মহাকাশ
সূর্যের দূরত্ব কীভাবে জানলাম
সূর্য কত দূরে? ভাবলেন প্রাচীন গ্রিক চিন্তাবিদেরা। শুধু ভেবে বসে থাকেননি; সত্যি সত্যি বের করে ফেলেন পৃথিবী থেকে চাঁদ ও সূর্যের দূরত্ব মাপার উপায়। তখনো টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হয়নি। খালি চোখেই তাঁরা পরিমাপ করেন এই দূরত্ব! এ এক দুঃসাহসী উদ্যোগ। মানুষের কৌতূহল ও বুদ্ধির জয়গান…
সূর্য পৃথিবী থেকে কত দূরে? বর্তমানে এটা খুবই সরল প্রশ্ন। আজ আমরা এই দূরত্ব শুধু জানিই না, এটাকে দূরত্বের একক হিসেবে ব্যবহারও করি। পৃথিবী থেকে সূর্যের এই গড় দূরত্বের নাম এক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট বা এইউ। বাংলায় বলা যেতে পারে, সৌরজাগতিক একক। তবে এটাই জ্যোতির্বিদদের ধাঁধায় ফেলে রেখেছিল দুই হাজার বছরের বেশি সময় ধরে।
প্রাচীন গ্রিক চিন্তাবিদেরাই প্রথম মহাবিশ্বের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। তাঁদের কাছে হাতিয়ার বলতে ছিল কেবল খালি চোখ। ছিল না কোনো যন্ত্রপাতি। খালি চোখেই অবশ্য বেশ কিছু ব্যাপার বোঝা যায়। চাঁদকে আকাশে বেশ বড় দেখায়। ফলে এর অবস্থানও কাছে হবে বলে অনুমান করা হয়। সূর্যগ্রহণ থেকে দেখা গেল, পৃথিবীর আকাশে চাঁদ ও সূর্যের আকার প্রায় সমান। কিন্তু সূর্য চাঁদের তুলনায় অনেক উজ্জ্বল। তাহলে হয়তো সূর্য আসলে অনেক বড়, কিন্তু অবস্থান দূরে। এদিকে পাঁচটি গ্রহ দেখা যায় খালি চোখে। প্রায় তারার সমানই দেখায়। তবে এদের গতিপ্রকৃতি ভিন্ন, দ্রুত। এরা হয়তো তারা ও সূর্যের মাঝামাঝি কোনো জায়গায় আছে।
এলোমেলো এসব চিন্তা থেকে সঠিক দূরত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। জ্যামিতির আবিষ্কার সে কাজ সহজ করে দিল। প্রথম পরিমাপ করা হলো চাঁদের দূরত্ব। এটা খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। গ্রিক জ্যোতির্বিদ হিপারকাস প্যারালাক্স বা লম্বনপদ্ধতির ব্যবহার চালু করেন। প্যারালাক্স ধারণাটা খুব সরল। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে একই বস্তুকে দেখলে অবস্থান পাল্টে গেছে বলে মনে হয়। চোখের সামনে আঙুল রেখেই এটা পরীক্ষা করা যায়। এক চোখ বন্ধ করে চোখের সামনে আঙুল ধরে দেখুন। একই কাজ আবার করুন অন্য চোখ বন্ধ করে। দেখবেন, আঙুলের অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে। বস্তুর দূরত্ব বেশি হলে দুই অবস্থানের পার্থক্য বা কৌণিক দূরত্ব কমে যাবে। আর তা থেকে জ্যামিতিক, বলা ভালো, ত্রিকোণমিতিক উপায়ে বের করা যাবে বস্তুটার দূরত্ব।
অ্যারিস্টার্কাস তবু থেমে থাকেননি। তাঁর হিসাবে এ কোণের মান পেলেন ৮৭ ডিগ্রি। হিসাবটাকে ভালো না বলে উপায় নেই। সত্যিকার মান প্রায় ৮৯.৮৫৩ ডিগ্রি। তবে বড় দূরত্বের ক্ষেত্রে এটুকু ব্যবধানই বিশাল পার্থক্য গড়ে দেয়।
