সূর্য নিয়ে আপনার যে ধারণাগুলো একদম ভুল!

১. সূর্যের মৃত্যু হলে ৮ মিনিটের মাথায় জেনে যাব আমরা

আমরা জানি, আলো প্রতি সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার পাড়ি দেয়। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছাতে লাগে প্রায় সাড়ে ৮ মিনিট। একদম সঠিকভাবে বললে, সূর্যের দৃশ্যমান পৃষ্ঠ ছেড়ে বেরোনোর পর পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে আলোর ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ডের মতো লাগে। এই সূত্র ধরেই বলা হয় সূর্যের বুকে যদি থেমে যায় ফিউশন বিক্রিয়া; যদি মৃত্যু হয় সূর্যের, তাহলে আমরা সেটা টের পাব ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড পর। এই কথাটা একদম ভুল!

আমরা জানি, সূর্যের বুকে নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন-হাইড্রোজেন যুক্ত হয়ে তৈরি করে হিলিয়াম। এ সময় যে শক্তি বেরিয়ে আসে, তা-ই আমরা দেখি আলো হিসেবে। কিন্তু সূর্যের কেন্দ্রে এই যে বিক্রিয়া হচ্ছে, সেখান থেকে সূর্যের পৃষ্ঠে আলো (বা বিক্রিয়ায় সৃষ্ট শক্তির) এসে পৌঁছাতে লাগে ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ বছর। সূর্যের ঘন গ্যাসীয় স্তর পাড়ি দিতে এই সময় লেগে যায় আলোর। অর্থাৎ কেন্দ্রে নিউক্লিয়ার ফিউশন বন্ধ হয়ে গেলেও আরও প্রায় দুই লাখ বছর সূর্য জ্বলবে স্বাভাবিকভাবেই। তারপর হয়তো পৃথিবী টের পাবে, নিভে গেছে সব আলো। বিস্তারিত জানতে পড়ুন: ৩০ হাজার বছর আগের আলো

শিল্পীর কল্পনায় কৃষ্ণগহ্বর

২. সূর্যের জায়গায় সমভরের ব্ল্যাকহোল বসিয়ে দিলে সেটা গিলে নেবে গোটা সৌরজগৎ

সৌরজগতের সবচেয়ে ভারী বস্তু সূর্য। সে জন্য অনেকে এই নক্ষত্রটিকে বলেন সৌরাধিপতি। একে ঘিরেই ঘুরছে সবকটি গ্রহ। অনেক সময় বলা হয়, সূর্যের জায়গায় যদি সমভরের কোনো বস্তু বসিয়ে দেওয়া হয়—সেটা হতে পারে ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর কিংবা আর কিছু—তখন সেটা হয় গিলে নেবে গ্রহগুলোকে, অথবা গ্রহেরা সব ছিটকে যাবে বাইরের দিকে।

আসলে তা হবে না। সমভরের কোনো বস্তু দিয়ে সূর্যকে বদলে দেওয়া হলেও গ্রহগুলো একই কক্ষপথে ঘুরে চলবে।

তবে সূর্যের চেয়ে ভারী বস্তু হলে সেটা গ্রহগুলোকে নিজের দিকে টেনে নেবে। আর কম ভারী বস্তু হলে গ্রহগুলোর কক্ষপথ বাইরের দিকে চলে যাবে। কেন্দ্রীয় বস্তুটি যথেষ্ট ভারী না হলে ছিটকেও যেতে পারে গ্রহগুলো।

৩. সৌরবায়ু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পৌঁছালে দেখা যায় মেরুজ্যোতি

সূর্যের করোনা অঞ্চল থেকে প্লাজমা ছিটকে বেরোয় মাঝেমধ্যেই। এতে মুক্ত চার্জযুক্ত প্লাজমা কণা, গামারশ্মি ও এক্স-রের মতো বিভিন্ন কিছুর সমন্বিত রূপ বাইরে বেরিয়ে আসে। এরই নাম সৌরবায়ু বা সৌরঝড়। বিষয়টা অবশ্য এত সহজ-সরল নয়, বোঝার সুবিধার্থে অতিসরলীকরণ করে বলা হয়েছে। যাহোক, এই সৌরঝড় বয়ে যায় গোটা সৌরজগৎ জুড়ে, আসে পৃথিবীর দিকেও। পৃথিবীর দিকে আসার সময় সৌরবায়ু নিজেই তার চারপাশে একধরনের চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে। কিন্তু এর কোনোটিই পৃথিবীকে ছুঁতে পারে না। কারণ, প্রতিরক্ষা বলয়ের মতো পৃথিবীকে রক্ষা করে চলে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র।

