গ্যালিলিও গ্যালিলি: পর্যবেক্ষণ জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রপথিক

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর সম্পর্ক। পৃথিবী ও আকাশ নামের এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…

চাঁদের মতোই একটা কাস্তের রূপে শুক্র গ্রহকে দেখেন গ্যালিলিওছবি: হিস্ট্রি ডটকম

জিওর্দানো ব্রুনোর প্রাণদণ্ডের বছরে গ্যালিলিও গ্যালিলি ছত্রিশে পা রাখেন। কোপার্নিকীয় দর্শন ঠিক বলে মানতেন তিনি, কিন্তু ব্রুনোর ভয়ঙ্কর পরিণামে এত বিচলিত হন যে প্রত্যক্ষভাবে সে দর্শন সমর্থন করার ঝুঁকি নিতে চাননি।

ঠিক এ সময়ে ঘটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা: দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কৃত হলো। নতুন যন্ত্রটি দিয়ে প্রথম তারা দেখেন গ্যালিলিও। ইতালির এই জ্যোতির্বিদ আকাশে যা দেখলেন, তাতে মোক্ষম বোঝা গেল যে কোপার্নিকীয় দর্শন সত্য। চাঁদে গ্যালিলিও দেখলেন পাহাড়; আর দেখা গেল, চাঁদ বেশ বড় একটা জগৎ, আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে অনেক মিল আছে।

চাঁদের মতোই একটা কাস্তের রূপে শুক্র গ্রহকে দেখেন গ্যালিলিও, গ্রহটি আকাশে একটি উজ্জ্বল বিন্দু মাত্র নয়।

সবচেয়ে কৌতূহলের বিষয় হলো, বৃহস্পতির পর্যবেক্ষণ, যেটা গ্যালিলিও শুরু করেন ১৬১০ সালের ৭ জানুয়ারি। তিনি দেখলেন, বৃহস্পতি আলোর একটি ক্ষুদ্র কণামাত্র নয়, বেশ বড় একটা বৃত্ত। বৃত্তের কাছাকাছি তিনটি ছোট দাগ। ১৩ জানুয়ারি আরেকটি দাগ চোখে পড়ল গ্যালিলিওর।

আরও পড়ুন
বিজ্ঞান জগত গ্যালিলিওর আবিষ্কারকে অবজ্ঞার সঙ্গে পাত্তা দিল না। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ক্রেমোনিনি দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে রাজি হলেন না।
গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২)

নিচের ছবিটা দেখ। দেখে হয়তো অবাক হবে এই ভেবে যে গ্যালিলিও কেন সঙ্গে সঙ্গে আলোর চারটি বিন্দু দেখেননি—ওদের ফটোগ্রাফ কত ভালো ওঠে! কিন্তু ভুললে চলবে না যে তাঁর দূরবীক্ষণ যন্ত্র ছিল অতি দুর্বল শক্তির। আরও পরে তাঁর তৈরি দূরবীক্ষণ যন্ত্রগুলোর মধ্যে যেটি সেরা, তার বিবর্ধনশক্তি ছিল মাত্র ৩০ গুণ। গ্যালিলিও আবিষ্কার করলেন যে বৃহস্পতির গতির সঙ্গে সঙ্গে আলোর চারটি বিন্দু বিরাট গ্রহটিকে শুধু অনুসরণ নয়, প্রদক্ষিণও করে। এ ভাবে ধরা পড়ল যে বৃহস্পতির চারটি চাঁদ আছে।

বিজ্ঞান জগত গ্যালিলিওর আবিষ্কারকে অবজ্ঞার সঙ্গে পাত্তা দিল না। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ক্রেমোনিনি দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে রাজি হলেন না। ‘আমি যখন জানি যে বৃহস্পতির কোনো উপগ্রহ নেই, থাকতে পারে না, তখন দূরবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ দেওয়ার দরকারটা কী?’

