পৃথিবীর মহাকর্ষ কতদূর ছড়িয়ে আছে

পৃথিবীর বুকে থাকা সবকিছুই পৃথিবীর আকর্ষণ বল, অর্থাৎ এই গ্রহটির মহাকর্ষ বল খুব ভালোভাবে অনুভব করে। এ বলের কারণে পৃথিবীর ওপর কোনো কিছু আটকে বা ‘পড়ে’ থাকতে পারে। কোনো গ্রহের মহাকর্ষ বল কতটা শক্তিশালী, তা নির্ভর করে এর গঠন ও ঘনত্বের ওপর। গ্রহের পৃষ্ঠের দিক বরাবর মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর গতি প্রতি সেকেণ্ডে কী পরিমাণ বাড়ছে, তা থেকে সেই গ্রহের মহাকর্ষ বলের প্রাবল্য বোঝা যায়। পৃথিবীর ক্ষেত্রে এই মহাকর্ষ বলকে অনেকে বাংলায় বলেন অভিকর্ষ বা মাধ্যাকর্ষণ। ইংরেজি অবশ্য একটিই, গ্র্যাভিটি। গড়ে এই ত্বরণের পরিমাণ প্রায় ৩২.২ ফুট/বর্গ সেকেন্ড বা ৯.৮১ মিটার/বর্গ সেকেন্ড। এর অর্থ হলো, ভূপৃষ্ঠের ওপর থেকে মুক্তভাবে কোনোকিছু পড়তে থাকলে প্রতি সেকেন্ডে সেটার বেগ ৯.৮১ মিটার/সেকেন্ড হারে বাড়বে। এই আকর্ষণ বল একেবারে পৃথিবীর কেন্দ্র বরাবর কাজ করে। ভূকেন্দ্রে মহাকর্ষ বলের পরিমাণ শূন্য।

মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর সব জায়গায় মহাকর্ষ বলের মান, অর্থাৎ অভিকর্ষজ ত্বরণের মান সমান নয়। কোনো বস্তুর মহাকর্ষ বল তার আশেপাশে সবজায়গায় সমান হবে, কেবল যদি বস্তুটি সুষম গোলক হয় এবং ঘূর্ণায়মান না হয়। মহাকাশ থেকে পৃথিবী দেখতে গোলক মনে হয়। বাস্তবে পৃথিবী পুরোপুরি গোলাকার নয়। একটু চ্যাপ্টা। ভূপৃষ্ঠেই আছে পাহাড়, খাদের মতো উঁচুনিচু পরিবেশ। অর্থাৎ, পৃথিবী সুষম গোলক নয়। এ কারণে পৃথিবীর ভরও এর সবজায়গায় সমানভাবে ছড়িয়ে নেই। তা ছাড়া পৃথিবী নিজ অক্ষে অনবরত ঘুরছে, বছরে একবার চক্কর খাচ্ছে সূর্যের চারপাশে। সবকিছু মিলিয়ে পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের পরিমাণ ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন জায়গায় একটু ভিন্ন হয়। এই ভিন্নতার পরিমাণ অবশ্য বেশি নয়। মাত্র ০.৭ শতাংশ।

সাড়ে ৪ কোটি আলোকবর্ষ পর্যন্ত পৃথিবীর মহাকর্ষ বল অনুভব করা যাবে। তবে, অতদূরে পৃথিবীর মহাকর্ষ বল শনাক্ত করতে হলে প্রয়োজন অতি সূক্ষ্ম প্রযুক্তি।

অভিকর্ষ, অর্থাৎ পৃথিবীর মহাকর্ষের আরেকটি মজার বিষয় হলো, ভূ-পৃষ্ঠে এই বলের মান সবচেয়ে বেশি। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে যত ওপরে ওঠা যায়, ততই কমতে থাকে পৃথিবীর আকর্ষণ বল। একই ঘটনা ঘটে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে নিচের দিকে যাওয়ার সময়ও। আগেই বলেছি, পৃথিবীর একেবারে কেন্দ্রে অভিকর্ষের পরিমাণ শূন্য। কারণ, পৃথিবীর ঠিক কেন্দ্রে মহাকর্ষ বল তৈরি হওয়ার মতো আর কোনো ভর থাকে না। আবার ভূপৃষ্ঠ থেকে ওপরে উঠলে দূরত্বের কারণে পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের প্রাবল্য কমতে থাকে। কিন্তু ঠিক কতদূরে গেলে এই প্রাবল্য একবারে শূন্য হয়?

বিজ্ঞানীরা সে প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে বের করেছেন। তাত্ত্বিকভাবে, সাড়ে ৪ কোটি আলোকবর্ষ পর্যন্ত পৃথিবীর মহাকর্ষ বল অনুভব করা যাবে। তবে, অতদূরে পৃথিবীর মহাকর্ষ বল শনাক্ত করতে হলে প্রয়োজন অতি সূক্ষ্ম প্রযুক্তি।

প্রায় সাড়ে ৪ কোটি আলোকবর্ষ দূরে পৃথিবীর মহাকর্ষ বল আর চাইলেও শনাক্ত করা সম্ভব নয়। কারণটা খুব সহজ। পৃথিবীর জন্ম হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৪ কোটি বছর আগে। মহাবিশ্ব প্রতি মুহূর্তে সম্প্রসারিত হচ্ছে। আর মহাকর্ষ আলোর গতিতে কাজ করে। তাই, সাড়ে ৪ কোটি আলোকবর্ষ দূর পর্যন্তই পৌঁছে গেছে পৃথিবীর মহাকর্ষের প্রভাব। পৃথিবীর বয়স আরও বাড়লে বাড়বে এই সীমানাও।

লেখক : শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞানবিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস, উইকিপিডিয়া