চাঁদের দূরত্ব এভাবেই বের করা হয়। হিপারকাস দুটি আলাদা শহর থেকে চাঁদ পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর খুব সরল জ্যামিতি কাজে লাগিয়ে বের করেন দূরত্ব। সেই দূরত্বের সঙ্গে আধুনিক পরিমাপের পার্থক্য মাত্র ৭ শতাংশ। বলে রাখা ভালো, হিপারকাস ত্রিকোণমিতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও খ্যাত। কী বিশাল দূরের জিনিস সহজে করায়ত্ত হয়ে গেল। আসলেই মহাবিশ্ব এক ধাঁধা। আর সে ধাঁধা সমাধানের সূত্র ছড়িয়ে আছে এখানে-সেখানে।
এরপর দৃশ্যপটে এলেন আরেক গ্রিক জ্যোতির্বিদ অ্যারিস্টার্কাস। তিনি সূর্যের দূরত্ব মাপার অভিযানে নামলেন। তা করতে গিয়ে খেয়াল করলেন দারুণ এক জিনিস। চাঁদ অর্ধেক আলোকিত থাকার সময় পৃথিবী ও সূর্যের সঙ্গে সমকোণী ত্রিভুজ উৎপন্ন করে। চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্ব আগেই জানা। এখন পৃথিবী ও সূর্যের দূরত্ব জানতে হলে পৃথিবীতে উৎপন্ন চাঁদ ও সূর্যের মধ্যকার কোণ জানা চাই। এত দারুণ এ কৌশল মার খেয়ে যায় পর্যবেক্ষণের হাতিয়ারের অভাবে। খালি চোখ ছাড়া যে পর্যবেক্ষণের আর কোনো উপায় নেই! তার ওপর সূর্য অনেক দূরে অবস্থিত বলে কাঙ্ক্ষিত এ কোণের মানও প্রায় ৯০ ডিগ্রি। ফলে নিখুঁতভাবে মাপতে পারার গুরুত্ব অনেক বেশি। অ্যারিস্টার্কাস তবু থেমে থাকেননি। তাঁর হিসাবে এ কোণের মান পেলেন ৮৭ ডিগ্রি। হিসাবটাকে ভালো না বলে উপায় নেই। সত্যিকার মান প্রায় ৮৯.৮৫৩ ডিগ্রি। তবে বড় দূরত্বের ক্ষেত্রে এটুকু ব্যবধানই বিশাল পার্থক্য গড়ে দেয়। অ্যারিস্টার্কাসের পাওয়া মানে তাই সত্যিকার পরিমাপ থেকে এক হাজার গুণের বেশি ব্যবধান ছিল।
চিত্র ২-এর সঙ্গে মিলিয়ে এ দূরত্ব এখন আমরাও বের করতে পারি। ব্যবহার করতে হবে ত্রিকোণমিতিক কোণ কস (cos)। cos-এর মান পাওয়া যায় সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজকে ভূমি দিয়ে ভাগ করে। এখানে সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব অতিভুজ (c)। আর θ কোণের জন্য পৃথিবী ও চাঁদের দূরত্ব (a) হলো ত্রিভুজের ভূমি। তাহলে cosθ = a/c । অ্যারিস্টার্কাসের θ-এর মান ছিল ৮৭ ডিগ্রি। চাঁদের জানা দূরত্ব ছিল ৪ লাখ কিলোমিটার (যা আসলে ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার)। ৪ লাখকে cos(87) দিয়ে ভাগ দিলেই অ্যারিস্টার্কাসের সূর্যের দূরত্ব পাওয়া যাবে। cos(87)-এর মান ক্যালকুলেটরে চাপলেই মিলবে ০.০৫২৩। কোণ ও চাঁদের দূরত্বের সঠিক মান ব্যবহার করলে বর্তমান মানটাও পাওয়া যাবে।
চাঁদ অর্ধেক আলোকিত থাকার সময় পৃথিবী ও সূর্যের সঙ্গে সমকোণী ত্রিভুজ উৎপন্ন করে। চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্ব আগেই জানা। এখন পৃথিবী ও সূর্যের দূরত্ব জানতে হলে পৃথিবীতে উৎপন্ন চাঁদ ও সূর্যের মধ্যকার কোণ জানা চাই।
