ছোট হয়ে আসছে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ। গত কয়েক শ কোটি বছরে অন্তত ৫০ মিটার কমেছে চাঁদের ব্যাসার্ধ। চাঁদের পৃষ্ঠের থ্রাস্ট ফল্টের ছবি বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্লেষণে ব্যবহৃত অতীতের ছবিগুলো তুলেছিলেন অ্যাপোলো অভিযানের নভোচারীরা। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার রোবোটিক নভোযান লুনার রিকনিসেন্স অরবিটারের তোলা ছবিও তাঁরা ব্যবহার করেছেন।
গবেষকরা বলছেন, ভূমিকম্পের কারণে তৈরি চাঁদের অগভীর কিছু ভূমিকম্পকেন্দ্র এসব থ্রাস্ট ফল্টের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। চাঁদের এসব ভূমিকম্পকেন্দ্র শনাক্ত করা হয়েছিল সিসমোমিটারের সাহায্যে। তাও সেই অ্যাপোলো যুগে, অর্থাৎ অ্যাপোলো মিশন চলার সময়ে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে মার্কিনিরা ৬টি অ্যাপোলো মিশনে মোট ১২ নভোচারীকে চাঁদে পাঠিয়েছে।
চাঁদের অভ্যন্তরীণ কোরের ব্যাস প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। অনেকটাই গলিত উপাদানে তৈরি এই কোরের ঘনত্ব পৃথিবীর কোরের চেয়ে অনেক কম। টেকটোনিকভাবে চাঁদ বেশ সক্রিয়। কারণ, এর ভেতরের অংশ এখনও ঠান্ডা হচ্ছে এবং পুর্নগঠিত হচ্ছে। তবে চাঁদের উপরিভাগ খুব ভঙ্গুর। তাই ভেতরের অংশ যখন সংকুচিত হয়, তখন উপরিভাগের উপাদান ভেঙে যায়। এতে সামগ্রিকভাবে আয়তন কিছুটা কমে। এর প্রমাণ মেলে চন্দ্রপৃষ্ঠের নানা ফাটল ও ক্ষত থেকে।
পাশাপাশি পৃথিবীর আকর্ষণের কারণে চাঁদে ভূমিকম্প বেশি হয়। এ কারণে চাঁদ সংকোচন হতে পারে। প্রশ্ন হলো, চাঁদ ছোট হলে পৃথিবীর, বিশেষ করে মানুষের কি কোনো ক্ষতি হবে?
এর উত্তরে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এতে মানুষের কোনো ক্ষতি নেই। কারণ, এই সংকোচনের হার অত্যন্ত কম। প্রতিবছর চাঁদের ব্যাসার্ধ কমে মাত্র ১ কুইন্টিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। এক কুইন্টাল সংখ্যা লিখতে হলে ১ এর পেছনে ১৮টি শূন্য বসাতে হয়। সুতরাং, কুইন্টিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ অত্যন্ত কম। হিসেবে ধরার মতো নয়, এমন।
চাঁদের সংকোচনের ফলে পৃথিবীতে যে কোনো প্রভাবই পড়বে না, তা নয় অবশ্য। পৃথিবী ও চাঁদের টাইডাল ফোর্সের কারণে চাঁদের কক্ষপথ প্রতি বছর ৩.৮ সেন্টিমিটার বা দেড় ইঞ্চি করে বাড়ছে।
অর্থাৎ পৃথিবী থেকে চাঁদের সংকোচন দেখার সুযোগ নেই। অন্তত বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর যে সম্ভাব্য জীবনকাল হিসেব করেছেন, তার মধ্যে। তা ছাড়া আয়তনের সঙ্গে কিন্তু চাঁদের ভর কমছে না। তাই পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যকার আকর্ষণ বল একই থাকবে।
চাঁদের সংকোচনের ফলে পৃথিবীতে যে কোনো প্রভাবই পড়বে না, তা নয় অবশ্য। পৃথিবী ও চাঁদের টাইডাল ফোর্সের কারণে চাঁদের কক্ষপথ প্রতি বছর ৩.৮ সেন্টিমিটার বা দেড় ইঞ্চি করে বাড়ছে। অর্থাৎ দূরে সরে যাচ্ছে। এভাবে দূরে সরার কারণে চাঁদের নিজ অক্ষে ঘুর্ণন বাড়ছে, কমছে পৃথিবীর আহ্নিক গতি। এখানে আবারও মনে করিয়ে দিই, এই হ্রাস-বৃদ্ধির পরিমাণটা খুবই সামান্য। নিকট ভবিষ্যতে এই পরিবর্তন আমরা বুঝতে পারব না।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাঁদ আমাদের ছেড়ে যত দূরে চলে যাবে, তত ছোট হয়ে আসবে এর আকার। সংকোচনের কারণে দৃশ্যমানভাবে চাঁদের আকার আরও ছোট দেখাবে। একসময় পৃথিবী থেকে আমরা আর চাঁদকে দেখতে পাব না।
মাসের নানা সময় আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদকে নানা আকারে দেখতে পাই। চাঁদের কক্ষপথ পুরোপুরি বৃত্তাকার নয়, উপবৃত্তাকার। ফলে পৃথিবীর কাছে এলে চাঁদ বড় দেখায়, আবার পৃথিবী থেকে দূরের বিন্দুতে অবস্থান করলে ছোট দেখায় চাঁদ। কক্ষপথের আকার পরিবর্তনের চেয়ে প্রতি মাসে চাঁদের এই পরিবর্তন অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
শত শত কোটি বছর পর চাঁদের সরে যাওয়ার মারাত্মক প্রভাব দেখা যাবে পৃথিবীতে। সমুদ্রের স্রোত প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে প্রচুর সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাবে। পাশাপাশি পুরো পৃথিবী হয়ে যাবে অস্থিতিশীল, অনেকটা দুলতে শুরু করবে। জলবায়ুতে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন।
তবে এসব কোনোটাই এখন চিন্তার বিষয় নয়। শত কোটি বছর পর এসব দেখার জন্য হয়তো আমরা কেউ বেঁচে থাকব না। আর থাকলে সে সময় নিশ্চয়ই কোনো একটা উপায় বের করে ফেলবে মানুষ। কে জানে!
বর্তমানে চাঁদের এই সক্রিয়তা দেখে বিজ্ঞানীরা ভাবছেন ভিন্ন কথা। চাঁদে দীর্ঘমেয়াদী মানববসতি তৈরির জন্য নিরাপদ জায়গা প্রয়োজন। চন্দ্রকম্পের ফলে তৈরি ফাটলগুলো এ ক্ষেত্রে বেশ কাজে আসবে বলে মনে করছেন তাঁরা।