সৌরবায়ু শুধু এই চৌম্বকক্ষেত্রে গোলমাল করে। বলা চলে, ঝড় তোলে পৃথিবীর চৌম্বকরেখা বরাবর। এর ফলে চৌম্বকক্ষেত্রে ঢেউ ওঠে। তখন বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরের মুক্ত প্রোটন ও ইলেকট্রনগুলোর সঙ্গে বায়ুমণ্ডলে ভেসে চলা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুগুলোর সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষের সময় কিছু শক্তি উৎপন্ন হয়। এই শক্তি গ্রহণ করে পরমাণুর ইলেকট্রন নিম্ন শক্তিস্তর থেকে উচ্চ শক্তিস্তরে প্রবেশের সুযোগ পায়। পরে নিম্ন শক্তিস্তরে ফিরে আসার সময় শক্তি বিকিরণ করে। বিকিরিত সেই শক্তিই ফোটন বা ফোটনের ঝাঁক বা আলো হিসেবে দেখা দেয়। সেই আলোকেই আমরা অরোরা বা মেরুজ্যোতি বলি।

এর মানেটা হলো, সৌরবায়ু বা ঝড় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে না। বরং পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রে গোলমাল করে, তার ফলেই আমরা মেরুজ্যোতি দেখতে পাই।

পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের কারণে ঋতুবৈচিত্র্য ঘটে না

৪. সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের কারণে ঋতুবৈচিত্র্য ঘটে

সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব পরিবর্তনশীল। পৃথিবীর কক্ষপথ যেহেতু উপবৃত্তাকার, তাই এই দূরত্ব ৯১.৩ মিলিয়ন থেকে ৯৫ মিলিয়ন মাইল পর্যন্ত হতে পারে। গড়পড়তা হিসেবে এ দূরত্ব ৯৩ মিলিয়ন মাইল বা ১৪৯ মিলিয়ন কিলোমিটার ধরা হয়। সে যা-ই হোক, দূরত্বের পরিবর্তন এ ক্ষেত্রে, তা মাত্র ৪ শতাংশের মতো। এটুকু পার্থক্যের জন্য ঋতুর মতো বড় পরিবর্তন হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাহলে কেন হয় ঋতুবৈচিত্র্য?

পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর সাড়ে ২৩ ডিগ্রি হেলে আছে। ফলে বছরের কিছু সময় উত্তর মেরু সূর্যের দিকে থাকে, দক্ষিণ মেরু থাকে উল্টো দিকে। কিছু সময় আবার এর উল্টোটা হয়। যে মেরু সূর্যের দিকে থাকে, সে মেরুতে বেশি সূর্যের আলো পড়ে এবং দিনের দৈর্ঘ্য বড় হয়। দিনের দৈর্ঘ্য বড় হলে—দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যের আলো পায় পৃথিবীর সে দিকটা; সে কারণে ওদিকে গ্রীষ্মকাল হয়। উল্টোদিকে দিনের দৈর্ঘ্য হয় কম, ফলে সূর্যের আলো ও তাপ পাওয়ার পরিমাণও কম হয়। এ কারণেই হয় শীতকাল।

অর্থাৎ ঋতুবৈচিত্র্যের জন্য দায়ী নিজ অক্ষে পৃথিবীর হেলে থাকা ও ঘূর্ণন। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের জন্য ঋতু পরিবর্তন হয় না।

বর্ণ অনুযায়ী নক্ষত্রগুলোকে O, B, A, F, G, K, M—এই ছয়টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। O শ্রেণির নক্ষত্রগুলো সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত এবং M নক্ষত্ররাজি সবচেয়ে শীতল। সূর্য একটি G শ্রেণির তারা। ছবিতে রঙের তারতম্যের মাধ্যমে তাপমাত্রার পার্থক্য বোঝানো হচ্ছে

৫. সূর্য একটি গড়পড়তা তারা

আমাদের সূর্য একটা মধ্যবয়স্ক তারা। আকারেও এটি খুব বড় বা ছোট নয়, মাঝামাঝিই বলা চলে। লালদানব তারাগুলো সূর্যের তুলনায় অনেক বড়, লাল বামন নক্ষত্রগুলো আবার অনেক ছোট। তবে শুধু আকার নয়, কী পরিমাণ আলো দিচ্ছে, তাপমাত্রা কতটা—এসবের ওপর নির্ভর করে নক্ষত্রের শ্রেণিবিভাগ করা হয়। এই আলো বা তাপমাত্রার হিসাবে সূর্য একটি G শ্রেণির তারা। শ্রেণিবিভাগটা এরকম—O, B, A, F, G, K ও M। O শ্রেণির তারাগুলো সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত, M শ্রেণিরগুলো সবচেয়ে কম উত্তপ্ত। দেখাই যাচ্ছে, সূর্য এক্ষেত্রে মাঝামাঝি আছে। এর পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ৬ হাজার কেলভিন। এই সব দেখে মনে হতেই পারে, সূর্য একটা গড়পড়তা তারা।

এটা সত্যি নয়। রাতের আকাশে যেসব তারা দেখা যায়, তার ৯৫ শতাংশই সূর্যের তুলনায় কম উত্তপ্ত। পৃষ্ঠ তাপমাত্রা ও উজ্জ্বলতার হিসেবে সূর্য থাকবে প্রথম ১০ শতাংশের মধ্যেই। জীবন ধারণের জন্য এই উত্তাপের প্রয়োজনীয়তা আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।

আমাদের নক্ষত্রটির দিকে তাকিয়ে তাই বিস্মিত হওয়া প্রয়োজন বৈকি!

সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস, উইকিপিডিয়া