দূরত্ব নির্ভুল না হলেও অ্যারিস্টার্কাস এ পরিমাপ থেকে অসাধারণ এক সিদ্ধান্তে পৌঁছান। পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্যের তুলনামূলক দূরত্ব থেকে তিনি ধরে নেন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। নিকোলাস কোপার্নিকাস সূর্যকেন্দ্রিক মডেল প্রকাশ করার ১ হাজার ৭০০ বছর আগেই সেটা বুঝতে পারেন তিনি।
১৬৫৩ সালে ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স সূর্যের দূরত্ব মাপেন শুক্র গ্রহের দশা কাজে লাগিয়ে। কৌশলটা অ্যারিস্টার্কাসের মতোই। চাঁদের বদলে শুক্র—এই যা। অ্যারিস্টার্কাসের চেয়ে এ পরিমাপ বেশি নির্ভুল ছিল। কারণ, তত দিনে টেলিস্কোপের আবিষ্কার আকাশ পর্যবেক্ষণ সহজ করে দিয়েছে। তবে তাঁর এ পদ্ধতিতে শুক্রের আকার অনুমান করে নিতে হয়েছিল। অনুমান পরে সঠিক প্রমাণিত হলেও পদ্ধতিটাকে বৈজ্ঞানিক বলা যায় না। এ কারণে তাঁকে এ কাজের জন্য কৃতিত্বও দেওয়া হয় না।
১৬৭২ সালে জোভান্নি ক্যাসিনি (প্রচলিত উচ্চারণ, জিওভান্নি ক্যাসিনি) প্যারালাক্স পদ্ধতি ব্যবহার করে মঙ্গল গ্রহের দূরত্ব মাপেন। প্যারালাক্সের জন্য আলাদা অবস্থান থেকে পরিমাপ নিতে হয়। বন্ধু জঁ রিচেকে তাই পাঠিয়ে দিলেন ফ্রেঞ্চ গায়ানার কেইয়েন শহরে। নিজে রইলেন প্যারিসে। দুজনে একই সময়ে দূরবর্তী পটভূমি তারার সাপেক্ষে মঙ্গলের অবস্থান দেখলেন। দুই শহরের দূরত্ব জানা। হিসাব কষে বের করে ফেললেন মঙ্গলের দূরত্ব। তত দিনে সূর্য ও বিভিন্ন গ্রহের আপেক্ষিক দূরত্বের অনুপাত জানা হয়ে গিয়েছিল। সূর্যের দূরত্ব বের করতে তাই পৃথিবী থেকে যেকোনো একটি গ্রহের দূরত্ব বের করলেই হতো। সেটাই করে ফেলেন ক্যাসিনি। তাঁর মাপা সূর্যের দূরত্ব ছিল ১৩.৮ কোটি কিলোমিটার (প্রকৃত মান প্রায় ১৫ কোটি)।
নিশ্চয়ই ভাবছেন, চাঁদের ক্ষেত্রে করা গেলে সূর্যের ক্ষেত্রে কেন প্যারালাক্স পদ্ধতি সরাসরি ব্যবহার করা হয়নি? প্যারালাক্স দিয়ে সূর্যের দূরত্ব মাপা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রথমত, সূর্য দেখতে বৈশিষ্ট্যহীন। তার ওপর অতি ঔজ্জ্বল্য এর আশপাশে ও পেছনে থাকা তারাদের উধাও করে দেয়। পটভূমির এ তারাগুলো দেখা না গেলে প্যারালাক্সের কোণের পরিবর্তন মাপা যায় না। কোণের পরিবর্তন বুঝতে পটভূমি থাকা চাই।
জ্যামিতির আবিষ্কার সে কাজ সহজ করে দিল। প্রথম পরিমাপ করা হলো চাঁদের দূরত্ব। এটা খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। গ্রিক জ্যোতির্বিদ হিপারকাস প্যারালাক্স বা লম্বনপদ্ধতির ব্যবহার চালু করেন। প্যারালাক্স ধারণাটা খুব সরল।
তবে গ্রহদের অতিক্রমণ কাজে লাগিয়েও সূর্যের প্যারালাক্স বের করা যায়। অতিক্রমণের সময় পৃথিবী থেকে দেখা যায়, গ্রহগুলো নক্ষত্রের (এ ক্ষেত্রে সূর্য) সামনে চলে এসেছে। সূর্যের গায়ে দেখা যায় কালো বিন্দুর মতো। পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে এ অতিক্রমণ দেখতে হবে আলাদাভাবে। কোথাও দেখা যাবে ছোট বিন্দু, কোথাও-বা বড়। জেমস গ্রেগরি বুধ গ্রহের অতিক্রমণের মাধ্যমে প্যারালাক্স বের করার কথা ভাবেন। তবে এডমন্ড হ্যালি দেখালেন, শুক্র গ্রহ দিয়ে কাজটা আরও নির্ভুলভাবে হবে।