এ নির্বোধোক্তিতে নিজের নাম ‘বিখ্যাত’ করেন ক্রেমোনিনি।

অন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বললেন, বৃহস্পতির কোনো উপগ্রহ থাকা উচিত নয়, কেননা সেগুলো মানুষের কোনো কাজে লাগবে না।

আরও পড়ুন
মহাশূন্যচারীদের মধ্যে চাঁদ পর্যবেক্ষণ করা সবচেয়ে সহজ। চাঁদনী রাতে আকাশের আমাদের এই বন্ধুটিকে অতি দুর্বল দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখা যায়। দেখে মানুষ কত তৃপ্তি পায়!
টেলিস্কোপে দেখা চাঁদের পৃষ্ঠ

একজন বিশপ বললেন:

‘সপ্তাহে সাতটা করে দিন; মানুষের মুণ্ডুতে সাতটা খোলা দ্বার—দুটো চোখ, দুটো কান, দুটো নাসারন্ধ আর একটা মুখ; আকাশে সাতটা গ্রহ—চাঁদ, মঙ্গল, বৃহস্পতি, বুধ, শুক্র, সূর্য এবং শনি। গ্যালিলিও আরও চারটি গ্রহ আবিষ্কার করেছেন, এটা মানলে গ্রহের সংখ্যা দাঁড়াবে এগারো—সেটা সম্ভব নয়!’

ইনিও দূরবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ দিতে রাজি হলেন না।

এঁদের সব আপত্তি সত্ত্বেও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের শেষ পর্যন্ত মানতে হয় যে বৃহস্পতির উপগ্রহ আছে বাস্তবিক।

মহাশূন্যচারীদের মধ্যে চাঁদ পর্যবেক্ষণ করা সবচেয়ে সহজ। চাঁদনী রাতে আকাশের আমাদের এই বন্ধুটিকে অতি দুর্বল দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখা যায়। দেখে মানুষ কত তৃপ্তি পায়!

তাঁর কথায় অবিশ্বাসী যারা, তাদের সবাইকে গ্যালিলিও বলতেন, ‘এসে দেখুন না একবার!’

তিনি বুঝেছিলেন যে আকাশের বিষয়ে সত্যিকার জ্ঞান বিস্তারের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো যত সম্ভব বেশি লোককে চোখে দেখানো। প্রতি রাতে কয়েকজন জমায়েত হতেন গ্যালিলিওর চারপাশে—তাঁর বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত ব্যক্তি, এমনকি একেবারে অপরিচিতরাও। সবাই নিজের চোখে দেখতে চাইত চাঁদকে। আর দেখে তাদের মনের অবস্থা কেমন হতো!

বৃহস্পতির দিকে টেলিস্কোপ ফিরিয়ে কী দেখেন গ্যালিলিও
আরও পড়ুন
অদ্ভুত এ সব আবিষ্কারের পর গ্যালিলিও আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তখনো ক্যাথলিক চার্চ প্রকাশ্যভাবে কোপার্নিকাসের দর্শনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও একটি বই লিখলেন, যার নামটি চমৎকার—সিডেরিউস নানসিয়াস; অর্থাৎ তারাদের অগ্রদূত।
গ্যালিলিওর দূরবীক্ষণ যন্ত্র

চাঁদের উপরিভাগে তারা দেখত প্রকাণ্ড কালো কালো ছোপ, যেগুলোকে গ্যালিলিও ভুল করে ভাবতেন সমুদ্র ও মহাসাগর; দীর্ঘ পর্বতমালা; ছায়ার দীর্ঘতা বিচার করে তাদের উচ্চতা হিসাব করতে শেখেন গ্যালিলিও। চাঁদ আকাশমণ্ডলে আবদ্ধ একটি রূপালি চাকতি, পৃথিবীকে আলো জোগানোর জন্য তার সৃষ্টি—এ কথা শুনলে তখনি লোকে হাসত।

অদ্ভুত এ সব আবিষ্কারের পর গ্যালিলিও আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তখনো ক্যাথলিক চার্চ প্রকাশ্যভাবে কোপার্নিকাসের দর্শনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও একটি বই লিখলেন, যার নামটি চমৎকার—সিডেরিউস নানসিয়াস; অর্থাৎ তারাদের অগ্রদূত। বইতে কোপার্নিকীয় দর্শনের স্বপক্ষে লেখেন গ্যালিলিও, কিন্তু লেখেন মহা সাবধানে।

