়ের কয়েক মিনিট আগে। সেটাই আসলে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন রোমার।

অবশ্য রোমারের যুগে পৃথিবীর কক্ষপথের প্রশস্ততা বা ব্যাস (সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব) সঠিকভাবে মাপা সম্ভব হয়নি। সে যুগে সবচেয়ে সেরা মাপটিই ব্যবহার করেন রোমার। এভাবে আই‌ও এবং পৃথিবী ও বৃহস্পতির আপেক্ষিক দূরত্ব নিয়ে তিন বছর পর্যবেক্ষণ করেন। সব শেষে তিনি হিসেব কষে দেখেন, এই দূরত্ব পাড়ি দিতে আলোর সময় লাগছে প্রায় ২২ মিনিট (এ নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে)। এভাবে আলো সেকেন্ডে কত পথ পাড়ি দেয়, তা হিসেব করা সম্ভব। এতে সেকেন্ডে আলোর গতি পাওয়া গেল প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার কিলোমিটার। বোঝাই যাচ্ছে, আলোর গতি অসীম না হলেও পৃথিবীর যেকোনো গতির চেয়ে অনেক বেশি। সে কারণেই চোখের পলকে আলো পাড়ি দেয় কল্পনাতীত দূরত্ব।

গ্যালিলিও কথিত সেই পরীক্ষায় দুটো পাহাড়চূড়ায় চড়ে যে আলোর গতি মাপতে পারেননি, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পরে যখন আলোর সত্যিকার বেগ জানা গেল, তখন বোঝা গিয়েছিল এর আসল কারণ। আসলে তাঁদের দুজনের পাহাড়চূড়ার মাঝখানের দূরত্ব যদি এক মাইলও হতো, তাহলেও আলো এক চূড়া থেকে আরেক চূড়া পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসত এক সেকেন্ডের মাত্র ১/৬০ হাজার ভাগ সময়ে। আর পাহাড়চূড়ার মাঝখানের দূরত্ব যদি ১০ মাইল হতো, তাহলে এক চূড়া থেকে আরেক চূড়ায় গিয়ে ফিরে আসতে আলোর লাগত এক সেকেন্ডের ১/৬ হাজার ভাগ সময়। বোঝাই যাচ্ছে, ওই যুগে গ্যালিলিও সময়ের এত ছোট ভগ্নাংশ মাপতে পারার কথা নয়।

ওলে রোমার

১৬৭৬ সালে আলোর গতির এই মান প্রকাশিত হয়। আধুনিক হিসেবে, আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল বা ৩ লাখ কিলোমিটার। সে হিসেবে, মাত্র এক সেকেন্ডে আলো পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে আসতে পারে প্রায় সাড়ে সাত বার। রোমারের মান আলোর গতির সঠিক মানের চেয়ে প্রায় ৮০ হাজার কিমি. কম ছিল। কিন্তু সে যুগের পক্ষে এই ফলাফলটা ছিল অসাধারণ। অনেক দ্রুতও বটে। ফলাফলে কিছুটা ভুল হলেও সেটা তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এর মাধ্যমেই প্রথমবার পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া গেল যে আলোর গতি সসীম। এর মাধ্যমেই প্রায় হাজার বছরের বির্তকের অবসান ঘটে।

এ গল্পের এখানেই শেষ নয়। রোমার যখন তাঁর ফলাফল ঘোষণা করেন, তা জেনে খুব হতাশ হন ইতালীয় জ্যোতির্বিদ জিওভানি ক্যাসিনি। কারণ তাঁর উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে আলোর গতি গণনা করলেও তাঁকে কোনো স্বীকৃতি দেননি রোমার। ফলে রোমারের কঠোর সমালোচক হয়ে ওঠেন ক্যাসিনি। সেই জেরে আলোর সসীম গতিও মেনে নেননি। এ দলে শুধু ক্যাসিনি নন, সে যুগের আরও অনেক বিজ্ঞানীও ছিলেন।

তাতে দমলেন না রোমার। তাঁর কথা যে ঠিক, তা প্রমাণ করতে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করেন তিনি। সেই ভবিষ্যদ্বাণীটি ছিল, ১৬৭৬ সালের ৯ নভেম্বর আইওর গ্রহণ কখন ঘটবে, তা নিয়ে। অন্য জ্যোতির্বিদেরা গ্রহণ ঘটার যে সময় নির্ধারিত করেছিলেন, রোমারের ভবিষ্যদ্বাণীর সময়কাল ছিল তার চেয়ে ১০ মিনিট পর। নির্ধারিত দিনে দেখা গেল, আলোর অসীম গতির পক্ষের ক্যাসিনি বা অন্য জ্যোতির্বিদেরা নন, রোমারের গণনা সঠিক। এভাবেই আলোর অসীম বনাম সসীম তর্কের নিষ্পত্তি হয়।

সূত্র: আইজ্যাক আসিমভ/ হাউ ডিড উই ফাইন্ড আউট অ্যাবাউট দ্য স্পিড অব লাইট

সাইমন সিং/ বিগ ব্যাং

উইকপিডিয়া