কিন্তু শুক্র গ্রহের অতিক্রমণ অনেক দুর্লভ ঘটনা। জীবনে একবার পাওয়ার মতো। যদিও অতিক্রমণ জোড়ায় জোড়ায় ঘটে। মানে, ১০০ বছরের বেশি সময় পর দুবার ঘটে। কাছাকাছি দুই অতিক্রমণের মধ্যে সময়ের পার্থক্য ১০ বছরের কম। হ্যালি বুঝতে পারলেন, এ পদ্ধতিতে দূরত্বটা বের করা যাবে। তবে এ–ও বুঝলেন, পরবর্তী অতিক্রমণ পর্যন্ত নিজে বেঁচে থাকবেন না। (সেটাই হয়েছিল। পরবর্তী অতিক্রমণ হয় ১৭৬১ সালে। তাঁর মৃত্যু হয় ১৭৪২ সালে।) তাই ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্য একদম নিখুঁত নির্দেশনা লিখে গেলেন। বলে গেলেন পর্যবেক্ষণের খুঁটিনাটি কৌশল। ফলাফল কাঙ্ক্ষিত মান পর্যন্ত নির্ভুল করতে অতিক্রমণের সময়টা কয়েক সেকেন্ড এদিক-সেদিকও হতে পারবে না। পর্যবেক্ষণের ভিন্ন ভিন্ন জায়গার দূরত্ব হতে হবে বিশাল। মেঘ যাতে পরীক্ষাটা নষ্ট করে দিতে না পারে, সে জন্য সারা বিশ্বের বিভিন্ন বিকল্প স্থান থেকে কাজটা করতে হবে। এমন এক সময়ের কথা বলছি, যখন এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যেতে কয়েক বছর লেগে যেত।
এত সব বাধার মুখেও ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের জ্যোতির্বিদেরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। ১৭৬১ সালের অতিক্রমণ ঘিরে সাজালেন পরিকল্পনা। কিন্তু এর মধ্যেই ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। বিখ্যাত সেভেন ইয়ারস ওয়ার। সমুদ্রপথে ভ্রমণ প্রায় অসম্ভব হয়ে গেল। কিন্তু অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মানল সব। সব জায়গা থেকে পর্যবেক্ষণ সম্ভব হলো না। কোথাও বাধা হলো মেঘ, কোথাও-বা যুদ্ধজাহাজ। তবু কিছু পর্যবেক্ষণ হলো। ৮ বছর পর ১৭৬৯ সালে হলো আরেকটি অতিক্রমণ। দুই অতিক্রমণের উপাত্ত মিলিয়ে ভালো রসদের জোগান মিলল।
সব উপাত্ত মিলিয়ে সূর্যের দূরত্ব বের করলেন ফরাসি জ্যোতির্বিদ জিরোম লালাঁন্ড। মান পেলেন ১৫.৩ কোটি কিলোমিটার, যা প্রকৃত মানের ৩ শতাংশ এদিক-ওদিক মাত্র।
পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের কথা ভাবলেই মনে রাখতে হবে, সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর (বা অন্য গ্রহের) কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। দূরত্ব তাই বাড়ে-কমে। আমরা সাধারণত যে দূরত্বের কথা বলি, তা গড় দূরত্ব৷ ফলে এক বছরে এমনিতেও গড় মানের ৩ শতাংশ এদিক-সেদিক ওঠানামা হয়। গড় দূরত্বটাই বর্তমানে এক এইউ (AU) বা সৌরজাগতিক একক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর বর্তমান মান ১৪.৯ কোটি কিলোমিটারের মতো।
সূর্যের দূরত্ব জানার মাধ্যমে আরও দূরের নক্ষত্রের দূরত্ব জানার পথও উন্মুক্ত হয়ে গেল। একবার ভাবুন তো কীভাবে পথ খুলল?