চার্চ-পিতারা চিন্তিত হলেন: ব্রুনোকে হত্যা করা হয়েছে, তবু কোপার্নিকাসের মতামত লোপ পায়নি, বরং সে দর্শনের একজন নতুন সমর্থক দেখা দিয়েছে লোকের মধ্যে মতবাদ ছড়ানোর জন্য।

আর এই সমর্থক এবং সহজ-লিখিয়ে এমন এক বিদ্বান ব্যক্তি, যাঁর নাম সারা ইউরোপ জানে।

ক্যাথলিক চার্চের প্রধান, রোমের পোপ ১৬১৬ সালে একটি ডিক্রি জারি করলেন। তাতে বলা হলো, কোপার্নিকীয় দর্শন সমর্থন করে বই ছাপালে গুরু দণ্ড দেওয়া হবে। এ ধরনের বই এমনকি কাছে রাখলেও অপরাধ বলে মানা হবে।

আরও পড়ুন
গ্যালিলিওর বই বিতরণ করা নিষিদ্ধ হলো; বৃদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে হুকুম করা হলো রোমে যেতে, সেখানে তাঁর বিচার করবেন স্বয়ং পোপ।
বিচারসভায় গ্যালিলিও

কোপার্নিকাসের মতামতের প্রতি চার্চের ঘৃণা এত বিপুল যে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত এর সমর্থন করে বই ছাপানো নিষিদ্ধ ছিল।

তারপর চার্চ-পিতারা স্বয়ং গ্যালিলিওকে আক্রমণ করলেন। ১৬৩২ সালে দুই বিশ্বদর্শন বিষয়ে কথোপকথন নামে একটি বইতে তিনি কোপার্নিকীয় দর্শন সমর্থন করেন। অনেক কষ্টে বইটা তিনি ছাপাতে পারলেন। মুদ্রাকররা তাঁর অর্ডার প্রত্যাখ্যান করে—কোপার্নিকীয় বিধর্ম প্রচারের অভিযোগে নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে। যাহোক, তবু বইটি ছাপা হয়ে বেরোল। চার্চ-পিতারা রেগে আগুন।

গ্যালিলিওর বই বিতরণ করা নিষিদ্ধ হলো; বৃদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে হুকুম করা হলো রোমে যেতে, সেখানে তাঁর বিচার করবেন স্বয়ং পোপ।

মৃত্যুর ভয় দেখানো হলো তাঁকে; জিজ্ঞাসাবাদ চলল নির্যাতনকক্ষে, সেখানে চোখের সামনে সেই ভয়াবহ যন্ত্রগুলো—চামড়ার ফানেল, যাতে করে পেটে বিপুল পরিমাণে জল ঢোকানো হয়, পা দুমড়ে দেওয়ার লোহার বুট, হাড় ভাঙার সাঁড়াশি...

জীর্ণ বৃদ্ধ এ সব হুমকি সইতে পারলেন না, নিজের মতামত প্রত্যাহার করলেন।

২২ জুন বিরাট জনতার সামনে চার্চে নতজানু হয়ে বসে তিনি প্রকাশ্যে তাঁর অনুশোচনা ব্যক্ত করলেন।

এমনকি তখনো চার্চ তাঁকে হাতের মুঠোছাড়া করল না। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ইনকুইজিশনের বন্দী হয়ে রইলেন। পৃথিবীর গতি সম্বন্ধে কারো সঙ্গে আলোচনা করা তাঁর বারণ। তবু গোপনে একটি বই লেখেন গ্যালিলিও, যাতে পৃথিবী ও জ্যোতিষ্কদের বিষয়ে সত্য কথাটি তিনি স্পষ্টভাবে বলেন।

নির্যাতন, যন্ত্রণা বা প্রাণদণ্ড, কিছুতেই নতুন মতামতের প্রসার রোখা গেল না। বিজ্ঞানের বীর ও শহীদদের মহতী কাজ সার্থক হতে লাগল।

(চলবে…)

মূল: আলেকজান্ডার ভলকভ, অনুবাদ: সমর সেন

* পাঠকের সুবিধার্থে বইয়ের মূলভাব ঠিক রেখে বানানরীতির কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।

‘পৃথিবী ও আকাশ’ বই থেকে আরও পড়ুন