তাই ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্য একদম নিখুঁত নির্দেশনা লিখে গেলেন। বলে গেলেন পর্যবেক্ষণের খুঁটিনাটি কৌশল। ফলাফল কাঙ্ক্ষিত মান পর্যন্ত নির্ভুল করতে অতিক্রমণের সময়টা কয়েক সেকেন্ড এদিক-সেদিকও হতে পারবে না। পর্যবেক্ষণের ভিন্ন ভিন্ন জায়গার দূরত্ব হতে হবে বিশাল।
আগেই বলেছি, দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্যারালাক্সের কোণ ছোট হবে। নক্ষত্রের মতো বিশাল দূরের জিনিস তো প্যারালাক্সকে দামই দেয় না। দূরের দুই শহর থেকে দেখলেও কৌণিক পার্থক্য চোখে পড়ার মতো হবে না। সূর্যের সবচেয়ে কাছের তারা প্রক্সিমা সেন্টাউরির প্যারালাক্স কেমন হবে, দেখা যাক। একটু দৃশ্যমান ব্যবধান পেতে পৃথিবীর একদম দুই প্রান্তে দুই টেলিস্কোপ বসিয়ে দেখতে পারেন। তাতেও প্যারালাক্সের মান আসবে প্রায় ০.০৬৫ আর্কসেকেন্ড, যা এক ডিগ্রির ৫৫ হাজার ভাগের এক ভাগ! এত ক্ষুদ্র মান পৃথিবীতে বসে মাপা প্রায় অসম্ভব।
সমস্যাটার আরও সহজ সমাধান আছে সূর্যের দূরত্বের মধ্যেই। পৃথিবী এক বছরে সূর্যকে একবার ঘুরে আসে। কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। তার মানে, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরতে গিয়ে নিজের অবস্থান থেকে ২ এইউ পর্যন্ত সরে আসে। কক্ষপথের দুই বিপরীত অবস্থান থেকে কোনো তারাকে দেখলেই প্যারালাক্স কোণের ভালো মান পাওয়া যাবে। একবার ভাবুন, পৃথিবীর দুই পাশ থেকে দেখার তুলনায় কত বিশাল দূরত্বের ব্যবধান থেকে দেখা সম্ভব হচ্ছে! পৃথিবীর ব্যাস মাত্র ১২ হাজার ৭৪২ কিলোমিটার। আর সেখানে কক্ষপথের বিপরীত বিন্দুর সর্বোচ্চ দূরত্ব প্রায় ১৫.২ কোটি কিলোমিটার।
হিসাবটাও সোজা। প্যারালাক্স থেকে প্রাপ্ত কোণের বিপরীত সংখ্যাই দূরত্ব। মানে কোণ দিয়ে ১-কে ভাগ দিতে হবে। কোণের একক হবে আর্কসেকেন্ড। এক ডিগ্রিকে ৬০ ভাগ করলে হয় ১ আর্কমিনিট। ৬০ দিয়ে আবারও ভাগ করলে হয় আর্কসেকেন্ড। এবার একটা সরল হিসাব করি। সূর্যের সবচেয়ে কাছের তারা প্রক্সিমা সেন্টাউরি। এর প্যারালাক্স ০.৭৬৮ আর্কসেকেন্ড। তাহলে এর দূরত্ব ১/০.৭৬৮ = ১.৩ পারসেক। দূরত্বের এই এককই জ্যোতির্বিদেরা ব্যবহার করেন। একে আলোকবর্ষ বানাতে ৩.২৬ দিয়ে গুণ করুন। পাওয়া যাবে ৪.২৪ আলোকবর্ষ।
দূরের নক্ষত্রের ক্ষেত্রে প্যারালাক্সের মান অনেক ছোট হয়ে আসে। যন্ত্রের আধুনিকায়ন সেই ক্ষুদ্র দূরত্বকেও নিয়ে আসে হাতের নাগালে। এই যেমন হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। এর ওয়াইড ফিল্ড ক্যামেরা থ্রি ৪০ মাইক্রো আর্কসেকেন্ড কোণও মাপতে পারে। পরিমাণটা ১ ডিগ্রির ৩৬০ কোটি ভাগের ১ ভাগ। দূরত্ব মাপা যায় ১৬ হাজার আলোকবর্ষ পর্যন্ত। এভাবেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হাত ধরাধরি করে মহাবিশ্বের ধাঁধা সমাধান করতে সাহায্য করে যায় মানুষকে। আরও বড় দূরত্ব মাপারও কায়দা আছে। সে গল্প তোলা থাকল।